ঈশানি রায়চৌধুরী
চললুম ইউরোপ
আমাদের সুহানা সফর সুইতজারল্যান্ড ! অবিশ্বাস্য! স্বপ্নের পিঠে ডানা লাগিয়ে এ যেন এক জাদুরাজ্যের দরজা খুলে যাওয়া !আসলে আমার ছেলের ফার্স্টলাভ সুইতজারল্যান্ড। ছ'বছর ইওরোপ প্রবাসে ওর পাঁচবার এদেশ ঘোরা হয়ে গেছে, এখন বাবামাকে না দেখালেই নয়। তবে সময়টা শুনে শিউরে উঠেছিলাম।ক্রীসমাসের ন'দিনের ছুটিতে আমাদের সুইতজারল্যান্ড বেড়াতে নিয়ে যেতে চায়। ওরে বাবা! ওখানে তো তখন টেম্পারেচার মাইনাস কত হবে কে জানে! আমরা কি পারবো ? মানে গরম দেশের লোক তো । আমার আঁতকে ওঠা দেখে ছেলে ঠান্ডা গলায় বলল ' মা, কোন ভয় নেই, আমি তো আছি!দেখবে ১৫ডিগ্রী টেম্পারেচারে ট্রেনে বসে আরামে সাড়ে দশহাজার ফিট ওপরে উঠে যাচ্ছ। আর ট্রেনে বসে বসেই তোমরা তুষাররাজ্যের একটা অন্য জগতে ঢুকে পড়বে। ' তাহলে তো এখন সব বরফের বিশেষ জামাজুতো গন্ধমাদন কিনতে হবে। যাই হোক করুণ মুখে ওর বাবাকে গিয়ে বললাম কিগো ছেলের যখন এত ইচ্ছা তখন কি আর না বলা যাবে ! তারচেয়ে চল লক্ষী ছেলেমেয়ের মত যা বলছে তাই করি। এরপর অনেক খোঁজখবর করে অনেক আটঘাট বেঁধে ছেলের বাড়ি আমস্টারডামে এলাম নভেম্বারের মাঝামাঝি। কারণ নিজেদেরতো কিছু এ্যাক্লামাটাইজ করে নিতে হবে। চমৎকার ঝকঝকে শহর আমস্টারডাম। আর দেশটাও খুব উন্নত আর সুন্দর। একটু পড়াশোনা করে দেখলাম ডাচরা এক আশ্চর্য জাত..... এরা সমুদ্র থেকে জমি ছিনিয়ে নিয়ে দেশটাকে আস্তে আস্তে বড় করেছে। পৃথিবীতে আর কোথাও এমন নিদর্শন আছে কিনা জানিনা তবে কত উন্নত প্রযুক্তি আর কত অধ্যবসায় থাকলে এই চিন্তা করা যায় ভেবে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অসামান্য লড়াই করেছে এরা শতকের পর শতক। সমুদ্রদানব এসে কতবার সলিলসমাধি করেছে সব স্বপ্নের। তবু হার মানেনি। আজও দেশের প্রায় ৬০শতাংশ অঞ্চল সমুদ্রতলের নিচে। নাঃ এভাবে ডিসট্র্যাকটেড হয়ে গেলে চলবে না। প্রসঙ্গান্তরে এসব কথা বলা যাবে। সুইতজারল্যান্ড দিয়ে শুরু করেছি , তার হিমসফর, তার আলপাইন শৃঙ্গ দিয়ে সাজানো শরীর, মখমলি সবুজ ভ্যালি আর আকাশের মত নীল হ্রদের কথাই বলবো। আজ ২২শে ডিসেম্বর ২০১৯। এসময়ে আল্পসের গায়ে আরোহণ তো তুষারযুগে ফিরে যাওয়ারই সামিল।
আমাদের গেটওয়ে অফ সুইতজারল্যান্ড ছিল জেনিভা। সেখানে আমরা ব্রোকেন চেয়ার, জেট ডি ইউ ইত্যাদি অনেক আশ্চর্য জিনিস দেখেছি। দেখেছি জেনিভা লেক যা এদেশে আছে প্রায় ৭০ কিলোমিটার বাকিটা অন্যদেশে। তবে লাস্ট উইক অব ডিসেম্বারে যে সুইতজারল্যান্ড দেখেছি সেই লক্ষ লক্ষ মেট্রিকটন বরফের গল্পই এখন বলবো। মন্ত্র (Montreux) স্টেশন থেকে ট্রেনে আমরা এলাম ভিস্প ( Visp) স্টেশনে। এখান থেকে ট্রেন বদল করে আমাদের যেতে হবে জারম্যাট ( Zermatt)। এবারের ট্রেনটা ছোট কারণ অনেক চড়াই ভাঙ্গতে হবে। ৬০০ থেকে ১৬০০ মিটার উচ্চতায় পৌঁছাব আমরা।তবে এত মসৃণ চলন যে আমরা টের পাচ্ছিনা যে এ বেচারা এত কষ্ট করে হাজার মিটার রাস্তা চড়াই ভাঙছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬০৪ মিটার বা ৫২৬২ ফুট উঁচু জারম্যাট স্টেশনে এসে দাঁড়ালাম আমরা। এই পথে আমাদের গন্তব্য ছিল গর্ণরগ্রাথ( Gornergrat) ..... সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ১০১৩৫ ফুট। তবে যে শহর থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল আবার শীর্ষভ্রমণ শেষে যে শহরে ফিরেছিলাম সেই জারম্যাট শহরের কথাই এখন বলব । গর্ণারগ্রাথ ভ্রমণ শেষ করে আমরা জারম্যাট শহরে পৌঁছালাম, তখন স্টেশন সংলগ্ন বাজার দোকান হোটেল আলোয় ঝলমল করছে। বৃষ্টি পড়ছে, পাথরের রাস্তা তাই আমরা পা টিপে টিপে হাঁটছি। ছোট একটা নদীর ওপর ব্রীজে দাঁড়ালাম। বরফপড়া এখন গা সওয়া হয়ে গেছে তবে ক্রীসমাস ট্রী সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা এমনতো ছুঁয়ে দেখিনি আগে..... সো ক্লিক! বাবাই শুধু সাবধান করছে ' সামলে মা,পিছলে যাওয়ার চান্স আছে। জানো এই জায়গার উচ্চতা ১৬০৪ মিটার। এর চারপাশে সুইতজারল্যান্ডের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গগুলো দেখা যায়।মাত্র ১০ কিমি দূরে ইতালি "। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, চোখে পড়ল এখানকার গ্র্যান্ড হোটেল জারম্যাটারহফ। প্রি-ক্রিসমাস আলোর ফোয়ারায় এক্কেবারে কনেবউ ! কম্পাউন্ডের ভেতর একটা গোল স্ট্রাকচার করা আছে.. সেখানে সবাই ছবি তুলছে অগত্যা আমিও। ছোট জনপদ তাই বেশি সময় লাগল না ঘুরতে , একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে প্রথমবার আইরিশ কফির স্বাদ নিলাম। সফর শেষে স্টেশনে ফিরলাম আমরা কারণ আমাদের আজ রাতের আস্তানা পাশের শহর তাস (Tasch) এ। স্টেশনের খুব কাছে আমাদের একরাতের ঠিকানা Tasherhof থ্রি স্টার হোটেল। বাসস্টেশন টাও আমাদের সামনে বরফের চূড়া মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে। রাতের অন্ধকারে ট্রেন আর বাস স্টেশনের মাথায় জমে থাকা প্রায় একফুট বরফের গা থেকে এমন উজ্জ্বল সাদা আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে যে মনে হচ্ছে মৃদু আলোয় ভরে আছে চারপাশ... কোথাও টুকরো বরফ খসে পড়ছে। সমতলের অনভ্যস্ত মানুষদের চোখ যেন চন্দ্রাহত হয়ে গেল এই দৃশ্য দেখে। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কতক্ষণ কে জানে
শুনেছি এখানে একটা দুর্দান্ত গলফ কোর্স আছে, আবার শীতকালে ক্রসকান্ট্রি স্কীয়িং চলে। নিজেকে টানতে টানতে রুমে এসে আমরা অবাক.... এত চমৎকার যে মনে হল আমরা রাজঅতিথি! ছবি তুলে আর আশ মিটছে না। বুঝলাম ছেলে যথাসাধ্য আরামে রাখতে চায় আমাদের। বাবা ছেলে গিয়ে স্প্যাগেটি খেয়ে এল ডিনারে.... আমি ড্রপ টায়ার্ড তাই নো নড়ন চড়ন। সকাল হতেই এক অন্য পৃথিবী! পর্দা সরিয়ে রূপসী তাসের চেহারা বিমুগ্ধ করে দিল... রজতশুভ্র তুষার এমন স্বর্গীয় আবহ তৈরি করেছে যে শান্ত আনন্দে ভরে উঠছে মন। ঘনঘন বরফ সাফাই করার যন্ত্র আসছে যার একটা দিক এমন কাত করা যে বরফ একপাশে জড়ো হয়ে যাচ্ছে। চারদিক সাদার মধ্যে রাস্তার কালো রং খুব মনে ধরছে তবে বেশিক্ষণ নয় ২০-২৫ মিনিটের মধ্যে বরফ আবার দখল করে নিচ্ছে তার এলাকা..... ছোট হ্যান্ড ড্রেজার দিয়ে ফুটপাথ পরিষ্কার হচ্ছে ঘনঘন। এখানে পেট্রল বা ডিজেল গাড়ি চলে না, চলে ইলেকট্রিক ভ্যান। ঠিক পাশেই একটা পাহাড় সবুজে সাদায় মনোরম। এমন জ্যান্ত তুষারের রাজ্যে আমার মিষ্টারও আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না.... ভিডিও কল করে বন্ধু বান্ধবদের দেখাচ্ছেন কমেন্ট্রি সহযোগে ; যদিও এমন আদিখ্যেতা তিনি সচরাচর করেন না। আমার মনে শুধু লতাজীর সেই তীক্ষ্ম সুরেলা স্বর ভেসে আসছে... " এ কঁহা আ গয়ে হাম "।
জীবনের সঞ্চয় পথপ্রান্ত থেকে কুড়িয়ে নিতে নিতে আবার নতুন পথে এগিয়ে যাওয়া। ২৩/১২ তারিখে ভিস্প জেলার তাস স্টেশন থেকে এসে ভিস্প ( Visp ) স্টেশন হয়ে আবার মন্ত্র । এবার আমরা এ্যাভেল করব গোল্ডেন পাস ট্রেন...এটা স্বপ্নের দেশের অনেক ট্রেজার লুকিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর। এই অভিজ্ঞতা এক একটা ঋতুতে একেকরকম। একটা দিগন্তজোড়া চালচিত্র যেন দমবন্ধ করে বসিয়ে রাখে এখানে। তিনটে পার্বত্য পাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এই পথে। ৪০০০ মিটার উচ্চতায় আলপাইন শৃঙ্গ, আর আটখানা লেকের প্রাকৃতিক নৈবেদ্য সাজানো আছে এই রেলযাত্রায়। টিপিক্যাল সুইস সবুজ উপত্যকা আর আঙ্গুরখেত দেখতে দেখতে যাত্রীরা অবিস্মরণীয় অভিঞ্জতা নিয়ে ফেরেন। এই যাত্রা শুরু হয় জার্মানভাষী লুসার্ণ (Lucerne ) থেকে আর শেষ হয় ফ্রেঞ্চভাষী মন্ত্র (Montreux ) তে। আমরা মন্ত্র থেকে ট্রেনে উঠে নামলাম Zweisimen বা জুইসমেনে। বাবাই সুইস পাস করে রেখেছে তিন দিনের জন্যে। ২২০ ইউরো ইচ। এই টিকেটে ট্রেন, বাস, লঞ্চ সবই ব্যবহার করা যায় কেবল কার ছাড়া । তবে আমরা শুধু ট্রেনে সফর করছি। তাই আমরা পছন্দমত স্টেশনে নামছি আবার পরের গন্তব্যের জন্য ট্রেনে উঠে পড়ছি।
আমরা স্টেশনের লাগোয়া কিয়স্কে গিয়ে বাদাম আর কফি খেলাম। ঘুরেফিরে আবার ট্রেনে। পরের ডেস্টিনেশন (Spiez ) স্পীজ। থুন লেকের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই শহর আঙ্গুর বাগানের জন্যেও প্রসিদ্ধ। আর স্বাভাবিকভাবে অসামান্য ওয়াইন তৈরি হয় এখানে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে দাঁড়ালে নিচে একটা অসামান্য ছবি পাওয়া যায়। ছবির মত চার্চ, ঘরবাড়ি গাছপালা দিয়ে সাজানো একটা নিখুঁত ছবি। আশ মেটে না তাই ক্যামেরার লেন্সে নিয়ে রাখি। এখানে ক্যাসলও আছে তবে আমাদের আগ্রহ নেই। আবার রেলযাত্রা আর পথ এসে মিশল ইন্টারলেকেন ওয়েস্টে।
সুইতজারল্যান্ড দেশটা প্রকৃতির এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এর রহস্য রোমাঞ্চের অভিজ্ঞতা এর তুষার রাজ্যের আকর্ষণ সারা পৃথিবীর ট্যুরিস্টদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। এদেশের প্রায় ৬২ভাগ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে আল্পসের সুউচ্চ শৃঙ্গের সারি আর তার বিস্তার। অতলান্তিক মহাসাগরের পরোক্ষ প্রভাবে এখানকার আবহাওয়াও আশ্চর্য অনুকূল। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষও এখানে তার অতুলনীয় কীর্তি রেখেছে। সুইসরা এই পার্বত্যপথে এত অনায়াস ভ্রমণের যে বন্দোবস্ত করেছে.... যত নিরলস পরিশ্রমে এমন অসামান্য কগ রেলওয়ে মেইনটেন করছে তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। অবশ্যই তারা পৃথিবীর সেরা প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছে তবে এই প্রকল্প তো সুইসদেরই। ১৮৯৮সালে শুরু হয়েছিল এই রেলওয়ে ট্র্যাক।আরও একটা চমক এটা নাকি পৃথিবীর প্রথম বিদ্যুৎচালিত রেলব্যাবস্থা যদিও এখন এটা চলে ইকো ফ্রেন্ডলি ব্যবস্থায়। আরও পালক আছে মুকুটে এটা পৃথিবীর সর্বোচ্চ উন্মুক্ত রেলওয়ে মানে মাটিতে যেমন খোলামেলা ট্রেন চলে ঠিক সেরকম। পর্যটন এদেশের কয়েনেজ, মূল আয়ের উৎস ঠিকই কিন্তু তার জন্য এঁরা যে ডেডিকেশন যে অতন্দ্র নজরদারি বজায় রেখেছেন তার জন্যে তাঁদের স্যালুট! এই তাপমাত্রা আর এই উচ্চতায় এমন মসৃণ আর নিরাপদ রেলভ্রমণ যাঁরা করাতে পারেন তাঁদের দেশে মানুষ তাদের সব সঞ্চয় আর স্বপ্ন উপুড় করে দেবে তাতে আর আশ্চর্য কি!
কি সব ধানাই পানাই রয়েছে মন্তব্য কলমে যে আমার মতো আনপর অনেক চেষ্টা করেও সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারলাম কিনা জানিনা।।
উত্তরমুছুনযাহোক, দারুন জমিয়ে লিখেছেন আপনি।। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আপনাদের সঙ্গে বুঝি আমিও ছিলাম এই ভ্রমণে।।
খুব ভালো লাগল দিদি তোমার ভ্রমণকাহিনি। সুইজারল্যান্ড আমিও গেছিলাম, তোমার লেখায় আবার নতুন করে অপূর্ব দেশটির সৌন্দর্য আস্বাদন করলাম। আমরাও মাউন্ট টিটলিস, লেক লুসার্ণ এবং এই দেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
উত্তরমুছুন-পৃথা চট্টোপাধ্যায়
খুলে ভালো লিখেছেন দিদি। ঠিক ঠিক সবটা। যথাযথ। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন- রাজদীপ ভট্টাচার্য