গৌতম দে সরকার
হাতির দেশে
শিলিগুড়ি ষ্টেশন ছাড়তেই ট্রেনের জানালার কাছের সিটে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকল তাথৈ। বাইরের দৃশ্য দেখার অসীম আগ্রহ চোখে মুখে। ওর ডান পাশে বসে রিনি। উল্টোদিকে ওর ভাই ছয় বছরের বুবু, বাবার সাথে বসে আছে। ও ও জানালার ধারেই বসবে।
এই ডুয়ার্সে আসা অবধি রথীন্দ্রনাথ কতই না গল্প শুনিয়েছে ওদের। প্রতিদিন নিয়ম করে। বলেছে, শিলিগুড়ি থেকে ট্রেন ছাড়ালেই জঙ্গলের শুরু। দুধারে শুধুই জঙ্গল আর চায়ের বাগান। পাহাড়, নদী। জঙ্গলের এই পাহাড়ি পথে নদী আসে একটু পর পরই।
তাথৈ-এর দশ পেরিয়ে এগারোয় পা। ক্লাস ফাইভ। এমন জঙ্গলের কথা শুনেই রথীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলো, "জঙ্গলে হাতি দেখা যায় বাবা?"
রথীন্দ্রনাথ বললো,"হাতিরই তো দেশ ওটা। শুধু কি জঙ্গলে? মাঠে ঘাটে, নদীর বুকে যখন তখন হাতি দেখা যায়।"
অবাক হয়ে শুনেছে সেই সব গল্প ওরা, দুই ভাই বোন। আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে আজকের দিনটির জন্য। রিনিও আগে কখনো ডুয়ার্সে আসেনি। বিয়ের পর থেকেই রিনি আর রথীন্দ্রনাথ কতবার যে প্ল্যান করেছে ডুয়ার্সে আসবে, প্রতিবারই কোনো না কোনো ভাবে ভেস্তে গেছে। তারপর চাকুরিতে বদল এলো ভুবনেশ্বরে। তাথৈ, বুবুরা ছোটো। আসা হয়ে ওঠে নি। ছুটিতে এলে তো কলকাতার বাড়িতেই আসা হয়। প্রায় দশবছর পর গতবছর আবার রথীন্দ্রনাথ কলকাতার অফিসে ফিরে এসেছে।
হাসিমারাতে রথীন্দ্রনাথের খুড়তুতো দাদারা থাকে। জ্যাঠামশাইয়ের এয়ারফোর্সে শেষ পোস্টিং ছিল হাসিমারাতেই। সেই তখন থেকেই ওরা এখানেই থেকে গেল। দাদারা যে কতবার বলে আসার জন্য। তবে এবার এই কালীপুজোর ছুটির সাথে প্ল্যানটা করেই ফেলল রথীন্দ্রনাথ। এই সময়টাই ঠিক আছে। এর পরেই স্কুলের পরিক্ষা শুরু হয়ে যাবে তাথৈদের। রিনি এ ব্যাপারে ভীষণ কড়া। পরীক্ষার আগে কোত্থাও বেড়ানো নয়।
এবছর দুর্গাপূজা তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। তাই কালীপূজোও অক্টোবরেই পড়েছে। শীতের কোনো বালাই নেই। তবে ডুয়ার্সের আবহাওয়া খুব ভাল। পরিষ্কার নীল আকাশে শুভ্র সাদা মেঘের ছড়াছড়ি। আর সবুজ ঘন জঙ্গল, সাজানো চায়ের বাগান পেরিয়ে যেতে মন খুশিতে ভ'রে গেল রিনি-তাথৈদের। এখানে সব কিছুতেই যেন অতি-র আধিক্য। আকাশের নীল এমন আর কোথাও নেই। সাদা মেঘের শুভ্রতাও বেশি। বনরাজির এমন সবুজ আর কোথাও দেখা যায় না। সবুজের যে কত রকম থাকতে পারে ডুয়ার্সের না এলে জানাই হয় না।
ট্রেন চলছে এঁকেবেঁকে। কখনো ব্রিজের ওপর দিয়ে। ঘটাং ঘটাং শব্দ। আর ব্রিজের রেলিং-এ সামনের দৃশ্যপট বাঁধা পায়। তাথৈ-এর চোখ বাইরে জঙ্গলের দিকে। সে হাতি দেখবে।
তাথৈ আর বুবুর উৎসাহ আর কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে জেরবার প্রায় রথীন্দ্রনাথ। ওদের কথা বলাতেই মুখর ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট। রিনি বলল,"এবার একটু চুপ করে বোস তো তাথৈ। বুবু তুমিও চুপ করবে।"
দিদি একটা কথা জিজ্ঞেস করলে বুবুও আর একটা প্রশ্ন করবেই।
"দিদি কেন বারে বারে প্রশ্ন করছে বাবাকে?"
"দিদি তো বড়, তাই না?"
"বড় বলে কি বেশি বলবে?"
হঠাৎই রথীন্দ্রনাথ জানালার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,"ওই তো হাতি!"
মুহুর্তেই ওরা সবাই ঘুরে তাকালো বাইরের দিকে। রিনি রথীন্দ্রনাথকে বলল,"তুমিও ওদেরই মতো, এখনো ছেলেমানুষী গেল না।"
ততক্ষণে তো ট্রেনটা কিছুটা এগিয়ে গেছে আরও কিছুটা। সুরঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেল ঝুপ করে।
বুবু জিজ্ঞেস করলো, "বাবা, ঠিক করে বলো তো, তখন সত্যিই হাতি দেখেছিলে কিনা?"
তাথৈ বললো, "বুদ্ধু, হাতিরা দল বেঁধে থাকে। থাকলে ঠিক দেখতাম। তাই না বাবা?"
অনেকদিনপর এই পথে এসে ভালো লাগছে রথীন্দ্রনাথেরও। আগে প্রতি বছরই একবার করে এসেছে। ডুয়ার্সের এই জঙ্গল পথ ওর ভীষণ চেনা। এই জঙ্গলের একটি নিজস্বতা আছে। বৃক্ষরাজির বিন্যাসেই চেনা যায় ডুয়ার্সের এই পথকে। বনপথে গাড়ির চাকার সমান্তরাল দাগটি যেন আজন্মের। রেল পথের সাথে সাথেই যেন তার চলা। চলতে চলতে আবার হারিয়ে যাওয়া গভীরের দিকে। আবার ফিরে আসে কখনো অজান্তেই। জঙ্গলের গভীরে কোথাও স্বচ্ছ জলের ক্ষীণ প্রবাহের স্থানটি, নিবিড় ছায়া ঘিরে থাকে। লতাগুল্মরা ভীড় হয়ে থাকে আপন বিস্তৃতিতে। এখানে যেন এখনো বাইরের সভ্যতা এসে ছুঁতে পারে নি। আদিম প্রকৃতি কোল পেতেই আছে। দূরে, কাছে পাহাড়গুলো প্রাচীর তুলে আছে দিগন্তে। বর্ষা পেরিয়ে এসে বনরাজি নতুন সাজে, উজ্জ্বল সবুজে ওদের যাত্রাপথ সাজিয়ে রেখেছে।
গতি বাড়িয়ে, কখনো ধীরে, ট্রেন চলছে। কখনো থেমে দাঁড়ায় অরণ্যের মাঝেই।
বুবু বলে, "বাবা ট্রেন কেন জোরে চলছে না?"
তাথৈ বলে, "বুদ্ধু, এখানে ট্রেন জোরে চলে না! ড্রাইভারকে খুব বুঝেশুনে চালাতে হয়।"
বুবু দিদির কথা শোনে, কিন্তু প্রশ্ন করে রথীন্দ্রনাথকে।
"বলো না বাবা, ট্রেন কেন জোরে চালায় না!"
উত্তর দেয় তাথৈ, " আরে, হাতির পাল মাঝে মাঝেই রেললাইনের ওপর চলে আসে। অ্যাক্সিডেন্ট হলেই বিপদ। কত হাতি একসাথে মারা যাবে বলতো!"
রথীন্দ্রনাথের কাছেই শোনা গল্প সব তাথৈ-এর। বুবুও মেনে নেয় অবশেষে, দিদি অনেক জানে!
রিনি দেখলো সুন্দর একটি ষ্টেশনে এসে ট্রেন দাঁড়ালো। গুলমা। কী সুন্দর নামটি। চারিদিকে সবুজ ঘাসের মাঠ, দূরে দূরে ওয়াচ টাওয়ার, সবুজ আর নিরালার এমন মিলমিশ, স্নিগ্ধতা এনে দিল মুহুর্তেই।
মেঘগুলো খন্ড খন্ড হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। যেন বৃক্ষরাজির ডালে ডালে এসে আটকে আছে কয়েকটি।
রথীন্দ্রনাথ নেমে এসেছে প্লাটফর্মে, ওদের জানালার কাছে। রিনি দেখে বললো,"তুমি নামলে কেন?"
"কী সুন্দর ষ্টেশনটি!"
"নামটিও খুব সুন্দর! গুলমা। "
"কতদিন ভেবেছি জানো আগে, এখানকার এই ষ্টেশনগুলোতে এক একদিন সারাটাদিন একা একা কাটাবো। এমন সবুজের মাঝে, এমন নিস্তব্ধতা কোথায় পাবে তুমি?"
রিনি ট্রেনের ভিতরে বসেই বলছে, "সাদা মেঘগুলো দেখেছ, যেন নেমে এসেছে গাছে মাথায়।"
রথীন্দ্রনাথের মাথায় কবিতা এলো," এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে।"
"ঠিক বলেছ।" রিনি বলল। "বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস/ এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে/ পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস দুয়ার চেপে ধরে।" (শক্তি চট্যোপাধ্যায়)
এই সময়েই ট্রেনটি নড়ে উঠলো। রথীন্দ্রনাথ ট্রেনের দরজায় উঠে দাঁড়ালো।
বিস্তির্ণ একটি শুকনো খাঁ খাঁ নদী পেরোচ্ছে এইবার ট্রেনটি। দু এক জায়গায় অবশ্য সরু প্রবাহে জল বইছে। দূরে, পাহাড়ের বাঁকে গিয়ে হারিয়েছে নদীর দৃশ্য। যেদিকেই চাও, কেবল সুন্দর আছে ছড়িয়ে। রথীন্দ্রনাথ ভিতরে আসতেই রিনি জিজ্ঞেস করলো, "কী নদী গো এটা? এত বিরাট!"
"এটা তো মহানন্দা।"
"একবার তো পেরোলাম, এই নদীটাই তাই না?" "একবার নয়, তিনবার পেরোলাম একই নদী।"
সেবক ষ্টেশনটি আরও সুন্দর! কাছাকাছি পাহাড়গুলি ঘিরে আছে। জঙ্গলের হাতছানি রয়েছে, যা পথিককে এই নির্জন ও সুন্দর জায়গাটিতে নেমে যেতে প্রলোভিত করে। ইচ্ছে জাগায় থেমে যেতে। উল্টোদিকের প্লাটফর্মের ষ্টেশন মাষ্টারের ঘরের চালায় বোগেনভালিয়ার ঝাড় ফুলে ফুলে সেজে রয়েছে। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হয়,উল্টো পথে আসা ট্রেনের ক্রসিংটা এখানেই হয়।
কোনো ক্লান্তি আসে না এ পথের জার্নিতে। শুধুই যেন সৌন্দর্য তার বিভিন্ন ভঙ্গিমার পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়েই যাচ্ছে। ভাল লাগছে রিনির। তাথৈয়ের ঠোঁট ভার এখনো একটাও হাতির দেখা মেলে নি। ময়ূরও তো দেখতে পেতে পারতো!
রথীন্দ্রনাথ বললো, "দাঁড়া এইবার একটা নদী আসবে। নদীর ওপরে সুন্দর একটা ব্রিজ আছে।"
"কি নদী বাবা?" তাথৈ জিজ্ঞেস করলো।
"তিস্তা।"
"কি করে জানবো, এটা কোন নদী?"
"ব্রিজে ওঠার আগে লেখা থাকে নদীর নাম।"
আস্তে আস্তে গড়িয়ে গড়িয়ে চলছে ট্রেন। তিস্তা ব্রিজে ওঠার আগে তাথৈ পড়ে ফেললো নদীর নামটি।
"ঠিকই বলেছ বাবা, তিস্তা।"
"আমিও পড়েছি।" বুবু বললো।
অনেক নীচে জল। গাছের পাতার মতোই সবুজ রঙ তার। দূরে করনেশন ব্রিজটাকে দেখা গেল।
রিনিকে বললো রথীন্দ্রনাথ, "ওই ব্রিজের কাছেই সেবক কালীবাড়ি। ব্রিজ না পেরিয়ে সোজা গেলেই সিকিম।"
"আর ব্রিজ পেরোলে, বাবা?" বুবু জিজ্ঞেস করলো।
"ব্রিজ পেরোলে এই আমরা যে পথে যাচ্ছি, সেই পথ।"
রিনির ভাল লাগছে। গতি নিয়ে ট্রেনও ছুটছে। ট্রেনে একজন দোতারা বাজিয়ে গানের আয়োজন করছেন। কী সুন্দর শব্দের মূর্ছনা। তিনি একজন ভাওয়াইয়া শিল্পী।
তাথৈ বুবু রিনি সবাই ঘুরে গেল সেই দিকে।
তিনি গাইছেন,
"হস্তি নাড়ান, হস্তি চড়ান, হস্তির গলায় দড়ি
ওকি ওরে সত্য করিয়া বল রে মাহুত
কোন বা দেশে বাড়ি রে
তোমরা গেলে কি আসিবেন,
মোর মাহুত বন্ধু রে
রাজার হস্তি চড়াও হে কন্যা
চম্পক নদীর ধারে....."
একে একে কত যে নদী পার হয়ে যাচ্ছে, ঘিস, মূর্তি, জলঢাকা, ডায়না। পেরিয়ে যাচ্ছে কত যে নিরালা ষ্টেশনগুলি। বাগরাকোট, ওদলাবাড়ি, ডামডিম, চালসা, নাগরাকাটা, বানারহাট। চাপড়ামারি ফরেষ্ট পেরিয়ে দূরে ভুটান পাহাড়ের রেশ। আকাশ ছুঁয়ে আছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত।
তোর্ষা নদী পেরিয়ে হাসিমারা যখন এসে পৌঁছল তখন ঘড়িতে বারোটা বাজে। প্লাটফর্মের বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রথীন্দ্রনাথের এক দাদা।সেখান সটান জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে এলো ওরা।
এখানে এখনো কাঠেরই দোতালা বাড়ি। তাথৈ খুবই রোমাঞ্চিত। রিনিও। কখনো এমন বাড়িতে থাকা হয়নি। খুব মজা পাচ্ছে বুবুও।
গল্প করে সকলের সাথে ভালোই কাটছে। বিকেলে চা বাগানের দিকে হাঁটতে বেরিয়েছিল রিনি,তাথৈ,বুবু। সাথে গিয়েছিল রথীন্দ্রনাথের বড়দার ছেলে বাবাই। কলেজে পড়ে ও। ওকে পেয়ে তাথৈয়ের কত প্রশ্ন।
"আচ্ছা,এখানে হাতি আসে?"
"হ্যাঁ, আসেই তো।"
"দলবেঁধে?"
"দলবেঁধেও আসে, একাও দেখা যায় মাঝে মাঝে!"
রিনি বললো, "তোকে দেখছি হাতিতেই পেয়েছে রে তাথৈ?"
"বাবা যে বললো এখানে, যেখানে সেখানে হাতির দল ঘুরে বেড়ায়। কিছুই তো দেখতে পেলাম না।"
বাবাই বললো, " সেদিনই তো একটা চিতা বেড়িয়েছিল এই এইখানেই।"
"ওমা তাই!" রিনি বললো।
তাথৈ জানতে চাইল,"তারপর কোথায় গেল?"
"লোক জমা হয়ে গেল। হৈ হৈ চিৎকারে ওই তোর্ষার চরের দিকেই চলে গেল।"
সূর্যটা একেবারে পশ্চিমে। দূরের গাছের একেবারে মাথায় মাথায়। শেষ নিস্তেজ আলো তখনো ছুঁয়ে আছে সামান্যই চা গাছের ওপরে। রিনি বললো, "এবার ফিরে চল বাবাই।"
রাতে কাঠের ঘরে শুয়ে জেগে ছিল ওরা অনেকক্ষণ। বাইরের কতরকম শব্দ, শুনতে পাচ্ছিল ওরা। সুরেলা কন্ঠী একটা পাখি ডেকে ডেকে উড়ে গেল। জমাট অন্ধকারে জোনাকির স্ফুলিঙ্গ দেখেছে সন্ধ্যায়। কলকাতায় এসবের দেখা মেলে না। এত তাড়াতাড়ি কেউ শুয়েও পড়ে না। কলকাতায় থাকলে, এইসময় রিনি বলতো তাথৈকে, "স্কুলের হোম টাস্কগুলো এবার শুরু কর।"
পড়াশোনা নেই এই ক'দিন। কী মজা!
চারপাশ এত শান্ত, মনে হচ্ছে বুঝি অনেক রাত! বাইরের একটি আওয়াজে ওরা সকলেই নিশ্চুপ হলো এক সাথে। কেমন যেন বিদ্রুপের অট্টহাসি রবের মতো, কিছুটা ভৌতিক!
রথীন্দ্রনাথ হেসে উঠলো। বললো,"ওটা তক্ষক!"
"তক্ষক!" রিনি তক্ষক বলতে ভয়ঙ্কর কিছুই বুজলো বোধহয়।
"হ্যাঁ। টিকটিকির থেকে একটু বড়। রঙ বেরঙের হয়। খুবই নিরীহ প্রাণী ওরা। কাল দেখাব। এবাড়িতে অনেক আছে?"
অনেক কিছু নিয়ে গল্প করতে করতে ওরা কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙলো শেষ রাতে এসে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ডুয়ার্সে এমনই হঠাৎই মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমে আসে। কার্তিক মাসেরও এমন বৃষ্টি হামেশাই হয়।
বৃষ্টির সাথে বজ্রপাতও চলছে সমান তালে। ইদানিং যেন বজ্রপাতের ঘটনা বেড়েছে কিছুটা হলেও। কাল তো আকাশ ভালোই ছিল। মাঝরাতে হঠাৎ এমন বৃষ্টি আর মুহুর্মুহু বাজ পড়ার শব্দে চারিদিক কেঁপে উঠেছে। রিনির মনে হলো এই বুঝি একটা বাজ বাইরে উঠোনের ওপরেই এসে পড়লো। তাথৈ ভয়ে একেবারে মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বুবু বাবার কাছে।
রথীন্দ্রনাথ ভাবছে, এই তো অকাল বৃষ্টি শুরু হলো। ভেবে রেখেছিল সকালে জলদাপাড়া ফরেস্টে যাবে। একদিন চিলাপাতা ফরেস্ট হয়ে কুচবিহারটা ঘুরে আসবে। জয়ন্তী বক্সা ফোর্টে যাবে ভেবেছে। একদিন ভুটানটাও ছুঁয়ে আসবে ভেবেছে। কিন্তু এমন বৃষ্টি যদি লেগে থাকে, ঘরেই বন্দি হয়ে থাকতে হবে।
শেষ রাতের এই ঘন্টাখানেক বৃষ্টিতে চারিদিক জলে থৈ থৈ। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে শুরু হলো এক আলসেমির সকাল। চাদর গায়ে মুড়ে বিছানায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা। চা খেয়ে আবারও একটু ঘুমিয়ে নিতে পারলে তো কথাই নেই।
বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগেই। টুপটাপ করে জল ঝরছে পাতার পরে। মেঘ কেটে গেছে অনেকটা। আকাশ নীল হতে শুরু করেছে। বাইরে মানুষের কথা শুনতে পেল, হাতির পাল বেরিয়েছে এদিকে। দলে দলে মানুষ ছুটছে।
তাথৈ শুনেই বললো, "যাবে বাবা?"
রথীন্দ্রনাথ যেন এই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করে ছিল। চটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লো। সাথে বাবাই রিনি তাথৈ বুবু। সব লোক ছুটছে তোর্ষা চরের দিকে। ওরাও ছুটলো সেইদিকে। বাঁধের ওপরে গিয়ে দেখল হাজার মানুষের ভীড় নদীর খাদে। মানুষের ভীড় ঘিরে আছে একটা কিছুকে কেন্দ্র করে।
ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢুকে তাজ্জব হয়ে গেল ওরা। রাতের বজ্রপাতে তোর্ষা চরে ছ'টি হাতির মৃতদেহ পরে আছে বালি পাথরের ওপরে।
চারটি বড় পূর্ণবয়স্ক আর দুটি বাচ্চা হাতি। মনটা খারাপ হয়ে গেল রথীন্দ্রনাথের। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো তাথৈ। দুচোখ ভেসে যাচ্ছে কান্নায়।
"কী হয়েছে তাথৈ?" রিনি জিজ্ঞেস করতেই কান্নার সাথে শব্দও যোগ হলো।
"আমি না এলেই ভাল হতো। এভাবে আমি হাতি দেখতে চাইনি।"
রথীন্দ্রনাথ ওদের নিয়ে সেখান থেকে চলে এল। পিছনে পড়ে থাকলো তোর্ষার চর, নিষ্প্রাণ হাতির দেহগুলি আর অসংখ্য মানুষ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন