সৌমী আচার্য্য
নীলছবি
(১)
( বিরক্তি, প্রতিভা আর দূরত্ব)
শ্রাবণ ঝাঁপিয়ে পড়েছে তথাগতর পাঁচতলার ব্যালকনি জুড়ে। সযত্নে বেতের পাত্রে রাখা টব, তার ভেতর আরামে বসবাস করা গাছেরাও দুহাত বাড়িয়ে ভিজে চলেছে অনবরত। রিখিয়া নেই এই স্বস্তিটা আরও প্লাবিত করছে এই ফ্ল্যাটের প্রায় সকলকেই। জ্যাক ড্যানিয়লস্ আর চিকেন নাগেট। এখন চুপ করে বসে থাকাই শ্রেয়। হাত পা ঝিম ধরে আছে। মাথার ভিতর জোনাকি। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে হয় তথাগতর। উঠে পড়ে। নিকন এ এফ এস্ কাঁচের টেবিলে পড়ে রয়েছে। গলা তুলে হেঁকে গেল, বিষ্ণু দেয়ার ওয়াজ আ ব্রাউন ক্রো।
-জি সাব্ আপ যাইয়ে, ম্যায় বন্ধ কর দুঙ্গা।
বিরক্তিতে 'গাম্বাট' বলে দড়াম করে দরজা আটকে বেরিয়ে গেল। স্টিল রঙের টাটা নেক্সান স্পিড তুলল মোলায়েম ভাবে। খানিক যেতেই তথাগতর মনে পড়ল ভিজবে ভেবেছিল। কতদিন ভেজেনি সে। সব শুকনো, তেষ্টা বুক জুড়ে।
-তোমার এই নামী মডেল তাদের পেমেন্ট বড্ড বেশি তথাগত। তাছাড়া ক্যামেরার কারসাজি, সুন্দরী মডেল এসব নয়, শিল্পীকে দেখতে চাই আমরা। দেখো তোমার আমার সম্পর্কের দায় কাজের উপর পড়ুক এটা আমি চাইনা। প্লিজ!
রিখিয়া স্পষ্ট। বাড়ির ভিতরেও সম্পর্ক ক্রমশ শীতল। ওদের মেয়ে রাশিয়ায় ডাক্তারী পড়তে যাবার পর থেকে সবকিছু আরো ঠাণ্ডা। তথাগত নতুন ভাবে ভাববার চেষ্টা করলেও সবই রিজেক্ট করছিল রিখিয়া। তারপর ইন্টারভিউ দিল টিভিতে। নিজের ফটোগ্রাফি পত্রিকার দশজন সেরা ফটোগ্রাফারের মধ্যে তথাগতর নাম না বলায় রিপোর্টার যখন কারণ জিজ্ঞাসা করল, মিষ্টি হেসে রিখিয়া বলল, তথাগত সেন আত্মধ্বংসে বিশ্বাসী, আমি সৃষ্টিশীলতায় তাই এই নামটি থেকে দূরত্ব রাখতে চাই। তথাগত কৈফিয়ৎ চায়নি, রিখিয়াও কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। ইতি পড়েছে সম্পর্কে।
(২)
(গল্পটা এখানেই শেষ নাকি?)
তথাগত মেয়েটাকে দেখতে পেয়েই ভাবল এই জন্য বাইরে আসাটা জরুরি। মেয়েটার টানটান চকচকে কালো মুখ, যেন ঘাম তেলে ভিজে রয়েছে। চোখের ভেতরটা একটু বেশি সাদা, কালো মণি। নিটোল শরীর। ঝপ করে গাড়ি থেকে নেমে ওর দিকে হেঁটে গেল। প্রথমে হিন্দিতেই বলল কিন্তু মনে হলনা মেয়েটা কিছু বুঝল। টাকা দেখিয়ে আরো নানা আকার ইঙ্গিত করতে মুখটা ম্লান হলেও মনে হল রাজি। ওকে ঠিকানাটা দিয়ে হাসিমুখে গাড়িতে উঠল তথাগত।
আকাশে মেঘ। মুন্নার ভিজে যাচ্ছে অগাস্টের বৃষ্টিতে। ইদুকি জেলার মাত্তুপেটি ড্যামের একটু দূরে ছোট্ট বাড়ি ভাড়া নিয়েছে তথাগত। সামনে নির্জন কুন্ডালা নদী। মেয়েটা যদি ঠিকঠাক বুঝে যায় কী পেলে সে তৃপ্ত হবে তাহলেই ভালো। মেয়েটা এল বৃষ্টি নিয়ে। ঘাড়ের কাছে কমলা ফুলের ছড়। পুরো সময়টাই নিজেকে উজাড় করেছে। জড়তা ছিল তবে তথাগত সেনের কাছে তাবড় রমণীরা নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্ফুটিত করতে বাধ্য হয় সেখানে এ তো নিতান্ত চুনোপুঁটি। শাড়ি ঠিক করে কাঁপা হাতে যখন টাকা নিল একটু খারাপ লাগছিল তার। তবে নিজের তৃপ্তিটুকু সে মোটেই ভাঙতে চায়না। সোনালি তরলে আচ্ছন্ন হতে হতেও মেয়েটির কোমড়, সুউচ্চ বুক, ক্লিভেজের ঠিক আগে থমকে যাওয়া মালা থেকে ছিন্ন ছোট্ট ফুল সবটা বারবার দেখতে লাগল। তখনি কল্পনায় ভেসে উঠল একটি দৃশ্যপট। মেয়েটা যদি রাজি হয়! উফ্! উত্তেজনায় ছটফট করে তথাগত। এদিকটা পুরোপুরি নির্জন। রাতে চাঁদের আলোয়। নাহ্ ভাবতে পারছেনা তথাগত।
মেয়েটা বড্ড দেরি করছে। তবে কী ভয় পেল? নাহ্ এমন কিছু বাড়াবাড়ি তো করেনি। অবশেষে এল। আজ একটু প্রসাধন আছে পায়ে গলায় নাকে রূপো। তথাগত একতাড়া নোট রাখে সামনে। দশহাজার। বুঝিয়ে বলতেই। মেয়েটা ভীষণ চমকে ওঠে। টপটপ করে চোখ থেকে জল পড়ে।
চাঁদের আলোয় ধুয়ে যেতে থাকে কুণ্ডালা নদী, পাশে ইউক্যালিপটাসের বন থেকে সিট্রানিনের গন্ধ মাতাল করে চরাচর। নদী থেকে উঠে আসে নিরাভরণ মায়াবী নারী। মুখ তার অস্পষ্ট। ধীরে কাপড় তুলে দাঁতে চেপে ধরে। মুহূর্তে চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে তথাগত কাজ সেরে ফেলতে থাকে দক্ষতায়। আশ্চর্য সুখ অনুভব করে।
-বাবু আমার কাজ শেষ?
খটোমটো হিন্দিতে মালায়লম টান তবু বড়ো মিঠে লাগে তথাগতর।
-হ্যাঁ, তুমি যাও। যদি আবার ইচ্ছে হয় ডাকব।
দ্বিধা নিয়ে মেয়েটা চলে যায়। তথাগত মগ্ন হয়। এবার দেখিয়ে দেবে রিখিয়াকে তথাগত সেন মরে যায়নি। একটা উঠতি ফটোগ্রাফারের সস্তা কাজের সাথে তার তুলনা করার আর সাহস করবে না। ছবিগুলোর সাবটাইটেলে নিপূণ ভাবে গল্পটা সাজাতে থাকে। এত কম টাকায় এমন মডেল আর প্রেক্ষাপট সে কোলকাতায় কখনোই পেতনা। কম্পিউটার স্ক্রিন জুড়ে চাঁদের আলোয় আদুর মোহময় শরীর। তথাগত অন্ধকারেও যেন মুখ জুড়ে খুঁজে পায় বিষাদ। ইমেলটার সেন্ড বটনে হাত রেখে কেঁপে ওঠে। বাইরে অঝোরে শ্রাবণ, তখন। মাঝের কয়েকটা দিন আদৌ সত্যি নাকি সবটাই কল্পনা? ভাবতে বসে তথাগত। মেয়েটার নাম সে নিখুঁত ভাবে বুকে তুলে নিয়েছে।
(৩)
(পনেরো দিন আগের এক দিন)
অনেকক্ষণ ধরে বেজে চলেছে ফোনটা। তথাগতর ইচ্ছে করছে না ফোনটা ধরতে। বাজুক আরো কিছুক্ষণ। ধারা একমনে পালাপাম রান্না করছে। ওদের সারনেম বেশ খটমটো সে কেবল মনে রেখেছে- ধারা মুপান। ওই যথেষ্ট। ধারা ধারা বিশুদ্ধ ধারা। ভাড়া বাড়িটার চারিদিক নারকেল গাছ আর একটা জলাশয়। চমৎকার! সবচে বড় কথা রিখিয়ার মতো প্রতি পদে ভুল দেখানোর কেউ নেই। তথাগতর নাকি ছবি দেখার চোখই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ফুঃ মাই ফুট। অস্ফুটে বলে উঠল তথাগত। আসলে নতুন ফটোগ্রাফার ছেলেটার সাথে মাখোমাখো সম্পর্কটাতে একটু বেশি ইনভেস্ট করতে হচ্ছিল। হবে নাই বা কেন? হাঁটুর বয়েসী ছেলে। ছ্যা ছ্যা।
হঠাৎ তড়াক করে উঠে বসে তথাগত। আচ্ছা রিখিয়াকে নিয়ে ভাবনাগুলো বড্ড সাবস্ট্যাণ্ডার্ড হয়ে যাচ্ছে নাকি? যার জীবন সে যদি সিদ্ধান্ত নেয় তাতে কার কী বলার আছে? আর এইসব ভাবছেই বা কেন? ধুস্ আবার ফোন! বিরক্ত হয়ে ওঠে তথাগত। আননোন নম্বর। সুইচ অফ করে শান্তি পেল।
ধারা চা দিয়েছে। আধভাঙা হিন্দিতে কথা বলে। একটা ফুল ফুল গন্ধ ওর গায়ের থেকে ভেসে আসে। কী ফুল কে জানে। লম্বা একহারা কালো মেয়েটার টানটান চেহারায় দুটো জিনিষ দেখবার মতো বুক আর চোখ। যেন স্বর্গের ফল। যেন শান্ত দীঘি।
-আপনার খাবার রোজের মতোই টেবিলে ঢাকা দেওয়া থাকবে। আর রাতেরটা ফ্রিজে। গরম করে নেবেন। যদি বিকেলে বেড়াতে বেরোন তো ছাতা নেবেন। বৃষ্টি হতে পারে।
-তুমি কী করে জানলে বৃষ্টি হবে?
-আকাশের ছায়া দেখে বুঝতে পারি।
ধারা চলে যাবার পর তথাগত বারান্দার বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। আহ্! কতদিন কতদিন এমন আরাম সে পায়নি। কিসের পিছনে যেন ছুটতে ছুটতে নিজেকেই পিছনে ছেড়ে এসেছিল? আচ্ছা কী হবে সাফল্য পেয়ে যদি নিজে এক মুহূর্তের জন্যেও ভালো থাকা না যায়। বাইরে সুন্দর ঝকঝকে দিন। ধারাটা বোকা, বলে কিনা বৃষ্টি হবে। কফি খেতে খেতে ল্যাপটপ অন করল, কয়েকটা মেল সেণ্ড করতে হবে। একটা মেল এসে বসে রয়েছে। কার মেল? লুকা! লুকা ব্রুনো! এও কি সম্ভব? বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে।
(৪)
(শিল্পীর অপমৃত্যু)
বুনো গন্ধে ভরে আছে বাড়িটা। মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। তথাগত সারারাত স্বপ্ন দেখে।
ইমারতগুলো ভেঙে গুড়িয়ে গিয়েছে। শহরের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা বুকভর্তি গাছ নিয়ে ছোট্ট কাঠের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ঘুমের ভিতর অনেকটা মদ খায় তথাগত। ছুটতে ছুটতে এগিয়ে যায় বাড়িটার কাছে, কার বাড়ি এটা, একি বাড়িটা থেকে কে বেরিয়ে আসছে? ইস্ কী কুৎসিত! রিখিয়া তুমি গায়ে জামা দাও, আহ্ তোমার পেট দিয়ে কিলবিল করে কৃমি উঠে আসছে তোমার ঝুঁকে যাওয়া বুকের চারিদিকে সাদা সাদা আলপনার মতো কৃমি ঘুরছে, আহ্ আহ্! হা হা করে কে হাসছে?
-আমি হাসছি তথাগত। রিখিয়া। এত প্রিয় এত চেনা সেই শরীরটাতে এত ঘেন্না? একবার নিজেকে দেখবে নাকি? এসো এসো।
ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া শহর থেকে একটা বড় আয়না নিয়ে মুখের সামনে ধরতেই ন্যূড এক বিশ্রী ন্যূড ভেসে উঠল। ঝুলে পড়া ঈষৎ ভূড়ি, বন জঙ্গলে ভরা সাদা ছোপ ছোপ বুক, চর্বির মালভূমির মতো নিতম্ব, আর ব্যর্থ প্রেমিকের মতো শ্রীহীন শিশ্ন। ইস্ ঘেন্না, ঘেন্না।
-এতটাই কুশ্রী হয়ে পড়েছে তোমার ফটোগ্রাফ তথাগত। যে তরুণ ক্রিয়েটিভ মানুষটিকে আমি চিনতাম সে নেই তোমার ভিতর। তুমি অশ্লীল ছবিই কেবল এখন তুলতে পারো। দেখো ওই তোমার শেষ ছবি ভেসে যাচ্ছে।
তথাগত ভুরু কুঁচকে তাকায়। প্রবল জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে একটা ফ্রেম। পাগলের মতো ছুটছে তথাগত, হাঁফাচ্ছে, ছবিটা আরেকটু চেষ্টা করলেই ধরতে পারবে, একি! এতো তার মেয়ে ঐশিকার ছবি। শালীনতা হীন এক কুশ্রী ফটোগ্রাফ। আহ্!
ঘুম ভেঙে উঠে বসল তথাগত। কুকুরের মতো হাঁফাচ্ছে। এতটা অপদার্থ হয়েছে সে। স্বপ্ন মানে অবচেতন! সেকি নিজেই নিশ্চিত নিজের অপদার্থতা সম্পর্কে। অজানা আশঙ্কায় ছটফট করে। অথচ ধারার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করছে। কি দিয়ে বশ করা যেতে পারে? টাকা? শরীর? নাকি অন্য কিছু!
(৫)
(প্রস্তাব ও নীলছবির জন্ম)
ধারার চোখে গভীর ভাবে তাকায় তথাগত। বিস্ময়ে বড় বড় চোখ তার। তথাগত সংযত হয়। কফি কাপে চুমুক দিয়ে বলে, ধারা তেমন মেয়েই এনো, যার প্রয়োজন আছে টাকার। আমি বেশি কথা খরচ করতে পারব না। ধারা চুপচাপ চলে যেতে নেয়। পিছন ফিরে এসে বলে, বাবু আমাকে পছন্দ নয় আপনার!
-কী বলছো এসব?
-আমি জানি আমি দেখতে তেমন ভালো নই কিন্তু টাকাটা অনেক বাবু। আমার সংসারটা বেঁচে যাবে। সারা বছর এর ওর কাছে কাজ চেয়ে নোংরা ইঙ্গিত সহ্য করে শেয়াল কুকুরের মতো বাঁচতে হয়। ভাইটা পড়া ছেড়েছে, কলার আড়তে কাজ করে। মায়ের কাজ করার ক্ষমতা গেলেও গাল দেবার ক্ষমতা কমেনি। তাছাড়া ঘর ভাঙা, কল নেই।
বিরক্ত হয়ে ওঠে তথাগত। এই হল এদের এক দোষ। বিশ্বের সব সমস্যা এদের থাকে। একটু জোরেই বলে ওঠে, ঠিক আছে ঠিক আছে বুঝেছি। পরশু রাতেই ঠিক হল। তোমার ভাইকে সাথে আনবে। ও থাকবে। ধারা ম্লান হেসে বলে, পরশু সুন্দর চাঁদ উঠবে বাবু। আপনার সব আশা পূর্ণ হবে। ওর কথায় একটা এমন বিশ্বাস ছিল তথাগত বিশ্বাস না করে পারেনা। যদিও আকাশ জুড়ে ঘনকালো মেঘ, কুণ্ডালানদী জলের সুখে থৈথৈ।
সকাল থেকে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে চরাচর ভাসছে তথাগতর পরিকল্পনাও। এমন চললে সব পণ্ড। প্রকৃতির আলোর ভিতর যা হতে পারত তা কৃত্রিম আলোতে সম্ভব নয়। ইভিওটা যত্ন করে দেখতে থাকে আর হতাশ হয়। নাইট ভিশন ড্রোনটা ছবিগুলোতে প্রাণ দিত কিন্তু এখন! যদিও ধারা এল। সে পরিপাটি চুলে কমলা ফুলের গজরা পরেছে। শাড়িখানা বারবার টেনে টেনে ঠিক করছে। বৃষ্টি ধরে এল সন্ধ্যার আগেই। অলৌকিক আলোয় ভরে উঠল বাড়িটার পিছনের জঙ্গল, আর কুণ্ডালানদী। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এল ধারার। তথাগতর কথা কিছুই বুঝল না, এই জঙ্গলের মধ্যে গাছের আড়ালে গিয়ে সব খুলে জলে নামতে বলল কেন তাকে? ওর ভাইকেই বা রেখেছে কেন? ভাই ওর হাতে দিল একগোছা শালুক আর তথাগত ছবি তুলল পরপর। তৃপ্ত নয় ক্যামেরা। এদিকে সময় এগিয়েছে অনেক। চাঁদ বদলে ফেলেছে রঙ। আকাশের নীল এখন বেশি, ঘোলা সর পড়া চাঁদ। ধারা হঠাৎ জলে ডুব দিল বেশ কয়েকটা, উঠে এল ফুল হাতে। নাল গোপন জন্মবৃত্তান্ত আড়াল করে বাম বুকের কাছে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ডান বুকের উপর চাঁদ। ধারাকে ঈশ্বরী মনে হচ্ছে। তথাগতর মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আর কিছু না বাবু! এতেই এত টাকা দেবে? বুঝেছি আমি ছোটজাত তোমার ঘেন্না হচ্ছে?
-ধারা, তুমি অনেকক্ষণ জলে ভিজেছো বাড়ি যাও।
সারা ঘর জুড়ে নাইটল্যাম্পের নীল আলো অথচ তথাগতর মনে হল সবটুকু যেন ওই মানবীর বুকের রঙ। লুকা ব্রুনো এই ছবিই কি চাইছেন? ওর মেল তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে। আবছা ছবিতে ফোকাস কেবল শালুকে, পুরো শরীর বোঝা যায় যদিও তবে ঘষা কাঁচ যেন জমাট হয়ে রয়েছে মুখে। ছবিটা মেল করতেই দশ মিনিটের ভিতর উত্তর।
-মাই ডিয়ার এতদিন তুমি কোথায় ছিলে। মার্ভেলাস। বিজ্ঞাপনে এই ছবি যাচ্ছে। আর ইতালি ভোগ এবার কভারপেজ করবে ইণ্ডিয়ান বিউটি। মডেলের মুখের ফোকাস আছে এমন ছবি দাও অবশ্য দুটো ফ্লাওয়ারই থাকা চাই, আশাকরি বুঝেছো? সেণ্ড করো দ্রুত। বাই দা ওয়ে আমার কল রিসিভ করো।
(৬)
(বহুগামীর আত্মদংশন!)
ধারা মুপান নাক টানতে টানতে কাজ করছে। সারাঘর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সিগারেটের টুকরো, ছাই যত্নে পরিস্কার করেছে।
-তোমার রাগ হচ্ছেনা এত নোংরা করেছি।
-আপনি বাবু আজীব। আপনাকে দেখলে মায়া হয়।
-কেন?
-কী খোঁজেন বাবু আপনি?
ধারা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওর ছবি তুলতে আবার ইচ্ছে হয়। গরম ভাতের টগবগ ধোঁয়ায়। মিক্সির নবে। হঠাৎ পিঠের ঘামে অথবা কফি দিতে আসা মুচকি হাসিতে। অস্হির লাগে নিজেকে। ধারাকে সে ডিমাণ্ড করছে নাকি? একমনে আশ্চর্য সে রাতের ছবি দেখতে থাকে। কফি দিতে এসে নিজের ছবি দেখে ধারা।
-আমার নীল ছবিখানা একটা দিও কিন্তু বাবু। লোককে বলব, তুমি শরীর নিয়েছ, সবার কাছে বেচবে কিন্তু ইজ্জত নাওনি, আমাকে নাওনি।
শরীর নিয়েছে সে! অথচ ধারাকে গ্রহণ করেনি। অলৌকিক সেই নীল ছবি তথাগতর তুরুপের তাস হয়ে ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ভরে দিয়েছে অলরেডি। তথাগত ধারার হাত ধরে।
-কী চাও তুমি ধারা?
ফিসফিস করে, জানিনা, ছাড়ো বাবু! তথাগত আরো জোরে হাতটা ধরে, আমি বিবাহিত জানো? ফ্যালফ্যাল করে তাকায় ধারা।
-জেনে কী হবে বাবু! আমি শুধু মুহূর্তে বাঁচি।
কফিরঙা ঠোঁটটায় নিজেকে ডুবিয়ে দেবার ইচ্ছে প্রবল হতেই সরে যায় তথাগত। মনে মনে বলে,ধারা তুমি জানোনা আমি বহুগামী! কখন কীভাবে নিজেকে দিয়ে, নিংড়ে নিয়েছি অন্যকে সে কেবল আমি জানি। সদ্যতোলা ছবিগুলোর ভেতর একটা রিখিয়াকে মেল করে নীচে লেখে, ধ্বংসের পাঁজরে।
(৭)
(ধারা ধারা বিশুদ্ধ ধারা)
আলগোছে বৃষ্টিনদী বাড়িটার গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে। কাজ সেরে বারান্দায় এসে ভিজছে ধারা। তথাগত হাতে ক্যামেরা নিতেই অস্ফুটে বলে, পোষাক পরে আছি বাবু, এখন আমার ছবি তুললে বিকোবে না। আমি যে অত সুন্দর নই। নিজের গজরা থেকে একটা একটা ফুল খুলে ভাসাতে থাকে বয়ে যাওয়া জলে। ওর কোমরের ভাঁজে, নিমগ্ন দুটি হাতে ভিড় করে এসেছে জোনাকি। গলে গলে পড়ছে আকাশের অভিমান।
-তুমি খুব সুন্দর ধারা।
-আপনার বউয়ের থেকেও!
তথাগত অনুভব করল ও যেন দেখতে পাচ্ছে শরীরের ভিতর বয়ে যাওয়া নদীর আবেগ। বেতের চেয়ার ছেড়ে ধারার পাশে বসল। স্রোতের টানে বয়ে চলেছে ফুল। ছাঁটের জল জমেছে মেয়েটার মুখে, চুলে, গলায় আরো কোথাও অন্য কোথাও। তথাগত বোঝে রান্না করা বাসনমাজার মেয়ে ধারা মুপানকে সে গ্রহণ করতে পারছে না অথচ চাইছে। সময় ভিজে যায় ধারার নিঃশব্দে উঠে যাওয়ায়।
রিখিয়া ঠিক কবে কী ভাবে তথাগতর প্রতিভা শেষ হয়ে যেতে দেখল ভাবতে চায় সে, পারেনা যদিও। একদিন কাজের প্রেশার বাড়াতে উপার্জন বাড়তে খুশিই তো হয়েছিল রিখিয়া। নিজের পত্রিকা করে তথাগতকে দেশে বিদেশে ফেমাস করবে এইতো স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু ক্রমশ নিত্য নতুন ফটোগ্রাফারের ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছে তথাগত। কম্পিটিশানের ঝাঁঝে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে বারবার। এককোণে জড়ো হয়ে রয়ে গিয়েছে তথাগত আর ওর ফটোগ্রাফ।
এমন প্রাণের ভিতর হাওয়া বয়ে যায়নি কতদিন। ধারার প্রথমদিনের চোখ আজও ভোলেনা সে। যখন বলল ছবি তুলবে বিনিময়ে টাকা দেবে। হতবাক হয়েছিল মেয়ে। তারপর নিজে থেকেই রান্না করা, ঘর পরিস্কার, বাসনমাজা সব দায়িত্ব নিয়ে নিল। এর জন্যে আলাদা টাকা দিতে চাইলে বলেছিল, তোমাদের অনেক টাকা না বাবু! অথচ আমরা কিছুতেই অনেক টাকা ধরতে পারিনা, বুঝতেও পারিনা। হ্যাঁ দিও টাকা। ভাইটাকে যদি কিছু জমিয়ে দিতে পারি। ওর জীবনবোধ প্রতিদিন আশ্চর্য করেছে। অদ্ভুত ওর প্রকৃতি দেখার চোখ। ধারা ধারা বিশুদ্ধ ধারা। তেলের বিজ্ঞাপনটার গান বারবার ভেসে ওঠে।
রাতে ল্যাপটপে বসল যখন তখন বাড়িটায় কেবল সে। মনে মনে ভাবল এতক্ষণে ধারা নিশ্চই বাড়ি ফিরে রাতপোষাক পড়েছে। কী রঙ ওর শরীরে এখন। তথাগতর সারা ঘরে নীলচে আভা। ক্যামেরায় যে নারীকে দেখছে তার শরীর অজন্তার গুহাচিত্রের মতো। চাঁদ আলোয় স্বর্গের দেবী, ফুল চয়নে রত। ভেসে আসে কন্ঠস্বর,তুমি শরীর নিয়েছ, সবার কাছে বেচবে কিন্তু ইজ্জত নাওনি, আমাকে নাওনি। লুকা ব্রুনো, ইতালি ভোগ পত্রিকা চিফ্ এডিটার, ছবি চেয়ে ফোন করে, কিছুটা অধৈর্য্য মনে হয়। ল্যাপটপে ছবিটা জ্বলজ্বল করছে। লুকার কন্ঠস্বর বিব্রত করে। তথাগত ইমেলের সেণ্ড বটনটায় হাত রাখে।
সংপৃক্তিও একটা ডায়নামিক প্রসেস! ধারক বা দ্রাবকের বুকে মুক্ত পরিসর বাড়তে থাকলে সংপৃক্তির সাধনা চলতেই থাকে। আমি সেই নেশাগ্রস্ত মানুষদের একজন, ভাঙনের আওয়াজ শুনে যাঁরা আনন্দ পান। অনেকের মতো বিশ্বাস করে চলেছি, রক্ষণশীলতার কড়িবড়গা ভাঙতে ভাঙতে আর পরস্পরে সংপৃক্ত হতে হতে কবিতা ও গদ্যের মধ্যে একদিন ভেদরেখা মুছে যাবে অনেকটাই।
উত্তরমুছুনএ গল্পের ভাষায় কোথাও কোথাও ন্যারেটিভ হাতপা মেলেছে কবিতার ভাষায়। ইঙ্গিত,ইশারা, মেটাফোরে আঁকা গল্পের চলন পাঠকের কাছে কবিতাপাঠের মগ্নতা চেয়েছে কোথাও কোথাও ।
উপস্থাপনার নির্মিতি নির্মোকের ন্যারেটিভকে উপেক্ষা না করেও অন্তর্গূঢ় চেতনার খোঁজে পাঠককে মগ্ন করেছে। এ রীতি কথাশিল্পে যে নতুন তা নয়। কিন্তু যে ভঙ্গিতে তীব্র স্বাতন্ত্র্য-চিহ্নিত এক বিচ্ছিন্ন জীবনের অস্তিত্ব-সংকটকে তীক্ষ্ণ করে তোলা হয়েছে, সেটা গল্পবলার ধ্রুপদি ধারার সমান্তরাল এক চলন!
একেবারে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের সীমানাতেও বিচ্ছিন্নতার গহন পরিসর থাকে। সেটুকু আমাদের দহনেরও পরিসর! ব্যক্ত ও অব্যক্তের মাঝে দাঁড়িয়ে তীব্র অভিমান নিয়ে সম্পর্ক পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ সামলাতে হয়। কোন চ্যালেঞ্জ? মূল্যায়নের Extrinsic প্যারামিটারগুলোকে তবু উপেক্ষা করা যায়। কিন্তু আসল আততিতো সত্তার ভিতর অস্তিত্বের নিজস্ব সংকট! পুনর্গঠন, পুনর্বাসনকে প্রাসঙ্গিককে করে তুলে নিজেকে নিজের হাতেই সামলাতে হয় আমাদের। এ গল্পেও মূল চরিত্র সেই existential crisis টা সামলেছেন। শিল্পীসত্তার মূল সে-সঙ্কট তা নান্দনিকতাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে এ গল্পে। গল্পের নানন্দনিক উৎকর্ষতা ও উত্তরণও সেখানেই।
চমৎকার লাগল গল্পটা।
----Pallab Ganguly