চন্দ্রাণী বসু

 


 রবীন্দ্র নাটকে বৌদ্ধ ভাবনার প্রভাব



কলকাতা শহর জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মন্দির, মসজিদ, চার্চ, প্যাগোডা ছড়িয়ে আছে। শহরের বৌদ্ধ বিহারগুলি অনেক সময় আমাদের চোখের আড়ালে থেকে যায়। কিন্তু একশো বছর আগে এই কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, শ্রীধর্মরাজিকা চৈত্য বিহার। এখানে স্তূপের ভিতরে সসম্মানে রাখা আছে ভট্টিপ্রলুতে সম্রাট অশোকের স্তূপ থেকে পাওয়া গৌতম বুদ্ধের অস্থি। ঠিকানা কলেজ স্কোয়ারের কাছে ৪এ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। একশো বছর আগে ২৬ নভেম্বর ১৯২০ তারিখে মহাবোধি সোসাইটির চেষ্টায় এই বিহার স্থাপিত হয়। অজন্তা শৈলীর এই সৌধ ভারতীয় স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। ইতিহাস ও অপূর্ব স্থাপত্যের মেলবন্ধনে সৃষ্ট এই বিহার ২০০৪ সালে কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের তরফে ঐতিহ্যশালী সৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পায় ... কলকাতার এই বৌদ্ধ বিহারে মাঝেমাঝেই নানা অনুষ্ঠানে পা রাখতে হয় আমাদের, আমরা এই প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে কম বেশি সবাই পরিচিত।

আর সকলের পরিচিত এই বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে রবিঠাকুর পা রেখেছিলেন ১৯৩৫ -এ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মহামানব বুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮ মে, ১৯৩৫ সালে কোলকাতায় মহাবোধি সোসাইটির ধর্মরাজিকা বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে, মহাবোধি সোসাইটি হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন,

“আমি যাঁকে আমার অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করেছি আজ তাঁর জন্মোৎসবে তাঁকে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি, এ কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্ঘ নিবেদন নয়, যাঁকে নির্জনে বারংবার অর্ঘ নিবেদন করেছি, সেই আজ নিবেদন করতে উপস্থিত হয়েছি।"

প্রখ্যাত রবীন্দ্র-জীবনীকার কৃষ্ণ কৃপালনির জবানিতে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ‘জীবনে একবারমাত্র একটি মূর্তির সামনে আমার প্রণত হওয়ার প্রেরণা জেগেছিল, সেটা বুদ্ধগয়ায়, যখন আমি বুদ্ধমূর্তি দর্শন করি।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তিটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ব্যাপারটি তৎকালীন ঠাকুর পরিবার ও সমাজের পক্ষে মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। কারণ ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম, নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক, এবং মূর্তিপূজার ঘোরতর বিরোধী। সেই রবীন্দ্রনাথের মনন বৌদ্ধ ভাবধারায় এতটাই আবিষ্ট ছিল যে তাঁর পবিত্র মূর্তির সামনে প্রণাম নিবেদনে কোনো দ্বিধা ছিল না। 

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের উপর এই বৌদ্ধিক ভাবধারার প্রভাব এল কিভাবে ?

ঠাকুর পরিবারে বৌদ্ধ ভাবনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথই প্রথম পরিচিত হননি, এর সূচনা তাঁর পরিবারে তাঁর পূর্বেই।  তৎকালীন বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির পীঠস্থান  ছিল সিংহল,বর্তমানে শ্রীলঙ্কা। ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে জ্ঞান অন্বেষণে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ করেন, সঙ্গে ছিলেন সেই যুগের অসাধারণ প্রতিভাশালী পণ্ডিত কেশব সেন, কালী কমল গাঙ্গুলি এবং মহর্ষির পুত্র সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীর্ঘ সময় শ্রীলঙ্কায় অবস্থান করে তাঁদের বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। সেখানকার বৌদ্ধদের ধর্মনিষ্ঠা, উপাসক-উপাসিকাদের সম্মিলিত প্রার্থনা, ভিক্ষু সংঘদের ধ্যানধারণা, উচ্চাঙ্গের জীবনচর্চা, সুগভীর রীতিনীতি, সাধন-ভজন তাঁদেরকে মুগ্ধ ও প্রভাবিত করল। সেই ভাবধারায় বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের তুলনামূলক গবেষণা করে মহর্ষি ব্রাহ্মধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করেন। এবং ঠাকুর পরিবারে তা চর্চারও বিষয় হয়ে ওঠে। সত্যেন্দ্রনাথ ‘বৌদ্ধধর্ম’ নামে একটি বই লেখেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ লেখেন ‘আর্যধর্ম্ম এবং বৌদ্ধধর্ম্মের পরস্পর ঘাত-প্রতিঘাত ও সংঘাত’। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে গিয়ে প্রখ্যাত ভারতত্ত্ববিদ ম্যাক্সমুলারের সংস্পর্শে পৌঁছে এই বিষয়ে আরও সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন।  অতএব রবীন্দ্রনাথের সমগ্রসত্তা বুদ্ধের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণটি সহজেই অনুমেয়। বুদ্ধের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধামিশ্রিত কৌতূহল জাগিয়েছিলেন আর একজন—ইংরেজ কবি এডুইন আর্নল্ড। আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ কাব্যগ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ ও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাধনায় এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে বুদ্ধগয়াতেও আর্নল্ডের বইটি নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

কবি একবার নয়, অন্তত দু’বার বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন। ১৯০৪ এবং ১৯১৪ সালে। প্রথমবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র, ভগিনী নিবেদিতা, ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার-সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরা একত্রে বসে আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ এবং হার্ভার্ডের প্রাচ্যবিশারদ হেনরি ক্লার্ক ওয়ারেনের ‘বুদ্ধিজম’ বই থেকে অংশবিশেষ পড়ে আলোচনা করতেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গোঁসাইজিকে উদ্ধৃত করে অধ্যাপক সুধাংশুবিমল বড়ুয়া লিখেছেন, ‘এবার (১৯০৪) বুদ্ধগয়া থেকে আসার পর রবীন্দ্রনাথ মস্তক মুণ্ডন করেছিলেন। তখন কবির মনে নাকি বৈরাগ্যের সঞ্চার হয়েছিল।’ কবি দ্বিতীয়বার বুদ্ধগয়ায় গিয়ে তিনদিনে দশটি গান লিখেছিলেন—যেগুলিতে ভগবান বুদ্ধের প্রতি অনুরাগ প্রচ্ছন্ন। 

কবি কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার উচ্চারণ করেছেন, অমেয় প্রেমের মন্ত্র ‘বুদ্ধের শরণ লইলাম’।

রবীন্দ্রসাহিত্যে গৌতম বুদ্ধ, বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধআখ্যান এসেছে নানাভাবে। নাটকে, কবিতায় ও প্রবন্ধে বুদ্ধ প্রসঙ্গের অবতারণা ব্যাপক হলেও উপন্যাস এবং ছোটগল্পে সরাসরি বুদ্ধপ্রসঙ্গ নেই বললেই চলে। নাটকে আমরা দেখতে পাই ১০টি নাটকে বৌদ্ধআখ্যান রয়েছে। মালিনী (১৮৯৬), রাজা (১৯১০), অচলায়তন (১৯১২), গুরু (১৯১৮), অরূপরতন (১৯২০), নটীর পূজা (১৯২৬), চন্ডালিকা (১৯৩৩), নৃত্যনাট্য চন্ডালিকা (১৯৩৮), শাপমোচন (১৯৩১) নাটকে বৌদ্ধআখ্যান রয়েছে। তবে শাপমোচনকে কেউ কেউ নাটক না বলে ‘কথিকা’ বলতে চান। এই ১০টি নাটক ছাড়াও ‘শোধবোধ’ নাটকে প্রাসঙ্গিক উক্তি ও সংলাপে বৌদ্ধপ্রসঙ্গ রয়েছে।

তাঁর সাহিত্যের গভীরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে অতি সহজেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বুদ্ধের জীবন এবং দর্শন কবিকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এর ফলে গান, নাটক এবং গীতিনাট্যের মূল উপাদান বুদ্ধের অতীত জন্মের ‘জাতক’ কথা এবং বুদ্ধের আলোকিত জীবনাদর্শের বিভিন্ন দিক কবিগুরুর অলোকসামান্য প্রতিভার গুণে তাঁর সাহিত্যকে পরিস্ফুটিত করেছে। আলোচ্য প্রবন্ধে তারই কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে চাই। প্রথমেই বুদ্ধের অতীত জীবন-বোধিসত্ত জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবহুল কাহিনি ‘জাতক’ মালা উপাখ্যানের ওপর ভিত্তি করে রচিত গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্য বিষয়ে দৃকপাত করা যাক। লেখার শুরুতে ‘জাতক’ গ্রন্থ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : ‘জাতকের বাংলা অনুবাদ পরলোকগত ঈশানচন্দ্র ঘোষ মহাশয়ের একটি আশ্চর্য কীর্তি। …এই অসামান্য উদ্যোগে লেখক বাংলা পাঠকদের নিকট চিরস্মরণীয় হইয়া রহিলেন। এই গ্রন্থখানি অনুশীলন করিয়া অনেক উপকার পাইতেছি; সেইজন্যেও অনুবাদকের নিকট আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ।’ গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্মসমূহের বৃত্তান্ত সংবলিত, ফৌসবোল সম্পাদিত জাতকার্থবর্ণনা নামক মূল পালিগ্রন্থ থেকে ঈশানচন্দ্রকৃত বাংলা অনুবাদের এই মূল্যায়ন এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনার্থে এই উক্তি করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। এবার নাটকগুলির আলোচনায় আসা যাক।যদিও আলোচনার বিস্তার বৃহৎ তবে ক্ষুদ্র পরিসরে যতটুকু সম্ভব তারই প্রচেষ্টা মাত্র।



মালিনী (১৮৯৬)

বৌদ্ধআখ্যান নিয়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটকের নাম ‘মালিনী’। নাটকের সূচনায় এর রচনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি লিখেছেন,

‘মালিনী নাটিকার উৎপত্তির একটা বিশেষ ইতিহাস আছে, সে স্বপ্নঘটিত। কবিকঙ্কণকে দেবী স্বপ্নে আদেশ করেছিলেন তাঁর গুণকীর্তন করতে। আমার স্বপ্নে দেবীর আবির্ভাব ছিল না, ছিল হঠাৎ মনের একটা গভীর আত্মপ্রকাশ ঘুমন্ত বুদ্ধির সুযোগ নিয়ে।

তখন ছিলুম লন্ডনে। নিমন্ত্রণ ছিল প্রিমরোজ হিলে তারক পালিতের বাসায়। প্রবাসী বাঙালিদের প্রায়ই সেখানে হত জটলা, আর তার সঙ্গে চলত ভোজ। গোলেমালে রাত হয়ে গেল। যাঁদের বাড়িতে ছিলুম, অত রাত্রে দরজার ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে হঠাৎ চমক লাগিয়ে দিলে গৃহস্থ সেটাকে দুঃসহ বলেই গণ্য করতেন; তাই পালিত সাহেবের অনুরোধে তাঁর ওখানেই রাত্রিযাপন স্বীকার করে নিলুম। বিছানায় যখন শুলুম তখনো চলছে কলরবের অন্তিম পর্ব, আমার ঘুম ছিল আবিল হয়ে।

এমন সময় স্বপ্ন দেখলুম, যেন আমার সামনে একটা নাটকের অভিনয় হচ্ছে। বিষয়টা একটা বিদ্রোহের চক্রান্ত। দুই বন্ধুর মধ্যে এক বন্ধু কর্তব্যবোধে সেটা ফাঁস করে দিয়েছেন রাজার কাছে। বিদ্রোহী বন্দি হয়ে এলেন রাজার সামনে। মৃত্যুর পূর্বে তাঁর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করবার জন্যে তাঁর বন্ধুকে যেই তাঁর কাছে এনে দেওয়া হল দুই হাতের শিকল তাঁর মাথায় মেরে বন্ধুকে দিলেন ভূমিসাৎ করে।

জেগে উঠে যেটা আমাকে আশ্চর্য ঠেকল সেটা হচ্ছে এই যে, আমার মনের একভাগ নিশ্চেষ্ট শ্রোতামাত্র, অন্যভাগ বুনে চলেছে একখানা নাটক। স্পষ্ট হোক অস্পষ্ট হোক একটা কথাবার্তার ধারা গল্পকে বহন করে চলেছিল। জেগে উঠে সে আমি মনে আনতে পারলুম না। পালিত সাহেবকে মনের ক্রিয়ার এই বিস্ময়করতা জানিয়েছিলুম। তিনি এটাতে বিশেষ কোনো ঔৎসুক্য বোধ করলেন না।

কিন্তু অনেক কাল এই স্বপ্ন আমার জাগ্রত মনের মধ্যে সঞ্চরণ করেছে। অবশেষে অনেক দিন পরে এই স্বপ্নের স্মৃতি নাটিকার আকার নিয়ে শান্ত হল।'

স্বপ্নে-পাওয়া এই গল্পের সঙ্গে যুক্ত হল মহাবস্তু-অবদানের আখ্যান। গৌতম বুদ্ধ যেমন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, মালিনীও তেমনি। মালিনীর চরিত্রের মধ্যে বুদ্ধের আদর্শ বিশেষত ক্ষমার বাণী প্রকাশ পেয়েছে এই নাটকে। মূর্ছা যাওয়ার আগে মালিনীর শেষ সংলাপ ‘ক্ষম ক্ষেমংকরে’ বলে ক্ষমার চরম পাঠ প্রকাশিত। যে ক্ষেমংকর একটু আগেই ধর্মপ্রাণ সুপ্রিয়কে বধ করেছে, তাকেও মালিনী ক্ষমতা করে দেয়। এই তো বুদ্ধের আদর্শ। মালিনী নাটকে ব্রাহ্মণ্যবাদকে যেমন আঘাত করা হয়েছে, তেমনি বৌদ্ধ আদর্শকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। বৌদ্ধ আখ্যানকে অবলম্বন করে লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম নাটক এই ‘মালিনী’।

১৯১০সালে রাজা’ নাটক প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। নাটকের প্লটটিতে বারবার তুলি বুলিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ এবং ১৯২১ সালে ‘রাজা’ নাটকের দুটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালে প্রকাশ পায় ‘অরূপরতন’ এবং ১৯৩১-এ ‘শাপমোচন’। প্লট কিন্তু একই। ‘রাজা’ নাটকের অন্তরালে  জাতকের গল্পের অনুপ্রেরণার কথা বেশিরভাগ সমালোচকই মেনে নিয়েছিলেন। রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal'-এ রাজপুত্র কুশের দুটি গল্প ছিল। একটি 'Kusa Jatak' এবং অপরটি মহাবস্তু অবদানের 'The Story of Kusa'। রবিজীবনী রচয়িতা প্রশান্তকুমার পাল খুব জোরের সঙ্গেই জানিয়েছিলেন 'The Story of Kusa' অবলম্বনে ‘রাজা’ নাটক রচিত হল। এই উপাখ্যানটি রাজেন্দ্রলাল সম্পাদিত গ্রন্থে ১৪২ থেকে ১৪৪ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রবীন্দ্রনাথের সংগ্রহে যে বইটি ছিল, সেটির ১৪৪ পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের হস্তাক্ষরে ‘রাজা’ শব্দটি খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়া, ১৯৩১ সালে রচিত ‘শাপমোচন’ প্রসঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যে বৌদ্ধ আখ্যান অবলম্বন করে রাজা নাটক রচিত তারই আভাসে শাপমোচন কথিকাটি রচনা করা হল।’ 'The Story of Kusa'-তেও কুশরাজার রাণীর নাম সুদর্শনা। তাদের মিলনও অন্ধকারের রহস্যময়তায় আবৃত ছিল। রাজার কদাকার রূপ, সুদর্শনার গৃহত্যাগ, বিপর্যয়, ইন্দ্রের আশীর্বাদে রাজার রূপবান হওয়া এবং রাজা রাণীর মিলন— এই হল কুশজাতকের গল্প। ‘রাজা’ নাটকে অন্ধকার রহস্যময়তার মধ্যে রাজা রানির মিলন, রাজাকে দুর্ভেদ্য অন্ধকারের ওপারে আলোর পৃথিবীতে খুঁজতে গিয়ে সুদর্শনা ভুল করে। তারপর হৃদয়ের অগ্নিদহনে শুদ্ধ হয় সুদর্শনা। রাজা তাকে রূপে নয়, ভালোবাসায় ভুলিয়ে প্রশান্তি দেয়। 


অচলায়তন (১৯১২) ও গুরু (১৯১৮)

এর আখ্যান নেওয়া হয়েছে দিব্যাবদানমালার চূড়াপক্ষাবদানের পঞ্চক-কাহিনি থেকে। এখানেও ব্রাহ্মণ্যবাদের সংকীর্ণতার কথা বলা হয়েছে। 


চণ্ডালিকা : 

নাটকের ঘটনাস্থল শ্রাবস্তী। তখন তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্তীর অনাথপিণ্ডক শ্রেষ্ঠী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। একদিন রৌদ্রতাপদগ্ধ দিনে বুদ্ধের প্রিয় সেবক শিষ্য আনন্দ এক গৃহস্থ বাড়িতে পিণ্ড গ্রহণ করে বিহারে ফিরছিলেন। এই সময় তাঁর বড় জল পিপাসা পেল। তিনি দেখলেন, একটি চণ্ডালকন্যা ইদারা থেকে জল তুলছে। তার নাম প্রকৃতি। আনন্দ তার কাছে তৃষ্ণা নিবারণার্থে জল চাইলেন।

মেয়েটি বলল, ‘ক্ষমা করো প্রভু, আমি চণ্ডালকন্যা-তোমারে জল দিতে পারি হেন পুণ্যের অধিকারী আমি নই।’ আনন্দ বললেন, ‘আমি যে মানব, সেই মানব তুমি কন্যা, তৃষ্ণার্তকে জলদানে কোনো অন্যায়-অপবিত্র নয়।’ প্রকৃতি হৃষ্টচিত্তে আনন্দকে জলদান করল। আনন্দ গণ্ডূষ ভরে জলপান করে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী।’ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর এই আশীর্বাদমন্ত্রে প্রকৃতির অন্তর-আত্মায় এক অনির্বচনীয় প্রশান্তি করুণার স্রোতধারা প্রবাহিত হল। পরবর্তীতে প্রকৃতি বৌদ্ধধর্মের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জাতপাতের ঘৃণ্য প্রথার জন্মান্তরের অভিশাপ থেকে মুক্ত হলো। মহাকারুণিক বুদ্ধ বিশ্বের সকল প্রকার বর্ণবৈষম্যের ঊর্ধ্বে, সমগ্র মানবজাতিকে এক অখণ্ড জাতিতে পরিণত করতে চেয়েছেন। কবিগুরু চণ্ডালিকা নাটকে অন্ধ সংস্কার, অস্পৃশ্যতা বর্জনের মানবিক ব্যাখ্যা করে বৌদ্ধধর্মের সাম্য-মৈত্রী-করুণার আদর্শে মানুষের মানবিক সত্তার বিজয় ঘোষণা করেছেন।


শ্যামা : বুদ্ধের অতীত জন্মের কাহিনি-‘কণবের-জাতক’-এ বর্ণিত এক গণিকা নিজের প্রণয়ীর জীবনের পরিবর্তে এক দস্যুর জীবন রক্ষা করে। পরে তার প্রেমে মত্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে সেই গণিকা-প্রেমিক দস্যুর হাতে মিথ্যে প্রলোভনের সমুচিত দণ্ড পেয়েছিল। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের গ্রন্থে মহাবস্তু-অবদানে শ্যামা জাতকের যে কাহিনি আছে, সেই কাহিনি অবলম্বনে ‘পরিশোধ’ কবিতা এবং পরবর্তীকালে তার পল্লবিত নাট্যরূপ ‘শ্যামা’ রচিত হয় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায় আছে, বজ্রসেন তক্ষশীলার বণিক। বাণিজ্যের জন্য বারানসীতে আসছিলেন; পথে দস্যু কর্তৃক লুণ্ঠিত হন। অতঃপর এক গৃহে আশ্রয় নেন। সেই রাত্রেই রাজকোষাগারে চুরি সংঘটিত হয়। বজ্রসেন তস্কররূপে ধৃত হন। রাজার আদেশে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার সময় গণিকা শ্যামা তাকে দেখে মুগ্ধ ও প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে। রাজপুরুষদের স্পর্শদান ও অপরাধীর বিনিময়ে অন্য পুরুষকে প্রেরণের অঙ্গীকারে বজ্রসেনকে মুক্ত করে তার সঙ্গে প্রেমাভিসারে লিপ্ত হতে থাকে। একদিন বজ্রসেন শ্যামাকে তার মুক্তির বিশদ বিবরণ বর্ণনা করতে বললে শ্যামা তা অকপটে তার অপকৌশলের কথা বর্ণনা করে। বজ্রসেনের মনে প্রচণ্ড রাগ, দুঃখ, ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে বজ্রসেন শ্যামাকে পরিত্যাগ করে বহুদূরে চলে যায়। লোভ-লালসা-ভোগের টানাপড়েনে নাটকে অন্তিম পর্বে শ্যামার প্রেম, বজ্রসেনের ক্ষমাহীনতাকে অতিক্রম করে এক করুণ রসের সৃষ্টি করে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট বজ্রসেনের অনিন্দ্যসুন্দর কান্তির অন্তরালে তার শুদ্ধসত্ত্বেরও পরিচয় পাই আমরা। তার প্রেমানুগ কুশলে স্থিত থাকার মানসিক দৃঢ়তা থেকে কখনো নিজেকে বিচ্যুত করেননি, পাপের মূল্যে কোনো লাভই তার কাক্সিক্ষত নয়। নাটকের অন্তভাগে বজ্রসেনের পরিতাপ সেটি শ্যামার বিচ্ছেদজনিত কারণে নয়, বরং বিপদগামিনী সেই ভাগ্যবিড়ম্বিতা অসহায় নারীকে কল্যাণের পথ চিনিয়ে দিতে না পারার অক্ষমতার গ্লানি তাকে বারবার ব্যথিত করেছে।


শাপমোচন : নাটকটি রচিত হয় ১৯৩১ সালে কবিগুরুর ৭০ বছরের জন্মজয়ন্তী উৎসব উপলক্ষে। জাতক মালার ‘কুশ জাতক’ এর কাহিনিতে বর্ণিত মল্লরাজ্যের রাজধানী কুশাবতী নগরে ইক্ষাকু নামক এক অপুত্রক রাজা রাজত্ব করতেন, পরবর্তীতে দেবতার বরপ্রাপ্ত হয়ে অগ্রমহিষী অভিনব উপায়ে জমজ পুত্রলাভ করলেন। তাদের একজন অতি কুৎসিত এবং গুণবান ছিলেন। জন্মসূত্রে রাজপুত্র অভিশাপভ্রষ্ট হলেও দেবতার অনুগ্রহে ‘কোকনদ বীণা’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অপরজন খুবই সুশ্রী-রূপবান কিন্তু অতিশয় নির্বুদ্ধি ও অলস প্রকৃতির ছিলেন। পরবর্তীতে কুশ্রী রাজপুত্র অরুণেশ্বর দেবতার বরে অভিশাপমুক্ত হয়ে স্বীয় স্ত্রী কমলিকার সান্নিধ্য লাভ করে গান্ধারে রাজত্ব করতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথ কুশ জাতক থেকে রাজার কুৎসিত কদাকার রাজপুত্রের জীবনপ্রবাহের উজ্জ্বলতম সুন্দর নান্দনিক দিক উন্মোচিত করে এই নাটকে আখ্যানভাগে তার পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন। বিরহ-বিচ্ছেদের কৃষ্ণপক্ষের কালো অধ্যায় অতিক্রম করে মিলনের অমৃত সুধায় অরুণেশ্বর এবং কমলিকার বৈচিত্র্যময় জীবন আকীর্ণ করেছেন। মানুষ যখন তার সকল বিভ্রান্তিকে নিরসন করে চিত্তপ্রবৃত্তি অন্তর্মুখী হয়ে জ্ঞান চক্ষু উন্মূলিত হয়, তখন তার জীবনে পরম প্রাপ্তির সিংহদ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। অতীত জন্মের কৃত অভিশাপমুক্ত হয়ে নতুন আলোর সন্ধান পায়।


নটীর পূজা : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধযুগের পালি সাহিত্য ও পরবর্তীকালের অনূদিত সংস্কৃত গ্রন্থ অবদান শতক থেকে উপাদান গ্রহণ করে পূজারিণী কবিতার ভাব অলম্বনে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে লিখলেন নাটক ‘নটীর পূজা’। এই নাটকে বৌদ্ধযুগের প্রাচীন ঐতিহাসিক বিবরণ ও তাৎপর্য নিম্নরূপ :

মগধরাজ বিম্বিসার বৈদিক ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করলেন। মহারানি লোকেশ্বরীও স্বামীর অনুগামিনী হলেন। বৌদ্ধধর্মের নীতি ও আদর্শ রাজা-রানি উভয়কে নির্লোভ, ক্ষমাশীল, বিষয়-বাসনার প্রতি অনাসক্ততা, বৌদ্ধধর্মের প্রতি অতলান্ত গভীর শ্রদ্ধায় আপ্লুত করে তুলল। এই সময় রাজপুত্র অজাতশত্রু বুদ্ধবিদ্বেষী দেবদত্তের প্ররোচনায় কূটকৌশলে পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করে নিজেকে মগধরাজ হিসেবে দাবি করে বসলেন। অতঃপর রাজাকে বন্দী করে কারান্তরালে অন্তরীণ করে রাখলেন। রাজ্যময় ঘোষণা জারি করা হলো, এখন থেকে রাজ্যের কেউ বুদ্ধের উপাসনা বা পূজা করতে পারবে না। আদেশ অমান্যকারীকে নির্বাসন অথবা শূলে চড়ানো হবে। রাজার আদেশে সকলে ভয়ে তটস্থ হয়ে রইল। রাজনর্তকী শ্রীমতী নাম্নী এক দাসী বুদ্ধের অমৃত ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে বুদ্ধের পূজা করত। শ্রীমতী রাজাদেশ অমান্য করে সকাল-সন্ধ্যায় তরুমূলে পুষ্প-প্রদীপ-ধুপ-চন্দনে পূজার অর্ঘ্য নিবেদনে নৈবেদ্য সাজিয়ে বুদ্ধের চরণতলে শ্রদ্ধা নিবেদন করত। একদিন রাজাদেশ অমান্যের ফলে ঘাতকের তরবারির আঘাতে শ্রীমতীর শিরচ্ছেদ করা হলো। খণ্ডিত রক্তমাখা মস্তক পাষানবেদিতে পড়ে রইল। এভাবে রাজনর্তকী শ্রীমতী করুণাঘন বুদ্ধের পূজা করতে গিয়ে করুণভাবে আত্মাহুতি দিল। তাতে দান-পরমার্থপারমী পূরণ করে বলিষ্ঠ হেতুপ্রত্যয় সঞ্চয় করে পরম শান্তির সংস্কার উপার্জন করল রাজনটী শ্রীমতী। এই বলে কবিগুরু কাব্যের যবনিকা টানলেন :


‘সেদিন শুভ্র পাষাণ ফলকে পড়িল রক্তলিখা

সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে

প্রাসাদ কাননে নীরবে নিভৃতে

স্তূপ পদমূলে নিভিল চকিতে শেষ আরতির শিখা।’


নাট্যবিশেষজ্ঞ বিপ্লব বালার মতে,  ‘দাসত্ব-মান্যতা-অন্যায়-অসত্য-সাধারণ মানুষের অনুভূতি-জীবনাচরণ এসবই রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রধানতম উপকরণ। রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, সত্য কাজ ব্যক্তিকেই করতে হয় এবং সত্য ছাড়া ধর্ম নিষ্প্রাণ। উপমহাদেশে যত বড় বড় ধর্ম এসেছে সব ধর্মকেই রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন অতি সহজভাবে। তাই তো তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন, তার সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের একটি বড় ভার। তিনি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের নন, তার ধর্ম সামগ্রিক। ’


শেষ করব রবিঠাকুরেরই নটীর পূজা নাটকের সংলাপ দিয়ে ...

রক্ষিণী। শ্রীমতী তো পূজার মন্ত্র পড়েনি।

শ্রীমতী। (জানু পাতিয়া) বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি-

রক্ষিণী। (শ্রীমতীর মুখে হাত দিয়া) থাম্ থাম্ দুঃসাহসিকা, এখনো থাম্।

রত্নাবলী। রাজার আদেশ পালন করো।

শ্রীমতী। বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি-

কিংকরীগণ। সর্বনাশ করিসনে শ্রীমতী, থাম্ থাম্।

রক্ষিণী। যাসনে মরণের মুখে উন্মত্তা।

দ্বিতীয় রক্ষিণী। আমি করজোড়ে মিনতি করছি আমাদের উপর দয়া করে ক্ষান্ত হ।

কিংকরীগণ। চক্ষে দেখতে পারব না, দেখতে পারব না, পালাই আমরা।

(পলায়ন)


রত্নবলী। রাজার আদেশ পালন করো।

শ্রীমতী।  বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি

সংঘং সরণং গচ্ছামি।

লোকেশ্বরী।   (জানু পাতিয়া সঙ্গে সঙ্গে)


বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি

ধম্মং সরণং গচ্ছামি

সংঘং সরণং গচ্ছামি।


তথ্য ঋণ ও কৃতজ্ঞতা: 


রবীন্দ্রনাথের বুদ্ধচর্চা - সম্পাদনা হেমেন্দ্র বিকাশ চৌধুরী

বাংলা সাহিত্য পত্রিকা ( ষোড়শ সংখ্যা ) , ২৫ শে বৈশাখ, ১৪২২ - রবীন্দ্র নাটকে বৌদ্ধ আখ্যান, কল্যাণী শঙ্কর ঘটক, পৃ: ৪১৫

রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধআখ্যান- তপন বাগচী

বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতি - ডঃ আশা দাস, ক্যালকাটা বুক হাউস, পৃ: ৫৩১-৬২৪

আনন্দবাজার পত্রিকা


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য