হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পরিত্যক্ত ভূখণ্ডের পোড়ো অক্ষরমালা
-----------------------------------------


অনেক বছর বসে আছি গাছের পাশে। অনেক সময়ই সেটা ভুলে যাই। গাছের পাশে বসে, কখনও গাছের গায়ে হেলান দিয়ে মাঝে মাঝেই গাছের কথায় সাঁতার কাটি। আলাদা করে কখনও মনে হয় না, এটা কাউকে বলার মতো। গাছের সঙ্গে যোগাযোগ যে কোনো নতুন বাক্যে যখন তখন সাজানো যেতে পারে। অনেকেরই কানে গিয়ে তা থেকে যেতে পারে অনেকক্ষণ। কারণ এইধরনের বাক্য সচরাচর খুব একটা তৈরি হয় না আর হলেও তা পরিবেশনের ভুলে অনেকের কাছেই অবহেলা পায়। আসলে এটা তো সত্যি যে জল কাদা দিয়েই বর্ষা হেঁটে আসে আবার মাঠের সবুজেও তাকে বেশ উজ্জ্বল করেই ধরে রাখা যায়। কিন্তু অশক্ত বা অদক্ষ হাতে নাড়াচাড়ার ভুলে অনেক কিছু গুলে গিয়ে রঙ বদলে বদলে তা অনেক বেশি রুক্ষ হয়ে যায়। 

যেদিন প্রথম জানলা দিয়ে চোখ বাড়ালাম সেদিন তাকানোটা মিথ্যে হয়ে যেতে পারতো। পৃথিবী সম্পর্কে একটা একপেশে ধারণা তৈরি হয়ে যেতে পারতো। মনে হতো পৃথিবীতে কোনো আচ্ছাদন নেই যার নিচে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে মাথা রাখা যেতে পারে। মনে হতে পারতো পৃথিবী জুড়ে শুধুই বালি। ভারসাম্য বজায় রেখে ঠিকমতো দাঁড়াতে না পারলে চোখ জুড়ে এসে দাঁড়াতো অশান্ত মহাদেশ। কিন্তু সেদিন গাছ শুধু চোখ নয় মাথার ওপর টাঙিয়ে দিয়েছিল সবুজের চাঁদোয়া। একদিন পা তো হাঁটবেই মরুভূমি দেশে। তবুও এখনই সবটুকু নয় ----- বুঝেছিল গাছ। সবুজের গহন প্রদেশে নিমজ্জিত হওয়ার আনন্দে মন প্রথম দিন থেকেই পাতার পর পাতা পাঠের ইচ্ছা প্রকাশ করে। আপ্তবাক্য পাঠের আগেই রক্তের মধ্যে প্রবেশ করেছিল গাছের সঙ্গে আত্মীয়তার বীজ।

ঠিক মনে নেই, জানলা দিয়ে কে একজন ডেকেছিল। গাছ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কে ডেকেছিল তা আমার কাছে খুব একটা বড় মনে হয় নি। শুধু মনে হয়েছিল আমাকে কেউ ডেকেছে। এটাই আমাকে ভাবিয়েছিল অনেক বেশি। তার মানে আমি ডাকার মতো হয়েছি। জানলা দিয়ে আমি কিছুটা হলেও ওই ছেলেবয়সে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু আমার এই খবর নিয়ে গেল কে ? ওই ছেলেবয়সে কাকেই বা চিনতাম। কে-ই বা আমায় গুরুত্ব দিয়েছে ? কথা বলার মানুষ বলতে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াতেই সে। গাছ কি শুধু গাছের মতো করেই নিজের চারপাশে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে ? সেখানে কি আমার কোনো উপস্থিতি ছিল না ? গাছের শরীর মন জুড়ে কোথাও কি আমার কোনো স্বপ্ন লুকিয়ে ছিল না ? একজনও কেউ গাছের মধ্যে আমাকে খুঁজে পায় নি ? 

কখনও কোনো রোদ্দুরমাখা দুপুরে অথবা বৃষ্টিভেজা সন্ধেয় আমার মনে হতো জানলা দিয়ে গাছই আমায় ডেকেছে। সেই কোন সকালে গাছের এক একটা কথা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ত। সেখানে আমার পরিবারের সঙ্গে গাছও কখন এক হয়ে গেছে। আকাশ না দেখেও কোনো কোনো দিন গাছের শরীরী উষ্ণতায় আমাদের পড়া হয়ে যেত মেঘের গাঢ়ত্ব। প্রয়োজনে কখনও ঢেকে ফেলতাম নিজেকে আবার কখনও আকাশ ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে ছড়িয়ে দিতাম রোদ্দুরের মতো। এতো গাছেরই কোনো এক সকালের পাঠ। 

কোনো এক উদাসী দুপুরে কোনো পথই চারদেওয়ালের শাসনে আবদ্ধ হতে চায় না। সেই সময় কোনো নদীর তীর ধরে অথবা উন্মত্ত জলরেখার হাত ধরে হারিয়ে যেতে যেতে আবার সবুজের গন্ধে যখন কেন্দ্রে ফিরে আসে তখন সারা মাটি জুড়ে গাছের শরীরের ফাঁক দিয়ে কখন যেন রোদ আল্পনা এঁকে দেয়। এসব তো গাছের ঘর। গাছের শরীরী প্রবাহ থেকেই উত্থিত হওয়া এক একটা প্রকোষ্ঠ। সবুজের আখড়া। সাতসকালেই বসে গেছে আলোপথের উত্থানের পাঠে। আমিও কখন যেন আলো ছায়ার হাত ধরে আখড়ার অনুশীলনে। আমার গায়ে কি কোনো হারানো পথের গন্ধ ছিল ? হয়তো ছিল আর ওইটুকুই হয়ে গেল আমার উৎসবিন্দুর সূত্র। আলোর মন্ত্র পড়তে পড়তে কখন যে অন্দরমহলে পা রেখেছি জানি না। সবুজ জলের পৃথিবীতে নৌকা ভাসিয়ে দেখি পা কবেই চৌকাঠ পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে। নেই কোনো বয়সের মাপকাঠি। ঘরের পাঠ শেষ করেই চেনা মুখের সারি পার হয়ে অজানা অচেনাকে আত্মস্থ করার চেষ্টা। নদীর মতো জীবনযাপন প্রণালী। ঘর থেকে বেরিয়েই আপন ছন্দে বয়ে চলার অঙ্গীকার। আমার হাতে এসে কী উঠল ? আমার চলার পথে কারাই বা পা রেখে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে গেল আরও কয়েক পা ? কোথাও ওড়ে না এসব কথা। অধ্যয়ন চলাকালীন সময়ের শরীরী ভাষাই এখানের সারা জীবনের পাথেয়। সমগ্র জগতের কাছেই এরা বড় বিনয়ী। শুধু চোখ চেয়ে আর কান পেতে আছে সারাটা দিন। খোলা আকাশের নিচে তাই এদের বিস্তার বিস্মিত করে।

জল মাঠ সবুজ পেরিয়ে যখন ঘরে ফিরি তখন তো বিকেলের ঘরে চাবি পরে গেছে। আমার দীর্ঘ পথ পরিক্রমার খবর কথায় উঠে আসে। সে এক অসামান্য সফর। গাছেরা তো জানেই না তারা কে। পূর্বাপর অভিজ্ঞতায় তারা শুধু চিনেছে মাটি। যেখানে প্রথম পা রেখেছি পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকার জন্যে সে তো আমার জন্মমুহূর্তের আলোর বিন্দু , এই আলোকবিন্দু তো আমার আমৃত্যু সঙ্গী -------- এসব তো তার কাছ থেকেই শোনা। তবুও এসব কথারা উড়ে যায়। কোথাও কোথাও এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। বাক্যবন্ধের চিরসবুজ কমনীয় রূপ কিন্তু তবুও বেশিরভাগ মুখেই তা অনুক্ত থেকে যায়। সভ্যতার চাদরে ঝরে ঝরে পড়ে জং ধরা কালো কালো গুঁড়াে অক্ষর। বোঝা যায় অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে সভ্যতার নিজস্ব পরিচয়। এখন পরিত্যক্ত ভূখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে পোড়ো অক্ষরমালা। 


মন্তব্যসমূহ

  1. ভীষণ মায়াময় লেখা। বরাবরের মতো ভালোলাগা

    উত্তরমুছুন
  2. এসব লেখায় লুকানো নেশা একবার খুঁজে পেলে,,,মন্তব্য বেমানান হয়ে যায়।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য