শুভশ্রী সাহা

যে যেখানে দাঁড়িয়ে--
অনুজিত পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে বাড়ি ঢুকল। কলতলার এই দিকটা ছ্যাতলা পড়া, জীর্ণ সিমেন্ট খুবলানো। সামনেও বা কি আর ভালো আছে, ওই তবু নামেই কাটে। বাড়ুজ্যে বাড়ি মানেই অভিজাত আর জমিদারি বাড়ি। এদিকে বাসিন্দারা সব মাপের ঘরে থাকে। নামেই রাজা উজির।

-- বাবু এলি,
-- বাবা কোথায়,
-- কোথায় আবার নিজের ঘরে! গেছিলি আজ অজিতের বাড়ি?
--- যাব না কেন!  সেই এক কথা, জেলা পরিষদ নাম টাঙাবে হয়ে যাবে।
-- কবে টাঙাবে! একবছরের আগে থেকে শুনছি। একজোড়া বালাও বিক্কিরি
  করে টাকা দিলাম!
অনুজিত উষ্ণ হচ্ছিল। এক কথা তোমাদের, এই জন্যই বাড়ি আসি না, একে তো বাবা, এখন তুমিও। অনুজিত হাত দিয়ে ভাতের থালা ঠেলল।
-- কি হলো কি, বস বলছি! বলি কি আর সাধে! বাবার মাস্টারির ওই কটা পেনশন। বাড়ির হাল দেখেছিস, নামেই জমিদার, জমাদারদেরও  নিজেদের  কল পাইখানা থাকে!
-- বুঝেছি !  রোজ যাই অজিতদার বাড়ি বুঝলে
-- সেই অজিত এখন নেতা! মাগো, জাতে জেলে ওরা বুঝলি,ওর বাপের বাপ এ বাড়ির উটুনে মাছ দিয়ে যেত কেজি, কেজি!
-- এই গল্প হাজার বার শুনেছি! অজিতদা তোমার শ্বশুর বাড়ির গুস্টিকে পোঁছেও না, বুঝলে!
মা চলে গেল  অজিতের চোদ্দ পুরুষকে গাল পাড়তে পাড়তে।
অনুজিত খাটের উপর টান টান হলো, কবেকার খাট কে জানে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে উঠল। ঘরবাড়ির কথা সে একবার ও ভাবছে না, সে ভাবছে তৃষার কথা।
  আহ, কি সুগন্ধ তার বুকের ভেতর।  ফ্লুরোসেন্ট ইয়েলো  বেলফ্রন্টের ব্রা, নাতি উচ্চ তীক্ষ্ণ স্তন। কোমল চামড়া, অনুজিত জন্নত দর্শন করেছে। যেমন করে হোক এই চাকরী তাকে পেতেই হবে। সে অভিজাত পরিবারের,বেশ সুদর্শন চেহারার, বাবাও মাস্টার ছিল।  তৃষার বাবা ব্যাঙ্কে চাকরী করে তাদের একটাই দাবী কংক্রিট সরকারী চাকরী একটা। জেলা পরিষদে আহামরি কিছু নয় তবুও সরকারী চাকরী, সব হয়ে গেছে সে জানে তার নাম আছে শুধু  টাঙানোর অপেক্ষা। তৃষাকে না পেলে সে কি করবে!
সারাজীবন বাবার আক্ষেপ আর অনুযোগ আর মায়ের ঘি খাওয়ার গল্প, ছ্যা! অনুজিত মন দিয়ে তৃষার শরীরটা ছুঁতে চেষ্টা করলো।
-- অজিতদার ঘরে ঢুকতেই অজিত দা ইশারা করল দোতলায় উঠে যেতে। মনে হলো আজ ডিস্টার্বড আছে। এমনিতে অজিত মান্না মোলায়েম ছুরি। তাকে ছাড়া এ ওয়ার্ডে মাছিও গলে না।
-- শোন না, খুব চাপে আছি বুঝলি,
-- কিসে দাদা!
-- আরে তোর কাকা টা!
  শালা বুড়ো মরেই না।
-আমার -খুড়তুতো
  কাকা? ওরা তো পয়সাওলা লোক। আমাদের মত নয়, সব বিদেশী মাল
-- বুড়োটার সাথে গণাদার কথা হয়েছিল বাড়িটা দেবে এখন পুরো পাল্টি। ওখানে চেয়ারম্যান থেকে আই সি, সবার বখরা আছে
  ওই প্রোজেক্টে বুঝলি! অনেকটা জমি! কত এগিয়ে গেছে কথা বার্তা, আর মাইরি কি রে!
গণাদা! মানে গুণীন্দ্রনাথ কর! জেলাপরিষদের সভাধিপতি, অনুজিত ঢোঁক গিলল।
-- আমাদের সাথে তো সম্পর্কই নেই, মানুষ ভাবে না,নইলে বলতাম কথার খেলাপ করছেন কেন! যদি কথা হয়ে থাকে দিতেই হবে!
-- বলবি বলেই তো ডেকেছি। বলতে হবেই
  সম্পর্ক তৈরি কর আবার-- গুণীদার পোস্টটা মনে রাখ তাহলেই সব পারবি। অনুজিত চুপ করে গেল। জেলাপরিষদের চাকরী পেতে গেলে তার মানে কাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
অনুজিত উত্তেজিত হয়ে গেল,  খচ্চর বুড়োর ছেলে আমেরিকায় বসে ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকা রোজগার করছে। বুড়ো নিজেও জ্ঞাতি শরিকদের রাস্তার উপরের সব বড় বড় বাড়ি মামলা করে হজম করে নিয়েছে। কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা বলে কথা। তাও এই বাড়িতে বসে ডিমে তা দিয়ে চলেছে এখনো। কাকিমাতো কবেই ফুটে গেছে।  অনুজিত সব শুনে বেরিয়ে এল অজিতদার বাড়ি থেকে। তার পকেটের
ফোন বেজে উঠল
-- হ্যালো
-+ বলো, আমি রাস্তায়, বাড়ি ফিরছি
-- গেছিলে আজ!
-- রোজই যাই তৃষা কিন্তু হয় কই।
ফোনের ওপাশে চুপচাপ সব কিছুক্ষণ। --মন খারাপ কোরো না
  কিছু না কিছু হয়ে যাবেই দেখো।
-- আমি তোমাকে হারাতে ভয় পাই,কিন্তু কত নিচে নামব বলো তো, সফল হতে অনেক নিচে নামতে হয়
  আমি বুঝে গেছি।
-- তোমার মন টা আজ খারাপ না! গাল টা একটু ঠেকাও নাগো, নাও,চুমু খেলাম। আওয়াজ পেলে?
অনুজিত অন্যমনস্ক ছিল, তবুও আলগোছে উত্তর দিল, পেলাম তো! তৃষাও
  বুঝলো অনুজিত আজ এলোমেলো খুব।
ফোন রাখতে না রাখতেই অজিতদার ফোন ঢুকছে দেখল।
--- বলো,
-- গেছিস!
-- কোথায়!
 
কোথায় মানে, আরে তোর খচ্চর কাকার বাড়ি
-- অজিত দা, এখন দশটা বেজে গেছে। শুয়ে পড়েছে। তার উপর দশ বছর সম্পর্ক নেই, কি করে এই ভাবে এখন চলে যাব।
-- বুঝেছি, গান্ডু
  তোমার চাকরীটার দরকার নেই! তাই তো! মারো মারাও গাঁড় নিজের।
বহুদিন বাদে অনুজিতের অভিজাত রক্ত টা চাগাড় দিয়ে উঠল, জেলের বাচ্ছা বলতে গিয়েও সামলে নিলো সে,
শান্ত স্বরে উত্তর দিল, অনেকটা পড়াশোনা করেছিতো এটুকু জানি, কোথায় কখন কাকে কি বলতে হবে দাদা--
-- ভালো বাপ! নিজের ভালো টা বুঝলেই হলো।
অনুজিত ভোর হতেই চোখ মেলে দিল। কাল মা কে কিছুটা বলেছে সে, মা কিন্তু কাকার উপর রাগ করেনি কোনদিন বরং বলত তার বাবা কাঠ গোঁয়ার আর আলসে। কাকা উদ্যমী মানুষ অনেক। নিজের রক্ত নিয়ে ধুয়ে জল না খেয়ে পরিশ্রম করেছে দিনরাত, আর কাকার ছেলেও তাই সফল ব্যবসায়ী বিদেশে।
তাতো সে জানেই, কাকাতো ভাইয়ের সাথে তাকে সারাজীবন ডুয়েল লড়তে হয়েছে, এবং সে এখন পরাজিত নায়ক সবার কাছেই।  অভিজিত বাড়ুজ্যে এ বাড়ির হিরো।
চা খেয়েই সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একদম রাস্তার সামনের দিকে এগিয়ে এলো। খুড়তুতো কাকার ভাগে সামনের বাড়িটাই পড়েছে উনি কাকাদাদুর একমাত্র ওয়ারিশন। তার দাদুর মত তিনছেলে দুই মেয়ে নেই।
-- সদর দরজা খুলে দিল একজন বুড়ি ঝি। সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে সে সংকোচে পড়ল আবার। যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে, কি জানি, কিন্তু যেতে তাকে হবেই,অজিতের থেকে অন্তত নিস্তার নেই।
-- কাকাবাবু, কেমন আছেন! চওড়া বারান্দায় চেয়ারে বসে ছিলেন মৃগাঙ্ক বাড়ুজ্যে।
ভুরু কুঁচকালো তার,  সামনে যেতেই বলে উঠলেন অনু না!
তুমি হঠাৎ? দাদা ভালো আছে তো!
অনুজিত নরম সুরে অনেকটা স্বচ্ছন্দ হয়ে গেল যেন।
-+ বাবা ভালো আছে কাকাবাবু। আপনার কাছে আমি একটা অন্য ব্যাপারে এসেছি।
সোজা চোখে তাকালেন মৃগাঙ্ক বাড়ুজ্যে,
বলো, কি ব্যাপারে
-- আপনি অজিত দা আর রাণাদের কাছে এই বাড়িটা বিক্রি বা প্রমোটিংএ দেবেন বলেছিলেন কি?
মৃগাঙ্ক চুপ হয়ে গেলেন সহসা কথা বের হলো না তার
-- দেব বলেছিলাম কিছুদিন আগে, এখন আর দেব না।
-- কেন বাড়ি বেচার সিদ্ধান্ত বন্ধ হলো কাকা, অভিজিত দা জানে?
-- অভিজিত? শূন্য দৃষ্টিতে তাকালেন কাকা , কেমন যেন ফ্যালফেলে
-- হ্যাঁ আপনি যে এখানে কার কার সাথে কথা বলেছিলেন তা কি জানিয়েছেন! জানেন ওরা কেমন লোক! এখন না করছেন ওরা আপনাকে ছাড়বে! রেজিস্ট্রি অফিস থেকে সব সার্চিং করিয়েছে দলিল পড়চা-- জানে মেরে দেবে কাকাবাবু! এটা আমেরিকা নয়, ফিস ফিস করে উঠল অনুজিত
তার ঘাড় মাথা দপ দপ করছে, বুড়োকে নিরুত্তর দেখে। নিশ্চয় অন্য কোথাও বড় দাও মারবার কল করেছে।
--- তুমি কি ওদের হয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছ অনুজিত!
-- দেখাই নি কিছুই এখনো, কিন্তু দরকারে দেখাতে হবে বইকি! আপনি কথা দিয়েছেন মনে রাখবেন আর আমাদের এই পাড়ায় টিকে থাকতে হবে। রুলিং পার্টির লোকজন এরা--
আমি নিজে ওদের পাশেই দাঁড়াব। আর এত বড় বাড়ি বিষয় সম্পত্তি নিয়ে এখনো কি করবেন টা কি! আর অভিজিত দার সাথে কথা বলুন আজকেই, আমি জানি সেও না করবে না। অভিজিত দা আমেরিকায় আছে এত বড় জায়গায় সে কি করবে মফস্বলে!
একটানা কথা বলে দম নিল অনুজিত। বুড়োর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করল। ভাঙবে তবু মচকাবে না মার্কা!
 
-- অনু, অভি আর আসবে না এখানে কোনদিন। আমার যা সর্বনাশ করার করে দিয়ে সে চলে গেছে।
-- মানে! কি বলতে চাইছেন আপনি!
বাড়ি বিক্রি করতে গিয়ে দেখি অভিজিত কবে দলিল।নিয়ে বাড়ি বন্ধক দিয়ে রেখেছে! বন্ধকী বাড়িকি বিক্রি হয়? শুধু তাই নয় টাকা পয়সা জয়েন্ট আকাউন্টে রাখতাম বিজনেস ফাইলের সুবিধার জন্য। সেখান থেকে সব টাকা তুলে নিয়েছে।সামান্য কিছু টাকায় কোনমতে চলছে। গাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি, সেই টাকা আছে কিছুটা।
-- অনুজিত মাটিতেই বসে পড়ল দালানে।
বিশ্বাস করিনা, অভিজিত দা এই বংশের উজ্জ্বল বংশধর সারাজীবন শুনে শুনে বড় হয়ে উঠেছি! দূরে থেকেও প্রতিযোগী হয়ে বসে  থেকেছে  আমাদের জীবনভোর, কেন মিথ্যা বলছেন!! বাড়ির ভয়ে! ছি:! অনুজিত ধিক্কার দিল, যেন অভিজিয়ের অসফলতার গল্প তাদের বাড়ির বনেদীয়ানায় আঘাত করেছে।
-- কাকাবাবু ম্লান হাসলেন, চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।
কি জানিস অনু,বনেদিয়ানা হারানোর ভয়ে বলতে পারিনি অভি কোনোদিন ই কিছু ডিগ্রি পেয়ে উঠতে পারিনি। আমেরিকায় লোকে কত কিছু করে পেট চালায়, টাকাগুলো নষ্ট হয়ে যাবার পর কি ভাবে চালায় জানি না! এখানে কাকে বলব, সবাই জানে মৃগাঙ্ক বাড়ুজ্যের ছেলে  আমেরিকায় মস্ত সিভিল ইঞ্জিনীয়ার। বংশের গর্ব! থাক থাক সবাই এই টুকু নিয়েই-
--- আপনার চলছে কি করে?
- -- ওই সামান্য টাকার যা সুদ ওই দিয়েই--
--- কার কাছে দলিল পড়ে আছে বলুন তো--
-- কলকাতার এক মারোয়ারি  ফার্ম, আমি সব দেখাচ্ছি তোমায়।
-- শুনুন কাকাবাবু, আমি কাল গিয়ে সত্য বলি সব। ওরা টাকাগুলো ওদের দিয়ে  যদি নিতে চায় নেবে! নাহলে মারোয়ারি ফার্মকে বেচে দিন, হিসেব করুন বিক্রি করলে আপনার সব দায় মিটবে কিনা!
--- লোক জানাজানি হবে অণু, কি বলব  অভিজিত সব বন্ধক দিয়ে চলে গেছে! বলা যায়!
-- বলা যায় কাকাবাবু। মানুষ পরিস্থিতির সাথে বদলে যায় অনেকটা। অভিজিতদাও বদলে গেছে হয়তো!
-- আমি কোথায় থাকব অনু! ওরা কেউই কি আমার দায় নেবে!
বাড়ি ছেড়ে দিলে গাছতলায় আসতে হবে।
-- আমি কাল আপনাকে বাড়ি নিয়ে যাব। ওখানেই থাকবেন আপাতত পরে দেখা যাবে!
অনুজিত কি ভরসা করে বলল তা সে নিজেই জানে না কিন্তু কাকার দিকে তাকাতেই সে বিস্মিত হলো। কি নিস্পৃহ দৃষ্টি আর আলগা ভবিষ্যৎ আঁকা!
-- তুই! অবিকল আমাদের দাদুর মতো   অনু--
অনুজিত হেঁটে ফিরছে বাড়ির দিকে। পকেটে বহুবার বেজে বেজে তৃষার ফোন কেটে গেছে। অজিতদারা নিশ্চয় এত বড় অংকের টাকা দিয়ে এই বাড়ি ছাড়াবে না, মারোয়ারি ফার্মই বা বারাসাতে কোন প্রোজেক্ট করতে আসবে! কোন ভাবেই তার চাকরীটা আর হবে না। বরং আর একটা পেট বেশি হবে এখন।
অনুজিত লাথি মারলো রাস্তায় পড়া বড় একটা থানইটের টুকরোয়, ইটটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল চারদিকে। অনুজিত হাঁটছে, হাসছেও নিজের মনে, তার ছায়া ক্রমশ অশত্থ  গাছের মত  দীর্ঘ হচ্ছে মাটিতে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য