অসিত মন্ডল

ফেরা
........

              ১.

বেলাশেষের মরা আলোর রেশ এখনও কিছুটা লেগে রয়েছে গাছ গাছালির পাতায় পাতায়। অলস ছাদের কার্নিশে।সন্ধ্যা নামার একটু আগে পাড়াটা কেমন থমথমে,  ঝিম ধরা। কমবয়েসী ছেলেরা এখন জটলা পাকিয়ে পথের পাশে আড্ডা মারে না।বাস থেকে নেমে গলির মুখে নারানের চায়ের দোকানে তর্ক বিতর্ক, হাসি ঠাট্টার ফোয়ারা ছোটে না।দুজন রিটায়ার্ড মানুষ প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের স্থির চিত্র হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্য পানে।দু চারজন উঠতি যুবক মুখ গুঁজে আছে মোবাইল স্ক্রিনে।
ছোটবেলার সেই প্রাণ চঞ্চল পাড়াটা কেমন দ্রুত পাল্টে গেল।চেনা পাড়াটাকে অচেনা মনে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির গেটে এসে পৌঁছুলো অমলকান্তি।
জামা কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখে সে।অফিসের সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদ প্রাণপনে মুছে ফেলার চেষ্টা করে।
আদ্যিকালের পুরনো টি টেবলে চায়ের কাপ রাখে তৃণা। নিজের কাপটা হাতে নিয়েই আলপটকা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় --
'কিছু কি ঠিক করলে? সুমিতদার সাথে কথা হল? '
প্রত্যাশিত প্রশ্নটার জন্য অমলের মানসিক প্রস্তুতি ছিল।তবু ব্যাডমিন্টন কোর্টে অপোনেন্ট খেলোয়াড়ের কাছ থেকে দ্রুত ছুটে আসা সার্ভ আলতো স্ট্রোকে সামলানোর চেষ্টা করল সে। ছদ্ম উদাসীনতার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় সুন্দরী ব্রেকিং নিউজ পাঠিকার চোখে চোখ রেখে বলল ---
'কি সব হচ্ছে চারিদিকে! ভাবা যায়! '
ঘটনাস্থল থেকে একজন রিপোর্টার সীমাহীন উদ্বেগ মিশিয়ে নাটকীয় স্টাইলে বলে চলেছে --
'একজন শিক্ষিত মানুষ, কলেজের অধ্যাপক, তাঁর বৃদ্ধ বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার এই ঘটনা এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় অসহায় বৃদ্ধ পথে রাত কাটাতে বাধ্য হয়েছেন।এলাকার প্রাতঃভ্রমনকারীরা প্রায় অচেতন অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে ....'

টি.ভি.র রিমোটটা ছোঁ মেরে তুলে নেয় তৃণা --

'উঃ ছাড়ো তো! যত্তসব! ওসব আমার জানা আছে। দেখগে সিমপ্যাথি ক্রিয়েট করার জন্য ও বুড়ো হয়তো নিজেই বাড়ির থেকে বেড়িয়ে গিয়ে ...আচ্ছা সুমিতদাকে কি ফোন করেছিলে? '

এবার অমলকে প্রসঙ্গে ঢুকতেই হয়।

'ও ট্যুরের কথা? হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার সুমিতদাই ফোন করেছিল।সব ফাইনাল করে কাল জানাবে।'
'তোমার সুমিতদা শব্দবন্ধের কটাক্ষটা তৃণা গায়ে মাখল না।তার মেয়েবেলার প্রাইভেট টিউটর। তা ওই বয়সে একটু আধটু প্রেম আবার কার না হয়! এক অাধবার চুমু চাপাটি, এক আধদিন লোডশেডিং অন্ধকার -- এই তো। বছর দুয়েক হল ফেসবুকের সৌজন্যে তৃণা তার সুমিতদাকে খুঁজে পেয়েছে হঠাৎ একদিন।
'শোন তোমাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। এবার যদি অফিসের বাহানা দেখিয়ে কেঁচিয়ে দাও না! '
তৃণায় কথায় রীতিমতো হুমকির সুর।
বছর চারেক হল বিয়ে হয়েছে ওদের।অমলের স্পার্ম কাউন্ট মারাত্মক কম থাকায় তৃণার কোল এখনও শূণ্য। হানিমুন ট্রিপের ঠিক আগের দিন অমলের মা সরমার ম্যাসিভ হার্ট আটাক হয়। নার্সিং হোম, অপারেশন, পেস মেকার -- এসব করে মাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনে অমল ।মাকে একা রেখে অমল কোথাও বেড়াতে যেতে পারে নি।প্রতিবারেই লোকদেখানো উদ্যোগ নিয়ে অফিসের মনগড়া বাহানায় ক্যানসেল করেছে।
টি.ভি. স্ক্রিনে এখন প্রচন্ড ক্রাইসিস। 'ত্রিকোণ ' সিরিয়ালের সুপর্ণার হাসব্যান্ড অতনু তার অফিস কলিগ - কাম -প্রেমিকা চৈতিকে আজই রেজিস্ট্রি বিয়ে করবে বলে বাড়ি থেকে চলে গেছে। সুপর্ণার জন্য একটু কষ্ট হলেও, চৈতিকেই বেশী পছন্দ করে তৃণা। নিজেকে চৈতি ভাবতেও বেশ লাগে তার।

দোতলায় একখানা মাত্র ঘর। তার সাথে লাগোয়া একচিলতে রান্নাঘর, পায়খানা -স্নানঘর। চওড়া প্যারাপেটে ঘেরা ছাদ।পুরনো আমলের কড়িকাঠ। মোটা দেওয়াল। আলো বাতাসের প্রবেশ সীমিত। প্যারাপেটে ঘেরা ছাদের কার্নিশে অবলীলায় বাড়ে বট অশথের চারা।তাদের শেকড় চারিয়ে যায় দুর্বল হয়ে আসা চূণ সুড়কি গাঁথনির ভেতর। বাড়ির পেছনদিকে একফালি জমিতে  জটলা পাকিয়ে কোনরকমে বেঁচে বর্তে আছে তার বাবার আমলের নারকেল সুপারি আম কাঁঠালের প্রাচীন একান্নবর্তী পরিবার।শ্যাওলা ধরা কালচে দেওয়াল ঘেঁষে উঠে আসা বুড়ো নিম গাছটা পাতাভরা ডালপালা নিয়ে ছাদে উঠে এসেছে। মৃদু মন্দ হিমেল বাতাসে ঝিরি ঝিরি কাঁপে চিকন সবুজ পাতারা।টুপ টাপিস করে ঝরে পড়ে টোপা টোপা নিম ফল।

স্মৃতির ভারে পুরোনো বাড়িটার মতই ভারাক্রান্ত, ন্যুব্জ  সরমা।ভরসন্ধেবেলায় কালচে পালিশের লতা পাতা ডিজাইনের নড়বড়ে খাটের এক কোণে দেওয়ালে পিঠ রেখে বসে আছে সে।ঘরে একখানা সাদামাটা কাঠের আলমারি। একটা ঠাকুরের সিংহাসন। তাতে ঠাসাঠাসি করে রাখা সিঁদুর চন্দন লেপা  ছোট ছোট বাঁধানো ঠাকুরের ছবি ।কোনটা যে কি ঠাকুর চেনা দায়।একটু বিশেষ যত্নে জরির কাপড়ে মোড়া গোপাল। ছোট রেকাবে নকুলদানা। গ্লাসে জল।ছড়ানো সকালের কিছু নেতানো ফুল।দেওয়ালে সেট করা একটা আয়না।ছোট  টেবিলে একটা ২০ ইঞ্চি টি.ভি.।
এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসা ইস্তক তিল তিল করে গড়ে তোলা তার ভরপুর সংসার ক্রমশ ছোট হতে হতে এই এক চিলতে ঘরে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।
মায়ের এই একান্ত নিভৃতবাসে ছেলের রুটিনমাফিক আসা।রোজকার।
এঘরে সিরিয়ালের কূটকাচালি নেই। সুরমা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে গভীর অরণ্য, নদী পাহাড়, দেশ বিদেশের  জনজাতি ও জীব জন্তুর বিচিত্র জীবন দেখে।
বেশ সময় কেটে যায় সুরমার।
'আয় অমু, বোস। '
সন্ধ্যার মিহি বাতাসের মত মায়ের এই স্নিগ্ধা কথাটুকুর
অমল সারাদিন অপেক্ষায় থাকে। মায়ের কাছে আসলেই সে নতুন করে যেন প্রাণ ফিরে পায়।
'হ্যাঁ, মা কেমন আছো? আজ দাঁতের ব্যথা নেই তো? '
সারাটা ঘর জুড়ে আবাল্য -লালিত মায়ের চেনা গন্ধ। অমল সেই ছোট্ট শিশুটি হয়ে মায়ের কোল আঁকড়ে ধরতে চায়। সে অনুভব করে জন্ম মুহূর্তে নাড়িকাটা বলে কিছু হয় না। সন্তান মায়ের তার মায়ের সাথে অদ্ভুত এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে জুড়ে থাকে আজীবন। কোন দিন, এমন কি মৃত্যুর পরেও তা অক্ষুণ্ণ থাকে। ছাদের কার্নিশে বেড়ে ওঠা সবুজ রোদ ঝলমলে বট চারাটাকে উপড়াতে পারে না সে। চূণখসা দেওয়ালে চারিয়ে যাওয়া তার শেকড়ে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে অমল।
মায়ের কোল ঘেঁষে বসে।
'হ্যাঁ, বাবা কম আছে।'
অমল টেবিলে ওষুধের স্ট্রিপ দেখে। মায়ের সুগার প্রেশার হার্টের ওষুধ।
টি.ভি.তে একটা ভীত সন্ত্রস্ত মা হরিণী। করুণ ভয়ার্ত চোখে সবুজ ঘাসের মধ্যে থেকে উঁকি মারছে। পাশেই তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে তার নরম তুলতুলে শাবক।বাতাসে হিংস্র শ্বাপদের গন্ধে মে আতঙ্কে উদ্বেল, দিশেহারা। পরম মমতায় ছানাটাকে নিয়ে অতি সন্তর্পণে লুকিয়ে পড়ে ঘন সবুজ ঘাসের অন্তরালে।
মাথার ওপর একনাগাড়ে কট্টরর কট্টরর শব্দে ঘুরে চলেছে পুরনো সিলিং ফ্যান।
সরমা হঠাৎ বলে ওঠে --
'বাবা, অমু, আমার একটা কথা শোন। আমার জন্য তোরা কোথাও বেড়াতে গেলি না। বৌমার কথাটাও ভাব। বেচারা সারাদিন মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। এবার অন্ততঃ ট্যুরটা ছল ছুতোয় এড়িয়ে যাস না। '
অমল অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কি করে বুঝে গেল মা সব। অমল এবার ঠিক করেছিল একবার মায়ের থেকে দূরে গিয়ে পরীক্ষা করেই দেখবে। মাকে ছেড়ে থাকতে ওর কতখানি কষ্ট হয়।এ অভিজ্ঞতা তো তার হয়নি  কখনও। কেন যে অন্তর্মুখী মনের অন্তঃসলিলা অতলে এমন এক অদ্ভুত ভাবনা তাকে পেয়ে বসল কে জানে! নাকি তৃণার প্রতি এতদিনের স্বেচ্ছারোপিত ব্যাবধানের কিঞ্চিৎ প্রায়শ্চিত্ত করতে চায়। নাকি চেনা গন্ডীর লক্ষণরেখা পেরিয়ে নিজেকেই একটু বুঝে নিতে চায়। কে জানে!
সকালে ঠিকে ঝি চম্পার মার কাছে সই শুনেছে সরমা --
'হ্যাঁ গো বড়মা। বৌদি বোলতেছেল, ওরা নাকি কোন পাহাড়ের গেরামে যাবে বেড়াতি। ওই যে, বৌদির সেই দাদা না কি, ওদের সঙে।এবার নাকি কোন কতা শোনবেনেকো। আমারেও ছুটি দেবে কদিন। '
চম্পার মা বলেছে।
মুখ নীচু ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে, চুলে বিলি কেটে দেয় সুরমা। বলে --
'বাবা, অমু, আমাকেও কদিন আমার মত থাকতে দে না। আমিও দেখি না পারি কিনা।আর তুই আছিস বাবা, সবসময় আমার কাছে।সন্তান কখনও মায়ের কোল ছাড়া হয় না রে। সে তুই যত দূরেই যাস। দেখবি আমি সবসময় তোর পাশে পাশেই থাকব। তুই একদম চিন্তা করিস না। '

নিম গাছের  প্যাঁচাটা কেমন যেন আজ ককিয়ে উঠল তার কোন অব্যাক্ত যন্ত্রণায়। নিথর অন্ধকারের বুক ফালা ফালা করে চিরে।

                ২.

কালিম্পং থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার ভেতরে এক ছোট্ট পাহাড়ী গাঁও। বন পাহাড়ের খাঁজে কয়েকঘর মানুষের বাস। একটাই মাত্র হোম স্টে। "The Retreat ".আসলে এটা এক বৃটিশ টি কোম্পানির কোন এক ইংরেজ ম্যানেজারের পরিত্যক্ত বাংলো। চারিদিকে অদ্ভুত ঝিম ধরা নীরবতা। মৃদু মন্দ হিমেল হাওয়ায় পাইন গাছের চিরুনি চিকন পাতায় নিরন্তর মিঠে খুনসুটি। সবুজে সবুজ। অনেক দূরে গাঢ় নীল আকাশের প্রেক্ষাপটে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘার আলতো আভাস।
এসেই কাছে পিঠে কোথাও হাঁটতে গেছে তৃণা, সুমিত, তার বৌ করবী, ছেলে বুকুন।
হঠাৎ মুক্তি পাওয়া কোন হরিণীরই মত চঞ্চল, আগলখোলা তৃণা আজ।
অনেক অসম্ভবের পায়ে মাথা কূটে পাওয়া এইকটাদিনের এক মুহূর্তও নষ্ট করতে চায় না সে। সাপ লুডো পাহাড়ী পথের কোন এক নির্জন বাঁকে সে তার সুমিতদাকে বুঝিয়ে দেবে সে এখনও মন ও মনের আধারে ফ্রক পরা ক্লাস নাইন।এখনও সে লালন করে অন্তঃকরণে সেদিনের সেই স্বপ্নে পাওয়া চকিত চুমুর অমোচনীয় আদর দাগ
ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে শরীর এলিয়ে দেয় অমল।সুদূর শূণ্যতায় শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনেক্ষণ ধরে।ইচ্ছা করেই হাঁটতে যায় নি।নির্জন প্রকৃতির নিথর অনুষঙ্গে নিজের সঙ্গে একান্ত সে। একলা। আধপোড়া সিগারেটের ধোঁয়া কুণ্ডলী মিশে যাচ্ছে হিমেল হাওয়ার হিম শূণ্যতায়। অবলীলায়। ভাবনার জটিল আবর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলে অমল। মাকে ছেড়ে কতদূর চলে এসেছে সে! অনেকদিন পর।
শুধু কি তাই! তৃণা যে তার শারীরিক অক্ষমতার কারণে মন থেকেও সরে গেছে অনেক দূরে। কোনদিন মুখ ফুটে একটা কথাও বলে নি সে তারই খামতির জন্য। সুমিত সেনের ভার্চুয়াল জগতে তার আশ্রয় ও প্রশ্রয় কোনটাই অমলের অজানা নয়।

             ৩.

চম্পার মাকে এই কটাদিন মায়ের সাথে দিনে রাতে সবসময় রাখার কথা অমল বলেছিল। সুরমা কিছুতেই রাজি হয় নি।
ফ্রিজের মধ্যে দিন পাঁচেকের মত সবজি রেখে গেছে।তেল মশলা, চা পাতা, রান্নার বাসনকোসন, গ্যাস ওভেন সব গুছিয়ে দিয়ে গেছে।
সুরমার মনে হয়েছে তার নিজস্ব জীবন বড় বেশী অন্যের ওপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেছে। নিজেরই হাতে গড়া সংসারে সে যেন পরাশ্রয়ী পরগাছা হয়ে গেছে।অন্যের দয়ায় বাঁচতে বাঁচতে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাসহীনতার ঘূণ পোকা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। অমল কষ্ট পাবে বলে এতদিন কিচ্ছু বলতে পারে নি সুরমা।
কিন্তু বলা এক, আর করা অন্য। ওরা চলে যেতেই সুরমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। এত বড় বাড়িতে তাকে একা থাকতে হবে! ও পাশের বোস বাড়ি দীর্ঘদিন তালাবন্ধ। শরীকী বিবাদ। তৃণা আসার পর থেকে পাড়া পড়শিদের এ বাড়িতে যাতায়াত কমতে কমতে এখন তলানিতে।
একা হওয়ার প্রথম সন্ধ্যায় মনে হল সারা বাড়িটা যেন তাকে গিলতে আসছে। যেন হঠাৎ করে কে সব আলো নিভিয়ে দিয়েছে।ছাদের দিকের জানালাটা খুলতেই হিলহিলে সাপের মত নিকষ কালো অন্ধকার তার দিকে ছুটে এল।ঝুপসি কালো নিমগাছটা যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী। জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ে সরমা। অমলের ফোন এলে দাঁতে দাঁত চেপে ভয় লুকিয়ে কথা বলে। সামান্য কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। ঘুম আসে অনেক রাতে।
সকালের ঝলমলে রোদ্দুর তাকে ডেকে দেয়। ধড়ফড় করে উঠে পরে সরমা।
মন থেকে সব ভয় মুছে ফেলার মরিয়া চেষ্টা করে।
সকাল সকাল পুজো সারে।
কাঠের আলমারিটা খুলে ভাঁজ করা শাড়ির পেছনে রাখা একটা ছোট্ট বাক্স বের করে।তাতে যত্ন করে রাখা তার স্বামীর চশমা, কলম, রুমাল। কয়েকটা স্মৃতিবিজরিত বিবর্ণ সাদা কালো ছবি। স্মৃতির নুড়ি পাথর। সেসবের ঘ্রাণ নিয়ে ঝাড়পোছ করে রেখে দিল।
অনেকদিন পর সে হারানো দিনের গন্ধ ফিরে পেল।তার ফেলে রাখা শাড়িগুলো নাড়াচাড়া করল।তার স্বামীর সাদা পাজামা পাঞ্জাবিটা ভাঁজ খুলে আবার ভাঁজ করে রাখল। বাক্স থেকে খালি পারফিউমের শিশিটা বুলিয়ে দিল! ওঃ! সেই গন্ধ!
এক সময় অল্প সল্প হলেও গান গাইতো সরমা। বহুদিন আগে এপাড়ার রবীন্দ্র জয়ন্তীতে গেয়েওছিল সে।খুঁজে বের করল গানের খাতা।ধুলো ঝাড়ল হারমোনিয়ামের। হার্ট আটাকের পর অমল তাকে আর গান গাইতে দেয় নি। বহু কষ্টে হলেও মেনে নিয়েছিল সুরমা।
আজ স্মৃতি হাতড়ে আবার সে গাইল ....
' দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই মায়া.....'

অবাক বিস্ময়ে সাড়া বাড়িটা যেন নতুন করে জেগে উঠল। পিছনদিকের বাগানের গাছগাছালি, ছাদে ঝুঁকে পড়া নিমগাছ মুগ্ধ হয়ে শুনল তার গান।

এমনি করে কেটে গেল। চার চারটে দিন আর রাত।

            ৪.

তৃণার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিনগুলো যেন ফুরফুরে হালকা বাতাস। এই ট্যুরে না এলে জানাই হতো না ফেসবুক স্বপ্ন দেখানো সুমিতদা আসলে প্রচন্ড ভীতু আর ধুরন্ধর। তৃণাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে কথা শক্ত পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে।
"The Retreat " হোম স্টের শেষ রাতে অমলের বুকে মাথা গুঁজে চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়েছে। সে মর্মে মর্মে অনুধাবণ করেছে, মনের পরিচর্যা ছাড়া শরীর উদযাপন অসম্ভব। একটাকে বাদ দিয়ে আর একটাকে আঁকড়ে ধরার মত মূর্খামি আর কিছুতে নেই।
অমল মুখে কিছু বলেনি। শুধু তার শরীরে নতুন শিহরণ অনুভব করেছে।


               ৫.
আজই শেষ রাত। কাল সকালেই অমলরা ফিরে আসবে। একটাদিন মন্দ কাটল না সুরমার। এক্কেবারে নিজের সঙ্গে থাকা। নিজের মত করে। এটুকু সে বুঝল, যে সে একেবারে ফুরিয়ে যায় নি। এটাই বা কম কি।
জীবন থেকে আরও একটা দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এল ধীরে। পা টিপে টিপে। অনেক নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে সরমা। এবার থেকে নতুন করেই বাঁচবে।
অমলকে ফোন করল একটা।
ছুটন্ত গাড়িতে দুর্বল নেটওয়ার্ক। কেটে কেটে যাচ্ছে সুরমা ফোন। তবু ..
"বাবা, তোরা সাবধানে ফিরে আয় অমু। আমি খুব ভালো আছি। তোরা তো টায়ার্ড হয়ে আসবি। বৌমাকে বলিস, কাল আমি নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াবো .....'

কথা শেষ হয় না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মা ও ছেলের।
শুয়ে পড়ে সুরমা তাড়াতাড়ি। এখন আর কোন ভয় নেই তার। মাথার কাছে জানালা খোলায় থাকে। হালকা ঠান্ডা বাতাস ঘরময় খেলা করে।

আলোয় ভেসে যাচ্ছে ছাদ। কি ধবধবে দুধলি জোছনা! কি স্পষ্ট চারদিক। নিমগাছের দিকটায় একটা আবছা অবয়ব। চেনা যায়, আবার যায় না। কিসের যেন অমোঘ টানে দরজা খুলে ছাদে গেল সুরমা। কি অপূর্ব আলোয় ভেসে যাচ্ছে সব। একটু দূরে টবে ফোটা টগর গাছের পাশে একমনে খেলা করছে তার ছোট্ট অমু। অর বাবার পরনে  ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি। আর সেই কবেকার পারফিউমের গন্ধ। ধক করে নাকে এসে লাগল!
কার যেন অপ্রতিরোধ্য ইঙ্গিতে সরমা জ্যোৎস্না প্লাবিত ছাদে গাইল তার স্বামীর প্রিয় গান ....
'আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে ....'

চাঁদের মায়াবী আলোয় আলোকিত ফুলে ভরা টগর গাছের পাশে আপনমনে খেলে বেড়াচ্ছে তার ছোট্ট অমু সোনা।

খুব ভোরেই ফিরে এল অমলরা।তখনও আলো ফোটেনি ভালো করে। পাড়াটা ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন।শীতের রাতের শেষ ঘুমের আবেশ গাছপালায়, ছাদের কার্নিশে।

পড়িমরি করে হাঁফাতে হাঁফাতে  দোতলায় মায়ের বন্ধ  ঘরের  দরজার সামনে থমকে দাঁড়াল অমল।
সমস্ত আবেগ উৎকন্ঠা উজাড় করে 'মা 'বলে ডাকল অমল।
অনেকবার। অনেক্ষণ ধরে। ঝিমধরা বাড়িটার দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে একসময় ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে হারিয়ে গেল।

ভেতর থেকে কোন উত্তর এল না।

মন্তব্যসমূহ

  1. কি সরল আবেগে লেখা মর্মস্পর্শী এ কাহিনী। ভীষণ ভীষণ ছুঁয়ে গেলো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য