অমিতাভ দাস
আধুনিক
হিন্দি কবিতা :কিছু কথা
✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪
যে
গদ্যটি লিখতে চলেছি , তার বিষয় আধুনিক
হিন্দি কবিতার চর্চা । এ সম্পর্কে কিঞ্চিত পাঠ করবার সুযোগ হয়েছিল । তা থেকেই
দু-চারটি কথা বলার চেষ্টা করবো এই রচনায় ।
কেবল
পাঠক হিসেবে আমার অনুসন্ধিৎসাই যার কারণ ,আর কিছু নয় ।পড়তে গিয়ে দেখলাম সমালোচকরা বলছেন ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্র ও
তাঁর অনুগামী কবিদের হাত ধরেই আধুনিক হিন্দি কবিতার সূচনা ।সময়টা 1857 থেকে 1947 সাল । সমালোচকরা এই সময়কে কয়েকটি পর্বে
ভাগ করেছেন ।
এক.
ভারতেন্দু
যুগ ।1850থেকে1900 সাল ।
দুই
.
দ্বিবেদী
যুগ ।1900--1920 সাল ।
তিন.
ছায়াবাদী
যুগ ।1920--1937 সাল ।
চার.
প্রগতীবাদী
যুগ ।1937--1943 ।
পাঁচ.
প্রয়োগবাদী
যুগ ।1943--1950 সাল পর্যন্ত ।
সুতরাং
দেখা যাচ্ছে প্রায় একশো বছরের ভিতর অনেক ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়ে আধুনিক হিন্দি কবিতা
এগিয়েছে ।প্রতিটি পর্বেই নানা ভাঙচুড় ,নানা পরীক্ষার ভিতর দিয়ে ছিল তার যাত্রা ।ভারতেন্দু ছাড়াও আর যাঁরা ছিলেন
প্রথম পর্বে তাঁরা হলেন বদরী নারায়ণ চৌধুরী ,রাধাকৃষ্ণ দাস ,অম্বিকা দত্ত ব্যাস প্রমুখ ।
বাংলায়
যেমন মধুসূদনের 'মেঘনাদ বধ ' কাব্যের রচনাকাল 1861 থেকে আধুনিক কবিতার সময় কাল
ধরা হয় ।হিন্দিতেও প্রায় একই সময় থেকে ভারতেন্দুর হাত ধরে হিন্দি কবিতার আধুনিকতার
পথ চলা শুরু ।
ভারতেন্দু
প্রচুর লিখেছেন ।অনেকগুলি কবিতার বই আছে ।তিনিও মধুকবির মত নাট্যকার বটে ।আধুনিক
কাব্যের যে কিছু কুলগত বৈশিষ্ট্য যেমন ,ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রবোধ ,নারী জাগৃতি ,স্বাধীনতা স্পৃহা ,আত্মমুখীনতা তথা সমাজ ভাবনা --সবই
আমরা ভারতেন্দুর লেখাতে পাই ।
তিনি
ছিলেন যুগ-প্রবর্তক কবি। প্রাচীন কাব্যের প্রতি যেমন আনুগত্য ছিল ,তেমনি ছিল আধুনিকতার প্রতি আগ্রহ ।ভারতেন্দুর ভাবনা ছিল--'নিজভাষা উন্নতি সব উন্নতির মূল ।' তিনি নিজ ভাষার
প্রতি জোর দিয়েছিলেন ।মাধুর্য তাঁর কাব্যের মহৎ গুণ ।ব্রজভাষার প্রয়োগ তাঁর কাব্যে
ছিল অধিক ।প্রেরণা আদর্শবাদ ও জাতীয় উন্নতি । এ ক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে ঈশ্বর
গুপ্তের সাথে তাঁর মিল আছে ।কেননা ,তাঁর 'সুন্দর তিলক' বা 'মুকরিয়োঁ'
তে প্রাচীন ও নবীন ভাবনার মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায় ।
আবার
দ্বিবেদী যুগের বক্তব্য ছিল ,'কবিতা কা
বিষয় মনোরঞ্জক এবং উপদেশজনক হোনা চাহিয়ে ।' দ্বিবেদী যুগের
শ্রেষ্ঠ কবি মৈথিলীশরণ গুপ্ত ।তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় সরস্বতী পত্রিকায় 1905
সালে ।কবিতার নাম হেমন্ত ।
এরপর
তাঁর কবিতায় ধর্মীয় ও রাষ্ট্রিক চেতনার স্ফুরণ দেখলাম আমরা ।মধুকবির মত তিনিও রাম
ও রামায়ণের ঘটনাকে আধুনিক মননে কাব্যরূপ দিলেন 'সাকেত ' কাব্যে (1931) ।
এই
যুগের অন্য কবিরা হলেন অযোধ্যাসিংহ উপাধ্যায়
,লোচনপ্রসাদ পান্ডেয় ,শিয়াশরণ
গুপ্ত ,সত্য নারায়ণ কবিরত্ন ,নাথুরামশংকর
প্রমুখ ।
দ্বিবেদী
যুগের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য এই রকম—
ক
।
নিরস
কবিতা কবিতা হী নহী অর্থাত্ রস কবিতার প্রাণ ।
খ
।
অর্থ
ও রসের সার্থক সমন্বয়ে প্রকৃত কবিতা সৃষ্টি হয় ।
গ
।
কব্যপ্রতিমা
নির্মাণই কবির প্রধান লক্ষ্য ।
এই
সূত্রগুলি মূলত মহাবীর প্রসাদ দ্বিবেদীর রসজ্ঞ রঞ্জন ও অন্য সমালোচনা থেকে সংগৃহীত
।মৈথিলীশরণের কবিতায় দ্বিবেদী যুগের কাব্যবৈশিষ্ট্যের ছাপ ছিল প্রকট ।তাঁকে
গান্ধিজী বলেছিলেন রাষ্ট্রকবি ।জাতীয় ভাব ও ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন ।
এর
পরেই চলে এলো ছায়াবাদ ।ছায়াবাদ সম্পর্কে অনেকে অস্পষ্টতার অভিযোগ করেন ।তবে সেটা
ঠিক নয় ।ছায়াবাদ কোনো রহস্যবাদ বা অস্পষ্টতাবাদ নয় ।ছায়াবাদে প্রকৃতির সৌন্দর্যের
পাশে কবি হৃদয়ের সুক্ষ্ম ভাবের প্রকাশ থাকে বেশি ।এই পর্বের প্রধান কবি নিরালা
।নিজের লেখা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন ,'মৈনে জো কুছ ভী লিখা ,সদৈব নতুনতা সে দৃষ্টি কোণ সে
লিখা ।' তিনি পরিমল কাব্যে লিখেছেন ,
'দেখতা হুঁ
ফুলতে
নহীঁ ফুল বসৈ বসন্ত মেঁ
জৈ
সে তব কল্পনা কী ডালো পর খিলতে হৈঁ ।'
এখানে
কল্পনার চাইতে হৃদয়ের আকুতিই প্রাধান্য পেয়েছে ।অনুভূতিরই প্রকাশ ঘটেছে ।
ছায়াবাদের
আরেক কবি সুমিত্রানন্দন পন্ত ।কাব্যে অন্তর্চেতনার পাশাপাশি প্রাধান্য পেয়েছে
সংগীত গুণ ।তাঁর কাব্যের আরেক গুণ আধ্যাত্মিকতা ।লিখেছেন ,'গান হী মেরে প্রাণ ,অখিল প্রাণো মেমেরে গান ।'
ছায়াবাদের
আরেকটি বড়ো বৈশিষ্ট মানবতাবাদ । মহাদেবী বর্মা ছায়াবাদী কবি হিসেবে অন্যতম ।তিনি
লিখলেন ,
'মেরে হঁসতে অধর নহীঁ জগ-
কী
আঁসু লড়িয়া দেখো !
মেরে
গিলে পলক ছুও মত
মুরঝাই
কলিয়া দেখো !
ছায়াবাদী
কাব্যান্দোলনে মহাদেবী বর্মার ভূমিকা অসীম ।তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি
হলো--
ক
।ভাব তন্ময়তা ।
খ
।প্রকৃতির প্রতীকীরূপকতা ।
গ
।সংগীতময়তা ।
ঘ
।রহস্যময়তা ।
ঙ
।দুঃখকাতরতা ।
ছায়া
শব্দটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ,'স্বচ্ছন্দ চন্দে মেঁ চিত্রিত উন মানব অনুভূতিয়োঁ কা নাম ছায়া' ।
প্রকৃতিমগ্ন
কবি প্রিয় আগমনের সংকেত বার্তা শুনতে পান ।লেখেন 'সান্ধগীত ' ।
রঞ্জিত
কর দে য়হ শিথিল-চরণ
লে
নব অশোক কা অরুণ রাগ ।
এভাবেই
প্রকৃতির ওপর নিজস্ব ভাবকল্পনার আরোপ করেন তিনি ।আবার কোথাও প্রকৃতি হয়ে ওঠে
সুন্দরী নারী ।
"রূপসী তেরা ধন কেশপাশ
শ্যামল
শ্যামল কোমল কোমল
লহরাতা
সুরভিত কেশপাশ ।"
আবার
মিস্টিসিজম বা মরমীয়াবাদ তাঁর কাব্যকে সুরভিত করেছে ।লৌকিক প্রেম অলৌকিক হয়ে ওঠে
তাঁর কাব্যে ।মিলন অপেক্ষায় বিরহবোধে পূর্ণ তাঁর কবিতা ।লিখেছেন ,'
মিলন কা মত নাম লে
বিরহ
মেঁ মৈঁ চির হুঁ ।' মহাদেবী বর্মার মধ্যে
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল ।সেকথা তিনি অকপটে স্বীকার করতেন ।কেননা
স্কুলজীবন থেকেই তিনি রবীন্দ্রকবিতা পাঠ করে আসছিলেন ।
এর
পর প্রগতিবাদী আন্দোলন দেখা দেয় হিন্দি সাহিত্যে ।সময়টা 1940
সাল ।এই আন্দোলনের প্রধান হোতা নাগার্জুন ।তাছাড়া সুমিত্রানন্দন
পান্তের লেখাতেও প্রগতিবাদের ছোঁয়া এসে লাগে ।এছাড়াও কেদারনাথ আগ্রবাল ,রাঙ্গেয় রাঘব ,গিরিজাকুমার ,শিবমঙ্গল
সুমন প্রগতিবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত ।
#
কবি
নাগার্জুন সমাজ সচেতন কবি ।রাজনৈতিক সাম্য রচনার কথা বলেছেন তিনি ।অন্যায় শোষণের
বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন ।প্রচুর ব্যঙ্গ কবিতাও লিখেছেন । কেবল হাস্যরস নয় ,যেন চাবুক চালিয়েছেন সমাজের পীঠে ।
মহামানব--কবিতায়
কবির ব্যঙ্গের লক্ষ্য কিছু অসত্ গান্ধীবাদী নেতা ।
'বেচ বেচ কর গাঁধীজী কা নাম
বটোরো
ভোট
ব্যাঙ্ক
ব্যালান্স বাঢ়াও
রাজঘাট
পর বাপু কী বেদী কে আগে অশ্রু বহাও ।'
'
কিছু নেতা ,যাঁরা গান্ধীজীর নাম বেঁচে খায়
।তাঁদের ভোটবাক্সে ভোট ,ব্যাঙ্কে টাকা বেড়ে যায় আর তাঁরা
বাপুর নামে রাজঘাটের সমাধিস্থল কুম্ভীরাশ্রুতে বইয়ে দেয় ।'
কবি
নাগার্জুন সংগ্রামী । ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ।গান্ধীজীর মৃত্যুর পর শপথ
কবিতাটি লেখার জন্য তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল ।
বিফল
হৈ গুলাব কবিতায়
কি চমৎকার বললেন ,
"বিফল হৈ গুলাব ,
করেগা
প্যার কৌন
কন্টকিত
বৃন্ত কো ?
বিফল
হৈ গুলাব ,
সমঝেগা
কৌন
অন্তর্ভেদী
মুকুলিত সৌরভ
#
বিফল
হৈ গুলাব ,
মৃদুতা
কো করেগা অঙ্গীকার
কহাঁ
,কৌন সংকল্প দীপিত বক্ষ
#
বিফল
হৈ গুলাব ,
সুনেগা
অব কৌন
গমলৌঁ
কা অরণ্যরোদন ?"
নাগার্জুন
।জন্ম 1911
সালে ।মাতৃভাষা মৈথিলী ।যাত্রী ছদ্মনামে সুবিখ্যাত ।তাঁর আসল নাম
বৈদ্যনাথ মিশ্র ।অথচ নাগার্জুন নামে তিনি খ্যাত ।বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর 1936
সালে তাঁর নাম হয় নাগার্জুন ।তখন তিনি সিংহলে ।1938 এ ভারতে ফিরে এসে বৌদ্ধধর্ম ত্যাগ করে সংগ্রামী কাজে যোগ দেন ।1942এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন ।
তাঁর
অনেক কবিতার বই ।উল্লেখযোগ্য যুগধারা ,তালাও কী মছলিয়া ,খিচড়ী বিপ্লব দেখা হমনে ,প্রেত কা বয়ান ,অপনে খেত মে ইত্যাদি ।1968 সালে সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার পান মৈথিলী ভাষায় রচিত 'পত্রহীন নগ্ন গাছ' কাব্যগ্রন্থটির জন্য ।
প্রগতিবাদ
আধুনিক ভারতীয় কাব্য উপন্যাস নাটকে বেশ প্রভাব ফেলেছিল ।চল্লিশের দশক থেকে এই
পর্বের যাত্রা শুরু ।বাংলায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'পদাতিক' ,ওড়িয়া ভাষায় মনমোহন মিশ্রের 'মুক্তি সংগীত ' ,তেলেগুতে দাশরথির' অগ্নিধারা' ,মারাঠি ভাষায় শরৎচন্দ্র মুক্তিবোধের 'যন্ত্রিক' উল্লেখযোগ্য কাব্য ফসল ।যার আবেদনকে আজ ও
অস্বীকার করতে পারে না সচেতন কাব্য পাঠক ।
প্রগতিবাদী
কবিরা সাম্যবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন ।সমাজের প্রগতি ছিল তাঁদের লক্ষ ।ছায়াবাদের
কল্পনা পেরিয়ে ,প্রগতিবাদের
সমাজচেতনার পথরেখা ধরে চলে এলো প্রয়োগবাদী কবিতাচর্চার যুগ ।বলা যায় প্রগতিবাদের
প্রতিক্রিয়া থেকে জাত প্রয়োগবাদ ।এর মূল কথা 'ন ঈ কবিতা'
র অন্বেষণ ।
অজ্ঞেয়
,ধরমবীর ভারতী ,গিরিজাকুমার মাথুর এই পর্বের
কবি । জনৈক সমালোচক লিখেছেন ,"প্রয়োগবাদই নতুন কবিতার
পথ প্রস্তুত করেছিল ।প্রয়োগবাদীরা অর্থ ব্যঞ্জনায় নতুনত্ব আনতে আগ্রহী ছিলেন ।তাই
বুদ্ধিমার্গ ও ভাবনামার্গ মিলে মিশে গিয়েছে তাঁদের কবিতায় ।অনুভূতি ,শব্দ জিজ্ঞাসা ,চিত্রকল্প প্রভৃতির মিশ্রণে নতুন
কাব্যপ্রতিমা নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন ।এই নতুন নির্মাণে লোকদর্শনও গুরুত্ব পেয়েছে
।"
প্রয়োগবাদ
আধুনিক হিন্দি কবিতাকে নতুন দিশা দেখিয়েছিল ।এই ধারার কবিরা সর্বদা জীবনকে আস্বাদন
করতে চেয়েছেন ।তাঁরা শব্দকে সাধারণ অর্থের বাইরে গভীর অর্থে প্রয়োগ করেছেন
।তাঁরা নিখিল সৌন্দর্যের সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন মানবতাবাদকে ।আর এখানেই হয়তো প্রয়োগবাদের
সার্থকতা ।
তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, লেখকের কলমের গুণে লেখাটি দারুণ ভাবে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ সোনালী।
মুছুনতথ্যসমৃদ্ধ লেখা, লেখকের কলমের গুণে লেখাটি দারুণ ভাবে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে
উত্তরমুছুনভালো লেগেছে আরো এমন পড়তে চই
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ সৌমী ।
মুছুনঅনেক কিছু জানলাম,এ ধরনের প্রবন্ধ আরও পড়তে চাই
উত্তরমুছুন