সৌরভ বর্ধন

  

বাংলা কবিতায়

 

একদিন গঙ্গার ঘাট থেকে আমি নিখোঁজ হয়ে গেছিলাম বাংলা কবিতায়। চেতনার কারুকাজ আমি নতুন করে গড়ে তোলবার কথা ভেবেছিলাম কবিতার কথা পড়ে। অঘ্রাণের অনুভূতিমালার প্রাবল্য দিয়ে বিনয় মজুমদার আর প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না দিয়ে শম্ভু রক্ষিত আমাকে অস্থির করে তুলেছিলেন, এমনকি তাদের যাপন দিয়েও ----- আমার তো বারবার মনে হয় সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ, কেন কবিতা বুঝিনি আমি আজও। আবার সত্তরের সমুদ্র নিয়ে দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় আহ্নিক নিয়মেই কেবল দেখেছেন শিয়রলতা; জলের তিলক পরে বীতশোক ভট্টাচার্য, তিনি আমার অন্যযুগের সখা, তিনি আমার প্রদোষের নীল ছায়া; কিংবা সলমা-জরির কাজ নিয়ে পুরী সিরিজের উৎপলকুমার বসু আমার চিন্তামণি হয়েছেন, আমায় স্থির হতে দেননি। আমি সামাজিক বনে বনে ঘুরে বেরিয়েছি চন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাসান মঙ্গলে চেপে। আবার স্বদেশ সেন পড়ে মাঝ রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেছে, মাটিতে দুধের কাপ পড়ে থাকতে দেখে, আপেলকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আমি চিৎকার করেছি 'ওকে তুমি দাঁত দিয়ে জাগাও' ---- অথবা 'পায়রা পিছলে যাবে এমনই হয়েছে আকাশ'। ওদিকে শৈলেশ্বর ঘোষ আর অরুণেশ ঘোষ আমাকে একা একা বাথরুমে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন দীর্ঘক্ষণ, আমি ঘোড়ার সঙ্গে বলেছি ভৌতিক কথাবার্তা, তিনজন বিধবাকে নিয়ে আলোচনার পরিবর্তে আমি দরজাখোলা নদীর দিকে তাকিয়ে থেকেছি, দেখেছি 'মানুষের কান্না থেকেই এত আলো আসে'; আমি গুহা মানুষের গান গেয়েছি, আমি ক্লান্ত কবীরের দোঁহাগুলো আউড়ে গেছি রাতভোর। আমি রঘু ডাকাত বা ফালগুনী রায় হতে না চেয়েও তাকেই হিরো বলে ডেকেছি, মাঝরাতে চালিয়ে দেখেছি নষ্টআত্মার টেলিভিশন। আমাদের পিতামহ, আমাদের উত্তরপুরুষ, ভালো থাকুন ভূমেন্দ্র গুহ, আমি আপনার জীবনানন্দের বিপন্ন বিস্ময় থেকে ছিটকে এসে নিজেকে অনন্য রায়ে রাঙিয়ে দেখেছি ব্রাউন বিস্ময় আর দৃষ্টি অনুভূতি ও ইত্যকার প্রবাহ; দেখেছি বারবার বিরক্ত হয়েও আমাকে ফিরতে হয়েছে গানের হাউই নিয়ে বসে থাকা রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীর কাছে অথবা অতিচেতনার বারীন ঘোষাল ও তাঁর প্রণয়ধ্বনির সফটওয়্যারের কাছে, দেখেছি তাঁর উদোমডাঙায় পুব আর ফুরোয় না। একসময় ধুলোমাখা ঈথারের জামা পরে আমি যৌবন বাউল হয়েছি, হাতে নিয়ে ঘুরেছি মরমী করাত, নিরীশ্বর পাখিদের উপাসনালয়ে আমি মুখোমুখি হয়েছি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের ---- 'এখন আমার হাত ছড়ে গেলে শিশির বেরোয়'। তারপরেও, আজ যদি আমাকে জিগ্যেস করো আমি অস্বীকার করতে পারবো না, বিতর্ক থাক, তবুও আমার সবুজ যৌবন জাগিয়ে তোলা সূর্যপোড়া জয় গোস্বামীকে। সেই কবে থেকে আমি বারবার খুলে খুলে দেখি নোটবুক, কোন কোন নোটস্ নেওয়া এখনো বাকি, কার কার সাক্ষাৎকার ঝুলে আছে, উত্তরপর্বের কবিতার কাজ কতদূর এগোলেন প্রভাত চৌধুরী! কিংবা যখন জিগ্যেস করি 'কতদূর এগলো মানুষ!' তখন আমার সোনালি কাবিন হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন কালের কলস ও আল মাহমুদ, পরাণের গহীন ভিতর বাজেন সৈয়দ শামসুল হক, বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে এসে দাঁড়ান শামসুর রহমান, তাঁর হরিণের হাড় নিয়ে আমাদের পথ চলা। আমাদের দিনগুলি রাতগুলি, আমাদের হাতে হাত রাখা শঙ্খ ঘোষ, আমরা জানু পেতে বসি তাঁর কাছে, নিবিড় হয়ে শুনি গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ। আমরা মা কিংবা প্রেমিকাকে স্মরণ করি শামশের আনোয়ার দিয়ে, জীবনের বিস্তর সারেগামা পেরিয়ে যাই ভাস্কর চক্রবর্তীর শয়নযানে করে, যদিও তাঁর আকাশ অংশত মেঘলা। কিন্তু আমাদের ব্যান্ডমাস্টার তুষার রায়ের ছাই ঘেঁটে যে পাঠক পাপ খুঁজে পেয়েছেন, তিনি কোথায়, তিনি কি আজ মরুভূমির আকাশে তারা হয়ে আছেন, নাকি ভাসিয়ে দিয়েছেন শেষ নৌকা! আসলে এতসব জানাও তো অসম্ভব, তাই আলোকিত সমন্বয় ----- আমাদের আলোক সরকার, বিশুদ্ধ অরণ্যের তিনি হলুদ পাখি, অর্থহীন অর্থহীন। তথাপি তাকাতে হয় নিসর্গের দিকে, রাতের আকাশে একটি উল্কাপাতের মতো আমি অপেক্ষা করি, আনোয়ার আসে, শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই এখানে ওখানে, সেখানে, দূর তরঙ্গে। তারপর যেতে যেতে যেতে দ্যাখা পাই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের, তিনি পা চালিয়ে হেঁটে চলেছেন, বারেবারে বলছেন 'ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য'! আমরা যারা কবিতা লিখি তারা তো মুখুজ্জেরই পদাতিক সৈন্য। আবার হেমন্তের অরণ্যে আমরাই পোস্টম্যান, আমরাই ফুটপাত বদল করি মধ্যরাতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে ডেকে বলি আমাদের অনন্ত কুয়ার জলে পড়ে থাকা চাঁদের কথা। যেভাবে নিত্য মালাকার তাঁর অন্ধের বাগান খুঁজে খুঁজে আমাদের দেখিয়েছেন নিমব্রহ্ম সরস্বতী, সেভাবেই অতিশয় তৃণাঙ্কুর পথে আমাদের নয়নপথগামী গৌতম বসু। আমাদের একদিকে মৌপোকাদের গ্রামবাসী মণীন্দ্র গুপ্ত, তিনি শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু, তিনি ছত্রপলাশ, অন্যদিকে চাঁদ ও খোঁড়া বেলুনওয়ালা শ্যামল সিংহ। যদিও আমার বয়স ত্রিশ বৎসর পূর্ণ হইতে এখনও দেরি আছে, আবার চলিত ক্রিয়াপদে বাংলা লিখিতেও একদম যে ইচ্ছে করে না তা নয়, তবুও আমার দূরের সন্ধ্যার টেবিলে আছেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। অন্যদিকে আমার প্রসূতির অলিন্দে, আমার উড়ন্ত স্যানিটোরিয়ামে আছেন শঙ্করনাথ চক্রবর্ত্তী। পাশের শহরেই আচার্যের ভদ্রাসন পেতে বসে আছেন দেবদাস আচার্য, তিনি এখনও নিড়ানি চালান শস্যে। ছোটবেলায় অবাধ্যের পুঁথি হাতে হেঁটে যেতে দেখেছি লুঙ্গি পরা ফল্গু বসুকে। জহর সেনমজুমদারকে ভেবেছি, তাঁর গৃহসন্নিকটে এতো অন্ধকার কেন, কেন তিনি জগজ্জননীকে বারবার ডাকছেন, তাঁর হৃল্লেখবীজে কীসের ব্যাকুলতা এতো! কীসের এষণায় তাঁবু ও মই নিয়ে সুধীর দত্ত বসে আছেন ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়ায়, আমি দেখেছি তাঁকে স্বয়ং বাক্ দেবীকে খেয়ে নিতে মুণ্ডুসমেত। কিন্তু এতসব আমি কেন দেখেছি! সেকি শুধু কবিতা লিখবো বলে, নাকি তার অন্য কারণ আছে! আছে অন্য কোনো গুসবাম্পস্!


মন্তব্যসমূহ

  1. হ্যাঁ, উন্মুক্ত গদ্যের মধ্যে আবহমান বাংলাকবিতায় সাধ্যাতীত বিচরণ দীর্ঘকাল অপেক্ষা রাখে ; প্রকৃত একজন কবির পক্ষে দুঃসাহস মনে হয় ; সৌরভের তন্নিষ্ঠ এই গদ্যভাবনাটি মুক্তমানুষের, তথা একজন বিশুদ্ধ কবির পাঠ-পরিক্রমণ ---- আমার ভালো লাগায়, লেখককে ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. ভাল লাগল লেখাটি। খুব সুন্দর।
    পৃথা চট্টোপাধ্যায়

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য