দীপশেখর চক্রবর্তী



সেলুনের শাদা আলখাল্লা
❂❂❂❂❂❂❂❂❂❂❂❂❂
বড় লরিটার সামনে মাল খেয়ে নাচতে নাচতে আসছিল শ্যামা। নাচছিল না,উড়ছিল যেন । আমি ভ্যানের ডানদিকে বসে দেখলাম শ্যামা নাচের আবেগে একেকবার চলে আসছে সামনের মেয়েদের জটলাটার গায়ে।জগদ্ধাত্রী পুজোর ভাসানের শ্যামা সেদিন উড়তে উড়তে চলে গেছিল পৃথিবী ছাড়িয়ে।

শ্যমার নাম যে শ্যামা তা আমি জেনেছিলাম বড় লরিটার চাকা ওর মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়ার পর। তিন চারটে মেয়ে নাকি সেই ভাসানের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যায় এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখে।লরিটার দাউ দাউ করা আগুন শ্যামার চিতার মতো জ্বলে আমাদের এই মফঃস্বলের আকাশ কালো ধোঁয়ায় ভরিয়ে দিচ্ছিল।
সেবার থেকেই ভাসান বন্ধ মধুমুরলিতে।পুজোটাও এখন হওয়ার জন্য হয়। বিকেলবেলা মনোরঞ্জনের মাঠে বেপাড়ার ছেলেরা এসেও খেলে যেত। পূর্ব বারাসাত ইশকুলের বিরাট ছায়াটা তখন আমার কিশোরবেলার মতো দাঁড়িয়ে থাকতো মাঠের বাইরে। আমাকে কেউ কখনও খেলায় নেয়নি। ছোট থেকে ক্রমাগত বড় হয়ে উঠেছে আমার শরীর।বৃদ্ধ আলুকাবলিওয়ালা তার টিনের গাড়িটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো মাঠের বাইরে। ইশকুলের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। শেষ হত বিক্রির মুখ্য ভাগটা। তারপর বিকেলের এই খেলা দেখার মধ্যে একজন দুজন কিশোর এসে আমসির আচার কিনে নিয়ে যেত।
বুকের মধ্যে ব্যথাটা কি বেদনার নাকি অসুখের তা ভালো করে বুঝতে পারতো না এই আলুকাব্লিওয়ালা।তবে যাই হোক না কেন তার উড়ে যাওয়ার পথ এবং শ্যামার উড়ে যাওয়ার পথ এক নয়। আলুকাবলিওয়ালা ওড়ে এই মনোরঞ্জনের মাঠের ওপর দিয়ে। অদৃশ্য আচার বিক্রি করে মাঠের ছেলেদের কাছে। একেকদিন মাঠের মধ্যে নেমে আসে খেলার জন্য। নিজেকে আজকাল বেশ ফুরফুরে লাগে তার।
এই মাঠের পাশে পাপানদের দোতলার ছাদের চিলেকোঠার ঠাকুর মাঝে মাঝে ছাদে এসে বসে। ছাদের উত্তর দিকের জঙ্গলটায় একটা দাঁড়াশ সাপ শুয়ে আছে ছায়ার মধ্যে। দূরের উঁচু বাড়িগুলো দেখে তার মনটা কেমন ছ্যাঁক করে ওঠে।আসলে এমন হয়। পুরনোদের প্রতি চিরকাল আমাদের একটা টান ঠিক থেকে যায়। উত্তরদিকের মাঠের দিকে তাকিয়ে পুরোনো খেলাগুলোর কথা মনে আসে তার। এখন সেখানে কত জাল। একজন দুজন প্রশিক্ষক। বেপাড়ার ছেলেদের খেলা বন্ধ। মাঠের মধ্যে মাঝে মাঝে বিয়েবাড়ি বসে। উৎকট শব্দে মাঝে মাঝেই রাতের ঘুমটা নষ্ট হয়ে যায় তার। এদিকে চিলেকোঠার ঘরটায় একটাই ছোট জানলা। বাইরে বেরিয়ে এসে বড় রাস্তার দিকে চোখ যায় ওর। একজন দুজন কেমন ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফের  সাইকেল চালিয়ে এই নৈশব্দের মাঝে।এমন সুখের কথা ভাবেন ঠাকুর।খুব একা লাগে তার।মনে হয় কারও কাছে একটা ফিরি। অথচ এই তার নিস্তব্ধ চিলেকোঠা। ভালোবাসার মানুষমাত্র নেই। শুধুই ভক্তি।
এই চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে এখন প্যান্টের ভেতর  হাত ঢুকিয়ে দুটো হাত চটচটে করে ফেলে না পাপান। সেই কিশোরবেলা তাকে ছেড়ে এখন ওড়ে বৃদ্ধ আলুকাবলিওয়ালার সঙ্গে। বৃষ্টির দিনে একেকদিন এই ঘরে চুপটি করে এসে বসে ও। জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখেতে আচমকা বাংলাদেশের কথা মনে হয়। অথচ বাংলাদেশে কখনই যায়নি পাপান। তবু কেন মেঘলা দিনে একটা মন খারাপ করা হাওয়া এই মাঠের ভেতর থেকে বয়ে ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায় বাংলাদেশ। মনে হয় ওর জন্য কেউ অপেক্ষা করে আছে ওখানে।
পাপান কেনো এই জায়গাটার অনেকেরই এমন মনে হয়। টাকির রাস্তা ধরে গিয়ে তারা দেখে আসে ইছামতীর জল।কেউ কেউ অতদূর যায়না।চুপ করে বসে থাকে মধুমুরলি নামের বিরাট দীঘিটির পাশে। বিকেলের মেয়েদের দল পড়তে যায় এবং এক দুদিন খুব সৌভাগ্য ছাড়া অধিকাংশ দিনই তাদের পিছুপিছু চলে শাড়িটাকে কোনক্রমে স্থূল শরীরে জড়িয়ে নেওয়া  মায়েরা। তবু কি কথা হয়না? চোখের ভেতর থেকে একটা কথা এসে বুকের ভেতরতা খামচে ধরে। বিকেলের আকাশের মধ্যে বেজে চলে একটা মফঃস্বলের পুরোনো রেডিও। কেউ বন্ধ করেনা তা।বৃদ্ধ আলুকাবলিওয়ালা কাশে ,উড়ে উড়ে শোনে সেই রেডিও।
 বড় লরিটার নীচে যখন শুয়ে পড়লো শ্যামা তখন বসন্তের দিনগুলো এমন করে শূন্য করে যেত না আমাকে।জীবনের একটা মানে বহু হাতড়েও কোনদিন খুঁজে পাইনি জানি তবু একদিন মনে হত,কিছু আছে।কিছু একটা আছে।স্কুল পালিয়ে এই মধুমুরলির জলে পা ডুবিয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হত একটা ডাক ঠিক আসবে একদিন।সে ডাকের পিছুপিছু ঠিক বেড়িয়ে পড়বো।ওই যেমন কাগজওয়ালা হাঁক দিয়ে যায় এবং উঁচু বাড়ির সরু বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার ডাক যথাসম্ভব বুকে আগলে রাখতে চায় রুগ্ন বালিকা। জীবন আমাদের কাছে এমন ভাবে এসেছে।
সারাদুপুর ছাদের ওপর থেকে শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি আমাদের কি কিছুই চাওয়া হয়েছিল সেভাবে?
সাত টাকায় একটা বাটি বসিয়ে মাথার চুল ছেটে দেওয়া সেলুনের শাদা আলখাল্লাটি মৃত্যুর অনেক কাছাকাছি নিয়ে যেত।যিনি চুল কাটতেন ওপার থেকে এপারে চলে এসেছিলেন তিনি সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলের কারণে।তার বড় রেডিওতে শুধু খেলার দিনটা বাদে বেজে চলতো হেমন্ত। আমি শাদা আলখাল্লার ভেতরে নিজের শরীরটাকে অনুভব করতে চাইতাম।ধীরে ধীরে আমার প্রজন্মের সকলের মৃত্যু দৃশ্য ফুটে উঠতো সামনের আয়নাটায়। এই জ্বলছে ঠাকুরদার চিতা। এই জ্বলছে বাবার চিতা। এই জ্বলছে আমার চিতা।
হাতে বড় মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রজন্মের পর প্রজন্ম। চিতায় আগুন দিয়ে চলেছে।
সেলুনটি বন্ধ হয়ে গেছে। নিজেকে অবিশ্বাস করি এভাবে মাঝেমাঝে। আমিই কি সেলুনের মালিকের গুপ্তঘাতক? আমিই কি ছিটকে চলে আসতে চাইনি সেই শাদা আলখাল্লাটা ছেড়ে মাঠের ভেতরে? সন্ধেবেলা এই জায়গাটায় তরুণী মেয়েদের জটলা আমাকে সুখী রাখে। আমি তাদের মধ্যে থেকে নিজের এই মৃত্যুচেতনাকে অতিক্রম করতে চাই। আমি চাই তাদের আদর। আমার বুকের ভেতরের এই খাঁখাঁ করা ঘরটার তারা টেনে নিক একটা ফুলের কারুকাজ করা রঙিন চাদর নিজেদের সুন্দর দেহের ওপরে।অনেক আলাদা তারা সেই পুরোনো বিকেলে মায়ের সামনে হেঁটে যাওয়া মেয়েদের থেকে।আমার কাছে এভাবে তাদের চোখ বদলে যেতে থাকে।
অথচ কিছুতেই বদলায় না আমাদের এই পুরনো দীঘিটা।কখনই শুকিয়ে যেতে দেখিনি।প্রবল গরমেও তার টলটল জল।বাতাস এসে তার ছোট ছোট ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করে যায়।দীঘিটির কাছ থেকে এই আশ্চর্য জীবন বোধ আমি শিখে নিতে চাই।একেকদিন নেমে পড়ি জলে।সাঁতার কাটি না।ডুবে গিয়ে গভীরে গিয়ে দেখি কত অসংখ্য দৃশ্য জমে আছে।কত সুখ,কত সম্পর্ক,কত অভিমান,কত ভালোবাসা,সহজ জমে আছে দীঘিটির তলায়।এমন সমস্তকিছুই যা মানুষ ইচ্ছেবশত হাত থেকে ফেলে দেয়।
আমিও কি ফেলে দিয়েছি কম?একটা ডাক পাইনা।এগিয়ে চলেছি আরও আরও।কাজিপাড়ার চায়ের দোকানে গভীর রাত অব্ধি বসে থাকি।শ্মশানের রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় দেখি বৈদ্যুতিক চুল্লি লাগানো হয়েছে।রাত বাড়ে।ঘোলা চোখের ভ্যানওয়ালা প্রস্তাব দেয় রাজি হলেই আমাকে দিয়ে আসতে পারে বাড়ির সদর দরজা অব্ধি।একেবারে বিনে পয়সায়।
যারা সদ্য এ দল ছেড়ে ও দলে রঙ  বদল করেছে নতুন পার্টি অফিসটা বন্ধ করার আগে শেষ সিগারেটটা ধরিয়ে নেয়।রুটির দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা এখনই এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার মাঝে খুঁটিয়ে দেখে নেয় আমাকে।আমি এখনও এ পথে ভেবে চলি এই আটাশ বছরে একজন মানুষও আমি খুঁজে নিতে পারিনি যাকে বলে যেতে পারি-
একটি ফুলের বাগানের মাঝে সামান্য মাটি রেখো আমার কবরের জন্য।
ভালোবাসার এই সামান্য কথাটি আমি কি কাউকে বলে যেতে পারিনা?আমি কি বলে যেতে পারিনা সেই বান্ধবীকেও যে আমাকে বিশেষ ভাবেনি।আমি তার বিপন্নতার একটা আশ্রয় হয়ে রয়ে গেছি।যদি প্রেমিক না হতে পারি তবে কি এই কথা কখনই কাউকে বলা হয়ে উঠবে না আমার?
আমার পুরোনো দীঘির জলের কাছে বসি। একটা সিঁড়ি,আরেকটা সিঁড়ি।টলমল করে জল।আমার পাশ থেকে খালি পায়ে জলে নেমে গেছে জ্যোৎস্না।তার উন্মুক্ত বুকদুটো আমার চোখের ওপরে এক সুখের প্রলেপ দিয়ে রাখে।সে বুক নগ্নতা নয়।সে বুকের ভেতর থেকে একটা আমের মুকুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আমার সমস্ত শরীরে।
প্রতিদিন প্রথম পুরুষ হওয়ার জন্যই কি এতো যুদ্ধ,এত লড়াই,এত সন্দেহ আমাদের এই সামান্য মফঃস্বলে।আমি চিরকালের দ্বিতীয় পুরুষ যার কাছে সমর্পণের প্রমাণ ক্ষণে ক্ষণে দিয়ে যেতে হয়না।যাকে হৃদয়ের সমস্ত কথা বলা যায়।চোখের দুয়েক ফোঁটা জল যার কোলের ওপরে নিশ্চিন্তে রেখে আসা যায়।
ফেলে দেওয়া সমস্ত কিছুর ওপরে কেমন এভাবে দু ফোঁটা জল কার জমে আছে আমাদের পুরনো দীঘিটা রূপে।তার পাশ থেকে এখনও পড়ার মেয়েরা যায়,বিকেলের মেয়েরা।তাদের চোখের ভাষা বোঝার মতো প্রাণ আমার নেই আর।
বড় লড়িটার সামনে নেচে যাচ্ছিল শ্যামা।উড়তে উড়তে বোঝেনি কেন এত হাল্কা হয়ে গেছে ওর শরীর।পাপানের কিশোরবেলা ওড়ে বৃদ্ধ আলুকাব্লিওয়ালার সঙ্গে।আর সমস্ত আকাশ জুড়ে বেজে চলছে একটা অদৃশ্য রেডিও।
সাইকেল  সারানোর দোকানে সাইকেল সারাতে আসবে এবার গ্রীষ্মকাল।পাশের মুদিখানার দোকানে নতুন ফ্রিজ আসায় সরবত রাখতে শুরু করেছে।সেও কিছু খাবেন তিনি।বুড়োদের দল হাঁটতে হাঁটতে শুধু গুনে যাবে আগের মাসে কজন ছিল।এমাসে কজন হেঁটে চলেছি পৃথিবীর বুকে।
বেড়ালটি পাঁচিলের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কান পেতে শুনে নেবে বাড়ির স্ত্রী লোকের আলাপ।রাতে কোথাও মাছ হবেনা জেনে তার মন খারাপ হয়ে যাবে।রেলগাড়ি করে ফিরে আসবে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ।কেউ কেউ স্টেশন থেকে রিকশা না নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে হেঁটে ফিরবে ঘরে ফেরার পথটুকু।
পাপানের দেবতা গরমের দিনে গভীর রাতে ছাদে বেড়িয়ে এসে একটা বিড়ি ধরাবেই।ঈশ্বর- বলে হাতদুটো মাথার ওপরে তুলে অনেকটা নিশ্চিন্ত হবেন তিনি।রাতের বেলা আমাদের পাশের বাড়ির বাচ্চাটি ঘুমোতে চায়না বলে আরও আরও বকবে তার মা।তারা খেয়াল করবে না আমি এবং আমার সেই পুরনো দীঘিটি ছাদের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি।
অন্ধকার।মাথার ওপর দৃশ্যের চিতা জ্বালিয়ে রেখেছে নক্ষত্ররা।সারা আকাশ জুড়ে নৈঃশব্দ্য,তার মাঝেও কেমন রেডিওতে বেজে চলেছে গান।আরও কাছে সরে আসি তার।হাত দুটো মুঠো করে ঠোঁটের ওপরে রাখি।
সে খুলে ফেলে তার ঊর্ধ্বাঙ্গের পোশাক।তার উন্মুক্ত বুকের মধ্যে বাতাস খেলে চলেছে ঢেউদের সঙ্গে।ছলাত ছলাত শব্দ।কচুরিপানার গন্ধ।একটা জলচর সাপ চলে গেলো দ্রুত বেগে এক বুক থেকে অন্য বুকে।জলের ধারে বসে আছি।দুয়েকটা মাত্র সিঁড়ি।
হাত বাড়িয়ে জল ছুঁয়ে দিলাম।ভিজে গেলো আমার সমস্ত শরীর।নক্ষত্রকে সাক্ষী রেখে বলেছিলাম একটি কথা যা বলার নয়
 ব্যথার দীঘি পার করে আসে কথাটি।আমার শাদা আলখাল্লাটি খুলে পড়ে যায়
সমস্ত আকাশ জুড়ে এদিকে নেচে নেচে চলে শ্যামাহাতে তার আগুনচোখে থেকে ঝরে পড়ছে আগুনের ভেতরের আরও আরও আগুন                            

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য