যুগান্তর মিত্র

 



শেষ ইচ্ছে

( ১ )

বুলিমাসি, তুমি কোন গানটা গাইবে? হাতের কলমটা দুই ঠোঁটের মাঝে চেপে জিজ্ঞাসা করল অর্চিতা।
আগুনেরপরশমণিগাইব ভাবছি।কৃষ্ণাদিরএই গানটা খুব পছন্দের ছিল।
নানা মাসি, তুমি অন্য গান করো।এই গানটা সবাই মিলে গাইব শুরুতে কিংবা শেষে। তুমি অন্য গান গাও, প্লিজ!
তাহলে অশ্রুনদীর গাই? এই গানটাও খুব শুনতে চাইত আমার কাছে।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অরিত্রর দিকে চোখ রাখে অর্চিতা। অরিত্রদাতো নজরুলের গান গাইবে? তাই না?
হ্যাঁ, ঠিক।কৃষ্ণামাসি আমাকে দেখলেই বলতেন, তুই কী সুন্দর ‘পার্থসারথি...’ গানটা করিস।কয়েকদিন আগেও বলেছিলেন, গানটা একবার শোনাবি? সেদিন আমার কাজ ছিল বলে আর শোনানো হয়নি। চলে গিয়েছিলাম।খুব আফশোস হয়রে! ঐদিন পার্থসারথিই শোনাব।
এরপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে আরও কয়েকটা নাম।সামনে উপস্থিতনা-থাকলেও এদের সঙ্গে ওকে কী গান গাইবে তানিয়ে আলোচনা হয়েছে।
চেয়ারে বসে এক মনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে সুকল্যাণ। একই স্কুলে পড়ায় দুজনে। স্কুলে জয়েন ও করেছে একদিনেই। অর্চিতা বাংলা আর সুকল্যাণ ফিজিক্সের টিচার। প্রথমদিন থেকেই ওদের মধ্যে বন্ধুত্ব জমে উঠেছে।একে একদিনে জয়েনিং, তার ওপর প্রায় সমবয়সী। ফলে আপনি আর তুমির চৌকাঠ ডিঙিয়ে ওরা পরস্পরকে তুই সম্বোধনকরে এখন।
সকাল আটটা লাগাদ অর্চিতার মা কৃষ্ণাদেবীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে যতদ্রুত সম্ভব চলে এসেছিল সুকল্যাণ। চার-পাঁচটা স্টেশনদূরেই তার বাড়ি। ফলে খুব-একটা দেরিও হয়নি। সুকল্যাণের হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল অর্চিতা। 'মা চলে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে। আমাকে একা করে দিয়ে। হেডস্যারকে আর জানালামনা। তুই জানিয়ে দিস। পারলে স্কুলের গ্রুপেও পোস্ট করিস।'
এরপর আর একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথেএসেছিল। চারদিন বাদে আজ আবার এ বাড়ি এল সুকল্যাণ।ওকে দেখেই ইশারায় বসতে বলেছিল অর্চিতা। তারপর থেকে উপস্থিত সবার সঙ্গে কথা বলে আট তারিখ সন্ধ্যায় কী কী হবে, তা সাজিয়ে নিচ্ছে।ওর সামনে আছে একটা ডাইরি।তাতে লিখেও নিচ্ছে। সুকল্যাণ জানেনা আসলে কী হচ্ছে। তাই চুপ করে থেকে বোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেনি। তাই জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, কীসের অনুষ্ঠান? কবে হচ্ছে?
অনুষ্ঠান? ভ্রুকুঁচকে সুকল্যাণকে দেখে অর্চিতা।তারপর কেটে কেটে উচ্চারণ করে, অনুষ্ঠান বললি? কেনরে? অবশ্য অনেকেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বলে। শ্রাদ্ধ মানে আসলে শ্রদ্ধা জানানো। আমার মতে অনুষ্ঠান না বলে নিবেদন বলা উচিত।
সুকল্যাণ অবাক হয়না। কেউ মনের মতো শব্দ বা কথা উচ্চারণ না-করলে বক্তৃতার ঢঙেই জবাব দেয় অর্চিতা। এখন যেমন দিল। তাই ওর বলাকে গুরুত্বনা-দিয়ে মাথা দুলিয়ে জবাব দিল, আচ্ছা। তার মানে আট তারিখে কে, কী করবেন সেটা ছকে নিচ্ছিস। বুঝলাম।
ঠিক বলেছিস। ব্যাপারটা পুরো ছকে নিচ্ছি। না-হলে সব গুলিয়ে যাবে। বুঝতেইপারছিস!
হেডস্যারকে ফোনে অর্চিতা জানিয়েছিল প্রচলিত শ্রাদ্ধবাসর বলতে যা বোঝায় সেটা হচ্ছেনা। ওর মা চাইতেন না পুরোহিত ডেকে শ্রাদ্ধ করা হোক। অর্চিতা অবশ্য এতটা মানতে পারেনি। মাসিরা, মাসতুতো দাদারা, পিসি, প্রতিবেশী কেউ কেউ বলেছে, 'অন্তত মন্ত্র পড়ে ফুল-জল দেওয়ার ব্যবস্থাটা করিস।সামাজিক ব্যাপারকে একেবারে এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।' তখনই সবার সঙ্গে আলোচনা করে একজন পুরোহিতকে ডাকা হয়েছে।তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে 'যেটুকু না-করলে নয়, সেটুকুই হোক। কোনও আড়ম্বর চাইনা। মা পছন্দ করতেন না।'
পুরোহিত ও মাথা ঝুঁকিয়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সেই হিসাবে ফর্দ করে দিয়েছেন। এ সব ব্যাপার সামলাচ্ছে অরিত্র। এ বাড়ির সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই। তবে অর্চিতার বাবা এক সময় অরিত্রকে পড়াশোনার খরচের ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করেছিলেন। সেই থেকে যাতায়াত আছে এখানে। বাড়ির সব ব্যাপারেই ওকে কাজেকর্মে পাওয়া যায়। গান শিখেছে কৃষ্ণাদেবীর উৎসাহে। স্কুলের বন্ধুর কাছেই পাঠিয়েছিলেন অরিত্রকে। শিক্ষিকার সম্মানদক্ষিণাও দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মণিমালা চক্রবর্তী কোনও টাকা নিতেন না।
পারলৌকিক ক্রিয়ার সময়কে মুখে আগুন দেবে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। স্বাভাবিকভাবেই অর্চিতা চেয়েছিল, কিন্তু সমবেত সিদ্ধান্তে মুখে আগুন দিয়েছিল বুলিমাসির ছোটছেলে প্রিয়াংশু। ওকে কৃষ্ণা খুব ভালোবাসতেন। অর্চিতা এ সবে খুব-একটা বিশ্বাস ও করেনা। বাবার বেলাতে করতে হয়েছিল একরকম বাধ্য হয়েই। প্রিয়াংশু মুখে আগুন দেওয়ার কারণে আট তারিখ সকাল থেকে যাযা কাজ, পুরোহিতের সঙ্গে থেকে সে-ই করবে। অর্চিতা তাই সেই দিনের সান্ধ্যবাসরের পূর্বাপর গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবে। এই কারণে খানিকটা নিশ্চিন্তও সে। শুধু মায়ের ছোটবেলার বন্ধু মিনতি মাসিকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছেনা সেদিন কিছু বলার ব্যাপারে। তিনি খুবই ভেঙে পড়েছেন। শৈশবের বন্ধু বলতে এই একজনের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল।
আমি যদি একটা রিসাইটেশন করি, তোর আপত্তি নেই তো? সুকল্যাণ কথাটা ভাসিয়ে দেয় অর্চিতার দিকে।
মানে? ইয়ার্কি করছিস? তুই ভালোবেসে মায়ের জন্য একটা আবৃত্তি করবি আর আমি আপত্তি জানাব? অবশ্যই করবি। কোন কবিতাটা বলবি ঠিক করেছিস?
না, তেমন কিছু ঠিক করিনি। এইমাত্রই মনে হল, তাই বললাম।
বেশ। তুই নিজে ভেবেই ঠিক কর। আমার সাজেশন থাকল 'অন্তর মমবিক শিত করো।' তুই অবশ্য অন্য কিছুও ভাবতে পারিস।
গুড সাজেশন। তবে আমি আরও ভেবে দেখি অন্য কোনও কবিতা মাথায় আসে কিনা। তোকে জানাব অর্চিতা।
মুচকি হেসে সুকল্যাণকে সাধুবাদ জানায় অর্চিতা। তারপরই মিষ্টুর দিকে তাকিয়ে বলে, সবাইকে আর-একবার চা খাওয়াবে নাকি মিষ্টু? জানি তোমার খুব খাটনি পড়ছে। সেদিন থেকে এক টানা করেই যাচ্ছ!
তাতে কী হয়েছে অর্চিদিদি? আমি এক্ষুণি চা করে আনছি।
ছুটকি পিসির ছেলের বউ মিষ্টু আর নাতি শুভম কৃষ্ণা দেবী মারা যাওয়ার দিন থেকেই এখানে আছে। অর্চিতার থেকে বয়সও সম্পর্কে ছোট মিষ্টু। তাই নাম ধরেই ডাকে। খুব কাজের মেয়ে।বাড়িটা গুছিয়ে রাখছে। সবদিকে খেয়ালও রাখে। মিষ্টু যখন চা করার জন্য রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছে, তখনই অর্চিতা আবার ডাকল। শোনো মিষ্টু, তুমি কী গাইবে বলো তো? সবাইকেই জিজ্ঞাসা করা হল। তুমি বাদ থেকে গেছ।
এখনও ঠিক করিনি অর্চিদিদি। পরে ঠিক করব।
তোমার গলা ভারী মিষ্টি! তোমার নামের মতোই। যেটা ইচ্ছে গাইবে। আমাকে আগে জানিও। আমি চাইছি যেন কমন গাননা-হয়ে যায়।
তা বোধহয় হবেনা অর্চিদিদি। কেননা আমি ভানু সিংহ থেকে গাইব ভাবছি।
বেশ বেশ। তোমার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।
স্কুলে অর্চিতা যেমন হইহই করে কাটায়, বাড়িতে ও মায়ের শেষ ইচ্ছেকে মর্যাদা দিতে হইহই করে সব কিছু ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। দেখে ভালো লাগছে সুকল্যাণের।

                                                    
                                       (২)

এবাড়ির প্রথম আলো দেখা নারী অর্চিতার মা। অবশ্য নারী বলতে সে আর তার মা ছাড়া আর আছে সুধা পিসি। বাবার দূরসম্পর্কীয় বোন। একা একা ঘরের কোণে চুপকরে বসে থাকতেই যেন তাঁর ভালো লাগে। ঘরের টুকিটাকি কাজ করেন। বাকি সময় নিজের ঘরেই কাটান। কৃষ্ণা তাঁকে দিয়ে বেশি কিছু করাতেন না। স্বামীহারা মহিলাটির প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ছিল আলাদা রকমের।
ভোরবেলা মায়ের দরজা খোলার দৃশ্য কয়েক বার দেখেছিল অর্চিতা। পাশ থেকে উঠে যাওয়ার সময় ঘুম ভেঙে যেত কখনও। কাঠের দরজার খিল খুলতেন প্রথমে। তারপর দু-হাতে দরজা খুলে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যেন আগামী গোটা দিনটাকেই মেলে ধরছেন। এরপরই ঘরের বাইরে পা রাখতেন। কলতলায় লোহার বালতিতে জল ভরে মগে করে গাছে গাছে জল দিতেন প্রতিদিন। উঠোনের একপাশে বেগুন আর লংকা গাছ লাগিয়েছিলেন মা। আর আছে লাউগাছ। বাবা বাঁশের চটা দিয়ে মাচা করে দিয়েছিলেন। গাছটা লতিয়ে লতিয়ে মাচায় ছড়িয়ে পড়েছিল। বাবা মারা যাওয়ার পরে বছর দুয়েক ওভাবেই মাচাটা ছিল। মা আবার লাউগাছের বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন। অতি যত্নে সেই গাছটাকে মাচায় তুলেও দিয়েছেন।
বাবার মৃত্যুর পর গাছে জল দেওয়াটা মায়ের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ভোরবেলায় কল চাপার শব্দ আর শান বাঁধানো কলতলায় লোহার বালতির কর্কশ শব্দে বিরক্ত হত অর্চিতা। বালতিটাও যেন জানান দিত রাত্রিশেষে তার জেগে ওঠার বার্তা। একবার বলেছিল, এত সকালে ওঠার দরকার কী মা?
তুই স্কুলে যাবি না? খেয়ে যাবি তো! টিফিন ও নিবি। সেসব গুছিয়েনা-নিলে হয়?
সে তো অনেক দেরি আছে মা! আটটার সময় সবিতামাসি রান্না করতে আসবে। তোমার সাত তাড়াতাড়ি ওটার দরকারটা কী শুনি? কলপাড়ে বালতির এমন শব্দ করো যে ঘুম চটকে যায়!
তাহলে একটা প্লাস্টিকের বালতি কিনে আনিস। শব্দ কম হবে।
বেশ। তাই আনব। কথাটা বললেও কোনওদিনই আর আনা হয়ে ওঠেনি প্লাস্টিকের বালতি।
ছাদের ওপর কয়েকটা টবে ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন বাবা। সেগুলোতেও নিয়মিত জলদিতেন মা। অর্চিতা অনেকবার দেখেছে মা সেই গাছগুলোর গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। যেন বাবাকেই স্পর্শ করছেন!
সবিতামাসি আসার আগে রান্নাঘরে গিয়ে সবজির ঝুড়ি নিয়ে বসতেন মা। রেডিওতে এফএম চালিয়ে গান শুনতেন আর সবজি কেটে ছোট ছোট ঝুড়িতে সাজিয়ে রাখতেন। অর্চিতা একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে দিয়েছিল মাকে। তাতে নেট ভরে দিত নিয়মিত। মা কেবল ইউটিউবে গান শুনতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, আধুনিক গান। মান্না দের গানের প্রতি মায়ের পক্ষপাতিত্ব বেশি ছিল, বুঝতে পারত অর্চিতা। শুধু গান শোনার জন্যই যেন ছিল ফোনটা। কাউকে ফোন করতেন না খুব-একটা। কেউ ফোন করলেও অল্প কথা বলেই রেখে দিতেন। গানই ছিল মায়ের জীবন। নিজেও ভালোগাইতে পারতেন।
বাবা মারা যাওয়ার পরে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন গানকে। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়তে লাগল। কিন্তু এভাবে আচমকা চলে যাবেন, ভাবতে পারেনি অর্চিতা। শেষদিকে প্রায়ই বলতেন,  আমি মরে গেলে শ্রাদ্ধশান্তির দরকার নেই রে। পারলে আমার ছবির সামনে গান চালাস। তাহলেই আমি শান্তি পাব।
আহ্মা! মরার কথা বলছ কেন তুমি? এখনও অনেকদিন বাঁচতে হবে তোমাকে। একদিন বিরক্ত হয়ে বলেছিল অর্চিতা।
মানুষ কি আর চিরকাল থাকে রে? একদিন-না-একদিন তো মরবই। আগে ভাগে জানিয়ে রাখলাম। কখন কী হয়, বলা তো যায় না!
আর একদিনের কথাও মনে পড়ছে খুব। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেস হয়ে মায়ের পাশে বসেছিল অর্চিতা। মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করেছিল, এই সময় শুয়ে আছো কেন? শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি?
ক্লান্ত লাগেরে আজকাল। এত ওষুধ খাই, তাও কেমন যেন দুর্বল হয়ে পড়ছি। আর বোধহয় বেশিদিন থাকব না আমি।
ছাড়ো তো! শুধু হতাশার কথা কেন বলো? সব ঠিক হয়ে যাবে মা। সেদিনও তার বিয়ের কথা তুলেছিলেন মা।
তুই কি বিয়ে করবি নারে অর্চি?
করতেই তো চাই, কিন্তু মনের মতো ছেলেই তো পাচ্ছিনা মা! হাসতে হাসতে বলেছিল অর্চিতা।
সবসময় মজা করতে ভালো লাগেনা। মুখ গম্ভীর করে বলেছিলেন কৃষ্ণা। মায়ের মেঘলা মুখ দেখে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল, আচ্ছামা। বিয়েই কি মেয়েদের শেষ কথা? তুমি কী এমন পেয়েছ বলতে পারো?
যা পাওয়ার ছিল, সেটুকুই পেয়েছি। এর বেশি আর কিছু পাওয়ার ছিল না হয়তো! দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে বলেছিলেন কৃষ্ণা।
এসব বাজে কথা বলছ। আমি জানি তোমার অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। পাওনি। বাবার থেকে তুমি সেই মর্যাদাটাই পাওনি!
এসব কথা বলতে নেইরে মা। আমার তো এটুকুই পাওয়ার ছিল। এরবেশি। কথাশেষ না-করেই থেমে গিয়েছিলেন তিনি। আচমকা কৃষ্ণা বলে উঠেছিলেন, সুকল্যাণ কিন্তু ভালো ছেলে। আমার ওকে খুব পছন্দ!
যাহ্বাবা, বিয়ে করব আমি আর পছন্দ তোমার? হোহো করে হেসে উঠেছিল অর্চিতা।
কী যে বলিস বুঝিনা। আমি থাকতে থাকতে বিয়েটা করলে মরেও শান্তি পেতাম।
সুকল্যাণ আমার বন্ধু মা। খুব ভালো বন্ধু।
যা ভালো বুঝিস কর। আমি আর কী বলব! হতাশ কৃষ্ণা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন দেওয়ালের দিকে। অর্চিতাও আর প্রসঙ্গটা বাড়াতে চায়নি।
আগামীকাল মায়ের জন্য নিবেদনের দিন। বাড়ি ভর্তি লোকজন। অর্চিতা সকলের থেকে আড়াল খুঁজে নিয়ে ছাদে চলেএসেছে, যেখানে প্যান্ডেল বানিয়ে রেখেছে ডেকরেটার। সাদা কাপড় দিয়ে ঘেরা বাঁশের কাঠামো। ফাঁকা প্যান্ডেলে শুধু মায়ের ফটো একটা চেয়ারে দাঁড় করানো। মা যেমন প্রায় একা একাই একটা জীবন উপভোগ করতেন বলে মনে করে অর্চিতা, তেমন করেই যেন একা আছেন ফটো হয়ে। মিষ্টু ফটোটা এখানে এনে রেখেছে। রাতে সবাই যখন খাওয়াদাওয়ার পাটচুকে গেলে বিশ্রাম নেবে, সেই সময় সে চন্দন দিয়ে ফটো সাজাবে। ছাদের মেঝেতেও আলপনা দেবে ঠিক করেছে। এই নিরিবিলি জায়গাটাকেই অর্চিতা বেছে নিয়েছে একান্ত সময় কাটাতে, মায়ের কথা ভাবতে। মায়ের কথা ভাবার পাশাপাশি সন্ধ্যায় কীভাবে সবকিছু উতরে দেবে, সে কথাই ও ভাবছিল সে।
বাবা খারাপ মানুষ ছিলেন বলা যাবে না। তবে মায়ের ইচ্ছে-অনিচ্ছে নিয়ে তেমন করে ভাবতেন বলে মনে হয় না। কোনও ক্ষেত্রেই মায়ের মতামত নিতেন না। বলতেন, 'কৃষ্ণার আলাদা মতামত নেই। আমার মতামতই ওর মতামত।' কোনওদিন জানার চেষ্টাও করেননি। মা ও যেন চুপ করে মেনে নেওয়াটাই রপ্ত করে নিয়েছিলেন। সেই মানুষটার শেষ ইচ্ছেটুকুকে মর্যাদা দেওয়া যাবে না!
অর্চিতার কল্পনায় ভেসে উঠল, একে একে গান গাইছে সবাই। সুকল্যাণ 'অন্তর মমবিক শিত করো' আবৃত্তি করল।মায়ের ছবি থেকে এক চিলতে হাসি বেরিয়ে আসতেও দেখতে পেল সে।
সুকল্যাণ ফোন করে ছিল দুপুরে। ওর এক মামা নাকি মান্না দের গান গাইতে পছন্দ করেন। অর্চিতা তাঁকে নিয়ে আসতে বলেছে আগামীকাল। কথাটা মনে হতেই ফোন হাতে তুলে নিল অর্চিতা। ডায়াল করল সুকল্যাণের নম্বরে।
কাল সকাল সকাল চলে আসবি।   
হ্যাঁ হ্যাঁ যাব। কাকিমার ফটোতে মালা দিয়েই স্কুলে চলে যাব। তারপর ওবেলা যাব তোরকাছে।
'তোরকাছে' শব্দটা কিছুক্ষণ ঘুরপাক খায় অর্চিতার কানের পর্দায়। তারপর নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলে, নানা সুকল্যাণ। তা হবে না। কাল ছুটি নিয়েনেনা, প্লিজ।
আচ্ছা দেখি।
দেখি নয়, সুকল্যাণ। তুই কাল সকালেই আসছিস। আমার পাশে থাকিস। তুই ছাড়া আর কে আছে বল? আত্মীয়স্বজন তো কয়েক দিনের জন্য। কথাগুলো বলেই নিজেকে গুটিয়ে নেয় অর্চিতা। একটু বেশিই বলা হয়ে গেল! ভাবে সে।
তোকে একটা কথা বলব অর্চি?
এইপ্রথম সুকল্যাণ অর্চি বলে ডাকল। অর্চিতা খেয়াল করে। এতদিন পুরো নাম ধরেই ডেকেছে।
হ্যাঁ বল।
আমি তোর পাশেই থাকতে চাই। সারা জীবন। ভেবে দেখিস।
কী জবাব দেবে ভেবে পায়না অর্চিতা। থমকে যায় খানিকটা। তারপর সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করে বলে, আগামীকাল মায়ের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করি। তারপর না-হয় তোর ইচ্ছে নিয়ে ভাবব, কেমন? প্লিজ সুকল্যাণ, কালকের দিনটা যেতে দে!

ফোন কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে থাকে অর্চিতা। তারপর মায়ের ছবির দিকে চোখ রেখে উঠে পড়ে। নীচে সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে।





বুলিমা

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য