পর্ণা চক্রবর্তী

  



 #এসেছে আষাঢ় 

 

নিদাঘ গ্রীষ্ম । চারপাশ যেন  দাউদাউ জ্বলছে। মাটি ফুটিফাটা। চবুতরার কাছে পিপল গাছেরতলায় বসে একটু জিরোচ্ছিল হরিরাম। বৃষ্টির নামগন্ধ নেই  অথচ বর্ষার তো সময় হয়ে এলো। পাপ্পু ওর পাশে এসে বসে বলল," কি কাকা এই ভরদুপুরে কি করছ"। পাপ্পুর ইলেক্ট্রিকের কাজ করে বেশ চালাক চতুর ছেলে।   হরিরাম বললো,

"এই গরমে  কি আর করবো ? হ্যাঁরে পাপ্পু, বর্ষাকাল আসতে কত দেরি বলতো?"  

"কি বলছো কাকা এক সপ্তাহ হলো বর্ষা তো এসে গেছে। টিভিতে বলছে শোনোনি ?" 

হরিরাম অবাক হয়ে বলে,

"সে কিরে বৃষ্টিই তো নেই।  নাচনীর চাষ না হলে খাব বা কি বেচবোই বা কি।"

"মন্ডিতে ঐ যে গণপতি মন্দির, সেখানে তো রোজ পুজো হচ্ছে। কাল বড় করে যজ্ঞও হবে।" 

হরিরাম মাথা নেড়ে বলে," ও, ওই জন্য শিন্ডে সেদিন পুজোর কথা কি সব বলছিল। তা কার যজ্ঞ হবে রে পাপ্পু?" 

"কার আবার ,পর্জন্যদেবের"।

"সে আবার কে"?

"আরে কাকা, বৃষ্টির দেবতা গো,জানো না?" 

 

হনহন হাঁটে হরিরাম। কাজের খোঁজে এসেছিল শিন্ডের কাছে। মণ্ডিতে শিন্ডের স্টীলের বাসনের দোকান। মনহারি জিনিষও বেচে তার সাথে। দূর শহর থেকে হোলসেলে মাল নিয়ে আসার জন্যে একটা বিশ্বস্ত লোকের দরকার। তাই হরিরাম শিন্ডের কাছে গিয়েছিল।

কিন্তু আজ ও দোকানে ছিল না।ওর বউ বললো আবার আসতে । চারপাশটা যেন গনগন করে জ্বলছে।  গাছের পাতা সব রোদে পুড়ে তামাটে হলুদ হয়ে গেছে। শুকনো পাতা নিয়ে গাছগুলো ধুঁকছে। পাহাড়গুলো ন্যাড়া হয়ে আছে।  

ফটফট  আওয়াজে পিছনে ঘুরে দেখে হরিরাম

সন্তোষ আসছে ওর মোটর সাইকেল নিয়ে।। 

"কাকা চলে এস, তোমার  ঘরের কাছেই যাচ্ছি।"  হরিরাম হাতে চাঁদ পেল যেন। টায়ারের চটিটা  ক্ষয়ে গিয়ে পায়ের পাতায় ফোস্কা পড়েছে বিচ্ছিরি ভাবে। 

সন্তোষের মোটর সাইকেলের পিছনে বসে হরিরাম। সামনেই খেরবাড়ি । এখানে দুটো রিসোর্ট আছে। গরমকালে  মোটামুটি ফাঁকাই থাকে। বর্ষা নামলে টুরিস্টরা ভীড় জমায়।  চারিদিকটাই  জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড় অঞ্চল। বর্ষাকালে অলৌকিক রূপ নেয় এই নির্জন বনপাহাড় । সবুজে সবুজ হয়ে থাকে বিশাল প্রান্তর। সফেদ,ফেনিল জল ছুটিয়ে ঝর্ণা নামে কত।  কোন আদিমকালের কালো পাথরের চাট্টানগুলোর ওপর দিয়ে সোঁ সোঁ জল বইবে তখন, ছোট,ছোট নদীরা ক্ষণিকের জন্য আবার জন্ম নেবে। সে সব  দেখতে কংক্রিটের জঙ্গল থেকে শহুরেরা আসবে, বুক ভরে অক্সিজেন নেবে।  রকমারি ফুলে ভরে থাকবে পথঘাট জঙ্গল। 


রিসর্টের গেটের মুখে দাঁড়িয়েছিল রতন বিশ্বাস ।  লোকটি আদতে  বাঙালি, আদি বাড়ি মাকরদা। তবে প্রায়  কুড়ি বছর কাজের সূত্রে ঘর ছাড়া।  সন্তোষকে দেখে রতনের যেন ধড়ে প্রাণ এল।

"এক ট্যাংক জল অন্তত  দিয়ে যা সন্তোষ।  না হলে খুব বিপদে পড়বো"। 

সন্তোষ  বলে, " জলের খুব আকাল ভাও। গরমিন্ট থেকে আগে গাঁওগুলোতে জল  দেবে তারপর  বাকিদের"।  হরিরাম ভাবে ,সত্যি বৃষ্টি না হলে এবার খাওয়ার জলটুকুও পাওয়া দায় হবে। রতন  মিনতি করে, "যা পারিস দিয়ে যা বাবা।  সামনেই সিজিন  শুরু হবে, এদিকে এখনো বৃষ্টি  নামল না। আষাঢ় মাস পড়ে গেছে তা প্রায় সাত দিন হল।  এই দ্যাখ দুটো ফ্যামিলি  বুকিং ক্যানসেল করে দিল। এভাবে চললে তো  ব্যবসা চালানোই মুশকিল।"  

সন্তোষ বলে ," কাল দেখছি । তবে গরমিন্ট কড়াকড়ি করলে তখন তোমাকে জল দিতে পারব না সে আগে থেকেই বলে রাখছি। খুব লাফরা হয়  এসব নিয়ে।"

এ অঞ্চলে জলের খুব কষ্ট। গরমে সে আরো তীব্র হয়। খরা অজন্মা লেগেই থাকে।বর্ষা এখানে দীর্ঘ সময় ধরে থাকে। তাই বর্ষার জলই ভরসা। 

সন্তোষ  নীচে বৈতরণ নদী থেকে জল এনে ট্যাংকারে  ভরে গরমে  নানান জায়গায় জল দেয়। এক ট্যাংক দুহাজার করে পড়ে। যাদের পয়সা আছে, মন্ডির দোকানদার ,সরকারি কর্মচারী এরা পারে।কিন্তু    গাঁওর লোকেরা বড্ড গরীব।ওরা কি করে পারবে। তাই গ্রামে বড়,বড় বাউড়িগুলোই ভরসা। কিন্তু সময়ে বৃষ্টি না হলে বাউড়িতেও আর জল থাকে না।  শেষে গিয়ে গভরমেন্টের জল আসে। ততক্ষনে মানুষ, পশু  সব ধুঁকছে জলের অভাবে।    

রতন  হরিরামকে বলে, "সামনের সপ্তাহে একবার এস হরিরাম । লোকজন সব আসতে থাকবে, তোমাকে দরকার হবে।" 

হরিরাম  মাথা নাড়ে। সন্তোষকে বলে, "ঘর চল , বড্ড খিদে লেগেছে।" 


 রাতের দিকে ঝোপড়ার বাইরে বসে থাকে হরিরাম।ভেতরে ভ্যাপসা গরম, তার ওপর  পাঁচ পাঁচটা লোক ,ঘুমতে পারেনা হরিরাম ঠিক করে।  বসে থাকে আর ঢুলতে ঢুলতে আকাশটা দেখে।  ঝকঝকে আকাশে লক্ষ তারার ভীড়, মেঘের নাম গন্ধ নেই। চিন্তায় হরিরামের ঘুম  আসেনা। এবারে ভেবেছিল নাচনী লাগাবে ওর জমিতে। নাচনীর ভাল বাজার এখন। শহরের লোকরা নাকি  গমের আটার সাথে  নাচনী মিশিয়ে আজকাল খুব খাচ্ছে  পুষ্টিকর বলে। কিন্তু এখনো বৃষ্টি এলোনা, কখন রুইবে, কখন সে ফসল ঘরে তুলবে। সময় পেরিয়ে গেলে ফলনও হবেনা।  মহাজনের কাছে  কিছু ধার ছিল।আইকে  ডাক্তার দেখানো আছে। তার ওপর  বাথরুমটাও  এবারও বানানো হলোনা।  হরিরামের মাথা দপদপ করে চিন্তায়। বাইরে খাটিয়াটা পেতে শোয়। রাতের দিকে হাওয়া ছাড়ে, শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া। হরি  ধড়মড়য়ে উঠে বসে। গায়ে যেন দুফোঁটা পড়লো না? কোথায় কি, নির্মেঘ আকাশ।  ঘরের দরজা খুলে  ওর বউ আর মেয়ে বেরিয়ে আসে। মেয়েটা দশ ক্লাসে পড়ছে, সেয়ানী হয়ে গেছে।

 "তোরা এই রাতে  কোথায় যাস?"  হরিরাম অবাক। ওর বউ  পুষ্পা বলে,  "রাত ? চারটে বাজতে গেল। এখন না গেলে বাউড়িতে আর জল পাবো না।" এই বলে ,বালতি, ঘড়া নিয়ে ওরা ছুট লাগায়।  দুজন না ফেরা অব্দি জেগে  বসে থাকে  হরিরাম। বাউড়িতে জল তলায় এসে ঠেকেছে। অত বড় বাউড়ি থেকেও বালতি দিয়ে আর জল উঠছে না বলে  লোকজন এখন বাউড়ির ভেতর নেমে জল তুলছে । পুষ্পাই নামে।  বাউড়ির ভেতরের গায়ে থাক থাক শ্যাওলা পড়া সিঁড়ি।পড়ে গেলে আর দেখতে  হবে না। ।আগে হরিই যেত জল তুলতে। কিন্তু শরীরটার জন্য এখন  আর পারে না।  হরিরামের অস্থির লাগে। ভগবানের কাছে  আকুল প্রার্থনা করে,"একটু  বৃষ্টি দাও বাপ্পা।" 


 সকাল সকল সুখলাল আসলো। হরিরাম তখন  বসে বসে ঝিমোচ্ছিলো।   

"কি খবর  সুখলাল ?" 

হরিরাম  আড়মোড়া  ভাঙ্গে।  

"আশ্রমের  শিলাদিদি আজ যেতে বলেছে। কি কাজ আছে।"  

"চা খাবি" ?  

"না এখন শহর যেতে হবে।"

 হরি তাড়াতাড়ি করে বেরোয়।  শিলাদিদি  ডেকেছে মানে আজ কিছু কাজ পাওয়া যাবে। দুটো পয়সাও ঘরে আসবে তবে। হরিরামে মনটা খুশ হয়ে যায়।

সকাল থেকেই সূর্য ওপর থেকে অগ্নি বর্ষণ করে চলেছে।   হরিরাম টিলার রাস্তা ধরে চলে, তাড়াতাড়ি হবে বলে।  চারপাশে কোথাও একটুকরো সবুজ নেই। ঘাসগুলো খড়ের মতো হয়ে আছে। সেই খড়গুলোই টেনে টেনে খাচ্ছে কয়েকটা গরু। কি হাড় জিরজিরে চেহারা সব। 


আশ্রমে  ঢুকলেই  হরিরামের মনটা শান্ত হয়ে যায়।   সুলভা ফুল তুলেছিল,ওকে দেখে বলল,

"আজ অনেক কাজ আছে রে হরি। দুপুরে এখানেই প্রসাদ খাস।"

আশ্রমের পিছনের নদীটা শুকনো পাথুরে বুক নিয়ে পড়ে আছে।  একদল গরু এসে দাঁড়িয়ে  আছে । চারপাশে  কোথাও কোনো খাবার নেই ওদের। আশ্রম থেকে  সবজি, সবজির‌ খোসা মেশানো ভাত এই গরমকালটা জুড়ে ওদেরকে খাওয়ানো হয়। শিলা, সুলভা ওদের খাবার দিচ্ছে। কি ভাবে খাচ্ছে গরুগুলো, আহা।  হরি রোদজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে  মনে মনে বলে,"অন্তত এই অবলা জীবগুলোর জন্য একটু  বৃষ্টি দাও ভগবান।"


রাত গভীর হচ্ছে। হরি খাটিয়ায় শুয়ে টাকার হিসেব করে। কদিন টানা এখন আশ্রমের কাজ থাকবে।

সুলভা দিদিরা বড় ভালো। গ্রামের লোকদের জন্য  অনেক কাজ করে। খুব ক্লান্ত আজ হরিরাম । বেশিক্ষন আজ আর বাইরে থাকে না। ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। পুষ্পা গল্প করে মণ্ডিতে খুব সুন্দর করে আজ যজ্ঞ হয়েছে। এবার নিশ্চয়  বৃষ্টি আসবে। হরির দুচোখে ঘুম নামে ,সুলভাদিদির কথাগুলো আবছা কানে বাজে, "আসবে , বৃষ্টি আসবে….তিনি জগৎনাথ। সবার জন্য তাঁর কৃপা। যতটা তোর আমার জন্য ততটাই ওই অসহায় প্রাণগুলোর জন্যও।"  "জগৎনাথ"এই কথাটা ওর মাথার মধ্যে গুণগুণ করে আর ঘুরপাক খায় ।তখন ও যেন  বৈতরণের জলে  ধীরে ধীরে  ডুবে যায় ….ওর সাথে পাহাড় গাছপালা,সন্তোষ ,রতন ভাও ,পাপ্পু, পুষ্পা, না খেতে পাওয়া গরুর দল ,মন্ডির দোকানদার সব ডুবে যায়।জলের ভেতর গোল গোল চক্কর কাটতে থাকে আর ঘুরতে থাকে সবাই একসাথে ।  সব একাকার হয়ে যায়। আকাশটা বৈতরণা হয়ে নীচে বইতে থাকে আর বৈতরণা  আকাশ হয়ে যায় …'জগৎনাথ হো….' ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে  হরিরাম।



আলা রে আলা ...খুব দূর থেকে  কারা যেন সুর টেনে টেনে চিৎকার  করছে,আর হরিকে ডাকছে।ওর মাথার কাছে ঢাক বাজাচ্ছে কারা। হরি লাফ মেরে উঠে পড়ে। ছুটে ঘরের বাইরে যেতে ঝুঁকে পড়া আকাশের সাথে ধাক্কা খায়। ও আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। ধুসর কালো মেঘে ঢেকে গেছে পুরো আকাশ। ঘন মেঘের ভারে সে যেন পৃথিবীর বুকের আরো কাছে নেমে এসেছে। ঠান্ডা  শিরশিরে বাতাস বইছে। আসপাশের ঘর থেকে মেয়ে মদ্দ বাচ্চারা সব বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে । ঘন কালো মেঘের মধ্যে বিজরি রেখা ঝলসে ওঠে। গুরুগুরু শব্দে সে জানান দেয় , আসছি ,আমি আসছি।   পশ্চিমের ওই পাহাড়চূড়া   পেরিয়ে, গাছপালাগুলোকে তোলপাড় করে ,ঝমঝম শব্দ করতে করতে কারা যেন ছুটে আসছে  ভীষণ বেগে।  পাশের ঘরে সুনীল  ,"পাওস আলা…আ আ….", বলতে না বলতেই হুড়মুড় করে সহস্র ধারায় প্রবল বৃষ্টি ঝাঁপিয়ে পড়ল চারদিক অন্ধকার করে। বছরের প্ৰথম বর্ষা, রতনভাও কি যেন বলছিল, আষাঢ় না কি? খুশিতে হরি হেসে ওঠে। বৃষ্টির জলে স্নান করছে সবাই । ভিজছে, হাসছে ,চিৎকার করে কথা বলছে। কি এক আগুনে জ্বলে পুড়েছে সব এতদিন। আঃ কি আরাম। মাটি থেকে সোঁদা গন্ধ উঠছে। বাতাস ভরে আছে ভিজে জঙ্গলের বুনো গন্ধের সুবাসে।  গাছপালা, প্রান্তর ,পাহাড়গুলো সব  যেন বিহ্বল হয়ে ভিজছে। 

তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি। নিমেষের মধ্যে হলুদ ঘাসগুলোতে সবুজের রঙ লাগল।  কে যেন সারা প্রান্তরে সবুজ মোম রং গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিয়েছে। চারপাশে অজস্র  ঝর্ণা দুধ সাদা জল নিয়ে হৈ হৈ করে নীচে লাফ দিল।  হরি ওর জমিতে নাচনীর  চারা লাগালো পুষ্পাকে নিয়ে দুদিন ধরে।

খেরবাড়িতে এখন  টুরিস্টদের ভিড়ে রিসোর্টগুলো উপচে পড়ছে। সকালে ওখানে তিন ঘন্টা কাজ করে হরি, ভালোই টাকা পায়।  রতনও খুব খুশি। সামনের দুমাস কোনো রুম আর খালি নেই।রকমারি সবুজ মেখে শুয়ে আছে  দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড় আর উপত্যকা।এখানে  বৃষ্টি হলে লাগাতার সাত দশ দিন চলতেই থাকে। রাস্তার ওপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। গ্রামের আদ্ধেক লোক এখন জমিতে  কাজ করছে।  হরিরামের জমিতে নাচনীর চারাগুলো লকলকে  সবুজ হয়ে পুষ্ট হচ্ছে দিনদিন। একটু বেলার দিকে আশ্রমে যায় হরি।  নানান রকমের কাজ থাকে,  দুপুরে প্রসাদ খায়। আশ্রমের পেছনে মরা শুকনো নদী বর্ষার জলে  ভরে উঠেছে। সারাদিন রাত গর্জন  করতে করতে ছুটে চলেছে কি এক উল্লাসে। হরি ওখানে গিয়ে বসে থাকে সময় পেলে। সামনের  পাহাড়ে  চড়ে বেড়াচ্ছে ছাগল, গরুর দল।  সবুজ নরম ঘাসে ছেয়ে গেছে সব পাহাড় । সুলভা বলে "দেখেছিস গরুগুলোকে? কি আনন্দ করে খাচ্ছে দেখ"। হরির মন ভরে যায় ওদের  খাওয়া দেখলে। আহা খাক, কতদিন পরে পেট পুরে দুটো খাচ্ছে। 


রাতের দিকে বৃষ্টিটা যখন একটু ধরে তখন  জোনাকির দলবল গাছের মাথায় গুঁড়ো, গুঁড়ো আলো  ছড়িয়ে তারার মতো জ্বলে,নেভে। বনপাহাড় মায়াবী আলোয় ভরে যায়।  মন্ডির গণপতির মন্দিরে গ্রামের বিঠঠলজির মন্দিরে মেয়ে বউরা পুজো দেয়। এই কটা মাস,সমৃদ্ধির মাস। ফসল ফলবে, ঘরে লছমি আসবে। রুখু মানুষ আর রুক্ষ প্রকৃতি চিকন শ্যামল হয়ে উঠবে। শহর আসবে দলেদলে এই অপূর্ব নিসর্গ শোভায় নেশাতুর হয়ে থাকতে। অর্থের লেনদেন বাড়বে। এমন অনেক হরিরামেদের  একটু বেশি রোজগার হবে। 

 রাত গভীরে ঝুম বৃষ্টি নামে । হরিরাম আজ নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরের ভেতরে ঘুমবে। বাউড়ি জলে ভরে গেছে।  পুষ্পাদেরও আর রাত থাকতে উঠতে হবে না। ওরাও এখন একটু আরাম পাবে।   হরির মনটা খুব খুশি হয়ে আছে। আশ্রমের  চাকরিটা  ওর পাকা হলো। এর সাথে সিজনের  বাকি কাজগুলোও করতে পারবে। আসলে রতনভাওর কাছে কাজ তো স্থায়ী কিছু নয়। সিজন না থাকলে সেই আবার কাজের  ধান্দায় জেরবার হতে হয় ওকে। শিলাদিদি বলেছে   হরি মাইনে ভালোই পাবে। এবার থেকে তবে একটু করে  টাকা জমাতে হবে। শীত লাগছে বলে হরিরাম চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। ।  


কাল মন্ডিতে জোর তর্ক লেগেছিল। শিন্ডে বলছিল,"সব গণপতির কৃপা। তাই বৃষ্টিটা হল, খরার থেকে বাঁচলাম"। সন্তোষ বলে, "এসব কিষনজীর দয়া", তো পাপ্পু বলে পর্জন্য দেবের। শেষ অব্দি  কি হলো হরির জানা নেই। ও পড়াশোনা শেখেনি, ও এসব আর কি বোঝে। কিন্তু সুলভার কথা শুনে শুনে হরির এক বিশালত্বের অনুভব হয় ,যাকে সেভাবে ধরা ছোঁয়া যায়না।  ঠিক বোঝাতে পারে না হরি  কিন্তু সুলভা যখন বলে, "জগৎনাথ," তখন বুকের ভেতর কেমন একটা হয় ওর। চোখে  জল আসে। ওই কেমন একটাকেই ও ভগবান মানে।  আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। সব হরিররামেরা ,পুষ্পারা নিবিড় শান্তিতে ঘুম যায়। 

শুধু ওই জগতের নাথ, করুণাদৃষ্টি মেলে তাঁর সৃষ্ট জগৎটিকে দেখতে থাকেন আদি,অন্তহীন কাল ধরে।


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য