বৈশাখী ঠাকুর
......রমণীর গুণে
আজও শিবানির রান্না বাড়ির কাজে যাওয়া হল না।
কিছুতেই যেন সে সব কিছু সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। একা হাতে আর সে কত করবে ! আগে তার
শাশুড়িমা তাঁদের সাথে থাকতেন--- ঠ্যাকাবেঠ্যাকায় অনেক সাহায্য করতেন।
কিন্তু এখন তিনি
দেশের বাড়িতে সেই নদীয়াজেলার গয়েশপুরে চলে গেছেন।তাই জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই
শিবানীর ঘাড়ে। এই যে সে রান্না বাড়িতে যেতে পারল না কিন্তু মাসে
মাসে টাকাটা তো শুধতে হবে নাকি! তা সে গতর খরচ করেই হোক বা ধার নিয়েই হোক । টাকাটা
নেবার সময় তো রতন একটুও দ্বিধা করেনি। আর যে এক লক্ষ টাকা দিয়ে সরকারি স্কিমে গাড়িটা বুক করেছে সেটাও তো তারই গয়না বিক্রি
করে।কিন্তু সে কথা মাথায় থাকলে তো!
ছোটবেলা থেকে শুধু কষ্ট আর লড়াই করে গেছে শিবানী।
পরের দিকে একটু যা সুখের মুখ দেখছিল।ইদানীং তাতেও যেন কার নজর পড়েছে! বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে
বড় ছিল সে। পাঁচ ভাই বোন তারা। বড় হওয়ার দরুন তার ওপরই
সব দায়িত্ব ---পান থেকে চুন খসলেই সব দোষারোপ।যত বড় হতে লাগল তত যেন চোটপাটও
তার ওপর বাড়তে লাগল।মাও অসুস্থ হয়ে পড়ছিল দিনকে দিন। শেষের দিকে তো বাবা চারটি চোলাই
গিলে এসে রাতে পছন্দমত কিছু না পেলেই তাঁকে উদ্দাম পেটাতে শুরু করত। ছোট ভাইবোনগুলো
এক কোনায় ভয়ে সিটিয়ে থাকত। রোগা রুগ্ন মা আটকাতে এলে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে এক
সেকেন্ডও সময় নিত না বাবা। দিন দিন অত্যাচার যেন বাড়ছিল।তার সাথে মুখে অশ্রাব্য গালিগালাজ।
যত বাবার রিক্সা চালিয়ে ইনকাম কমছিল তত বাবার আস্ফালন বেড়েই চলেছিল।
একদিন তার ছোটপিসি আচমকা বাড়িতে চলে আসাতে এই
দৃশ্য দেখতে পেয়ে যায়।থমকে যায় দাদার এই আচরণে! আর ভাগ্যের চাকাটা খানিকটা হলেও এখান
থেকেই ঘুরতে শুরু করে শিবানীর। পরদিনই তাঁকে আর ঠিক তার পরেই যে ভাই--- শৈবালকে নিয়ে তার ছোট পিসি আড়িয়াদহের অনুকূল ঠাকুরের আশ্রমে
চলে আসে। গ্রামের ওই দৈন্যদশা থেকে তারা যেন স্বর্গ রাজ্যে এসে পৌঁছল। খাবারদাবারের
অভাব নেই। চব্বিশ ঘণ্টা আলো--- পাখা ---জল ---কষ্টের বালাই নেই। তার বিনিময়ে আশ্রমের
কাজ করতে হত। এ আর এমন কি! বাড়িতে যে বিপুল পরিমানে কাজ শিবানী করত সে তুলনায় নস্যি!তারপর
গ্রামের কাজের ধরন আর শহরের কাজের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের আশ্রমে যে ক্লাস হত তাতে
সে আর তার ভাইও যেত।কোনওমতে এইট অবধি পাশ সে করেছিল।আর পোষায়নি।আসলে শিবানির কোনদিনই
লেখাপড়ায় তেমন মন নেই।আশ্রমে এক বয়স্কা মাতাজী ছিলেন। উনি বিশেষ স্নেহ করতেন শিবানীকে।
শিবানীও বিশেষ যত্ন নিত মাতাজীর। ব্যাক্তিগত যত ফাই ফরমাশ সব তো খাটতই , এছাড়াও গা
হাত পা টিপে দেওয়া ---সেবা শুশ্রূষা করা সবই শিবানী করত নিষ্ঠাভরে । ফলস্বরূপ আশ্রমের
সেরা ফল মিষ্টির ভাগ জুটত তার কপালে। ভাইকেও চুপিচুপি সে ভাগ দিত ।অন্য কর্মচারীরা
বেশ সমীহ করে চলত তাঁকে কারণ মাতাজীর ভাল প্রতিপত্তি ছিল আশ্রমে । প্রয়োজনে গাড়ি করে গ্রাম-গ্রামান্তরে মাতাজীর সঙ্গী হয়ে যেত
সে । থাকাখাওয়ার
কোন অসুবিধে নেই।বরঞ্চ কিছু ক্ষেত্রে খাতিরও জুটত। আবার দেওঘর বা
পুরী গেলেও শিবানিকে ছাড়া মাতাজী এক পাও নড়তে পারেন না।ভীষণভাবে নির্ভর করতে শুরু
করেছিলেন শিবানীর ওপর। এই করে তার দেশ ভ্রমণও কম হল না।জীবনে তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল।
তা সেই আশ্রমেই রতনের মাও আসতো।তিনিও ছিলেন অনুকুলঠাকুরের
দীক্ষিত। সঙ্গে রতন আসত মাঝেসাঝে। অল্প বয়সে রতনের চেহারায় ছিল একটা আলাদা বন্য আবেদন । শিবানীরও তখন ডাগর চেহারা। মন
দেওয়া নেওয়া করতে সময় লাগেনি।
সেই প্রথম শিবানীর ওই আশ্রম জীবন বড় বদ্ধ মনে
হয়েছিল। বেরিয়ে সে দেখা করতে যেতে পারে না রতনের সাথে। একটু সময় কাটাবে ---ঘুরবে –ফিরবে
–তার অবকাশ নেই।তাই তখন আচমকাই ছোট পিসির ওপর ভালবাসা উথলে উঠেছিলো।প্রায়ই মাসির বাড়ি
গিয়ে থাকতে শুরু করল। আশ্রমের থেকে খুব বেশী দূরত্বে ছিল না মাসির বাড়িটা।মাতাজী অবশ্য
রুষ্ট হতেন এতে।
রতনের মা তবে মনে মনে যে ফন্দিটা এঁটেছিলেন তা বলতে গেলে শিবানীর হিতেই গেল। রতন ভাল গাড়ি চালাতে জানত। লাইসেন্স ছিল। তাঁকে আশ্রমের
গাড়ি চালানোর কাজে নিয়োগ করা হল। এবার বলতে গেলে দুবেলাই দেখাসাক্ষাৎ হয় আর মাতাজী গাড়ি চড়লেই পোওয়া বারো শিবানীর। ঘোরার সাথে সাথে
রতনের সান্নিধ্য উপরি পাওনা। বেশ চলছিল কিন্তু আচমকা একদিন মাতাজীর একটা মাইল্ড হার্ট
অ্যাটাক হল।সেই রাতে ভাগ্যিস শিবানী ওই ঘরেই শুয়েছিল। ত্বরিতে রতনকে ফোন করে ডাক্তার বদ্যির সময়মত ব্যবস্থা করে সামনের নার্সিং হোমে ভর্তি করাতে প্রাণ রক্ষা হল মাতাজীর । আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত
সেক্রেটারি ভীষণ খুশী হলেন শিবানির এই তৎপরতায়---আন্তরিকতায়।সেই রোজ যেত নার্সিং হোমে
মাতাজীকে দেখতে। প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করত। ওষুধ কিনে দিত। কখনোও বা মাতাজীর প্রিয়
পদ রান্না করে নিয়ে যেত। আর যেত যখন তখন তার সঙ্গী অবশ্যই হত রতন। এই সময়ই আরও যেন
সে গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়ল রতনের সাথে।মাথার ওপর অভিভাবক নেই। বাঁধনছাড়া।লাগামহারা।
ঘনিষ্ঠতা চূড়ান্ত পর্যায় গিয়ে পৌঁছল।রতনকে ছাড়া তার জীবন আর সে কল্পনাই করতে পারে না।
এর অন্যথা আর কিছু যেন সে ভাবতেই পারছে না। তখনই তারা সিদ্ধান্ত
নেয় যে তারা বিয়ে করবে।একসাথে থাকবে সারা জীবন।কিন্তু বিয়ে করব বললেই তো বিয়ে করা যায়
না। একটা পাকা পোক্ত চাকরি--- ভাল রোজগার চাই। নাহলে চলবে কেন। ততদিনে আশ্রম এবং আশেপাশে
তাদের প্রেমের কাহিনীর দামামা বাজছে । বিয়ে না করে তেমন নিস্তারও ছিল না। ভাগ্যক্রমে সেই সময় একটা কোম্পানিতে চারশ আট চালানোর
চাকরি পেল রতন। মাইনে মন্দ নয়।অতএব বিয়ের দিন স্থির হল।
বহুদিন বাদে শিবানী ফিরল তার গ্রামে। মাঝে মধ্যে
আসত বটে তবে সে খুবই কম। এবার যেন বিদায় নেবার জন্যই এসেছে। এতদিনে বাবা মায়ের বয়সও
হয়েছে। বাবার সেই তেজ মেজাজ কোনটাই নেই। শরীর স্বাস্থ্যও ভাল যায় না।নানান অসুখ বাসা
বেঁধেছে জীর্ণ শরীরে। এখন সংযত জীবনযাপন করলেও এককালে শারীরিক অত্যাচারের ফল এখন হাড়ে
হাড়ে টের পাচ্ছে।সারাদিনই প্রায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। জোর না থাকলে মানুষ বেশ অসহায়
হয়ে পরে। এক্ষেত্রেও শিবানী দেখল তাই হয়েছে। এক বেলা বেরিয়ে ঘণ্টা দুই তিন রিক্সা চালানোর
পর আর শরীর দেয় না। বাড়ি ফিরে এসে ধুঁকতে থাকে।মা বরঞ্চ অনেক সেলাইফোঁড়াই করে বেশ কিছু
উপার্জন করে। ঠ্যাকা দিয়ে কোনরকমে টিকে আছে সংসারটা।
শিবানীর বাবা মাকে অবশ্য মেয়ের
বিয়ের কোন দায়িত্বও নিতে হয়নি । আশ্রমের কন্যা বলে আশ্রমই সব ব্যবস্থা করেছে । গ্রাম
থেকে তার মা –বাবা আত্মীয় স্বজন সকলে এসেছিল। বিয়ের খরচ করতে হল না বলে শিবানীর বাবা
মা তাঁকে যতটা যেমন পেরেছে অল্প কিছু টাকা দিয়েছে। আত্মীয় স্বজনও তাই। বিপদে
আপদে কাজে লাগবে---এই ভেবেছে তারা।
নতুন নতুন বিয়ের পর তো শিবানীর নিজেকে স্বর্গলোকের
বাসিন্দা মনে হত। এত সুখ ছিলও তার কপালে! একখানা পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল রতন।
সেখানে দুজনে তাঁদের সুখের সংসার পাতল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শিবানির কোল আলো করে এল
দুই যমজ সন্তান। একটা ছেলে একটা মেয়ে। দুটো বাচ্চাকে একসাথে মানুষ করা এই বাজারে চাট্টিখানি
কথা নয়। আর যেখানে তাঁদের দু চোখে অফুরন্ত রঙিন স্বপ্ন। তারা ভীষণ ভাল করে মানুষ করতে
চায় তাঁদের দুই সন্তানকে। সাধ্যমত ভাল ইস্কুলে পড়াবে। লেখাপড়া করিয়ে নিজের পায়ে
দাড় করাবে। তার সুবিধের জন্য শাশুড়িমা এসে থাকতে লাগলেন তাদের সাথে। গ্রাস
বাড়ল আর একটা কিন্তু পয়সার সুরাহা হল না। বাড়তি আয়ের নানা রকম চিন্তা করতে করতে রাজ্য
সরকারের একটা স্কিমের কথা শুনল রতন। এক লক্ষ্য টাকা দিয়ে গাড়ি বুক করলে গাড়ি
বের করা যাবে। ভাড়া খাটাতে পারবে সে।কিন্তু বাকি টাকা গাড়ি কেনার যেটা সরকার দেবে সেটা
ধীরে ধীরে শোধ করতে হবে কিস্তিতে।এমনিতেই রতনের গাড়ি নিয়ে কারবার বলে একটা নিজের গাড়ির
বড় শখ ছিল।জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা আর শিবানির গয়না বিক্রি করে নব্বই হাজার টাকা
জোগাড় হল। বাকি দশ হাজার সে রান্নাবাড়ি থেকে ধার নিয়েছিল। তাই দিয়ে গাড়ি বুক করল। ওই
জমানো সম্বলটুকু চলে যাওয়াতে শিবানির বুকের ভেতরটা কিরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগত।উল্টে বাজারে
ধার। কিন্তু রতনের অদম্য জেদ—তার রুটি রোজগার যখন গাড়ির মাধ্যমেই। তখন তার একটা নিজস্ব
যানবাহন চাই। চাই-ই চাই।
টাকা দেওয়া হয়ে গেল সরকারের ঘরে কিন্তু গাড়ি
আর আসে না। যতবার খোঁজ নিতে যায় শুনতে পায় তার আগের বছরের প্রার্থীরা এখন গাড়ি পাচ্ছে।
বছর ঘুরে গেল। তখনও তাঁদের চান্স এল না। এদিকে শিবানির বুক কাঁপতে লাগল। এখন সংসারে
কারো কোন কিছু ভাল মন্দ হয়ে গেলে তার হাতে জমানো টাকা নেই।তাই তার বুকেও আর বল নেই।
সংসারে টানাটানি আঁচ করে শাশুড়িমাও দেশে চলে গেলেন। বাচ্চাগুলো যা হোক বছর পাঁচেক হয়েছে।
ওদেরকে সামনে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছে শিবানী। ঘণ্টা চারেক আটকে থাকে।
নিশ্চিন্তে ঘরের কাজ সারে শিবানী। আর এই ফাঁকটাকে কাজে লাগানোর জন্য সে আশেপাশে বলে
রেখেছিল যদি কেউ রান্নার কাজে তাঁকে নেয়। সে আগ্রহী রান্নার কাজ করতে। দুটো পয়সা
আসবে আর সে এই রোজগারের পুরোটাই জমাবে। কাজটা জোটার পর প্রথম প্রথম সে কাউকে জানতে
দিতে চাইত না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত---আশ্রমে গেছিলাম। কিন্তু কালে ক্রমে রতন জেনেই
গেল । প্রথমে একটু ধমকালেও পরে বুঝল যে টাকা জমানোটাও বড্ড প্রয়োজন বিশেষ করে দুটো
ছোট ছোট বাচ্চা যখন রয়েছে তাঁদের।
অবশেষে রতনের স্বপ্ন পূরণ
হল। তারা একটা সুইফট ডিজায়ার কিনল। দুধ সাদা রং।শখ করে কিনল বটে কিন্তু মাসে মাসে তাঁদের
পনেরো হাজার করে ই এম আই মেটাতে হবে।চলবে এখন আগামী অনেক বছর ধরে। গাড়ির পারমিট
করিয়ে যাবতীয় কাজ মিটিয়ে গাড়ি পূজো করে এল। ড্রাইভারও ঠিক হল।কিন্তু গাড়ি চালু হবার
পর বোঝা গেল তেমন কামাই কিছু নেই। উল্টে রতনের রোজগার থেকেই অনেক সময় পয়সা
বের করতে হচ্ছে ই এম আই মেটানোর জন্য। বাড়িতে অশান্তির জের শুরু হল। দুটো বাচ্চা সামলে
রান্নাবাড়ির কাজ করে শিবানীরও আর শরীর দেয় না। সেও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এদিকে ড্রাইভার
নিচ্ছে প্রতিদিন নশো টাকা করে । তেলের খরচ। গাড়ি রিপেয়ারিং এর খরচ। মাসের শেষে দেখা
যাচ্ছে সাত আট হাজার টাকা যা বাড়তি ইনকাম হচ্ছে।সবই বেরিয়ে যাচ্ছে। পুরো ই এম আই টাও
আসছে না।সংসার খরচা থেকে টাকা বের করতে হচ্ছে।নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে সংসার চালাতে। এ
যে হিতে বিপরীত হল। কোথায় দু পয়সা আসবে সংসারের সুসার হবে ---তা না এ যে নুন আনতে পান্তা
ফুরনোর মত অবস্থা হয়ে গেল। প্রমাদ গুনল শিবানী। মনে মনে ঠিক করল আরও একটা কাজ নেবে।
সেই নিয়েও বিবাদ লেগে গেল দুজনের মধ্যে।রতনের শিবানীর কাজে প্রথম থেকেই আপত্তি
ছিল। আরও একটা কাজ শুনে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল,
-----টাকার নেশা বড় নেশা বুঝলি শিবানী।
----কে কাকে বলছে এ কথা! তোমার টাকার
নেশা নেই। তা নতুন গাড়ি কিনলে কেন?
----- তোদের কথা ভেবে। বাচ্চা
দুটোর মুখ চেয়ে। যেন আরও ভাল ভাবে থাকতে পারি। আরও ভালো ভাবে ওদের মানুষ করতে পারি
। ------তা
আমি তো সে কথাই ভাবছি নাকি!দুটো পয়সা এলে ভাল বই খারাপ তো কিছু হবে না।
-----তুই বাড়ি বাড়ি কাজ করিস এটা
আমার পছন্দ নয়।
------ আমি তো আর লোকের বাড়ি এঁটো বাসন মাজতে যাচ্ছি না।
রান্না করা পুন্যের কাজ। আর কাজটা নিয়েছিলাম বলে তো তবু একটু সুবিধে হচ্ছে।
----- এটা নেশার মতন
। একবার টাকা হাতে পাবার নেশা হয়ে গেলে আর তুই ছাড়তে পারবি না। সংসার ভাসিয়েও তুই কাজ
করে যাবি।
-----বাজে কথা রাখ। সংসার
কি ভাসিয়ে দিয়েছি আমি?কোথাও কোন ত্রুটি পেয়েছ?
------এখন তবু চলছে। আগে যেমন এসে গরম গরম রুটি
সেঁকে দিতি তা তো কবেই ঘুচে গেছে। রুটি করে চলে যাস। আমি এসে ঠাণ্ডা রুটি খাই।
আরও কাজ নিলে এবারে আমাকে সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেতে এসে রেঁধে বেড়ে খেতে হবে।
সেই দিন আসছে। আগে তবু ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে তরকারি বানাতি। এখন তো---- !
-----তখন কোমরের জোর ছিল । তাই ভাল মন্দ বাজার করে আনতে। এখন কোমরের জোর নেই। যেমন
আন তেমন রেঁধে দিই।
-----তোর লজ্জা করল না কথাটা বলতে! খুব সাহস বেড়েছে
দেখছি তোর! দুদিন কি বেরোতে শুরু করলি আর ওই দু পয়সা রোজগার করছিস কি মুখে তোর খই ফুটছে
দেখি!
-----সত্যি
কথা বললেই দোষ।! সংসারে এত টানাটানি ---বাচ্চাদের ওষুধ কেনার পর্যন্ত পয়সা নেই অথচ
তোমার নেশা করার পয়সা তো ঠিক জুটে যায়!প্রতি রোববার করে বন্ধুদের সাথে ফুর্তি না করলে
চলছে না!
------শিবানী—ই! বলে হুঙ্কার দিয়ে
উঠেছিলো রতন।
দু দিন অন্তর অশান্তি শুরু হয় আর আজকাল
প্রায় কামাই হয়ে যায়। রান্নাবাড়ি প্রায় প্রায় আর যাওয়া হয় না।এখনও তেমনভাবে তাঁকে কিছু
বলছে না কিন্তু এরপর বলতে কসুর করবে না। তারা পয়সার বিনিময়ে কাজ করাচ্ছে। কতদিন
আর এইসব সইবে! ভোর সকালেও শিবানী বেরিয়ে যায়। ঘণ্টা দেড়েক বাদে ফেরে। ফিরে দেখে গজগজ
করছে রতন।
ঘুম থেকে উঠেই রতন গাড়ি পরিস্কার
করতে লাগে। গাড়ি যেন তার প্রাণ। একটা আঁচর লাগলে মনে হয় তার প্রানে আঁচড় লেগেছে।
নিজে হাতে ধোয়—মোছে --- খুঁটিনাটি সব দেখে।সেদিনও তাই করছিল। আচমকা বুক চেপে বসে পড়ল।
ছুট্টে শিবানির ছোট্ট ছেলে পাশের বাড়ির কাকুকে ডেকে এনেছে। তারাই ডাক্তার ডেকে সব কিছু
করল। ডাক্তারবাবু অঢেল পরীক্ষা দিলেন করতে। হিসেব করে দেখা গেল ওই টেস্ট করতেই পাঁচ
হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে।দিন পনেরো পরেই সংসারের সব টাকা ফুরিয়ে গেল। ড্রাইভারকেও এক
হপ্তা ধরে পয়সা দেওয়া হয় নি। সেও কাজ ছেড়ে পালাল।
বড় মুষড়ে পড়ল রতন। এদিকে নিজে
সুস্থ হয়ে উঠেছে অনেকটাই। চাকরিটা ছাড়তে মন চায় না। দু দিন বাদে আবার কাজে লাগবে। সুযোগ
সুবিধে নেহাত খারাপ দেয় না কোম্পানি।কোম্পানির কাছে তার জমানো টাকাও আছে বেশ কিছু ।
মেডিক্যাল ফেসিলিটিও পায় তারা।হাফ বেলা কাজ করে যদি গাড়িটা চালাতে পারত তো মন্দ হত
না। প্রতিদিনের মত সকালবেলা গাড়ি পরিষ্কার করতে করতে এইসব কথাই চিন্তা করছিল
রতন। শিবানী কাজ থেকে এলে তার সাথে কথা বলবে। কিন্তু শিবানীর তো পাত্তাই নেই। আজ যেন
বেশিই দেরী হচ্ছে। এদিকে বাচ্চা দুটোর ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম থেকে উঠেই তাঁরা নানান
বায়না জুড়েছে। এদিকে মাথার ওপর কত দেনার দায় তারপর বাচ্চাদের ঘ্যানঘ্যানানি একদম
ভাল লাগছিল না রতনের। তীব্র রাগ জন্মাচ্ছিল শিবানীর ওপর।বড্ড বারমুখী হয়েছে শিবানীটা!তবে
কি এই সংসারে আর ওর মন নেই! অন্য কেউ জুটে গেল নাকি! যত বেলা বারছিল তত রাগের পারদও
চড়ছিল রতনের। তখন আচমকই দেখল মাকে নিয়ে ঢুকছে শিবানী।
-----মায়ের ট্রেনটা লেট করল তাই। নাহলে আরো আগেই চলে আসতাম।
----- তুমি মাকে আনতে গেছ –কই বলনি তো!মা যে আসবে
তাই তো জানি না আমি!
------ তোমার অসুখ করল...তার ওপর বাচ্চাদেরও অবহেলা
হচ্ছে ।তাই মাকে নিয়ে এলাম।
------মানে --- বলে উঠে দাঁড়াল রতন।তুমি কি করবে?
কি ব্যাপারটা কি বলতো? কি ঠাওরেছ বল তো তুমি? তুমি কেবল সারাদিন বাইরে টো টো করে ঘুরে
বেড়াবে।
-----আলবৎ বেড়াব।
-----মুখে সামলে শিবানী!
----নাহলে যে পথে বসতে হবে।
----তা কি করবে শুনি তুমি?
-----গাড়িটা আমি চালাব।
----তুমি চালাবে? চালাতে জান?
----- হ্যাঁ জানি।
রোজ সকালে উঠে আমি ড্রাইভিং শিখেছি।
----- শুধু শিখলেই হল না। লাইসেন্স চাই।
-----তাও পরীক্ষা দিয়ে ব্যারাকপুর গিয়ে করিয়ে এনেছি।এবার থেকে
মা রইল সংসারের দায়িত্বে। তুমি তোমার কাজ কর নিশ্চিন্তে। আর আমি গাড়ি চালিয়ে বাড়তি
উপার্জন করে সংসারটা ঠিক দাড় করিয়ে দেব। তুমি কিচ্ছু চিন্তা কর না। আমি সব ব্যাবস্থা
করে ফেলেছি। কাল থেকেই আমি বেরিয়ে পরব।আর ড্রাইভারকে রোজ রোজ পেমেন্ট করতে হবে না।
ওখান থেকে অনেক টাকা বেরিয়ে আসবে। দেখ ই এম আই দিয়েও তখন আমাদের হাতে যথেষ্ট টাকা থাকবে।
রতন যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
ভেতর ভেতর শিবানী এত কিছু করেছে! সে মিছিমিছিই শিবানিকে সন্দেহ করছিল!মনে মনে ভাবল
---শিবানীর মত মেয়ে যেন ঘরে ঘরে বৌ হয়ে আসে।সাধে বলে সংসার সুখের হয়......।
Khub sundor lekhoni te bortoman juger narider swanirvorotar ekti ujjol drishtanto .khub sundor ektu uposthapona
উত্তরমুছুন