সু ত নু হা ল দা র

প্রতিশব্দ
❋❋❋❋❋❋❋❋

সম্পূর্ণ অযাচিতভাবে বাড়ি বয়ে এসে হালকা আলাপচারিতার মধ্যেই হঠাৎ আমার ঠোঁটে মেয়েটি একটা দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দিল।

    আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলাম। হবারই কথা।কারণ আগে ওর সঙ্গে মাত্র তিনদিন দ্যাখা হয়েছিল, প্রতিবারই কমন ফ্যাক্টর ছিল ঝগড়া। দোষটা অবশ্য আমারই। সুন্দরী মেয়েদের রাগাতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। সুন্দরীদের ধৈর্য একটু কম থাকে, তাই যারা লাজুক সুন্দরী তাদের রাগিয়ে দিলে তারা শুধুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করে, আর যারা ঠ্যাঁটা সুন্দরী তারা বিরক্তি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ঝগড়াও করে। 

এই মেয়েটির বউদির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তিনদিনই বউদি তার ব্যক্তিগত একটা দরকারে মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে এসেছিল। বউদির কাজটা আমি করতে পারিনি। কিন্তু তিনদিনই বউদির ননদটিকে জব্বর রাগাতে পেরেছিলাম।

    মেয়েটি একটু ঠ্যাঁটা টাইপের। কিন্তু যথেষ্ট সুন্দরী। বয়স চব্বিশ পঁচিশ হয়ত হবে। যাদবপুরে ইংরাজি বিভাগে গবেষণা করছে। আমার সঙ্গে প্রথমদিন আলাপের সময়ই বউদি বলেছিল, 'রাজা, এটা আমার ননদ। পড়াশোনায় কিন্তু দারুণ। এই বছর জে.আর. এফ পেয়ে যাদবপুরের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে গবেষণা করছে।'

 ব্যাস। অমনি আমার মাথার পোকাটা নড়ে উঠেছিল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, 'বাহ্! তাই নাকি?'

মেয়েটি একটু মুচকি হেসে উত্তর দিল, 'হুম।'

আমি বললাম, 'আচ্ছা, তোমার ময়ুরপুচ্ছধারী কাকের ওই গল্পটা জানা আছে?'

মেয়েটা আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, 'কেন বলুন তো?'

আমি বললাম, 'না, বিশেষ কোনও কারণে নয়। তুমি সাহিত্যের মেয়ে তো তাই আর কি...'

'সাহিত্যের লোক না হলেও ওটা সবাই জানে। একটা কমন প্রবাদ?'

'হ্যাঁ। প্রবাদ। তবে সেটাও তো ভাষা-সাহিত্যেরই অংশ?'

'হুম। কিন্তু আমার গবেষণার বিষয় বিট জেনারেশন ও অ্যালেন গিন্সবার্গকে নিয়ে।'

'বেশ তো। তাতেও তো ওই প্রবাদটা না জানার কোনও কারণ নেই।'

'কী আশ্চর্য! আমি জানি না কখন বললাম? আপনি খুব ফালতু বকেন তো।' 

আমি কিছুটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললাম, 'এই কথাটা প্রায় সবাই আমাকে বলে। কিন্তু তুমি গবেষক। নতুন কিছুর দিকে সন্ধানী দৃষ্টি তোমার থাকা উচিত। তা নাহলে নতুন কথা বলবে কি করে?'

'মেয়েদের সম্মান দিয়ে কথা বলতেও শেখেননি দেখছি! প্রথম পরিচয়েই অপরিচিত একটা মেয়েকে তুমি বলে কথা বলছেন? বাহ্!'

আমার উদ্দেশ্যে বলা কথা কটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটি ওর বউদির দিকে তাকিয়ে বলল, 'বউদি আমার অন্য কাজ আছে। তোমার দেরি হলে আমি চলে যাচ্ছি।'

বউদি বলল, 'না, না। চল। আমিও যাব।'

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বউদি বলল, ' তুমি আর বদলাবে না রাজা! দিলে তো ওর মেজাজটার বারোটা বাজিয়ে।'

আমি মুখটিপে একটু হাসতে গেলাম, কিন্তু তার আগেই মেয়েটা ওর বউদিকে বেশ রাগত স্বরে বলল, 'যার তার কথায় আমার মেজাজের বারোটা বাজে না বউদি। এখন চলো দেখি।'

দরজা দিয়ে বেরোবার আগে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'উলু বনে মুক্ত ছড়িয়ে যেমন কোনও লাভ হয় না ঠিক তেমনই অস্থান কুস্থানে নতুন কিছুর সন্ধানও করতে নেই,  করার মতো জায়গাতেই সেটা করতে হয়। হিজিবিজি দাগকে অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বলে যারা ভাবে তারা মুর্খ। আমি সেই গোত্রীয়  নই।'

যাবার সময় মেয়েটি আমাকে একটা বাউন্সার দিয়ে গিয়েছিল। তবে তাতে আমার কিছু মনে হয়নি। বরং আমার উদ্দেশ্য যে সফল হয়েছে ওই বাউন্সারই তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য দিল। 

পরের দু'দিনও এমনই কথাকাটাকাটি হয়েছিল। অথচ  প্রত্যেকবারই বউদির মুখ দেখে মনে হয়েছিল ব্যাপারটা সে বেশ উপভোগ করছে। যদিও মুখে আমাকে বলত, 'রাজা! আহা! কী যে ছেলেমানুষী করো না! ওকে কেন রাগাচ্ছ তুমি?'

আর তার সুন্দরী ননদটি প্রতিবারই রাগে গজগজ করতে করতে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। লাস্টদিন যখন সে তার বউদির সঙ্গে আমার বাড়ি থেকে বেরচ্ছে তখন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই বউদিকে বলল, 'তোমারও যেমন কাজ কারবার! তিনদিন ধরে একটা ফালতু লোকের বাড়িতে এসে অযথা সময় নষ্ট করলে। কাজের কাজ কিছুই হ'ল না। আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম এসব লোকের দ্বারা কিস্যু সম্ভব নয়। যারা অতো ভাঁট বকে তারা কোনও কাজই করে উঠতে পারে না। ভরঘুরে অপদার্থ একটা লোককে ভরসা করে শুধু শুধু দিনগুলো নষ্ট করলে!'

সেই মেয়েই দিন কয়েক পরে একা এসে আমার সঙ্গে মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলে হঠাৎ করে অমন গোগ্রাসে আমার ঠোঁটে চুমু দিতে পারে, এটা একেবারেই ভাবতে পারিনি। সত্যি পারিনি।

আজ প্রথম যখন কড়া নাড়ার শব্দ শুনেছিলাম তখন মনে মনে একটু বিরক্তই হয়েছিলাম। যদিও বিরক্ত হওয়াটা আমার ধাতে সয় না। কিন্তু সেটার পরিসমাপ্তিতে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে সেটা ছিল আমার কাছে একেবারেই অকল্পনীয়। এইমাস থেকে আমার দুটো টিউশনি বাদ গিয়েছে, অতএব এমাস থেকে দুধটা বন্ধ করে দিলাম। তাই দুধওয়ালাকে পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে সবেমাত্র দরজাটা বন্ধ করে ঘরে এসেছি কী আসিনি, ঠিক তখনই আবার কড়া নাড়ার শব্দ! এই এক বিড়ম্বনা! অগত্যা আবার দরজাটা খুলতেই হ'ল। কিন্তু দরজা খুলে চমকে ওঠার বদলে বেশ খানিকটা অবাকই হয়েছিলাম। সেই কারণেই হয়ত কিছুক্ষণ মূক ও বধির হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।

 -'আশ্চর্য! এইভাবেই দাঁড় করিয়ে রাখবেন? না, ভেতরে আসতে বলবেন?'

নারী কণ্ঠের মিষ্টি গলার স্বরে আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে  কিছু বলতে গেলাম, ঠিক তখনই মেয়েটি আবার আমাকে বলল, 'সরুন তো মশাই, ভেতরে ঢুকতে দিন। নিজের বাড়িতে সুন্দরী একটা মেয়েকে একা দেখে আপনিও এমন ন্যাকা হয়ে যাবেন, এটা তো আগের তিনদিনে একবারও বুঝতে পারিনি! ন্যাকা ন্যাকা ছেলেদের আমার খুব অসহ্য লাগে।' কথাটা শেষ হওয়া মাত্রেই মেয়েটি আমাকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলো।

বাড়ি বলতে পৈত্রিক একটা ঘর আর একচিলতে উঠোন। মনে মনে আওরাতে লাগলাম, কী যেন নাম মেয়েটির? অতি কষ্টে মনে পড়ল তার নাম গার্গী।

আমার আগেই সে তখন আমার ঘরে ঢুকে নীলকমলের সবেধন নীলমনি চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে বসে পড়েছে। আমি ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আমাকে বলল, 'সত্যিই আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোটো করব না। কিন্তু আপনি কাজটা না করে দিলে আমি খুব সমস্যায় পড়তাম।'

'আমি আবার তোমার কোন কাজ করে দিলাম?'

'কেন? বউদি কিছু বলে নি?'

'কই না তো!'

'বলেন কী?'

'কিছুই তো বলছি না। শুধু তোমার কথা বোঝার চেষ্টা করছি।'

ঠিক তখনই গার্গী প্রায় ঝাঁপিয়ে এসে আমাকে চুমু খেল। তারপর বলল, 'আপনি তো মেয়েদের দেখেই সব কিছু বুঝে যান, তারা কী পারে আর না পারে সবই তো আপনার জানা। গতকাল আমার সম্পর্কে আপনি  বউদিকে কত কথাই তো বলেছেন। আমি সুন্দরী হলেও নাকি খুব নার্ভাস। আমার মুখ দেখেই নাকি বোঝা যায় আমি কখনও ঠিকঠাক কিস করতে পারব না! সেটাই দেখালাম আর কি। অবশ্য শুধুমাত্র সেই কারণেই নয়, আপনার মতো অপদার্থ একজন আমাকে কী বলল, তাতে আমার তেমন কিছু যায় আসে না। আসলে অপছন্দের ফালতু কোনও ঝগড়ুটে পুরুষকে কিস করলে কতটা গা ঘিনঘিন করে সেটা পরখ করে দেখার একটা ইচ্ছাও আমার হয়েছিল বটে। গবেষণা করতে এসে এভিডেন্সের মূল্য যে কতটা সেটা আমি এখন বুঝতে পারি। আর এভিডেন্স যদি প্র‍্যাকটিক্যাল এক্সপিরিযেন্সের মাধ্যমে হাতে আসে তাহলে ঝুঁকি অনেক কম থাকে। আপনিই তো বলেছিলেন গবেষকের সন্ধানী দৃষ্টি থাকা উচিত। তবেই নতুন তত্ত্বের কথা সে বলতে পারে।'

' তা, কি বুঝলে শুনি? এখন তোমার কতটা গা ঘিনঘিন করছে বলে মনে হচ্ছে?

'আপনার ঠোঁট থেকে লিপস্টিকের দাগটা মুছে ফেলুন।' বলার সময় গার্গীর গলাটা শুনতে একটু কেমন যেন ভারী-ভারী লাগল!

 জিজ্ঞেসা করলাম, 'তুমি কী কাঁদছ গার্গী? কাঁদছ কেন?'

'কারণ আমি আপনাকে খুব ঘৃণা করি। আপনি নিজেকে কী ভাবেন? মেয়েরা অত সহজেই কারো প্রেমে পড়ে? আমি আপনার উল্টোপাল্টা কথা শুনে আপনার প্রেমে পড়ে গেছি ভাবছেন? তাই আপনাকে চুমু খেলাম ভাবছেন? আমি চুমু খেতে জানি কী জানি না, এই কথা বলার আপনি কে? আপনার মতো ফালতু একটা লোককে ভালোবাসতে আমার বয়ে গেছে। আমি আপনাকে শুধুমাত্র ঘৃণা করি। ব্যাস।'

'আমি তো বউদিকে ওগুলো আড্ডা মেরেই বলেছিলাম। বিশ্বাস করো গার্গী, স্রেফ আড্ডা।'

কান্নাভেজা কণ্ঠে গার্গী ঝাঁঝিয়ে উঠে আমাকে বলল, 'থামুন। কোন কথার কী মানে হতে পারে সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা আপনার আছে?' 

সে আর দাঁড়াল না। সোজা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এই সময় আমার কী করণীয়? আমার ওকে আটকানো উচিত। তারপর ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ভালোবাসার কথা শোনানো উচিত। কিন্তু আমি সেসব কিছুই করলাম না। আমি জানি আমার রাজা নামটা আসলে আমার জন্য একটা মস্ত মস্করা। 

গার্গী যেমন হঠাৎ এসেছিল তেমন হঠাৎ করেই চলে গেল। আমিও যেমন দাঁড়িয়ে ছিলাম তেমনভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর কান্না থামানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলাম না। কান্না মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। পথিককে পথভ্রষ্ট হতে দ্যায় না। ভালোবাসাকে হয় ঋদ্ধ করে নয় তো রিক্ত করে।
 
আকাশেও তখন জলভরা মেঘ ছেয়ে গিয়েছে। আজ হয়ত প্রবল বৃষ্টি আসবে। প্রতিটা মনের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে একটা আস্ত আকাশ। সেই আকাশের গোপন প্রকোষ্ঠে যে সমস্ত মেঘ আত্মগোপন করে থাকে তারাও কখনও কখনও বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। 

গার্গী ঝড় হতে জানত, হয়ত বা মেঘও হতে জানে। কিন্তু আমার জন্য বরাদ্দ শুধুমাত্র ভূমির ওপর আছড়ে পড়া বৃষ্টির ওই আর্তনাদটুকু। যে আর্তনাদের কোনও প্রতিশব্দ হয় না।
 

মন্তব্যসমূহ

  1. উত্তরগুলি
    1. অনেক ভালোবাসা নিস। তোর ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল। আগামীতে লেখার জন্য অনেক সাহস পেলাম।

      মুছুন
  2. বন্ধু খুব খুব খুব ভালো লাগলো রে। অপূর্ব।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অফুরান শুভ কামনা রইল বন্ধু। গল্পটা ভালো লেগেছে জেনে আনন্দ পেলাম। ভালোবাসা রইল অনেক।

      মুছুন
  3. উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ দাদা। গল্পটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি খুব উৎসাহ পেলাম, আগামীতে লেখার জন্য নতুন করে অনেক সাহস পেলাম।

      মুছুন
  4. উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ। গল্পটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগল।

      মুছুন
  5. উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ।গল্পটা ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগল।

      মুছুন
  6. খুব ভালো দাদাটু। পূর্ণ বুনোট আছে গল্পটার।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ভালোবাসা নিও ভাইটু। গল্পটা তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম। ভালো থেকো।

      মুছুন
  7. ভালো হয়েছে রে....ভাষার বুনন দারুন...তবে plot টা আরো একটু চিত্তাকর্ষক ও curiosity based হলে আরো ভালো হতো...

    উত্তরমুছুন
  8. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক ধন্যবাদ তোকে ভাই। আসলে এই গল্পের প্লটটা এমনই ছিল। এটাকে আর চিত্তাকর্ষক ও curiosity based করা যেত না। তবে রাজাকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্লটে লেখা আমার আরো অনেক গল্প আছে। এক এক করে সবগুলো প্রকাশ করব

      মুছুন
  9. সুতনুদা খুব ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য