সুজিতকুমার বিশ্বাস

                                                                           

জনইতিহাসবিদ মোহিত রায়ঃ এক গভীর শূন্যতা 


আজ আগস্ট মাস। এ মাসের ২ তারিখে কবির মৃত্যুদিন। এ মাসেই আমাদের নদিয়া জেলার অন্যতম গবেষক ও জনইতিহাসবিদ কৃষ্ণনাগরিক মোহিত রায়ের মৃত্যুদিন। ২০০৫ সালে ২ আগস্ট তারিখে রাত ৯:৪০ মিনিটে উল্টোডাঙার নর্থসিটি হাসপাতালে প্রয়াত হন নদিয়াবাসীর এই আপনজন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। আমাদের নদিয়ার এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের ব্যস্ততায় আমরা তাঁর মৃত্যুদিন অনেকেই মনে রাখিনি। যে মানুষটি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিলেন নদিয়াকে  ভালোবেসে এবং নদিয়ার ওপর গ্রন্থ রচনা করে তাকে এই প্রজন্ম কতটা মনে রেখেছে? হ্যাঁ। কিছু গবেষক তাঁকে স্মরণ করছে নিয়মিত। নদিয়ার সকল গ্রন্থাগারে তিনি আদৃত। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার গত জুলাই মাসের ২৪ তারিখ তাঁর জন্মদিন ছিল।১৯৩৫ সালে বর্তমান বংলাদেশের পাবনা জেলার বনওয়ারীনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। 

জনইতিহাস বলতে আমরা বুঝি অনাদিকালের মানব সভ্যতার এক চলমান জীবনধারাকে। মানবজাতির প্রাচীনত্ব বা ঐতিহ্যের অতীত কখনও গোপনচারী নয়, বরঞ্চ তা চিরমুখর। জনইতিহাস অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমানের  অধ্যয়ন ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত এই তিনটি সূত্রে আবদ্ধ। শ্রদ্ধেয় মোহিত রায় সেই কাজে সহজাত ছিলেন। অনেকবার তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০০০ সালের পর নাগাদ। আমাকে লেখা তাঁর অনেক চিঠি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ হিসাবে রয়েছে। আমার লিখিত আঞ্চলিক ইতিহাস ‘বাদকুল্লা  পরিচয়’(২০০২)এবং ‘পায়রাডাঙ্গা নানাপ্রসঙ্গ’(২০০৪) বইয়ের ভূমিকা দুটিও ছিল তাঁর লেখা। দ্বিতীয় বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশও করেছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর ঠিক কয়েকমাস আগে পায়রাডাঙ্গা বইমেলায়। 

তাঁর পিতা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র রায় ও মাতা প্রিয়বালা দেবী। অবিভক্ত নদিয়ার কুমারখালির নিকটবর্তী গড়াই নদীর তীরে যদুবয়রা গ্রামে তাদের আদিবাস ছিল। আর এখানেই তিনি বসবাস শুরু করেন। উল্লেখ  থাকে  যে মোহিত রায় মাত্র বছর বয়স থেকে কৃষ্ণনগরে সপরিবারে বসবাস শুরু করেন। তিনি ১৯৫১ সালে কৃষ্ণনগরের দেবনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তারপর আই করবার জন্য  কৃষ্ণনগরের সরকারি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পাসও করেন।  কিন্তু মাতৃবিয়োগের পর তাঁর জীবনে নেমে আসে নানা সমস্যা। অবশেষে তিনি  যোগ দেন  নদিয়া জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের উচ্চবর্গীয় করণিক পদে। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির সভ্য হন। এখানেই অজস্র বাংলা ইংরেজি পুস্তক সম্ভার পাঠ করে তিনি নিজেকে তৈরি করেন। পরবর্তীতে  এই লাইব্রেরির পরিচালন সমিতির সদস্য হন।একবার সহ সম্পাদক তিনবার সম্পাদক পদ গ্রহণ করেন। মোহিত রায়ের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে এই লাইব্রেরির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা অর্জনের  পরিপূরক হয়েছে তাঁর এই গ্রন্থাগারের শিক্ষা লাভ। ১৯৯৪ সালে নদিয়া কালেক্টারির নিষ্কর ভূমি দান সম্পর্কিত নথিপত্রের নথি সংগ্রহ থেকে এক হাজার নথির নমুনার একটি তালিকা প্রস্তুতকরণের পরিকল্পনা অনেকের সাথে গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এ থেকে তাঁর সমধিক খ্যাতি আসে।  

মোহিত রায়ের গবেষণাকর্মে অদম্য প্রত্নতাত্ত্বিক প্রীতি ছিল। নবদ্বীপ থানার অন্তর্গত বল্লাল ঢিবিতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের পিছনেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁর দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফলস্বরূপ বল্লাল ঢিবি উৎখননে আবিষ্কৃত হয়েছে ইতিহাসের নানা উপাদান। চাকদহ থানার পালপাড়া মন্দির নদিয়া জেলার প্রাচীনতম টেরাকোটা মন্দির। অবহেলিত এই মন্দিরটির সংস্কার সাধন রক্ষণাবেক্ষণের  উদ্দেশ্য নিয়ে একটি কমিটি ১৯৮৭ সালে গঠিত হয়। মোহিত রায়ের সম্পাদনায় বিশ্লেষণে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক সংস্কৃত পুথি। অনুবাদ সাহিত্য রচনাতেও তাঁর দক্ষতার প্রমাণ রয়েছে। মোহিত রায় তাঁর ক্ষেত্রগবেষণার কাজে বাংলার   প্রতিষ্ঠিত ক্ষেত্রগবেষক সমাজবিজ্ঞানী পন্ডিত ব্যক্তিত্বদের থেকে আন্তরিক সহযোগিতা ও উৎসাহ পেয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কিছু বিশিষ্ট জনের নাম উল্লেখ করা যায়। বাংলার প্রতিষ্ঠিত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের নাম সবার আগে উল্লেখ করা প্রয়োজন।এছাড়া খ্যাতিমান গবেষক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়  তারাপদ সাঁতরা সুধি প্রধান নদিয়া জেলার বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় সমীরেন্দ্রনাথ সিংহ রায় এবং পন্ডিত ব্যক্তিত্ব সুকুমার সেন প্রমথনাথ বিশী অসীম বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের কাছ থেকে তিনি পরামর্শ ও প্রেরণা পেয়েছেন। তাঁর অগ্রজ ফণী  রায়ের সম্পাদনায় স্বাধীনতা দেশভাগের আগে কৃষ্ণনগর থেকে প্রকাশিত হত  সাহিত্য  পত্রিকাঅভিযান’ এই পত্রিকাতে ১৯৪৬ সালে তাঁর প্রথম রচনা ধাঁধা মুদ্রিত  আকারে প্রকাশিত হয়। মোহিত রায় কৃষ্ণনগর থেকে প্রকাশিত অন্যান্য অনেকগুলি পত্রপত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি পত্রিকার  নাম উল্লেখ করার মতো। অভিযাত্রী(মাসিক),মিতালী(ত্রৈমাসিক), মিলিত কন্ঠ (বার্ষিক)সাপ্তাহিক বঙ্গরত্ন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

নদিয়া  জেলার  শহর গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলির উন্নতি সাধনে মোহিত রায় সর্বপ্রথম আন্দোলন সংগঠিত করেন  এবং গ্রন্থাগারগুলির নানাবিধ সমস্যা ঊর্ধ্বতন প্রশাসকের নজরে আনেন।  মোহিত রায় ১৯৭১ থেকে ৭২ সালে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা দৈনিক আজকাল পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে তিন বছর সংবাদদাতা হিসাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তাছাড়া বাংলা ইংরেজি নানান  পত্রিকায় এক সময়ে সংবাদ নিবন্ধ লিখতেন। 

নদিয়ার মোহিত রায় বলতে আমরা গুরুগম্ভীর পাণ্ডিত্যপূর্ণ এক গবেষককে বুঝি। কিন্তু আসলে তা ঠিক নয়। শিশু সাহিত্যেরও তিনি একজন অসাধারণ লেখক ছিলেন। শিশুকিশোর মনের উপযোগী অসংখ্য বই তিনি রচনা করেছেন। নবসাক্ষরদের জন্য বই লিখে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন। কিশোর বয়স থেকে তিনি ছড়া কবিতা ধাঁধা লেখা শুরু করেন। শিশুসাহিত্য নিয়ে মোহিত রায় এর প্রথম লিখিত যে বইটি প্রকাশিত হয় সেটি হল ‘জয়যাত্রী’(১৯৫৪)।মোট ১০১ টি বই তিনি রচনা করেন। 

মোহিত রায়ের সম্পাদিত বইগুলি হল-নদিয়া জেলার পুরাকীর্তি’(১৯৭৫), দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় রচিত ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’(১৯৮৬)কুমুদনাথ মল্লিক রচিতনদিয়া কাহিনী’ (১৯৮৬),দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়েরআত্মজীবন চরিত’(১৯৯০),কুমুদনাথ মল্লিক রচিতসতীদাহ’ (১৯৯১)এবং কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ‘মৃত্যু ক্ষুধা’(২০০০) 

নদিয়া জেলাকে নিয়ে প্রধানত তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন।নদিয়া বিষয়ক মোহিত রায়ের গ্রন্থগুলি হল- বারোদোল মেলা(১৯৭৯), নদিয়া স্থাননাম(১৯৮৫),রূপে রূপে দুর্গা(১৯৮৫),নদিয়া উনিশ শতক(১৯৮৮) নদিয়ার সমাজচিত্র(১৯৯০), সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে নদিয়ার লোকসংস্কৃতি(১৯৯৩), নদিয়ার সেকালের বিদ্যাসমাজের কথা কাহিনি(১৯৯৩), নদিয়ার পুতুল নাচ(১৯৯৫), মদনমোহন তর্কালঙ্কার- জীবন ও সাহিত্য (১৯৯৬),আজীবন জ্ঞানতাপস শ্যামাচরণ সরকার (১৯৯৬),আদর্শ  শিক্ষক ব্রজনাথ(১৯৯৭), শিবনিবাস (১৯৯৭),নির্ভীক সাংবাদিক  হরিনাথ মজুমদার(১৯৯৯), বোলান (২০০০),মিলনের সেতু(২০০২), অষ্টক (২০০৩)।এই অসামান্য কৃতিত্ব তিনি একদিনে অর্জন করেননি, এর জন্য সমগ্র জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে নদিয়ার পথেঘাটে। তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তথ্যমূলক বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি যে কত প্রবন্ধ কোথায় লিখেছেন তার প্রকৃত হিসাব নেই। আজও তাঁর অনেক প্রবন্ধ অগ্রন্থিত অবস্থায় আছে। 

 মোহিত রায়ের এক অসামান্য কীর্তি তার পুরাতত্ত্বিক সংগ্রহশালা। জলঙ্গী নদীর তীরে নগেন্দ্রনগরের এক মনোরম পরিবেশে তাঁর বাড়িখেয়া’। সেই বাড়ির একতলায় তিনি বহু যত্নে গড়ে তোলেন এই সংগ্রহশালা। তিনি জীবিত থাকতে কয়েকবার সেখানে যাবার সুযোগ হয়েছিল। বর্তমানে তাঁর পুত্র মনামি রায়ের সৌজন্যে দেখে এসেছি। কী নেই এখানে? ইতিহাসের বিচিত্র  উপাদান উপকরণে সুসজ্জিত এই সংগ্রহশালা। যা প্রথম দর্শনেই এখানে সুসজ্জিত অতীত ইতিহাস দেখে মুগ্ধ হয়ে ওঠে সবাই। এ সব মোহিত রায় সযত্নে সাজিয়ে রেখেছেন। গোটা নদিয়া যেন তাঁর বাড়িতে উপস্থিত।সংগৃহীত অজস্র পুরা বস্তুর সম্ভারে ১৯৬৫ সালে তাঁর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত সংগ্রহশালাটি ধীরে ধীরে অধিকতর সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে। ইতিহাস পূর্ব যুগের মানুষের ব্যবহৃত পাথরের  অস্ত্রশস্ত্র, ভাঙামাটির পাত্রাংশ, মৌর্য যুগের রকমারি মাটির পাত্রাংশ, বাংলার পাল সেন যুগের নানা রকমের ধাতব প্রস্তর মূর্তি, পাঠান যুগের শিলালিপি,এখানে আছে বিভিন্ন সময়ের সিলমোহর ভাস্কর্য। শ্রী চৈতন্য পরবর্তী বাংলা চালরীতির পোড়ামাটির ভাস্কর্যমন্ডিত ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের নানা অনুপম মৃৎ ভাস্কর্য আর  জ্যামিতিক ফুলকারি নকশা। পৌরাণিক কৃষ্ণলীলা এবং পশুপাখির চিত্র ভাস্কর্য,  নানা দেশের অলঙ্কারিত ধাতব মুদ্রাসহ প্রাচীনকালের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা। এই সংগ্রহশালায় আছে গাছের ছালের তালপাতার কাগজের একাধিক পুঁথি।

তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকার বা সরকারপোষিত কোনো উল্লেখযোগ্য শিক্ষা  সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংবর্ধিত ছিলেন না। এসবের জন্য তাঁর কোনো ক্ষোভ  বা দুঃখ  ছিল না। তিনি বলতেন- গ্রাম গামান্তরে ঘোরাঘুরির সময় মানুষের  কাছ থেকে  নিঃস্বার্থ  ভালোবাসা স্বীকৃতি আর মর্যাদা তিনি পেয়েছেন। এটাই  তো তাঁর সেরা সম্মান। আমরা যখন গ্রামগঞ্জে ক্ষেত্রসমীক্ষা করি তখন সবাই মোহিত রায়ের কথা বলে থাকেন।তা থেকে সহজে প্রমাণ করা যায় শ্রদ্ধেয় মোহিত রায়ের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কতটা!  

অহমিকা বর্জিত অহমবোধ শুন্য প্রিয়ভাষী এই মানুষটির কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ কখনো বিমুখ হননি। দীর্ঘদিনের ব্যবধানে কোনো মানুষকে তিনি বিস্মৃত হতেন না। স্বার্থের প্রয়োজনে যারা সম্পর্ক গড়ে ও ভাঙে , মোহিত রায় তাদের ঊর্দ্ধে ছিলেন। বহু ইতিহাসবিদ তাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নদিয়া সম্পর্কিত যে কোনো গবেষণা সমীক্ষা আলোচনা তথ্য সংগ্রহের জন্য মোহিত রায় অপরিহার্য ছিলেন। মানুষের আহ্বানে তিনি সর্বত্র যেতে রাজি থাকতেন। আজকের দিনে এমন মহানুভব মানুষের  খুব অভাব বোধ করি। নদিয়া জেলার সাথে মোহিত রায় ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাঁর মৃত্যুমাসে তাঁর প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা। আগামীদিনগুলি তাঁর প্রেরণা সাথী করে চলার অঙ্গীকার  করছি। মহানুভবের প্রতি আমার প্রণাম। 

তথ্যসূত্রঃ মনামি রায় (মোহিত রায়ের পুত্র), মরমী রায় (মোহিত রায়ের পুত্র), ও গুরুপদ মণ্ডল (মোহিত রায় গবেষক) 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য