নন্দিতা কুণ্ডু মিত্র

কল্পার কল্পনালোকে
✤✤✤✤✤✤✤✤✤✤✤✤✤
হিমাচল মানেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হিমালয়ের অপরূপ রূপ।হিমাচল মানে সৌন্দর্যের আকর। আমরা যারা পাহাড়ের প্রেমে বারবার পড়ি,তাদের কাছে হিমাচলের আকর্ষণ চিরকালিন। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা পাইন, ফার, দেবদারু সম্বলিত পাহাড় – যার নিসর্গ রূপের অমোঘ আকর্ষণে পর্যটকরা ছুটে যায় বারবার।
তার সাথে রয়েছে শতদ্রু, বিপাশা বা বাসপার মত চঞ্চল নদী। হিমাচলের এই অপরূপ রূপের আস্বাদন করতে পুজোর ছুটিতে বেরিয়ে পড়লাম কিন্নর কৈলাসের উদ্দেশ্যে। কিন্নর নামের মধ্যে একটা দৈব ব্যাপার রয়েছে। সিমলা থেকে রামপুর ছাড়িয়ে যখন কল্পার রাস্তা ধরেছি তখন প্রকৃতি একটু একটু করে পরিবর্তিত হতে থাকল। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি নীল আকাশের বুক চিরে বরফের সাদা মুকুটপরা   
 কিন্নর কৈলাসের হাতছানি। গাড়ি যতই উপরে উঠছে ততই যেন শ্বেত-শুভ্র তুষারশৃঙ্গগুলি কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। সামনে, পিছনে যেদিকেই তাকাই অতন্দ্র প্রহরীর মতো তারা পাহারা দিয়ে রেখেছে আমাদের।

কিছুদূর যেতে যেতে মনে হল আমরা যেন শিব-ঠাকুরের আপনদেশে ঢুকে পড়েছি।চারিদিকে আপেল গাছে ছাওয়া পথ। প্রত্যেক গাছেই আপেলের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে আমরা প্রকৃতির অন্য একজগতে প্রবেশ করেছি। এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতেই আমরা প্রবেশ করলাম কিন্নর জেলার সদর শহর রেকংপিওতে। আদুরে নাম শুনেই ছোট্ট এই পাহাড়ী শহরটির প্রেমে পড়তে ইচ্ছা করে। এখানে গাড়ি গুলো দাঁড়ায় এবং প্রয়োজন মতো বাজার করে নেওয়া হয়। রেকংপিওকে বিদায় জানিয়ে আরও ১২ কিমি গিয়ে পৌছালাম স্বপ্নের রাজ্য কল্পাতে। বিকেলের মিঠে রোদ আমাদের সাদর সম্বর্ধনা জানালো। হোটেলে প্রবেশ করে যে ঘর পেলাম তা প্রায় গুপ্তধন পাওয়ার মতোই মনে হল আমার। কারন, ঘর, ব্যালকনি এমনকি বাথরুম থেকে পর্যন্ত কিন্নর কৈলাসের পর্বতমালা যেন আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলাম বিকেলের পড়ন্তরোদে পর্বতমালায় আগুন লেগেছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। আমাদের দলের ম্যানেজার দেখিয়ে দিলেন ঠিক কোন জায়গাটিকে কিন্নরের সবাই শিবলিঙ্গ জ্ঞানে পুজো করে, বরফের রাজ্যে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ভাল করে দেখলে বোঝা যায় যে, একটা বিশাল আকৃতির প্রস্তরখণ্ড দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি পাথরের উপর। এই পাথরের আকৃতি সত্যিই শিবলিঙ্গের মতোই। প্রায় ২৩ ফুট লম্বা এই পাথর যুগ যুগ ধরে কিন্নর কৈলাসের শৃঙ্গে বিরাজমান। কথিত আছে যে,
চারিদিকে বরফ জমলেও ঐ প্রস্তরখণ্ডে নাকি বরফ জমে না। রোদের আলোর তারতম্যের ভিত্তিতে দিনের একেক সময় একেক রঙে বদলাতে থাকে। এ যেন কোন অলৌকিক কাণ্ড, প্রকৃতির এক অপার রহস্য যা ভেদ করা আমার মতো নগণ্য মানুষের কাজ না। আমরা এই দৃশ্য যে দিন দেখেছিলাম সেদিন ছিল বিজয়া দশমীর পরের দিন অর্থাৎ একাদশীর দিন দৃশ্য দেখে হঠাৎ মনে হয়েছিল দেবাদিদেব মহাদেব যেন পার্বতীকে ফিরে পেয়ে অকাল হোলি খেলায় মগ্ন হয়েছেন। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়, হোটেলের
কাঁচের জানালার মোটা পর্দা সরাতেই ঘরের ভিতর চাঁদের আলো এসে পড়ল। সেই অভূতপূর্ব জ্যোৎস্নায় দেখলাম চতুর্দিক থেকে কিন্নর-কৈলাস পরম আদরে তার অতিপ্রিয় কিশোরী কল্পাকে তার বুকের মধ্যে পরম যত্নে আগলে রেখেছে। বড় মায়াবী সেই দৃশ্য। চারিদিকের শ্বেতশুভ্র তুষার গিরিশৃঙ্গের উপর চাঁদের আলোর বিচ্ছুরন দেখতে দেখতে ঘোর লাগার মধ্যেই মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ নেমে এসেছে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা মনে নেই।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। সেদিনও প্রকৃতি এক বিস্ময়কর দৃশ্য আমাদের উপহার দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল। হোটেলের ঘরের জানালা দিয়েই দেখতে পাচ্ছিলাম কিভাবে রাতের আঁধার পেরিয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছে কল্পা। পাহাড়ের এক চূড়া থেকে আরেক চূড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে সোনালী রোদের ছটা। গলন্ত সোনার সেই সোনালী বর্ণচ্ছটায় হিমাচূড়াগুলি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ দৃশ্য কখনোই ভোলার নয়। বাকরুদ্ধ অবস্থায় সেই দৃশ্য দেখেই চলেছি। এ এক অনাবিল স্বর্গসুখ। কল্পার এই অকল্পনীয় রূপকে মনের মণিকোঠায় চিরদিনের জন্য বন্দি করে রাখলাম। কবির ভাষায়- ‘অপূর্ব এক স্বপ্নসম লাগিতেছে চক্ষে মম’। কল্পনার তুলিতে আঁকা ছবির থেকেও অপূর্ব। ভোরের নরম সোনালী রোদের মুকুট পড়ে পাহাড় যেন তার সহচরীদের সাথে নৃত্যরত। বিশ্ব চরাচরের বেশী কিছু হয়তো দেখিনি, কিন্তু এই অপার্থিব, অনুপম দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য যে অর্জন করতে পেরেছি তার জন্য ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এই দুর্লভ দৃশ্য অবশ্য বেশীক্ষণের জন্য স্থায়ী রইল না। কিছুক্ষণ পরেই ফুটে উঠল তুষারের নিজস্ব শ্বেতশুভ্র রঙ। দিনের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে আমরা সবাই গেলাম কল্পার গ্রাম দেখতে। দুদিকে দুটি গ্রাম – একদিকে রোঘি আরেকদিকে কোঠি। পথের দুপাশের আপেল বাগানের ফাঁক-ফোঁকর দিয়েই দেখা যাচ্ছে রাজকীয় ভঙ্গীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিন্নর-কৈলাস। এখানকার গোল্ডেন আপেল জগৎবিখ্যাত। আঁকাবাঁকা চলতে চলতে হঠাৎ আমাদের গাড়ির ড্রাইভার এমন একটা জায়গায় দাঁড় করালো যেখানে গোটা পাহাড়টাই মনে হয় রাস্তার উপর থেকে খাঁড়া হয়ে নীচের খাদের দিকে নেমে গেছে। জায়গাটার নাম সুইসাইড পয়েন্ট। দেখেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। অবশ্য চারিদিকের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য ছেড়ে কার সুইসাইড করার বাসনা জন্মায় তা বুঝলাম না। চিনিগ্রামের এক প্রাচীন বৌদ্ধমন্দির ও শিবমন্দির দর্শন করে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। এবার আমাদের বিদায়ের পালা। কল্পার কল্পনালোক ছেড়ে আমাদের পাড়ি দিতে হবে আরেক স্বপ্নময় জগৎ ছিটকুলের উদ্দেশ্যে। 

কখন যাবেনঃ বরফ দেখতে চাইলে ফেব্রুয়ারী-মার্চ, আর আপেল দেখতে চাইলে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর।   

মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভাল লাগলো। কল্পার পাহাড়ী গ্রাম আর কিন্নর কৈলাসের অপরুপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য