ডঃ পার্থ প্রামাণিক


সন্ধিপূজো  
✪✪✪✪                                                           
কুরর্ কুরর্ ড্যাম, কুরর্ কুরর্ ড্যাম। মাঝরাতে হঠাৎ ঢাকের আওয়াজে অবাক হয়ে জেগে উঠল গোটা গ্রাম। যদিও এখন দূর্গা পূজোর সময় তবু এগ্রামে তো ঢাকের আওয়াজ হবার কথা নয়।
নদীয়ার চালতেতলা, লোকমুখে ঢাকিদের গাঁ বলে পরিচিত হলেও দূর্গাপূজোয় কোনকালে এখানে ঢাকের আওয়াজ শোনা যায় না। আসলে একক বা বারোয়ারি উদ্দোগে দূর্গাপূজোর আয়োজনের ক্ষমতা এ গ্রামের লোকেদের নেই। সামান্য দিনমজুর বা ভাগচাষীদের গ্রাম চালতেতলা। তবে একটা বিশেষ ব্যাপার আছে এ গ্রামের। এখানকার বেশীরভাগ পুরুষ ঢাক বাজায়। সারাবছর নানা কাজ করে দিনগুজরান করলেও পূজোর কদিন আগে তারা বেরিয়ে পড়ে ঢাক কাঁধে রানাঘাট, নৈহাটী, কাঁচরাপাড়ার বিভিন্ন পূজোমন্ডপে। একেবারে কালিপূজোর শেষে কিছু টাকাপয়সা, নতুন-পুরানো জামাকাপড় আর সিধে নিয়ে ফিরে আসে। বউ, ছেলেমেয়েগুলো কদিন একটু সাচ্ছল্লের মুখ দেখে। তবে কদিন পরে আবার সেই পুনঃ-মুষিক। এইভাবেই চলে বছরের পর বছর। 
এই গ্রামেরই এক পৌঢ় ঢাকি রতন। সারা বছর ছেঁড়া, আধময়লা জামাকাপড় পরে অন্যের ক্ষেতে কাজ করলেও মহালয়ার পরে টিনের বাক্স থেকে ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর বার করে যত্নকরে কেচে, বিছানার নীচে রেখে ইস্ত্রী করে তৈরী হয় সে। গ্রামের অন্য ঢাকীরা নৈহাটী, রানাঘাট স্টেশনে যায়, বাজায় আর পূজোর আয়োজক বাবুরা দরদাম করে ভাড়া করে নিয়ে যায়। রতনের কিন্তু গত বিশ বছর ধরে দূর্গাপূজোর চারদিন একটাই ঠিকানা। হালিশহর চৌধুরী পাড়ার সার্বজনীন পূজোমন্ডপ। বছর কুড়ি আগে নৈহাটী স্টেশনে বাজানোর সময় চৌধুরীপাড়ার মাধববাবু তার বাজনা শুনে রতনের বলা দরেই এককথায় রাজী হয়ে তাকে নিয়ে যান। সেই থেকে টানা বিশ বছর সে বাজিয়েছে চৌধুরীপাড়ায়। পূজোর চারটে দিনের মধ্যে রতনের সবচেয়ে প্রিয় সময় হলো সন্ধিপূজোর সময়টা। এই সময় তার মধ্যে কে যেন ভর করে। সন্ধিপূজোর সময় পূরোহিত মশায়েয় মন্ত্র শুরু হলে সে চোখে আর কিছু দেখতে পায় নাদুচোখ তার ভরে যায় জলে। সে শুধু বাজায় আর নাচে, নাচে আর বাজায়। পূজের শেষে দেখে তার জামা ভরে গেছে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো নোটে। চৌধুরীপাড়ার পূজোর একটা বড় আকর্ষন সন্ধিপূজোয় রতনঢাকির বাজনা আর নাচ। পূজোর কটাদিন সে খুব খাতির যত্নও পায় পাড়ার লোকেদের কাছে। একেকদিন একেক বাড়ী নেমতন্ন পায়। বাড়ীর গিন্নীমায়েরা নিজে বসে থেকে খাওয়ান তাকে।  প্রচুর কিছু নিয়ে সে ফিরে আসে গ্রামে। শিবুর নতুন জামা, শিবুর মার শাড়ী হয়। একটু টাটকা মাছ ভাতের থালায় ওঠে কটাদিন। ছেলেটার চেহাড়াটা যেন একটু চকচকে হয়। গ্রামের অন্য ঢাকিরা যেন একটু ইর্ষাও করে রতনকে। তাকে স্টেশনে দাঁড়িয়ে পূজাকমিটির ভাড়ার জন্য চেষ্টা করতে হয় না। পূজোর মাসখানিক আগেই গ্রামের পরমেষ হাতুড়ে ডাক্তারের মোবাইল ফোনে চৌধুরী পাড়ার কর্তারা ফোন করে তাকে আগাম খবর দিয়ে দেন, সে যেন ঠিক সময়ে পৌছে যায় পূজো মন্ডপে। 
তবে গত বছরেই যেন কোথায় একটু তাল কাটার আভাস পেয়েছিল রতন। পাড়ার পূজোকমিটির কর্তাদের মধ্যে পরিবর্তন হয়েছে। মাধববাবুর মত  বৃদ্ধরা যেন একটু পিছিয়ে এসেছেন। কম বয়সিদের চলাফেরা অনেক বেড়েছে। ঢাকের সঙ্গে যোগ হয়েছে কুড়কুড়ি বাজনার। পাড়ার বয়স্কদের এ বাজনা বিশেষ পছন্দ না হলেও ছোটদের 'ডিমান্ড' মেনে নিতে হয়েছে। রতনের নিজেরও অসহ্য লাগে এ বাজনা। কোথায় ঢাকের চামড়ার পর্দায় ওঠা মধুর বোল আর কোথায় কুড়কুড়ির কারখানায় তৈরী পর্দার কান জ্বালানি আওয়াজ। সেবারই রতন খেয়াল করেছিল যে, রতন বা রতনের বাজনাকে যেন বিশেষ কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। অনান্যবার প্রতি সন্ধায় রতনের বাজনা ঘিরে নানান বয়সি যে বাবুরা, দাদারা, দিদিরা, কচিকাঁচারা নাচের আসর বসাতো এবার তাদের বিশেষ আকর্ষনের কেন্দ্র নতুন ওই বাজনা। তাকে ঘিরেই চলছে সন্ধে বেলার নাচ। মন খারাপ করে এককোনে দাঁড়িয়ে একা একায় বাজাচ্ছিল রতন। তবে সন্ধিপূজোর সময় যখন মাধববাবু হাতের ইশারায় কুড়কুড়িওয়ালাদের থামিয়ে রতনকে বললেন 'রতন ধর', তখন রতনকে আর পায় কে। হ্যা বাজিয়েছিল বটে রতন ঢাকি। এ কদিনের সব অবহেলার জবাব দিয়েছিল তার ঢাকের বোলে। বাজনা থামলে জড়িয়ে ধরেছিলেন মাধববাবু। লোকে বলেছিল বাজালো বটে রতন আজ।
এবারও যথারীতি  মহালয়ার পর রতনের প্রস্তুতি শেষ। ঢাক পালিশ করে, পালকের সাজ লাগিয়ে প্রস্তুত সে। কিন্তু ডাক্তার বাবুর ফোনে ফোন আর আসে না। শিবুর মা বললে, ' দেখোনা কটা দিন, তোমার তো বিশ বছরের পাড়া, ডাকবেখন।' কিন্তু মহাষষ্ঠীর দুদিন আগেও যখন ফোন এলোনা তখন সে নিজেই বেরিয়ে পড়ল। হয়ত বাবুরা ডাক্তারবাবুর ফোন নম্বর হারিয়ে ফেলেছেন। তার বিশ বছরের পুড়ানো পাড়া, তাকে ডাকবেনা, তা আবার হয় নাকি কখনো। কয়েক ঘন্টা ট্রেন, বাসের ভেতর ধাক্কাধাক্কি সহ্য করে পৌছলো চৌধুরী পাড়ায়। আর পূজো মন্ডপে গিয়েই মাথায় বজ্রাঘাত। পূজোমন্ডপে দাঁড়িয়ে আছে এক ছোকরা ঢাকি আর জনা দশেক কুড়কুড়িওলা। পায়ের নিচের মাটি দুলে উঠলো রতন ঢাকির, বসে পড়লো মাটিতে। 'বাবু আমারে এবার ডাকলেন না' একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। এগিয়ে এলেন অল্প বয়সি আকাশদাদা। বললেন, রতনদা তুমিতো বেশ বুড়ো হয়ে গেছো এবার আমরা কম বয়সি একজনকে এনেছি। তুমি কিছু মনে করো না, নৈহাটি স্টেশনে চলে যাও, ভাড়া ঠিক পেয়ে যাবে।' কথা সরছিল না রতনের তবু একবার বললে ' মাধববাবু কোথায় গো দাদা? একবারটি দেখা করবো।' 'মাধবজেঠু অসুস্থ, ওঁর সঙ্গে দেখা করা যাবে না' একটু কড়া গলাতেই উত্তর এল। রতন তবু একটা মরিয়া চেষ্টা করলো, ' আমারেও একটু থাকতে দেননা দাদা, পূজোমন্ডপে একপাশে পড়ে থাকবো, যা দেবেন তাই নেব, আমারে শুধু একটু সন্ধিপূজোয় বাজাতে দেন,' 'না গো, তা আর হয় না, তুমি বরং এখন এসো, আমি এখন খুব ব্যস্ত। এবার আমাদের পূজোর পঞ্চাশ বছর তো, বুঝতেই পারছো।' 
কোন রকমে শরীরটাকে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে এল রতন, কারও কোন প্রশ্নের জবাব দিল না।  রতনের মুখ, চোখের দিকে চেয়ে শিবুর মাও বিশেষ কিছু জানতে চাইলো না। একরকম জোর করেই শিবু আর তার মাকে পাশে গ্রামে শিবুর মামার বাড়ি পাঠিয়ে দিল রতন। বললো পূজোর কটা দিন সে একা থাকতে চায়। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী কিছু খেলো না। চুপ করে শূন্য দৃষ্টিতে বসে রইলো সারাদিন, সারারাত। পাড়ার মেয়ে বউদের দিয়ে যাওয়া ডালভাত বেড়ালে খেয়ে গেলো। কিন্তু অষ্টমীর রাতে আর সে চুপকরে থাকতে পারলো না। হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লো। অভুক্ত শরীরটাকে টানতে টানতে পুকুরঘাটে নিয়ে গেল, পরিস্কার ধুতি পাঞ্জাবী পরে নিল। স্নান সেরে আসার সময় যে চারটে কাশফুলের শীষ নিয়ে এসেছিল সেগুলো গুঁজে নিল ঢাকের পিছনে। বাড়ির সন্ধাপ্রদীপটা এনে রাখলো উঠোনের ঠিক মাঝখানটায়। দেশলাই কাঠিটা প্রদীপটার সামনে ধরতেই সলতে আর গত তিনদিন ধরে রতনের বুকে ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা ক্ষোভ, দুঃখ আর অভিমানগুলো দাবানলের রূপ নিলো। চোখ বুঁঝতেই রতন দেখতে পেলো হালিশহরের চৌধুরীপাড়ার সাবেক ধরনের দূর্গা মায়ের মুখ, সন্ধিপূজোর সময় ঠাকুর মশায়ের পঞ্চপ্রদীপ হাতে আরতি। রতনের ঢাকে পড়লো কাঠি আর পায়ে উঠলো তাল। পাগল হয়ে গেল রতন ঢাকি। 
প্রথমে অবাক হওয়া, তারপর ভাঙা দেওয়ালের পাশদিয়ে উঁকিঝুঁকি। পাড়ার মেয়ে বউরা দেখলো তাদের রতন দাদা একটা মাটির প্রদীপের সামনে নাচছে আর ঢাক বাজাচ্ছে। ঢাকিদের গ্রাম হলেও এমন ঢাক কখনো শোনেনি চালতেতলা। এক অসহায় অভিমানির কান্না যেন ঢাকের আওয়াজ হয়ে রাতের বাতাসে মিশে মিশে যাচ্ছে একটু শীতলতার আশায়। দু-একজন এগিয়ে যেতে চাইলেও মানদা পিসি সবাইকে হাত তুলে বারন করলেন। বেশ কিছুক্ষন বাজনা শুনে যে যার ঘরে খিল দিল। বাজনা তখনও থামে নি।
তখন সবে পূব আকাশে অন্ধকার একটু কমেছে। গভীর রাতে ঢাকের আওযাজ থামার পর একরাশ উদ্বেগ আর প্রশ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে রতনের গ্রাম। হঠাৎ খুলে গেল তার বাড়ির দরজা। লাল চোখ, জলে ভেজা দুই গাল আর কাঁধে ঢাক নিয়ে বেরিয়ে এল সে। ধীর পায়ে এগিয়ে চললো গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা চূর্নি নদীর দিকে। আরো কিছুক্ষন পর যখন পূব আকাশে কুসুম রঙা আলো দেখা দিতে শুরু করেছে, তখন একবুক জলে ঢাক মাথায় করে দাঁড়িয়ে রতন। কি যেন বিড় বিড় করছে। ভোরের বাতাস শুধু কানপেতে শুনতে পেলো রতন ঢাকি বলছে, ' মা, তোমার পূজোয় ওরা আমারে বাজাতে দিলে না। তোরও বুঝি রতনের ঢাক আর শুনতে ভালো লাগেনা, নইলে তুই চাইলে কার কি ক্ষ্যামতা আমারে না বাজাতে দেয়। কিন্তু মাগো, তোমার সন্ধিপূজোয় না বাজালে যে আমি বাঁচতে পারতাম না মা। আমার বুকের ধুকপুক করার যন্ত্রটা বন্ধ হয়ে যেত। আমি মলে শিবু আর শিবুর মাটা যে না খেতে পেয়ে মরবে। আমার সন্তানরে তো আর আমি ফেলে দিতে পারি নে। তাই বাবুদের পাড়ায় তোরা আমার ঢাক না শুনতে চাইলেও আমি না বাজিয়ে পারিনি মা। আমায় ক্ষ্যামা করেদিস । তবে আর কোনদিন বাজাবো না, আর তোমায় বিরক্ত করবো না। তোর পূজোয় বাজানো ঢাক তো আর ভেঙে ফেলতে পারি নে তাই নদীতে ভাসায়ে দিলাম। কাল তোর বিসর্জন, সগ্গে পৌছেই দেখবি রতন ঢাকির ঢাক তোর দুয়ারে এসে গেছে। একটু যত্ন করে রাখিস মা। যেদিন এখান থেকে তোর কাছে যাব সে দিন যদি শুনতে ইচ্ছে হয় বলিস, সেদিন খুব বাজাবো; ততদিন আর না, আর না।' ধীরে ধীরে রতন ঢাকির ঢাক ভেসে চললো নদীর হাল্কা স্রোতে। ভোরের আকাশ শুধু সাক্ষী হয়ে রইলো রতন ঢাকির চোখের লোনা জল আর চূর্নীর মিঠা জলের সন্ধিপূজোর।


মন্তব্যসমূহ

  1. কি বলবো! দারুন! মনের গভীর থেকে যে লেখা উঠে এসেছে বুঝতে পারছি। দেখার মতো চোখ এবং অনুভব করার মত মন ঈশ্বর আপনাকে দিয়েছে এটাই এই গল্পে আমার পাওনা। এসব চরিত্র ছাড়া গল্প অনাথ। এরা বাঁচলে গল্প ও বেঁচে থাকবে।কলমেশকলমে আরও আসুক এই কামনা রইল।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. Everyone has to go through this phase ... like that of Roton... i could actually see myself in him through your story! A story of everyones life beautifully depicted through this chatacter. Great one!!! Yeh dil mange more ...

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য