সোমা কুশারী
আলো
"গণপতি বাপ্পা! আলা রে!"
দূর বাপু! অলপ্পেয়েরা আবার শুরু করেছে।
আর পারা যায় না !
গজগজ করতে করতে রেনু রাজ্যের কাপড় জামা তুলতে লাগলেন। রোদের তাপ আজ বড্ড চড়া, চাঁদি ফেটে যাচ্ছে রোদের তেজে। হাঁটু কোমড় বহুদিন জবাব দিয়েছে, ছাদে সিঁড়ি ভেঙে ওঠায় ডাক্তারের কড়া নিষেধ। তবু, তিনি নাচার। রোদের তাপে জামা কাপড় ভাজা ভাজা না হলে শান্তি নেই। কাপড়ের বোঝা ঘাড়ে চাপিয়ে নীচে নামতে লাগলেন রেনু।
পরিস্কার মেঝেতে কাপড়ের স্তুপ রাখায় রেনুর মত নেই, আবার বিছানায় কাচা কাপড় রেখে ভাঁজ করাও শাস্ত্রবিরুদ্ধ। অগত্যা, ব্যাথা কোমড় আরো ব্যাথিয়ে ওঠে। বারবার নিচু উঁচু হয়ে কাপড় তুলে ভাঁজ করতে থাকেন, আর অবিশ্রান্ত কথামালা রচিত হয়। একমাত্র ছেলে বৌ বাচ্চা নিয়ে বহুদিন মুম্বইবাসী, তিনিই পড়ে আছেন ভিটে আগলে। সঙ্গের লোকটা বছর দশেক হলো ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছে। থাকার মধ্যে রেখে গেছে সদর দরজায় মস্ত একটা নেমপ্লেট আর এই দশাসই বাড়িটা। নেমপ্লেটে এখনো ডক্টর জয়ন্ত চক্রবর্তী নামটা ঝকঝক করে, রেনু ঠিকে ঝি শিবানীকে দিয়ে প্রতিদিন ওটা মুছিয়ে রাখেন যে। পাশের বাড়ির শ্রীতমার তা নিয়ে সেকি হাসি! বলে কিনা, ও কাকি! নেমপ্লেটের বহর দেখে রোগী এসে যে লাইন দেবে গো!
রেনু, বরাবরের মুখচোরা তাই এক্ষেত্রেও মুখ বুজেই থাকেন। শুধু মনে মনে উত্তর আসে, ডাক্তারের সাথে ত্রিশ বছর ঘর করেছি বুঝলে! ও রোগী এলে নিজেই ব্যবস্থা করতে পারবো। তুমি বরং দেখো বর কোথায় লুকিয়ে চুরিয়ে ছাত্র পড়াবে !
তিনি চুপ করে থাকলে কী হবে, শিবানী তো চুপ থাকার মেয়ে নয়! তাই, ঠিক উত্তর আসে...
-নিজের বাড়িতে মাইনে করা লোক দিয়ে যা ইচ্ছে মোছাক না বাপু মাসি! তোমার তাতে কী বলোতো?
শ্রীতমার দুম করে জানলা বন্ধ করার ভঙ্গিতে হেসে গড়িয়ে পড়ে শিবানী। ঘাড় নেড়ে বলে,
-খুব ট্যাকট্যাকে কথা হয়েছে বৌটার বুঝলা মাসি! বর দুবেলা মাদুর পাতছে কিনা তাই অতো রুয়াব! বেশ করেছে সরকার স্কুল মাস্ট্যরগুলোর টিউশনি বন্ধ করে দেছে!
এই তো বছর পাঁচেক হলো চাকরি পেয়েছে পাশের বাড়ির অমিতাভ, ঐ তো শ্রীয়ের বর, এর মধ্যেই বাড়ি দোতলা করা মস্ত একটা গাড়ি কেনা সব কমপ্লিট! অথচ, রেনুর নিজের ছেলে অয়ন, মানে বাবান চাকরির কত বছর পর এই সবে গাড়ি কিনলো! গাড়ি অবশ্য রেনুর নিজেরও একখানা আছে। স্বর্গীয় ডক্টর জয়ন্ত চক্রবর্তীর বড় শখের গাড়ি। তবে, গাড়িটার বয়স বিস্তর। সেকেলে দুধসাদা এ্যমবাসাডারটা এখনও রেনুর খেরমত খাটে। পার্টটাইম ড্রাইভারও আছে একজন, সুরেশ। সে অবশ্য অন্য সময় একটা গ্যারেজে কাজ করে। রেনুর ফোন পেলে মেজাজ মর্জি ভালো থাকলে লজঝরে গাড়িটা নিয়ে বেরোয়। যাওয়ার মধ্যে তো রেনুর ছোটো ননদের বাড়ি আর মাস তিনেক অন্তর শম্ভু ডাক্তারের চেম্বার।
শম্ভুনাথ সরখেল জয়ন্ত চক্রবর্তীর কলেজতুতো ভাই-ই বলা চলে। জয়ন্ত চলে যাওয়া ইস্তক রেনুর একান্ত সহায়। ছেলে তো টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব সারে, একা একটা মহিলা কী করে কী না করে তার অনেকটাই দেখাশোনা করেন, শম্ভু। তবে, সেই মিন্টোপার্ক থেকে শ্যামনগর সশরীরে হাজির হওয়া সম্ভব নয় বলেই আলাপচারিতা পরামর্শদান সবটাই চলে ফোনে ফোনে। তবে, মাস তিনেক অন্তর রেনুকে একবার করে বিশদ চিকিৎসার জন্যে তার কাছে যেতেই হয়। আর সেদিন মুখচোরা রেনু মনের যত ক্ষোভ দুঃখ গরগর করে বলে শান্তি পান। শ্রোতা হিসেবে শম্ভুনাথ বরাবরই প্রথম শ্রেণির। আর, রেনুর ক্ষেত্রে শম্ভুনাথ আরো বেশি সচেতন থাকেন।বছর তিনেকের বড় জয়ন্ত এই মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় পড়তে আসা ছেলেটিকে এককালে যে কত সাহায্য করেছিলেন শম্ভু আজও তা ভুলতে পারেন না। শম্ভুর বেটার হাফ সুদক্ষিণা অবশ্য এই সম্পর্কটা ভালো চোখে দেখেন না। তার মতে এটি একধরণের পরকীয়া। আর, এই জন্যেই শহরে ঝুড়ি ঝুড়ি ডাক্তার থাকতেও আধবুড়ি রেনু চক্রবর্তী নিয়মিত ছুটে আসেন।
জগঝম্প গানের তোড়ে ঘরবাড়ি একেবারে ভেঙে পড়ার জোগাড় হয়েছে! রেনু বিরক্তিতে কান চাপা দিয়ে ডিভানে শুয়ে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এককালে গান গাইতে বড় ভালোবাসতেন বলে অ-সুরের এই অত্যাচার যেন আরো সহ্য হয় না! রান্নার মেয়ে সরলা আজ বিকেলে ছুটি নিয়েছে, ওদের পাড়ায় নাকি আজ গণভোজ! ভালোই আছে সব। বিশ্বকর্মা গনুদা পরবের পর পরব। রেনু উঠলেন, মাথাটা বড্ড ধরেছে, এককাপ চা করে খেলে কেমন হয়? সরলা রাতের রান্না বেলায় বেলায় সেরে যায় বলে চা পানের অভ্যেসটা বেলা চারটেতে এসে ঠেকেছে। আজ, পা দুটো বড় বেশি টনটন করছে। সরলা কাজে এলে ছাদসই জামা কাপড় নামাতে তাকে যেতে হয় না, ঐ নামিয়ে আনে। আজ সেটা হয়নি। সারাদিনে মোট চারবার আজ ছাদে উঠেছেন মনে মনে হিসেব করেন রেনু, আর তাতেই এই কনকনানি। চায়ের জলটা ফুটতে দিয়ে একবার বড়ননদকে ফোন লাগাবেন ভাবেন, এই আশ্বিনে বড়দি সাতাত্তরে পড়বে নিজেই বলছিলো। রেনুর চেয়ে ঠিক সতেরো বছরের বড়। কিন্ত এই বয়সেও মানুষটা দারুণ সক্ষম। একা একা হিল্লি দিল্লি ঘুরে বেড়াচ্ছে। বছরে বেশির ভাগ সময় অবশ্য কী একটা এন জি ওর কাজে পুরুলিয়াতেই থাকেন, বছর দুয়েক হলো একটা নাটকের দল খুলেছেন, দলটা নাকি শুধুই মেয়েদের। বড়দির, কল্যাণীর ভাড়া বাড়িতে তাদের আস্তানা! কতদিন যাবেন ভেবেছেন রেনু একবার ওদের ঐ নাটকের দলের কাজকর্ম দেখতে, তা আর হয়েই ওঠে না। কি যে ছাই কাজ! আসলে, কেমন একটা আলস্য কাজ করে। এই বাড়িটা ছেড়ে নড়তেই ইচ্ছে করে না। সকাল থেকে একটা ঢিমে তেতালায় গড়িয়ে গড়িয়ে দিন চলে তারপর বিকেল হলেই' জীবন মানে জি বাংলা' ! না! আজ দিদির সাথে কথা বলে যেতেই হবে একদিন।
লাল কামিজের তলায় কালো সালোয়ার। পনেরোটা নানান বয়সের মেয়ে রাজস্থানী সুরে গান গাইছে। মঞ্চে ঘুরছে স্পট লাইট। ঝিকিয়ে উঠল ফর্সা মেয়েটার নাকচাবি। লম্বা ঈষৎ ভারি মেয়েটা এখন সুর ধরেছে, খাটো চাপা রঙের মেয়ে হাতরাসের কথা বলছে... হাঁসখালি হয়ে গানের সুরে ওরা নির্ভয়াকে ছুঁয়ে মিশে যাচ্ছে কামদুনি কথায়। হলঘরে নিশ্ছিদ্র নীরবতা। রেনু মন দিয়ে দেখছেন। বড়দি যেন একটা অন্যজগতের দরজা খুলে দিয়েছে...ঐ ব্যানার্জি পাড়ার দুতলাবাড়ির জীবনটা বড্ড ফিকে লাগছে রেনুর। আহ! 'কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরে ভুলিব না'। রেনুর মনে পড়ছে, বিয়ের আগে বড্ড গল্পের বই পড়তে ভালোলাগতো, রাতারাতি শেষ হয়ে যেত হাঁসুলিবাঁকের উপকথা, বলয়গ্রাস, ইছামতী... আর ছিল গান! শ্বশুরমশাই তো ঐ গান শুনেই... অথচ বিয়ের পর কোথায় যে সব হারিয়ে গেল, অসুস্থ
শ্বশুর শাশুড়ি, ব্যস্ত বর, ছোটো ছেলে, মস্ত বাড়ি...
- দূর কি যে বলো! আমি তোমাদের দলে ভিড়ে কী করবো?
-কী আর করবি? দর্শক হবি। বসে বসে আমাদের মহড়া দেখবি ।
-রোজ আসবো? তাও কী হয়?
-রোজ কেন আসবি? সপ্তাহে ঐ একটা তো দিন! তাছাড়া মাস তিনেক পরেই তো আমি পুরুলিয়া ফিরবো। এই কটাদিন অন্তত আয়।
বেতো পা নিয়ে রেনু যে কোনোদিন একা ট্রেনে চাপতে পারবেন ভাবেনইনি । তবু কী করে যেন পরপর ক'সপ্তাহ চলেই এলেন। প্রথম দু সপ্তাহ তুতিয়ে পাতিয়ে সুরেশকে এনেছিলেন। তা সে বড় তাড়া দেয়। নগদ ছশো টাকা প্লাস তেল খরচ অত রেনুর পোষায় না। তার চেয়ে এই তিনটে সতেরোর শান্তিপুর লোকাল এই ভালো। কল্যাণী স্টেশনে নেমে নিরিবিলি পার্কের মধ্য দিয়ে হেঁটে একটুখানি। বড়দির ভাড়া বাড়িতেই 'উইংস অফ ফায়ারের' আড্ডাখানা। মেম্বার বলতে সতেরো জন মেয়ে আর বড়দি নিজে। রেনুর আজকাল বাড়ি ফিরতে মন চায় না। অবিবাহিত এই বড় ননদটি অবশ্য থাকতে বলেন বরাবরের জন্যে, রেনুর কোথায় যেন আটকায়। আসলে, সম্পর্কটায় কোথায় যেন একটা গিঁট পড়ে আছে। জয়ন্ত চলে যাওয়ার পর অবশ্য গিঁটটা যা হোক অনেক আলগা হয়েছে। কিন্তু তাও! বরাবরের জন্যে থেকে যেতে হলে ছেলের পারমিশন চাই। ছেলে যে তাতে রাজি হবে না ভালোই জানেন রেনু।
আজ ওরা নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলছে। কত সহজ সাবলীল আলোচনা। শর্মিলা বলে মেয়েটি স্বামীর সাথে থাকে না ডিভোর্সও নেবে না বলছিলো। শ্বশুরবাড়ির লোকের অনেক অত্যাচার সয়েছে তারই জবাব এই ডিভোর্স না দেওয়া। কান্তা সর্বাণী বিয়ে থা করেনি দুজনেই চাকরি করে। রেনুর অবশ্য সবচেয়ে ভালো লাগে মৌবনীকে, ভরভরন্ত সংসারী মেয়ে। তবু কী সুন্দর নাটক করে, এদের সাথে ট্যুরেও যায় একা। বর নাকি তখন বাচ্চা সামলায়। রেনুর শুনেই ভালো লাগে। নিজের কথা মনে হয়। তিনি নিজে এমনটা কখনো পারতেন? আর জয়ন্ত? তিনি বাবানকে একা ফেলে ঘুরতে গেলে দেখতো ছেলেকে? দূর! দু এক দিনের জন্যে বাপের বাড়ি গেলেই কত কথা শুনেছেন। তারপর তো বাপ মা যেতেই বাপের বাড়ি বলতে জায়গাটাই ভ্যানিশ হয়ে গেল! আজ ভাবতে বসলে মনে হয় সেসব বুঝি গত জন্মের কথা। আজকাল ওদের গল্প শুনতে শুনতে দেখ না দেখ রেনু নিজের অতীতে ডুবে যান। এসময় গুলোয় দেখেছেন বড়দি তাকে খোঁচা মারে,
-কীরে ঘুমুলি নাকি? তুই কিছু বলবি না? বল।
-আমি? আমি কী বলবো আবার?
-কেন তোর কোনো কথা নেই? এই যে আমার ভাইয়ের সাথে এতগুলো বছর ঘর করলি এখন একা একা দিন কাটাচ্ছিস ছেলের জন্যে সব গুছিয়ে রাখছিস , সেসব নিয়ে বল।
রেনুর কেমন আড়ষ্ট লাগে। মনে হয় নিজের কথা বলা মানেই জমে থাকা অভিযোগের পাহাড় ডিঙোনো, থাক সেসব থাক।
বড়দি ছাড়ে না। আবার খোঁচায়। রেনু বলে বসেন, - এসো বরং একটা গান শোনাই, তোমরা যে বলছ তোমাদের নাটকে গলা মেলাতে তা পরখ করে দেখো আগে! বহুবছর পর খালি গলায় গান ধরেন রেনু,
'শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে...'
ফেরার ট্রেনে উঠতে ভারি কষ্ট হয় রেনুর রাত আটটার পরেও কেন যে মেইন লাইন সেকশনে এত ভিড়! নামার সময় হোঁচট খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলেন। বহু কষ্টে নিজেকে সামলে টুকটুক করে হেঁটে ওভার ব্রিজ পেরোন। পুজোর আর মাস খানেক বাকি চারিদিকে ভীষন রকম হৈ হৈ চলছে টের পান। বাবানরা কী এবার আসবে? জানায় নি তো কিছু।বাবানের মারাঠিবৌ প্রাযক্তা খুব একটা আসতে চায় না জানেন রেনু। তবু নাতিদুটোকে তার বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে। বড়দি আজ পই পই করে বলে দিয়েছে বাবানকে জানাতে পুজোয় রেনু ওদের সাথে পুরুলিয়া যাচ্ছেন। রেনুর দোনোমনো ভাবটা কাটতে চায়না। বাবান কী রাজি হবে? বড়পিসির সাথে মাখামাখি কোনোকালেই সে ভালো চোখে দেখে না। আর পায়ে ব্যাথা নিয়ে মায়ের 'নেচে বেড়ানোটাও' হ্যা ঠিক এই শব্দটাই বলবে বাবান জানেন রেনু। বেঁচে থাকতে জয়ন্ত ও যে তাই বলতেন।
সপ্তাহে এই দিনটা নিয়ম করে ছুটি দিচ্ছেন সরলাকে, তাই নিজেই দুধ গরম করে মুড়ি মেখে খেয়ে নেন রেনু। তারপর ছেলেকে ফোন করেন...
-বড়পিসির সাথে? ভিমরতি ধরেছে নাকি?
মাঝপথে ফোন কেটে দেন রেনু। ছোটোপিসির সাথে হলেও কথা ছিল ... ছেলের একথার পর আর সময় নষ্ট করার মানে হয় না। রেনু অনেক রাত অবধি জেগে বসে থাকেন। বড়দি শ্বশুরের ঠিক করা ছেলেকে বিয়ে না করে সহপাঠী এক মুসলিম ছেলের সঙ্গে গৃহত্যাগ করেছিল শুনেছেন রেনু। তবে সে নিয়ে কোনোদিন কোনো কথা বলেননি জয়ন্ত। এ নিয়ে শাশুড়িমাও ছিলেন চূড়ান্ত নিশ্চুপ। ছোড়দি শুধু মাঝে মাঝে গজ গজ করতো। শ্বশুরমশাই মারা গেলে না এলেও শাশুড়িমার কাজে প্রথম এ বাড়ি এসেছিল বড়দি। সে নিয়ে কাজের বাড়িতে তেমন অশান্তি অবশ্য হয়নি।শুধু ফিসফাস শুনেছিলেন কিছু, এরপর জয়ন্ত আর রেনুর সাথে ফোনালাপ চলতো কালেভদ্রে। জয়ন্তর হার্ট এ্যাটাকে আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে জোয়ার এনেছিল। রেনু তখন দিশেহারা। একমাত্র ছেলেও অতদূরে... বড়দি এসে সব না সামলালে...
বড়দিকেই ফোন করে বসেন রেনু। মন দিয়ে সব শোনে বড়দি। তারপর বলেন, শোন, আজ তোকে একটা কথা বলি। চিরকাল শুনে এসেছিস আমি পালিয়েছিলাম, কিন্তু কার সাথে তা তো জানিস না। আজ শোন, আমার সাথেই কলেজে পড়ত আনসার, বাবা জোর করে পড়া ছাড়িয়ে বিয়ে দিচ্ছিল আমাকে। অনেক বুঝিয়েও বাবাকে নিরস্ত করতে পারিনি। তখন বাধ্য হয়েই এককাপড়ে বাড়ি ছেড়েছিলাম। আনসার-ই আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল পুরুলিয়ায়।
-পুরুলিয়ায়? রেনু হতম্ভব কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন।
-হ্যা রে...ওখানেই শ্রদ্ধাপ্রাণাজীর আশ্রমের খোঁজ পেয়েছিলাম আগেই, মাতাজী আমাকে ঠাঁই দিয়েছিলেন। লেখাপড়া শেষ করে, ওখানেই অনাথআশ্রমের দায়িত্ব নিলাম, সমাজ যাদের নষ্ট বলে সেসব মেয়েদের জন্যে নিজে হাতে তৈরি করলাম 'নিজের বাড়ি' ওরা ওখানে লেখাপড়া, হাতের কাজ সব সব শেখে। বেশ কজন তো সংসারও পেতেছে নিজের মতো। বাবা সবই জানতেন, তবু কলঙ্ক আমার ঘোচেনি। জয়ন্তকেও বাবা সব বলেছিলেন মৃত্যুর আগে, ছুটকিও সব জানে। তবু ওরা মুখ খোলেনি। ভেবেছিল বোধহয় বাপের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে সমাজসেবায় উড়িয়ে দেবো! তাই বোধহয় একটা মিথ্যেকে ইচ্ছে করেই এতবছর ধরে জিইয়ে রেখেছিল। আমিও জবাবদিহি করতে চাইনি। কেন করবো? এতগুলো বছর যে কাজ করেছি এখনও যা করছি তাই আমার সবটুকু, রেনু। আমরা মেয়েরা আসলে বড্ড বোকা জানিস! শুধু ওদের মতে মত দিয়েই জীবন কাটাই। আর তাই তোকে এমন করে বারবার ডাকি! তুই শুধু আমার ভাইবৌ বলে নয় রে! একটা কিচ্ছু না পাওয়া মেয়ে বলে! জয়ন্ত আমার ভাই বলেই আমি খুব ভালো করে জানি, ও কতটা ইগোইষ্ট ছিল! বাবানও তো ওরই রক্ত! ও আর কতই বা অন্যরকম হবে? মা যতকাল বাঁচবে বাপের সম্পত্তির কেয়ার টেকারের ভূমিকা পালন করুক তাই তো চাইবে! জীবনের অনেকগুলো বছর তো ঘর মুছিয়ে কাপড় জামা গুছিয়ে টাকা পয়সা সঞ্চয় করে কাটালি এবার না হয় একটু অন্যরকম ভাব। চল্ আমাদের সাথে।
রেনু, ঠিক করেছেন কাল সকালে তাড়াতাড়ি সব কাজ সেরে নেবেন। ব্যাঙ্কে গিয়ে জমানো টাকা তুলবেন, লকারের গয়নাও কিছু বার করে আনবেন। একমাত্র ছেলেরবৌ বলে শাশুড়ি অনেক গয়না দিয়েছিলেন তাকে, এসবে তো দেখতে গেলে বড়দিরও ভাগ আছে! তাই, প্রাযক্তার জন্য কিছু রেখে বাকিটা বড়দির হাতেই তুলে দেবেন। সত্যিকারের কাজে লাগুক ওসব।
শিবানী আর সরলাকে একমাসের অগ্রিম মাইনে দিয়ে আসতে বারণ করে দেবেন। বাড়ির চাবি বাবানকে ক্যুরিয়ারে পাঠিয়ে সুরেশকে বাবানের সাথে যোগাযোগ করতে বলে বাড়ি তালা বন্ধ করবেন নিজের কাছে রাখবেন একসেট চাবি।তার আগে অবশ্য শম্ভুকে সবটুকু বলতে হবে, ও মানুষটার অনুমতি বড় দরকার।
বড়দি তো ঠিকই বলেছে জীবন একটাই, যে কটা বছর আছেন একটু না হয় নিজের ইচ্ছেমতো বাঁচলেন! আর কিছু না পারেন ঐ অনাথআশ্রমের বাচ্চাগুলোকে রবীন্দ্রসঙ্গীত তো শেখাতে পারবেন! পরিবারের কেউ দাম না দিলেও ঐটুকু-ই বড় ভালোবেসে শিখেছিলেন মেয়েবেলায়...
Khub valo laglo
উত্তরমুছুন