সবুজ মোদক

 


 পরিযায়ী মেঘ 



আকাশে ক্ষয়িত চাঁদ মেঘের আঁচলে লুকোচুরি খেলছে। কতই বাহারি রং এঁকেছে তার বুকে। এমন ভোর কোনদিন চোখে দেখেনি তপন। এ  কিসের মায়াবী টান! কালিন্দীর জলে শুধুই ভাটা আর ভাটা। জোয়ার কি আসবেনা কখনো? রঙিন ডানা মেলে উড়ছে মাছরাঙা, দুই এক ফোঁটা জল ঝরছে ডানা থেকে, পিপাসা মেটে না। মাঝে মাঝে মেঘ নেমে আসে, ভিজে যায় শরীর মন ভেজে না।


      শ্রাবণ আজ বার্ধক্যে তবু যেন যুবতী, আষাঢ়ের সঙ্গে ভাব পাতিয়েছে দুদিন ধরে। তাই আজ দ্বীপে বন্দি তপন। কাল দুপুর থেকে সেই যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল আর থামেনি। থামলো ভোরবেলায়। আকাশ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ- "শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।" আজ ভান্ডারখালি হাট, তাই ভোর তিনটে থেকে উঠে সুকুমার সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। আজ রাজা ওর নৌকায় উঠবে কত যুবতী, কত পুরুষ, কত বৃদ্ধ, কত শিশু। কারো হাত ধরে নৌকায় তুলবে, কাউকে কোলে করে, কাউকে কাঁধে করে, আবার কাউকে কমলস্পর্শে। তাই ও সেজেছে রাজার বেশে। আড় চোখে তাকিয়ে দেখে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে মেঘের আড়ালে। এখনো সকাল হয়নি। বাবলা গাছের নিচে বসে তপন দেখে ভোর। 'মাস্টার, আজ যাবা নাকি হাটে?'-চিৎকার করে সুকুমার। গাছের পাতা থেকে সঞ্চিত বৃষ্টি জল ঝরে পড়ে চোখে মুখে। আজ তপন সারাদিন একাকী,যেখানে খুশি যেতে পারে পরিযায়ী মেঘের মতো।


      এখানে সকাল হয় না, সকালেরা আসে। পাখির ডানায় ভর করে নদীর কুলুকুল রবে সকাল আসে,  সকালেরা বাংলাদেশের সাতক্ষীরা থেকে সাহেবখালিতে বেড়াতে আসে- হাত বাড়িয়ে ডাক দেয় দোসর কালিন্দী। মেঘের ঢাকনা খুলে উঁকি দেয় সূর্য। তখনো মিনি সুন্দরবনের ঘুম ভাঙেনি। মাছরাঙা আর বক উড়ে উড়ে ওর ঘুম ভাঙায়, চোখ মেলে মিনি সুন্দরবন। আকাশের কান্না থেমেছে ঠিকই, যে কোন মুহূর্তে আবার কাঁদতে পারে তাই মুখখানা কেমন থমথমে হয়ে আছে। সূর্যের বার্তা নিয়ে এসেছে মেঘ হরকরা। রং বদলাচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। সাদা থেকে হালকা লাল, হালকা লাল থেকে তীক্ষ্ণ নীলচে। এত রঙ ছড়াতে পারে মেঘ আগে কখনো দেখিনি। যতদূর চোখ যায় মেঘ ক্রমেই কালিন্দী ছেড়ে ইছামতি, ইছামতি ছেড়ে রায়মঙ্গলে মিশে গেছে। ফোন বেজে ওঠে তপনের-'মা এসেছে; তুমি সাবধানে থেকো!' মাত্র দুটো কথা তাতেই মন শান্ত হয়ে যায়। মেঘকে কেমন চেনা চেনা লাগে ওর মধ্যে কত কিরূপ। কালিদাস কেন ভেবেছিলেন মেঘ দূত? বুঝতে পারে তপন।


        সকাল আটটা বাজতে না বাজতেই সুকুমারের নৌকায় রঙিন চিঠিরা আসতে শুরু করল। রঙিন শাড়ি, রঙিন ঠোঁট, রঙিন পা আর রঙিন হাসি। সপ্তাহে একদিন হাট, সেই হাটকে ঘিরে ওদের  আনন্দ উৎসব। সারাদিন নৌকায় নৌকায় ঘুরে বেড়ায় পরিযায়ী রঙিন চিঠি। চিঠির দলকে নিয়ে আসে ভান্ডারখালি হাট। আর এই চিঠিদের জন্যই সুকুমারের নৌকা বাওয়া। চিরকুমার পঞ্চাশের সুকুমার, আজও সু-কুমার। 

     মুরগি নিয়ে যে চিঠিরা এসেছে তাদের মুখে পান, স্বপ্ন নিয়ে যে চিঠিরা এসেছে তাদের মুখে গান। বৈঠা ধরে সত্তরের মাধব বাউলিয়া ভরা শ্রাবণেও গাইতে পারে- 'বসন্ত বাতাসে সইরে বসন্ত বাতাসে/ বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে'। তপন অবাক হয়ে বসে থাকে নৌকার এক কিনারে। মেঘ গুলিও তপনের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। মেঘ তাকিয়ে থাকে চিঠির দিকে চিঠিও আড় চোখে তাকায়। ওদের ভাব হয়-সঙ্গী কালিন্দী। ছোট সাহেবখালি, পুরাতন সাহেব খালি, সাতরা, শিববাড়ি পুঠিয়াচক পার হয়ে এবার সে ইছামতিতে মিশবে। তারপর রায় মঙ্গল। মেঘের ভালোবাসার জল দু একবার বর্ষিত হল চিঠির বুকে। না সে জল জমেনি শুকিয়েছে মুহুর্তে। তপন ছাতা মাথায় তবুও মেঘের জল ভিজিয়েছে তার শরীর। 'ও মাস্টার জ্বর আসবে যে'! হেসে লুটিয়ে পড়ে পরিযায়ী চিঠিরা। রায়মঙ্গলের  প্রবল ঢেউয়ে দুলতে থাকে সুকুমারের সজ্জিত নৌকো, ময়ূরপঙ্খী। প্রবল হাওয়া, প্রবল ঢেউ জলের মধ্যে মেঘ হরকরা। ডুবে থাকা সুন্দরী, গেওয়া, ফলসে ঢেউয়ের তালে তালে নাচতে থাকে। নাচতে থাকে চিঠিদের মন।


       এখানে মিশেছে ইছামতি- কালিন্দী। তারপর দুজনে মিলে যাবে রায়মঙ্গলে। দুলদুলি- লেবুখালী-ভান্ডারখালি তিন খানিগ্রাম মাঝে নদীর বহমানতা আর সুন্দরীর সমাহার। ভান্ডারখালি হাটে চলে গেল চিঠির দল। সুকুমার তাদের পাছে পাছে। নদীর ধারে হাড়িয়া নিয়ে বসেছে অসংখ্য মানুষ। ঢুলু ঢুলু চোখে পাশে পূজারির দল। দোকান শুরু হয়েছে ঘাট থেকে। হাটের মধ্যে আর তপন প্রবেশ করে না। চলে আসে লেবুখালী ঘাটে। সেখান থেকে দেখা যায় নদীর অপূর্ব সৌন্দর্য। হাট শুরু হয় সকাল দশটায়, চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিভাবে যে সময় চলে যায় টের পায় না তপন। চিঠির দল তখনো নৌকায় ফেরেনি। সুকুমার ঘুরে বেড়াচ্ছে পিছে পিছে। পড়ন্ত বিকেলে এই জায়গাটি বড় মোহময়ী হয়ে ওঠে। গোধূলির রঙিন আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে সূর্য রশ্মি। পাখিরা উড়ে যায় দল বেঁধে। ইছামতির জলে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে জেলেরা ফিরে যাচ্ছে মাছ বিক্রি করে। বড় বড় নৌকায় মহাজনি মাল চলে যাচ্ছে 
রায়মঙ্গল দিয়ে আরো দূরে যোগেশগঞ্জের দিকে। আলুর চপ আর পিয়াজের গন্ধে পুরো এলাকা মম করে। পাশে জেটিঘাট। বাস লরি হামেশাই পার হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট পার্কে ভিড় করেছে কচিকাঁচার দল।তখনো পরিযায়ী মেঘ, তখনও পরিযায়ী চিঠি, তখনো পরিচয় জীবন, তখনও পরিযায়ী স্মৃতি। এই বুঝি মেঘের কান্না শুরু হয়। নৌকায় উঠে বসে তপন। দল বেঁধে চিঠিরা ফিরে আসছে ফিরে আসছে তাদের মনোহারি পসরা। শ্রাবণের আকাশে পরিযায়ী মেঘ কালিন্দী, ইছামতি, রায়মঙ্গল পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, চলেই যাচ্ছে।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য