সোমা কুশারী
ই-ক্লাস
❃❃❃❃
মা! ওমা! ফোনটা দাও।কতক্ষণ বক্ বক্ করবে? আমার ক্লাস শুরু হবে না?
-সরি বাবি! ঐ অর্ণামাসির সাথে একটু...
ক্লাস
নাইনের ছেলে এমন ট্যাকট্যাক করে কথা শোনাচ্ছে দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়
সম্বিতার, ইশ! বড্ড দেরী হয়ে গেল। ঘরটরগুলো এখনো ডাস্টিং করা হলো না,
অর্ণাটা এত কলকল করে কথা বলে না! সম্বিতা তাড়াতাড়ি ঝাড়নটা তুলে নিয়ে
বইয়ের তাকটা মুছতে থাকে।
সুব্রত
মানে সম্বিতার বর, সেক্টর ফাইভে একটা বেসরকারী সংস্থার কর্মী। তারা এই
আনলক ওয়ানেই সব কর্মীদের অফিসে যেতে বাধ্য করছে। সুব্রত তাই সাত সকালেই
বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়, টানা দুঘন্টার বেশি হাইরোড দিয়ে গাড়ি চালিয়ে
অফিসে ঢোকে বলে এই সময়টা বেশ ভয়ে ভয়েই থাকে সম্বিতা। অন্য উপায় ও তো
নেই! সব অফিসেই নাকি এবার টুকটাক ছাঁটাই শুরু হবে তেমনটাই সুব্রত
কানাঘুষোয় শুনেছে। গত দুমাস কোম্পানি মাইনেও দেয়নি পুরোপুরি, অনেকটা টাকা
হাতে কম পেয়েছে সুব্রত। তারমধ্যে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে বাবানের নতুন
ক্লাসে ভর্তি ছিলো। স্কুল অবশ্য একমাস পিছিয়ে মে-তে ভর্তি নিলো, কড়কড়ে
বাইশ হাজার টাকা দিতে হলো অ্যাডমিশন ফ্রি বাবদ।সুব্রত একরকম ধার করেই
ছেলেকে ভর্তি করল, সম্বিতার তিল তিল করে জমানো টাকাটুকুও বের করতে হলো,
ছেলের বই বাবদ প্রায় সাত মতো পড়ল।
কী
যে ছাই দিন এলো! সম্বিতা ড্রেসিংটেবিলের সামনেটা পরিস্কার করতে করতে
ভাবলো, স্কুলটুল কবে যে খুলবে কেউ জানে না! খুললেই তো সংক্রমণ ছড়াবে ।অথচ
বাচ্ছারা কী আর রোগের ভয় পায়? নাকি ওদের আলাদা রাখা মুখের কথা? সুব্রত
ঠিকই বলছিলো এবার ওসব ক্লাস ম্লাস কিছুই হবে টবে না! এভাবেই ফোনে ফোনে
পড়াশুনা চলবে। আসলে স্কুলের ও তো দায় আছে মাস গেলে আড়াই করে নিচ্ছে তাতে
যদি এই সব ঢপের চপ অনলাইন ক্লাস ও না করায় কেউ মাইনে দেবে?
বাবানের
হাতে স্মার্ট ফোন টুয়েলভের আগে দেবে না ভেবেছিল সম্বিতা। ছেলে ঐ দুজনের
ফোন টোন চাইতো বটে কিন্তু তা আর কতক্ষণ? দু একটা খেলার ভিডিও বা গান শোনা
এই তো! আর, এখন? সকাল নটা থেকে অনলাইন! নাকি ম্যাম বলেছেন এখুনি ক্লাস
নেবেন। গুগল মিটে একের পর এক ক্লাস হয়, কানে হেডফোন গুঁজে শোনে ছেলে!
তারপর আছে পাঁজা পাঁজা এ্যসাইনমেন্ট! এ বই ও বই করে ছেলে খামচেখুমচে টুকতে
থাকে। সম্বিতা জিজ্ঞেস করলে নির্লিপ্ত ভাবে অতটুকু ছেলে বলে ওঠে আজকাল
এসবেই নম্বর ওঠে। যার অ্যাসাইনমেন্ট যত ইনফরমেটিভ তত নাকি নম্বর! সম্বিতার
ভুরুতে ভাঁজ পড়ে, মোবাইলে মগ্ন ছেলেকে দেখে, কী যেন মন দিয়ে দেখছে।
জিনিসটা কী দেখার জন্য পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই ছেলে কড়া চোখে তাকায়!
তাকাকগে! সায়েন্স গ্রাজুয়েট মা কী মুর্খ নাকি?
পড়াশোনার কিছুই বোঝে না?
-বাবান মেসেঞ্জারে কী করছিস তুই? চ্যাট করছিস?
-মা! তুমি না জাস্ট একটা পাগল! এগুলো দেখে তোমার চ্যাট মনে হলো?
-চ্যাট নয়? আমি স্পষ্ট দেখলাম তুই লিখছিস দেবপ্রিয়াকে ।
-হ্যা! দেবপ্রিয়াকেই লিখেছি। তাতে কী? ও কী আমার ক্লাস মেট নয়? কত প্রবলেম সলভ করতে হয় জানো?
সম্বিতা
বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে গজগজ করতে থাকে, কী যে এক ছাতার মাথা রোগ
এলো! পড়াশুনা সব নাকি ঘরে বসে হবে! ফোনে ফোনে! ছেলেপিলে সব গোল্লায়
যাচ্ছে। ফোন হাতে ক্লাস হচ্ছে না কী হচ্ছে খোদায় মালুম।
-বাবান! একটা বাজতে চললো চানে যা শিগ্গির।
গ্যাসের
বার্নার মুছতে মুছতে সম্বিতার নিজেদের স্কুল বেলার কথা মনে পড়ে যায়।
বাবানের মতো তখন ক্লাস নাইন, নীলপাড় সাদা শাড়িতে রাতারাতি যেন বড় বনে
গেছিল সম্বিতারা। সুমনা, গার্গী, তমিশ্রা, ঝিলিক আর সে নিজে ... অতনুদার
সাথে গার্গীর প্রেমটাও তো সেই নাইনেই। সায়েন্স পড়াতো অতনুদা, গার্গীর
চেয়ে প্রায় বারো তেরো বছরের বড়। চুটিয়ে টিউশনি করে তখন, আর ঐ পুচকে
মেয়ে ব্যাচে পড়তে গিয়ে প্রেমে একেবারে হাবুডুবু। তখন কোথায় মোবাইল
কোথায় হোয়াটস্ আপ কোথায় মেসেঞ্জার? প্রায় কোনো বন্ধুর বাড়িতেই
ল্যান্ডলাইন পর্যন্ত নেই। শুধু ক্লাসের পারমিতা আর রুকসানাদের বাড়িতে নাকি
ফোন ছিল। ওদের দুজনের বাবা-ই শুনেছিল নাকি বড় বিজনেসম্যান! অতনুদা আর
গার্গী তাই ঐ পড়া আর পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই প্রেম করত। কী আশ্চর্য! দিব্যি
টিকেও গেল সে প্রেম। সাততাড়াতাড়ি ছাদনাতলায় গেল দুজনে। মাঝখান থেকে
গার্গীটার রেজাল্ট গেল ঝুলে! গ্রাজুয়েট আর হওয়া হলো না! অবশ্য গ্রাজুয়েট
হয়েই বা কী হাতি ঘোড়া হয়? সেই তো সম্বিতা কেমিষ্টিতে অনার্স করে গ্যাস
মুছছে!
বাবান ঝুপঝাপ করে
চান করেই খেতে চাইল। স্কুল নাকি ঠিক আধঘন্টার ব্রেক দিয়েছে। বছর তিনেক
আগেও বাবান নিজে হাতে খেতে পারতো না। সেই বেলা আড়াইটেতে স্কুল থেকে ফিরলে
সম্বিতাকে ভাত মেখে গরস করে খাইয়ে দিতে হতো। এখন, ছেলে স্বাবলম্বী হয়েছে,
এক হাতে মোবাইল অন্য হাতে ভাত মেখে মুখে ভরছে। বাটা, ট্যাংরা এসব মাছ আগে
খুব ভালোবাসত, চিংড়িও। আজকাল ওসব মাছ ছুঁয়েও দেখতে চায়না, বলে বলে সব্জি
খাওয়াতে হয়! এখন শুধু ডিম না হলে চিকেন। ঐ এক চিকেনের ঝোল আর ভাত হলেই
শান্তি!
এই যেমন এখন চিকেনের আলু আর ঝোল মেখে ভাত খাচ্ছে । পাশে বাটিতে ভরা চিকেনের টুকরো।হঠাৎ মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বাবান বলে উঠল...
-মা! বাপিদের এরিক্সন ইন্ডিয়া কী গত দুমাস স্যালারি কেটেছে?
-কেন রে?
-না! ঐ যে তোমরা স্কুলের অ্যানুয়াল ফিজটা ক্লিয়ার করোনি তাই...
-তাই তো কী? বাইশ হাজার অ্যাডমিশন ফিজ প্লাস বইয়ের সাত হাজার সবটাই তো দিয়েছি।
-হ্যা তা দিয়েছ! কিন্তু দেবপ্রিয়া রাহুল অন্বেষা ওরা বলছিল ওদের পুরো ইয়ারের ফিজ ওদের পেরেন্টস্ দিয়ে দিয়েছে তাই...
-সে যার আছে সে দিয়েছে। আমাদের অতো টাকা নেই!
-সেটাই তো বলছি! টাকা যখন নেই ঐ সরকারী স্কুলেই তো পড়াতে পারতে আমায়! শুধু শুধু সবক্ষেত্রে এমন কম্প্রোমাইজ করতে হতো না আমায়!
-কম্প্রোমাইজ করছিস তুই? এ আবার কী বুলি? তোর বাবা কোন অভাবটা রেখেছে তোর?
-অতো হাইপার হচ্ছো কেন? নিজেই ভেবে দেখ না কী কী নেই আমার!
-না! তুই-ই বল!
-একটা ল্যাপি সেই কবে থেকে চাইছি...
-ল্যাপি মানে ল্যাপটপ? কী হবে তোর? এই তো বছর দুয়েক আগে বাবাই তোকে ডেক্সটপটা কিনে দিলো। বাড়িতে কম্পিউটার করবি বলে!
-মা! ডেক্সটপ আর ল্যাপি কী এক? ছাড়ো! ছাড়ো! যারা একটা অ্যান্ড্রয়েড দিতে পারে না...
-তাই বল! ফোন চাই তোর! স্মার্ট ফোন!
-হ্যা চাই! ক্লাসের ফরটিফাইভ জনের যদি থাকে তবে হোয়াই নট মি?আমাকে কেন তোমার ফোন ইউজ করতে হবে বলতে পারো?
-একটা ক্লাস নাইনের ছেলেকে স্মার্ট ফোন দেব না তাই! ফোন পেলে...
-রাখো তোমার যত বুলশিট ভাবনা! ফোন নিলে কী হবে? বিগড়ে যাবো?জানো ওরা সবাই আমাকে 'মাম্মাস বয়' বলে খ্যাপায়?
সম্বিতা
হতম্ভব হয়ে যায়! এ কী বলছে বাবি? বাবা মার ক্ষমতা মাপছে টাকার অঙ্কে?
অন্যেরা দিতে পারছে আর তার মা বাপ পারছে না মানেই সে পিছিয়ে পড়ছে! এইরকম
মনোভাব কোথা থেকে পেল ছেলে? মায়ের ফোনে ক্লাস করলে টনড্ হতে হয়? এই তবে
ই-ক্লাসের সারসত্য?
বাবান
রাগ দেখিয়ে উঠে গেছে। টেবিল জুড়ে পড়ে আছে আধখাওয়া মাংসের টুকরো, মুরগির
চেবানো হাড় মজ্জা আর ভাতের দানা! সম্বিতা টেবিল পরিস্কার করতে করতে ভাবতে
বসে কোথায় ভুল হয়ে গেল? ঠিক কোথায়? অতবড় নামী ইংলিশ মিডিয়মে ভর্তি
করার আগেই কী সুব্রত আর ওর আরো বেশি করে ভাবা উচিত ছিলো? না কি এই অনলাইন
ই- ক্লাস চাহিদা বাড়িয়ে দিলো? বুঝতে পারে না সম্বিতা।
দুপুর
গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসে। ফ্লাটের একচিলতে বারান্দায় একাকী বসে থাকতে
থাকতে চোখটা বুঝি লেগে এসেছিল সম্বিতার, হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ধড়ফর করে
উঠে বসে। নিশ্চয়ই অঞ্জু এলো, বিকেলের বাসনকোসন মাজতে! চেয়ার ছেড়ে উঠে
বেডরুম পেরিয়ে ডাইনিং লাগোয়া মেন দরজাটা খুলতেই অঞ্জু তড়বড় করে ঘরে
ঢুকে আসে, কোমড়ে আঁচল জড়িয়ে কিচেনের সিঙ্কে ডাঁই করা বাসন মাজতে মাজতে
সম্বিতাকে ডাক দেয়...
-ও বৌদি! বৌদি!
-হ্যা বল্ মঞ্জু!কী বলছিস?
-একটা কথা কবো?
-বল্! অতো কিন্তু কিন্তু করছিস কেন?
-পাঁচহাজার ট্যাকা ধার দিবা আমায়?
-পাঁচহাজার? কী করবি অতো টাকা?
-একটা সেমার্ট ফোন কিনবো!
-স্মার্ট ফোন কিনবি? কেন? একটা ছোটোমতো মোবাইল তো তোর আছে!
-গুড্ডির ইস্কুলি ফোনে ফোনে পড়াচ্ছে গো বৌদি! মেয়েটা আমার ফোন না পালি পিছায়ে পড়বে না? মেয়েডা তাই বড় কাঁদাকাটা করতিছে গো!
ভীষণ বাস্তব ও তার দ্বন্দ্ব সুন্দর উপস্থাপন।ভালো লাগলো।সংলাপের উপস্হিতি মন টানলো।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনসময়টাকে জাপটে ধরে লিখতে পারো।অতি সহজসরল প্রকাশে গভীরতাকে ছুঁতেও পারো।একটা বিষয়কে রেখেও শাখা প্রশাখায় জুড়ে থাকা সমস্যাগুলোকেও সুন্দর পরিমিতিতে ফুটিয়েছো।খুব ভালো গল্প।
উত্তরমুছুনখুব ভালো লাগলো। আমিও একই সমস্যায় ভুগছি রে।বুঝতে পারছি না কি করবো।
উত্তরমুছুনআমার তোমার গল্পের এই মোচড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা দারুণ লাগে..ভীষণ উপভোগ্য... এককথায় দারুণ
উত্তরমুছুনসময়ের লেখা। প্রতিটি ঘরে ঘরে ঠিক এই ছবিই এখন ঘোরাফেরা করছে। ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনবেশ ভালো গল্প। একটা গভীর সমস্যাকে তুলে ধরেছেন । এই সমস্যাটা এই করোনাকালে বাড়িতে বাড়িতে চেপে বসেছে। ভালো লিখেছেন ।
উত্তরমুছুন