রাজদীপ ভট্টাচার্য

 


 হে কবন্ধ দেশ 



হে কবন্ধ দেশ আমার,  ওরা তোমাকে ফেলেছে মেরে তারপর তুমি আজো বেঁচে আছ কেন? তুমি কি আদৌ বুঝতে পারনি যে তোমার দু’চোখ আসলে তোমার নয়, কবেই খুবলে খেয়েছে তা বেনিয়ার দল। তুমি কি সত্যিই বোঝোনি যে তোমার হৃদয় রাতারাতি বদলে দিয়েছে ওরা মৃত এক হৃদয়ের সাথে। রক্ত জমাট বেঁধে পাথর হয়েছে শুধু। তোমার দু’চোখে তাই জল নেই, আগুনও জ্বলে না। তোমার বুকেতে নেই হিল্লোল, জাগে না জাগে না রাত ঝঞ্ঝায় বিক্ষুব্ধ নগরে। তুমি এক নিস্পন্দ মৃত অবশেষ। পোড়া সময়ের বুকে তুমি ছাই, তুমি ভস্ম, তুমি এক বাতিল জঞ্জাল!



মৃত বাছুরের ওই খড়ভরা দেহখানি হয়ে তুমি বেঁচে আছ। তোমাকে মঞ্চে রেখে দলবেঁধে মেয়ে লুটে আনে। ওরা সব ভীষণ ধার্মিক। ওরা মন্দিরে - মসজিদে - গির্জায় বারুদের মতো ঠেসে ঠেসে ধর্মকথা ভরে। ওরা ঠিক করে দেয় সবার নসিব। ওরা হাতে ধর্মগ্রন্থ নিয়ে রোজ বিছানায় যায়। ভক্তের পেটে তাই গুঁড়িমেরে ঈশ্বর আসে বারবার। কেউ আর থানায় যায় না। তোমাকে সামনে রেখে রোজ বসে এদেশের মহান বাজার। সেখানে মেয়ে ও মানুষেরা আসে। মেয়েমানুষেরা সব বিক্রি হয়ে যায়। ভেড়ার পালের মতো ঘাস খায় কবন্ধ বন্ধুগণ, উপত্যকা জুড়ে। 



হে কবন্ধ দেশ, আমাদের কেউ নেই তুমি ছাড়া, তাই তোমাকেই নালিশ জানাই বারবার। আমাদের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীরা তোমার জন্য অনেক রক্ত দিয়েছে। তাদের শ্রম আর ঘামও দিয়েছে। তারা ভেবেছিল একদিন অপর্যাপ্ত পুষ্পে ভরে যাবে চরাচর। তারা জানতো না ধুরন্ধর মেষপালকেরা কচি ঘাসের খোঁজে উপত্যকায় হানা দেয় অগোচরে। নতুন ঘাসের জমি তাদের প্রলুব্ধ করে। নিরপরাধ ও সরল পূর্বপুরুষেরা ভরসা করেছিল তোমায় এবং তোমার দৈবী বাতাসে। পাহাড়ি ধূপের গন্ধে তাদের প্রত্যয় দৃঢ় হয়েছিল। অথচ ধূর্ত হানাদার এবং গড্ডলিকা প্রবাহ কচি ঘাসেদের বাড়তে দিল না এবং একদিন মরে গেল সকল ঘাসফুল।



কবন্ধ দেশের গর্ভে জন্ম নেয় কবন্ধ মানুষ। জন্মের পর পর তাদের শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া হয়। বুকের পকেটে গুঁজে দেওয়া হয় শুধু দুই মুঠো আয়ু আর মুখবেঁধে থাকার ফতোয়া। কবন্ধ মানুষেরা জন্ম নেয়, জন্ম দেয়। পুজো - পাঠ করে। দু’বেলা নামাজ পড়ে নিয়মমাফিক। কবন্ধ মানুষেরা মরে গেলে তক্ষুনি সবাই ভুলে যায়। তারা কেন বেঁচে থাকে তারা তা জানে না। তারা কেন মরে যায় তারা তা জানে না। মাঝে মাঝে জনগণতান্ত্রিক ভোট দেয়। সিনেমার গোলাপি টিকিট কাটে। মাঝে মাঝে পিকনিক করে। অযথা নিয়ম মানে, অযথা নিয়ম ভাঙে। কবন্ধ জীবনের মোম জ্বলে শেষ হলে আলো নিভে যায়। এই শিরহীন মানুষের দেশে একটু শিরঃপীড়া দাও হে ঈশ্বর!



এ দেশের মানুষের আর মাথা নেই। শুধু যৌনাঙ্গ রয়েছে। শিরহীন মানুষেরা গহ্বরে জ্বালানি ভরে দেয়। তারপর মালিক যেমন বলে তেমনই সুড়ঙ্গ কাটে। সাবান ফেনার মতো তাই এ শহর আজ ফাঁপা। বারেবারে শূন্যপথে টেনে নেয় ঘর ও জীবন। কার ঘর সংসার ডুবে যায় কেউ তা জানে না। এ শহর আর তার কবন্ধ মানুষেরা ক্রমশ তলিয়ে যায় গূঢ় অন্ধকারে। যেহেতু শিরহীন কেউ তাই কাউকে চেনে না। যেহেতু শিরহীন তাই কোনো লজ্জা নেই শোক-তাপ নেই। যৌন অঙ্গগুলি শুধু নড়ে চড়ে। বাতাসে সুঘ্রাণ ভাসে। অন্ধ মানুষেরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। তারপর পাশ ফিরে ঘুমায় সারারাত। ক্রমশ অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে।


মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ কবিতাগুচ্ছ।
    'কবন্ধ দেশের গর্ভে জন্ম নেয় কবন্ধ মানুষ',' সাবান ফেনার মত তাই এ শহর আজ ফাঁপা...'এরকম অনবদ্য পঙক্তিগুলি চমৎকৃত ও ভাবিত করে। যেমন কোমল কবিতা তেমনই এরকম জ্বলে ওঠার লেখাতেও সমান সাবলীল তুমি। মুগ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ জানাই। আনন্দ পেলাম। - রাজদীপ

      মুছুন
  2. খুব ভালো লাগলো রাজদীপ। তীব্র ক্ষোভ, প্রতিবাদ, খুব শিল্পীত শব্দের ব্যবহারে,অসামান্য করে তুললে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ জানাই। উৎসাহ পেলাম। - রাজদীপ

      মুছুন
  3. রঞ্জনা ভট্টাচার্য৮ নভেম্বর, ২০২৩ এ ১২:৪৯ AM

    অসাধারণ অসাধারণ 🙏

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ ম্যাডাম। আনন্দ পেলাম। - রাজদীপ

      মুছুন
  4. কবিতা গুচ্ছ গুলি এক সুতোয় বাঁধা।"কবন্ধ দেশের গর্ভ থেকে জন্ম নেয় কবন্ধ মানুষ"সমস্ত কবিতা শরীরে তীব্র ক্ষোভ,প্রতিবাদ ও অসহায়তা সব মিলে কবির অনুভূতি শিল্পিত শব্দে আত্মপ্রকাশ করেছে। সময়ের গভীর অসুখ খুব সুন্দর ভাবে ছুঁয়েছেন কবি।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ। পাঠকের ভালো লাগলে কবির আনন্দ। -- রাজদীপ

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য