মৌসুমী সেনগুপ্ত


বেনারসের ঘাট, ঘাটের বেনারস
✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪✪
ঘুম চোখে ঠিক ঠাওর হয়না ডাকটা। একটানা স্বরে চটকা ভাঙতে থাকে ---আও,আও। অমরীশ পুরী! স্বর্গ থেকে ডাকছেন নাকি! লাফ দিয়ে উঠে এসে দাঁড়াই গঙ্গার ঘাটের অনেক ওপরে ঝুলে থাকা গেস্টহাউসের ব্যালকনিতে।
২০১৮ র শেষ ডিসেম্বরের ভোরে  পাতলা চিকনের পর্দার মতো কুয়াশায় তখন হালকা সোনালী সুতোর সূর্যরশ্মির কারুকার্য।  


সদাবহ্ণিমান মণিকর্ণিকা ঘাট
ভোরের সোনারঙের গঙ্গা
তাড়াতাড়ি ধড়াচূড়া চাপিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি একেবারে গঙ্গার পাড়ে। চোখে পড়ে ওই ডাকের সাথে বিরাট গোল চক্কর কেটে ঘাটে আছড়ে পড়ছে সীগালের ঝাঁক। তাদের বেনারসের 'অমরীশ পুরী' খাবার দিচ্ছেন। হালকা কমলা আলোর ছটা তখন দিগন্তে।
যে চিরন্তন ছবিটি আমাদের আজীবনেও পুরনো হয়না, ঠিক সেই ছবি তৈরী হয়ে সূর্য ওঠে। শুরু হয় একের পর এক প্রাত্যহিকতা।        
সেই মূহুর্তে আর কিছু না ভেবে সিদ্ধান্তে আসি, পয়েন্ট দেখে পয়েন্ট না বাড়িয়ে আজ থাকবো আদি অকৃত্রিম বেনারসি ঘাটের সাথে৷ দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, হরিশ্চন্দ্র, মানমন্দির, তুলসী, কেদার,অসি ---এরা মোটামুটি নামীদামী। তবে মোট ঘাটের সংখ্যা ৮৮।আমি আছি কেদার ঘাটের কোলে, সীতা গেস্টহাউসে।সারাক্ষণ মনে, চোখে, পায়ে ঘাটের গন্ধ মাখবো বলে এই আস্তানা জোগাড় করেছি গুগলদার সাহায্যে। 


দশ্বাশ্যমেধের আরতিতে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিতে শুভকে আবাহন
জটায়ু ও তোপসে
হেঁটে হেঁটে এগোতে থাকি দশাশ্বমেধ ঘাটের পথে। শীত উপেক্ষা করে পূণ্যলোভী মানুষ গঙ্গাস্নান,পূজোপাঠ আরম্ভ করে দিয়েছেন। আর আমি পাপীতাপী, জ্যাকেট , টুপি পরেও শীতে কাঁপছি।
কয়েক পা এগিয়ে দেখি সবে উনুনে আঁচ পড়েছে সদালাপী যুবক চা বিক্রেতার। বসে যাই ভাঁড়ের চা আর গল্পের টানে। কথায় কথায় বলে, ওর বাবা খোকা বয়সে ফেলুনাথজির শুটিং দেখিয়েছিলো, ও কেয়া হ্যায় না মগনলাল মেঘরাজ! আমি আরো জেঁকে বসে যাই। আরে সেই তিনিই, সেই শালপ্রাংশু মহাভূজ মানুষটাই তো আমায় প্রথম বেনারসি ঘাট চিনিয়েছেন, ঘাটের প্রেমে পড়িয়েছেন।পরপর দুকাপ চা খাই, তবে গপ্পো শেষ হয়৷ 
একটি নতুন দিনের প্রারম্ভ
ধূপের গন্ধে আমোদিত আকাশ
দশাশ্বমেধ যেতে যেতে চোখে পড়ে ঘাটের সেই বিখ্যাত সব ছাতা, সেখানে নানারকম মুখের ভারতবর্ষ উপস্থিত। পূজোআর্চা, লোকঠকানো, হাতসাফাই সবকিছুই অবাধ সেই ছত্রচ্ছায়ায়। 
বেলা গড়ায়। দেখি নানাবিধ পসরা নিয়ে ঘাটের অপেক্ষাকৃত উঁচু সিঁঁড়িতে নানারকম বিক্রেতা। আশেপাশে ভারত - খোঁজা আলুঝালু পোশাক পরা বিদেশীর দল। সবচেয়ে যেটা অবাক করার মতো, এই অল্প শিক্ষিত বিক্রেতারা কি সুন্দর নিজস্ব ইংরেজী বা ফরাসি, এমন সব ভাষায় দরদাম, ডাকাডাকি করে চলেছেন। 
হঠাৎ চোখ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে আমার, আরে ওই তো ছদ্মবেশী জটায়ু আর তোপসে!! দূরে একটা বজরা দেখা যাচ্ছে কি! কানে যেন শুনতে পাচ্ছি সেই মোহাবিষ্ট করে দেওয়া গান---রেবা মুহুরির গলায় 'মোহে লাগি লগন '। 
গেস্ট হাউজের বারান্দা থেকে দেখা সীগালের ঝাঁক
ঘাট জুড়ে পায়রার ডানায় ভর করে আসা সকাল
বিকেলে দশাশ্বমেধ এ এসে একটু দূরে একটা রাবড়ীর দোকান দেখে কেমন শরীরটা দুর্বল লাগে যেন, পা আটকে যায়।  একটু শক্তিসঞ্চয় না করে কিছুতেই নৌকাবিহারে যাওয়া সম্ভব নয়। 
প্রথম গন্তব্য মণিকর্ণিকা ঘাট। সারাক্ষণ এখানে চিতা জ্বলে। এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় ভেতরে। জীবনে বসে মৃত্যুর উৎসব দেখা যেন। 
নৌকাভ্রমণ বেনারসের ঘাটকে চিনিয়ে দেয় আরেকরূপে।শীতের সন্ধ্যে নেমে আসে ঝুপঝুপ করে। একের পর এক ঘাটে জ্বলে ওঠে সাঁঝবাতি। তার প্রতিফলনে নদী যেন সোনার নেকলেসে সুসজ্জিতা। 
ঠিক সাড়ে ছটায় শুরু হয় দশাশ্বমেধের অনন্য আরতি। জেগে ওঠে সনাতন ভারতীয়ত্ব। নৌকায়, ঘাটে অজস্র জনসমাগম, কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই দৃশ্য শান্ত করে রেখেছে সদা বিশৃঙ্খল মানুষের ঢলকে। 
নৌকা থেকে ঘাটের সান্ধ্য শোভা
সাঁঝবাতিতে গঙ্গায় সোনার নেকলেস
চোখে পড়ে কারা কারা  যেন কি কি কারণে ভি আই পি গোছের কিছু।  পরে এসেও রোয়াব দেখিয়ে সামনের চেয়ারে বসে চবর চবর করে কিছু না কিছু খেয়েই চলেছে।এই ক্ষমতাপূজোর দেশে এটা না থাকলেই মনে হয় বেমানান হোতো। 
কোথা দিয়ে একঘন্টা কেটে যায়, ভাঙে মিলনমেলা। অন্যমনস্কভাবে ফিরে চলি, একটা গোটা দিন হৃদয়ের নিজস্ব সিন্দুকে পুরে। 
মনে হয় যেন হেঁটে চলেছি সেই আদি  ভারতবর্ষ কে বুকের মধ্যে নিয়ে। ছলাৎ ছল বয়ে চলে গঙ্গা, আদি অনন্তকাল জুড়ে।                                 

মন্তব্যসমূহ

  1. ভালো লাগল । বৈঠকী চালে স্বাদু গদ্য। এমন লেখাই অভিপ্রেত।

    উত্তরমুছুন
  2. এতো ভালো লাগে আপনার লেখা পড়তে।ছবি অসাধারণ।খুব সুন্দর।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ এক ভ্রমণকথা। সেই দশাশ্বমেধ, মণিকর্ণিকা, মগললাল মেঘরাজ আর মোহে লাগি লগন। বেনারসি ঘাটের প্রেমে পড়লাম।

    উত্তরমুছুন
  4. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য