সৌমী_আচার্য্য
ফলকআরা
❃❃❃❃❃❃❃❃❃❃❃
এ্যায় বতন তুঝে একবার দেখু একবার ছুঁলু/ইন সাসো মে একবার ভর লু তুঝে/এ্যায় বতন তুঝে একবার চুম কে বহে যাউ/ইন আঁখো সে ফিরসে পিলু তুঝে
এটা
কার লেখা নানি।জিজ্ঞাসা করতেই ঝিম ধরে বসে থাকে।একটু আগেও দিব্ব্যি
ট্যাঁকোস ট্যাঁকোস করে নানা তামঝামের কথা বলছিলো।আমি আমার নানি আর আম্মি এই
নিয়েই আমাদের এক কামরার ঘুপচি ঘর।নানির তোরঙ গুলো নিয়ে জামিলা মানে আমার
আম্মির অভিযোগের শেষ নেই।আজ রবিবার ইয়ার দোস্তদের মেহেফিলে না গিয়ে তোরঙের
পেছনে লেগেছি।রাজ্যের হাবিজাবি ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো,কাগজ,কিতাব আর এই খাতা
পেলাম।তেলের টিনের উপর পুরোনো সালোয়ার,কুর্তা রেখে দ হয়ে বসে আছে নানি।কাছে
গিয়ে বললাম,এসব কার লেখা নানি?বিজাতিয় ভাষায় বলে উঠলো কিসব তার মধ্যে
ভারত শব্দটা কানে লাগলো।গুণগুণ করেই চুপ করে গেলো।নানি!নানি!বেশ কয়েকবার
ডাকার পর ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে বললো,মাত পুছো।মাত পুছো।যা ছুটে গেছে তার কথা
আর মনে করিয়ো না।জামিলার ডাকে সিনা ধড়ফড় করে উঠলো।
-জায়ান!তোর কাজ নেই?ঐ রাজ্জ্যের নোংরা জিনিস নিয়ে বসে আছিস?ফেলে দে।
-জি আম্মি।
-ঐ বুড়ি কি বলছে?
-কিছুই তো বলছেনা আম্মি।এই দেখ খাতায় কতো শায়রি লেখা।উর্দু কম,হিন্দি বেশী এইসব কে লিখেছে?
-সায়রি?পেটে দুবেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি।ফেক উসকো।
-না আম্মি থাক।
জামিলা
আমায় কিছু বলেনা।আপনমনে জামিলাকে নাম ধরে ডাকতে আমার একটা পৈশাচিক আনন্দ
হয়।নানির মেয়ে হয়ে এত নিষ্ঠুর কেন জামিলা আমি ভেবে পাইনা।গত কুরবানীর ঈদে
নানি প্রতিবারের মতো কান্নাকাটি করছিলো।আমি জিজ্ঞাসা করলে সেই এক
উত্তর।আপনি অন্দর কি লালচ কো কুরবান করো কিসি জীব কো নেহি।নানি যত কাঁদে
জামিলা তত জোরে জোরে কাহানি বলে কোন মহল্লায় কটা উট,কটা গরু হালাল
হলো।বারান্দার কোণে কুরবানীর মাংসের গন্ধে আমার জিভে জল গড়ায় নানির
চোখে।নানি এক আজীব পহেলী।একাত্তর বছরের বুড়ি নানি ফলকআরা খাতুন।গেহুর মতো
রঙ,এখনো ঠোঁট গোলাপি।একদিন নানির গোসলের সময় পুরো জিসম দেখেছিলাম।ছাতিতে
গভীর অসংখ্য নিশান,পিঠ আর জাঙেও।জামিলাকে রাতে জিজ্ঞাসা করতেই খানিকক্ষণ
চোখ পাকিয়ে চেয়ে থাকলো।তারপর গলায় তেতো ঢেলে বললো,তোর উমর কত হলো
জায়ান?বুড়ি জিসিমের খোঁজ না করে কোনো কচি জিসিমের স্বাদ নেবার ক্ষমতা হয়নি
এখনো?
-আম্মি!
-ক্যায়া আম্মি?রাতদিন কিতাব নিয়ে বসে আছিস আর নয় নানির পাশে ঘুরঘুর।তুই কি ভেবেছিস কেউ কিছু বোঝে না?
-আমি তো নজরের পড়ার মতো কিছু করেনি।
-তুই মসজিদে যাসনা,সুযোগ পেলেই মূলতানে গিয়ে কিতাবঘরে মুখ গুঁজে পড়ে থাকিস একে কি বলে জায়ান?
-কি বলে আম্মি ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়া?
-জায়ান মুখ সামলকে রাখ।
জামিলার
মতো ধর্মের নেশা আমার নেই।জামিলা জানেই না লোধরানে ও এলো কোথা থেকে?নানির
কথার অসঙ্গতি আজ থেকে দশ বছর আগেও এতোটা ছিলো না।রাতে আসমান দেখতে দেখতে
নানি বলতো,জায়ান নিজেকে চেনাটা খুব জরুরি,খুব।পহেচান ঢুঁণ্ডো বেটা।আমি
নানির হাতে মুখ পেতে বলতাম তোমার পহেচান কি নানি?নানি তারাভরা আকাশে তাকিয়ে
বলতো মুহাজির।বুকের ভেতর রক্ত চলকে উঠতো।আজ কুড়ি বছরের আমি সেই নয়,দশের
মুহাজির শব্দটা এখনো বহন করে চলেছি।আমার আব্বাকে আমি দেখিনি।শুনেছি একরাতে
বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি।আমি তখন মাস তিনেকের।মূলতান থেকে জামিলাকে
তাড়িয়ে দেয় আব্বার বাড়ির লোক।সেই থেকে জামিলা নানির কাছে।আমার নানাজির কোন
ছবি নেই ঘরে,আছে শুধু জামিলার আক্রোশ আর আছে হাসান ওলা রোড লোধরানে এই এক
কামরার ইঁটের ঘর।আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে ডানহাতে দশ মিনিট হাঁটলেই জামিয়া
সুলেমানিয়া মসজিদ।ঐ পথেই লোধরানের বিখ্যাত জুতো তৈরীর ছোটবড়ো দোকান তারই
একটাতে জামিলা সারাদিন জুতো পিটায়।তাই ওর মুখ চামড়ার মতো পিটানো,খরখরে।
নানির
তোরঙ পরিস্কার করে খাতাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম।বেরোনোর আগে নানির কপালে
ঠোঁট ছুঁইয়ে এসেছি।ফলকআরাকে ছুঁয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে।ওর গায়ে আমি মাটির
গন্ধ পাই,বালির গন্ধ পাই কিন্তু বৃষ্টির গন্ধ পাই না।সাইকেলটায় তেল দিয়েছি
বেশ করে।দুটো রুটি আর রাজমা নিয়ে জামিলাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম।আমার
পাঠান কুর্তা ভেদ করে সূর্য তাপ ঢালছে।তবু আধঘন্টা মেনরোড দিয়ে সাইকেল
চালিয়ে শতদ্রুর পাড়ে এলাম।সারাদিন ডুবে থাকলাম খাতায়।নিজের দেশকে ছুঁয়ে
দেখার কি ভীষণ আর্তি।একবার ফিরে যাবার খোয়াইশ যেন এই শায়েরের বুক খুঁড়ে
দিচ্ছে।
আগ কি তপিশ মে হু লিপ্টি হুয়ি /তুঝে মিলনে কি চাহাত মে না জাগি না শোয়ি
ফলকআরা
দিনদিন চুপ হয়ে যাচ্ছে।আমার মনে তত বেচেইনি বাড়ছে।আমার মন বলছে এই সায়রি
ফলকআরার।নানি,তুমি এসব সায়রি লিখেছো?নানি?চুপ করে তাকায়।বড়ো চোখ দুটো ঝুলে
পড়া চামড়ায় ঢেকে গেছে অনেকটা।নানি তুমনে লিখা ইয়ে সব?ঠোঁটে আঙুল
ঠেকায়।মিনিট দশেক চুপ করে আমায় দেখে।
-ধীরে বলো,ইবলিশের বাচ্চা কলজের উপর চড়ে বসে আছে জানোনা?
-তুমি কি জামিলার কথা বলছো?
-রাতের
অন্ধকারে মুহাজির ফলকআরাকে ছিঁড়ে খেতো যে শুকুনরা তাদের আগুণের মতো
চোখ,পোড়া কাঠকয়লার মতো শরীর।তাদেরি কারো শাহাজাদি তোমার আম্মি।
আমার চোখ ফুঁড়ে দিলো নানির শব্দ।হাতটা ধরে বললাম,নানি?
-জায়ান,মেরি জায়ান।তুঝমে মেরি মিট্টিকি খুশবু হ্যায় মেরি জান।
কি
আশ্চর্য নানি আমার গায়ে নিজের মাটির গন্ধ পায়?আমিও পাই ওর শরীরে মাটির
গন্ধ।গতকাল রাতে রোটি দেবার সময় জামিলা বালিতে বালি ঘষা স্বরে বলেছিলো,আর
কতদিন বাঁচার শখ আপনার?কি কি খাবেন আর?এই নেতানো জিসিম দিয়ে এবার নাতিকে
ময়াল সাপের মতো গিলে খাচ্ছেন?খুদা আপনাকে কখনো মাফ করবে করবে না।নানি একটুও
খেতে পারেনি।শুধু কেঁদে গেছে।আজ আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,কালকেও করেছিলাম।
-নানি?তুমি নিজেকে মুহাজির বলো কেন?পাকিস্তানে তোমার জন্ম নয়?
আবার
ডুবে গেলো ফলকআরা।থুতনি ঝুলে পড়লো বুকে।ফলকআরাকে ছুঁয়ে বসে থাকলাম।দিন
দশেক আগে মোবাইলে অনেক ভিডিও দেখেয়েছি ফলকআরাকে।এমনিই।ভারতের গুজরাট দেখার
সময় নানি আমার হাতটা চেপে ধরেছিলো।তখনি ঘরে ঢুকলো জামিলা।আজিব ঔরৎ।
-লাহুল বিলাকুবায়েৎ।এভাবে হাত ধরে বসে আছেন নাতির?জায়ান তোর কি বুদ্ধি লোপ পেয়েছে?
-আম্মি কি যা তা বলছো?
-তুই
জানিস এই ঔরৎ জীবনের কতগুলো বছর জিসিম বেচেছে?আমার জীবনটাও শেষ করেছে এই
ঔরৎ।তোর আব্বা আমায় কেন ছেড়েছে?তোর দাদি কেন ঘরে ঠাঁই দেয়নি?সব এই ঔরতের
জন্য।
-আম্মি!
-আমার আব্বাজান যেদিন চলে গেলো আমি তখন পনেরো ষোলো।একফোঁটা কাঁদেনি এই ঔরৎ।কাঁদবে কেনো?আদমী কভি কম না পড়ি ইনকো।
-আম্মি আর একটা কথাও বলবে না তুমি।
চিৎকার
করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম।এলোমেলো পায়ে বনজর খেতের উপর বালি মেখে শুয়ে
শুয়েছিলাম।ঠাণ্ডায় মাংসের ভিতরের হাড় পর্যন্ত জমে যাচ্ছিলো তবু উঠতে ইচ্ছা
হয়নি।ফলকআরা এক অদ্ভুত পহেলী।ওর রিনরিনে বুড়ি গলা যেন কতজন্মের কান্না
বুনতে থাকে।কোনদিন রেশমি ওড়না,কোনদিন রাজাই আবার কোনদিন শেরওয়ানি বুনে দেয়
আমার বুকের মধ্যে।
ইঁউ
তো সায়েদ তুঝে ম্যায় ইয়াদ নেহি /ইঁউ তো সায়েদ তেরি খোয়াইশ মে ম্যায়
নেহি/পর হর রাত মে মেরি সিসকতি হুয়ি সাস তুঝে পুকারতা হ্যায়/এ্যায় বতন
তুঝে একবার দেখু তো জিউঠু/সিনে সে একবার তেরি মিট্টি লাগালু/ফিরসে তুঝমে হি
সামা জাউ
আজ ফলকআরাকে
দাওয়াইখানায় হেকিম দেখিয়ে বাড়ি আনিনি সোজা শতদ্রুর পাড়ে নিয়ে গেছি।তিরতির
করে কাঁপছে নানি।জলে পা ছুঁইয়ে হাসলো।দাঁত নেই বেশ কয়েকটা তবু সুন্দর শান্ত
মুখ।বিকৃতি নেই।পাড়ে তুলে প্রিয় গাছটার নীচে বসালাম।ফলকআরা জলের গভীরে
খুঁজতে লাগলো একঢাল খয়েরি চুলের চঞ্চল দস্যি গেঁহু রঙা মেয়েটা।মেয়েটাকে
আমি দেখেনি কিন্তু জানি ফলকআরার মধ্যে সে আছে।আস্তে করে ডাকি তাকে,ফলকআরা!
-এক
কাহিনী শুনো জায়ান,মেরি জান।আগুণে পুড়ছে সব মন্দির ভি,মসজিদ ভি।পুড়ছে
ইনসান।উগ্র গন্ধ,রক্ত আর ভয়।ভয়ানক ভয়।একটা কুড়ি একুশের মেয়ে ছুটছে ছুটছে
ছুটছে।তেজ আরো তেজ।ঠিক যেমন সে গাঁওএ সবার আগে দৌড়াতো মেলায় ঠিক তেমন।রেৎ
পেরিয়ে একটা ছোট্ট দলের সঙ্গে সেও শুধু ছুটছে।গায়ে এসে ঝাপটা দিচ্ছে নোনা
ভেজা হাওয়া।এক সময় মেয়েটা আর চলতে পারলো না।পেটের ভেতর ঢুকে গেলো তার পুরো
শরীর।যন্ত্রণায় একটা বিরাট দ হয়ে গেলো মেয়েটা।সকাল হলো কিছু বোঝার আগেই
মেয়েটাকে দুটো আদমী বগলের নীচে হাত ঢুকিয়ে ছ্যাঁচড়ে নিয়ে চললো মুখে তাদের
উল্লাস।সে জানতো না কোথায় যাচ্ছে সে।
-তারপর নানি?
-এই
জিসম কি আজিব কারখানা তুমি জানোনা জায়ান।মেয়েটার নরম বুকের মাংস,রান্ আরো
যত নিজের চেনা গোপন অংশ হাঁ হয়ে গেলো সকলের সামনে।নানা কায়দায় রোজ হামলে
পড়তো শকুন।খুবলে নিতো তাকে।তার ধর্ম তাকে বাঁচাতে পারেনি।তার তখন একটাই জাত
ঔরৎ।মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো ওরা,ওরা অনেকে,দুটো বছর।তারপর যেদিন
মেয়েটার পেট ঠেলে ইবলিশের বাচ্চা জানান দিলো সে আসছে সেদিন মেয়েটাকে
রাস্তায় ছেড়ে দিলো।মেয়েটা রাস্তায় বেরিয়ে জানলো এ তার বতন নয়।এই দেশে সে
মুহাজির...রেণ্ডী।মুঝসে মেরা বতন ছুট গ্যায়া,মুঝসে মেরা দেশ ছুট
গ্যায়া,মেরা ভারত ছুট গ্যায়া জায়ান,মেরা ভারত ছুট গ্যায়া।
ফলকআরা
ক্ষীণ শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।দুহাতে মাটি চেপে ধরে আর দাঁতে
দাঁত চিপে বলতে থাকে,এ মাটি আমার নয়,একবার জায়ান একবার আমায় আমার মাটি
ছুঁইয়ে দাও,একবার।
ফলকআরাকে
ছুঁয়ে বসে থাকি।ওর গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখি বিদেশী গন্ধ পাই নাকি।যত শ্বাস
নিই শৈশবের গন্ধ গুলিয়ে ওঠে।দাওয়াইখানা থেকে ওষুধ দিয়েছে যাতে শরীরের পানি
ইচ্ছেমত না বেরিয়ে যায়।প্রবল কান্নায় বোধহয় ধরে রাখতে পারেনি।আমি শান্ত
করি,স্নেহে হাতে চোখের জল মুছাই।রঙচঙে সাজগোজ করা টোটো রিক্সায় তুলে নিয়ে
ঘরে আসি।
দুদিন
ধরে জামিলার চিৎকার, নোংরা শব্দের স্তূপ ফলকআরা আর আমাকে চুপ করিয়ে
দিয়েছে।আমি মূলতান চলে এসেছি আজ।আসার আগে নানিকে বললাম।নানি!তুমি হিন্দু না
মুসলিম?নানি হেসে বললো আমি ফলকআরা।আমার বাবা,আম্মি সব মুসলিম ছিলো।আমি
গরবা খেলতাম।মেলায় সরিতা,কস্তুরির সাথে হনুমান কে নমস্তে বলতাম আর ঈদের
সিমাই দিতাম ওদের।সরিতার আব্বা পণ্ডিত ছিলেন বলতেন,আপনে লালচ কে লিএ কিসিকো
মাত মারো।আর আমার আব্বা বলতেন কুরবানী মানে নিজের অন্তরের লালচের
কুরবানী।আমরা কোনদিন উট,গরু মারিনি জায়ান।আমি শুধুই ফলকআরা।
আজ
সারাদিন গ্যারিসন পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়েছি।ফলকআরার এখন বয়স যদি একাত্তর
হয় তবে ঘটনা আজ থেকে একান্ন বছর আগের।কারণ ঘটনার সময় আমার বয়েসী ছিলো
ফলকআরা।তার মানে ১৯৬৯ এ কোনো ঘটনা তাকে ভারত থেকে পাকিস্তানে নিয়ে
আসে।ইতিহাস বলছে গুজরাটে পোষ্ট ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট রায়ট হয়েছিলো এই
বছরেই।তারমানে ফলকআরা সেই সময়ের ভিকটিম।কিন্তু গুজরাট থেকে নানি লোধরান এলো
কি করে?আর নানাজি পেলো কোথায় ফলকআরাকে?
জামিলার
ভয়ে খালি বাড়িতেও ফলকআরা চুপ করে থাকে।আমি দুদিন কলেজ থেকে হঠাৎ ফিরে
এসেছি আশ্চর্য জনকভাবে তার মিনিট দশেকের মধ্যে জামিলাও ফিরে এসেছে।একজন
একাত্তর বছরের বুড়িকে নিয়ে সন্দেহ করার মত মন কেবল জামিলারই আছে বোধহয়।ওর
তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুকের মধ্যে বিষ ঢালতে থাকে।এই সব কিছু থেকে মুক্তি পেতে
ইউ টিউব দেখি।ভারতের নানা জায়গা ঘুরে বেড়াই।গুজরাটে ফিরে যাই বারবার।জামিলা
না থাকলে ফলকআরাকে সেইসব ভিডিও দেখাই কাঁপা হাতে মোবাইল স্ক্রিন ছোঁয়
ফলকআরা।
ফলকআরা এর মধ্যে
বিপদ বাধালো।বাথরুমে যাবার তাড়ায় পা বেধে পড়ে গেলো।আমি তখন বাড়ি ছিলাম
না।বাড়ি ফিরে দেখি বিছানার চাদরে ঝুলিয়ে ফলকআরাকে নিয়ে ঘরের বাইরে বের করছে
আশপাশের লোক।আমি সাইকেলটা ফেলে কোলে তুলে নিলাম নানিকে।তখনো নানি
বেহোঁশ।ছুট লাগালাম রাস্তা ধরে।একটি মারুতি দাঁড় করালো কেউ।দাওয়াখানায়
নিতেই মূলতান রেফার করলো ফলকআরাকে।।বাড়ি এসে টাকা চাইলাম, জামিলা পরিস্কার
বলে দিলো,এখানেই থাক।মূলতান নিতে হবে না।আর কতোদিন জিন্দা থাকবে?বেকার পয়সা
খরচ।
জামিলাকে তখনি গলা
টিপে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করছিলো।নিজের মায়ের এতো কষ্ট দেখেও টাকা দেবে
না।কোমড়ের হাড় সরে গেছে,নিশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে নানির।সোজা জামিলার গোপন কৌটৌ
থেকে এক বাণ্ডিল টাকা বের করে নিয়েছি।মূলতানের বড়ো হাসপাতালে নানিকে নিয়ে
গেলাম।সময় লাগবে সারতে।আজ রাতে বাড়ি ফিরেছি।গোসল করে বসে নানির ফাঁকা বসার
জায়গাটা দেখছিলাম।জামিলা ঘরে ঢুকে বললো,আর যেতে হবে না মূলতান।
-মানে?
-নানিকে পাস মাত যা বেটা।আমার কথা বোঝার চেষ্টা কর।
-আম্মি আমি কুড়ি বছর পার করে ফেলেছি।নানি একাত্তরের এক বুড়ি অথর্ব মানুষ।তোমার কি বুদ্ধি বলে কিছু নেই।
-তুই
জানিস না জায়ান।আমার তখন ঘোর জওয়ানি।তোর আব্বার শাদির দুমাসের মধ্যে
লোধরান আসার নেশা চাপলো।সারাদিন তোর নানির কথা বলে।তোর নানি তখন মধ্য
বয়স্ক।লোকটা কেমন যেন বদলে গেলো জেদ ধরলো ইণ্ডিয়া যাবে।কাজি সাহেব খবর পেয়ে
দুজন লোক পাঠালো।তারা ইণ্ডিয়া নিয়ে যাবে বলে সেই যে তোর আব্বাকে নিয়ে গেলো
আর ফিরলো না লোকটা।তুই তখন মাত্র তিনমাসের।আমার আম্মি জাদু করতে জানেরে
জায়ান।উস পার কি কালা জাদু।আমার শাদির সময় তোর নানাজির কথা জিজ্ঞাসা করলে
আমার শশুরালের সবাইকে তোর নানি বলে দিলো আমি নাজায়েজ লড়কি।এমনকি তোর নানিও
জানেনা কে আমার আব্বা।যাকে ছোট থেকে আব্বা বলে জেনে এসেছি,সে নাকি ইণ্ডিয়া
বর্ডারের কাছে বিরহার থেকে আম্মিকে নিয়ে এসেছিলো।পথের পাশে রাস্তায় পড়েছিলো
সে।তোর আব্বু সব শুনেও আমায় বিয়ে করলো।আর ব্যাস্ তোর আব্বু যেই চলে গেলো
মুহাজির রেণ্ডির মেয়েকে তারা ঘরে রাখলো না জায়ান।ঐ ঔরৎ খতরনাক।ওর কথায়
আদমীর দিমাগ হুঁশ খুঁজে পায় না।তোর পায়ে ধরছি বেটা তুই নিজেকে সামাল
বেটা।আমি তোকে হারাতে চাইনা।
এই
প্রথম জামিলাকে আম্মি বলে জড়িয়ে ধরলাম।জামিলা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে
দিলো।সকালে জামিলা আমার কাছেই থাকলো দোকানে গেলো না,আমিও মূলতান গেলাম
না।পাশে বসে বললাম,আম্মি তুমি নানিকে কখনো বোঝার চেষ্টা করেছো?
-কি বুঝবো বেটা?তুই জানিস?আমি ছোটো থেকে শুনেছি তোর নানি কাফেরের গান করে।ঐ গান শুনেই আমি বড়ো হয়েছি।
-কোন গান?
-ঠিক সে ইয়াদ নেহি পর উসমে কৃশান ভগবান ও রাম কা নাম আতা থা।ইস গানে কে লিএ বহুত পরেশানি ঝেলেছে তোর নানা।হাজার বার হাজার খেসারত।
-নানির
বচপন ঔর জওয়ানি শুরু হয়েছে হিন্দুদের মধ্যে ভারতে।সে যা দেখে বড়ো হয়েছে
তাই শিখেছে।নানির একটাই ধর্ম মা,সে মানুষ,ফলকআরার একটাই জাত সে
ভারতীয়।ধর্মের চেয়েও তার দেশকে পাবার আকাঙ্খা প্রবল।
-চুপ
কর জায়ান তুই জানিস না।ভারত ভারত করে কতবার কত কে তোর নানিকে ভোগ করেছে।সে
সব দিয়েছে স্বেচ্ছায় শুধু ঐ ভারতে ফিরবে বলে।আব্বু ফুটফুটকে রোতা থা।
-আম্মি,একটা মানুষ কতটা মরিয়া হলে সব কুরবান করে দেশে ফেরার জন্য বুঝতে পারো?
-আমি
বুঝতে চাই না।আমি কোনদিন মা পেলাম না তার বেলা কি জায়ান?বুদ্ধি হয়ে থেকে
দেখছি আম্মি কোথাও নেই তার শরীর পড়ে রয়েছে।খিদের চোটে কেঁদেছি দেখেছি আম্মি
কাঁদছে আর কি সব লিখছে।আমার মানুষটাকেও তো চিরদিনের জন্য কেড়ে নিলো।
-আম্মি
!নানি আব্বুকে কেড়ে নেয়নি।তুমি বোঝো না আব্বুকে কারা কেড়ে নিয়েছে?আব্বু
ধর্ম দেশের ঊর্দ্ধে মানুষের ব্যথাকে স্থান দিয়েছিলো।আর কেউ সেই সুযোগে
আব্বুকে হালাল করেছে ধর্মের নামেই,দেশের নামেই।
বুঝতে
পারছিলাম জামিলা ভেতরে ভেতরে ভাঙছে।এতো দিনের জমানো ক্ষোভ শতদ্রুর মতো
বেগে বয়ে আসতে চাইছে।তবু যেন সবটা মানতে পারছে না।জামিলাকে হাত ধরে তারাভরা
আকাশের নীচে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালাম।
-আম্মি আজ যদি তোমায় হঠাৎ বলি এ বাড়ি তোমার নয়।
-মানে?
-মানে,এ
বাড়িতে তোমার কিছু নেই তুমি এবাড়ি থেকে চলে যাও!তারপর যদি বলি এই লোধরানে
তোমার জায়গা নেই,যদি বলি গোটা পাকিস্তান টাই তোমার বিদেশ।তুমি আসলে
বিদেশী।এখানে তোমার কিচ্ছু নেই কেমন লাগবে তোমার আম্মি?এই জায়ানকে যদি কেড়ে
নেয় কেউ,যদি বলে জায়ান তোমার কেউ নয় তোমার কেমন লাগবে আম্মি?
-এ্যায়স্যা মাত বোল বেটা ,মাত বোল।তুঝে খুদা কি কসম।
-কোনো
খুদা ফলকআরাকে বাঁচায়নি আম্মি।একজন ঔরৎ হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় দেশ ছেড়েছে
কি করে নিজেই জানেনা।চোখ খুলে শুধু নিজের জিসমকে খুবলে খেতে
দেখেছে।যন্ত্রণা শুধু যন্ত্রণা।এমন আরো হাজার ফলকআরা দুদেশেই আছে আম্মি।কোন
কাহানি,ফিল্ম তাদের সেই একবার মাটি ছোঁয়ার আর্তিটা বুঝবে না আম্মি।আমার
মাটি আমার দেশ আমি তার কাছে যাবো,থাকবো না এই পরদেশেএই কষ্ট বোঝা অতো
সহজ?মুসলিম তো ফলকআরাও তাহলে ওকে মুহাজির বলে কেন?ওর মতো আরো লক্ষ মুহাজির
পাকিস্তানে আছে আম্মি।তারা না তো ভারতের না পাকিস্তানের।আমার আব্বাজান হয়তো
ফলকআরার কষ্টটা বুঝেছিলো।আমি সেই মনটা ভিরাসাতে পেয়েছি।তাই নানির কষ্ট
আমায় ঘুমাতে দেয়না আম্মি।তুমি জানো নানি কি লিখেছে?
রতে
হুয়ে কহে দিল মুহাজির তো ম্যায় পয়দা না হুয়ি/জিন্দেগি আশুসে ধোলি ম্যায়
কভিভি না চয়েন সে শোয়ি/একবার বতন সে মিলাদে খুদা বহুত হ্যায় দিলমে
সান্নাটে/কফন জিতনা মিট্টি দেশকি তুনে সবকো হি তো বাটে!
জামিলা
কাঁদতে থাকে।এই প্রথম মনে হলো ইবলিশের বাচ্চার গায়ে ফলকআরার খুন কথা
বলছে।আমি আম্মিকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলাম।গেঁহু রঙা মেয়ের তামাটে চামড়ার মতো
বিটিয়া আমার বুকের সাথে লেগে গলে পড়ছে।আমায় ফিসফিস করে বলছে,জায়ান
হিন্দুস্তান যেতে কত টাকা লাগে বেটা?
-অনেক আম্মি,অনেক।এখন তো পাসপোর্ট, ভিসা পাওয়াই মুশকিল।
-বেটা,তুই অনেক কিতাব পড়ে চাকরী পেতে কত সময় লাগবে?
-অন্তত আরো পাঁচ বছর আম্মি।
-একাত্তর আর পাঁচ ছিয়াত্তর।যদি অনেক যত্ন করি বাঁচবে না তোর নানি?
-আম্মিইইই।
-ভারত কোনদিকে রে বেটা এখান থেকে?
আমি
হাত ধরে ডানদিকে দাঁড় করালাম আম্মিকে।বালিয়াড়ি শুরু হয়েছে যে দিকে সেই
দিকে দুহাত বাড়িয়ে আম্মি বললো,যে দেশে আমার আম্মি মুহাজির ছিলো না,সেই
দেশের রাতের কাছে দোয়া করছি আজ একটু শান্তিতে ঘুম পাড়াও আমার
আম্মিকে।তোমাদের কোলে ছোটবেলার মতো জড়িয়ে নাও তাকে স্বপ্নে।তার বতন তাঁকে
ফেরৎ দাও এটুকুই ফরমাইশ।আর কিছু চাই না।ইয়া আল্লাহ্।আমি বললাম,আমিন।সেই
রাতে ফলকআরার শায়েরি আমার সামনে জ্যান্ত হয়ে গেলো।জামিলার চোখের জলে।আর
পাঁচটা বছর দিও ফলকআরা তোমাকে তোমার বতনে নিয়ে যাবো।ছুঁয়ে নিও তোমার
মাটি।বুকে মেখে নিও তোমার শৈশব।চোখ ভরে দেখো তোমার দেশ।আর পাঁচটা বছর দিও
ফলকআরা।
অসাধারণ ! অসাধারণ !
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দিদি
উত্তরমুছুনআবেগটা এতো সুন্দর ধরেছো,খুব খুব ভালো লাগলো!!
উত্তরমুছুনপ্রতিবার তোমার মতামতটাই আগে পাই।এবার ভেবেছিলাম তোমায় ছুঁতে পারিনি।ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনপ্রাপ্তি
উত্তরমুছুনঅসাধারণ! অবাঞ্ছিত তুলনা না করেও মনে হলো সাদাত হোসেন মান্টোর পরিশীলিত সংস্করণ পড়লাম। এতটাই ভালো লাগলো। মান্টো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দগদগে বাস্তব এঁকেছেন নির্মোহ অনুপুঙ্খে। আর এ গল্পে লেখিকা নিষ্ঠুর বাস্তবের পটভূমিতে মায়াবী ও মানবিক এক রূপকথা এঁকেছেন! দেশভাগ আর নিরাপত্তাহীনতার নিরুচ্চার যন্ত্রণা এক আদর্শায়িত অনুভবের অবলম্বন ও পরিণতি চেয়েছে গল্পে।
উত্তরমুছুনঝরঝরে গদ্যে গল্পের টান কখনো শিথিল হয়নি! ভূগোল, ভাষা, স্থানিক জীবনশৈলীর সযত্ন অনুপুঙ্খ গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। শায়েরির ব্যবহারে যে মায়াময় ঘোর তৈরি হয়েছে সেখানেই লেখিকা মৌলিকত্বের মুন্সিয়ানা !মনস্তত্বের সামান্য অনুষঙ্গ কাহিনিকে আরও পূর্ণতা দিয়েছে। জামিলার ডিস প্লেসমেন্টও বুঝিয়ে দেয়ে লেখিকা স্পন্দমান চরিত্রের চরিত্রায়নেও অত্যন্ত দক্ষ। এ গল্প অনেক বড় পত্রিকাকেও গর্বিত করত!
আমার পরম প্রাপ্তি।চোখ জলে ভরে উঠছে।শ্রদ্ধা জানবেন।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লাগলো। ফলকআরা নামটির মধ্যে কিন্তু সত্যিই জাদু আছে...মোহিত হয়ে গেলাম চরিত্রায়নে..
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লাগলো। ফলকআরা নামটির মধ্যে কিন্তু সত্যিই জাদু আছে...মোহিত হয়ে গেলাম চরিত্রায়নে..
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লাগলো। ফলকআরা নামটির মধ্যে কিন্তু সত্যিই জাদু আছে...মোহিত হয়ে গেলাম চরিত্রায়নে..
উত্তরমুছুনঅপার আনন্দ পেলাম সোমা ফলকআরা আমার স্বপ্ন জাত।ভালো থেকো।ভালোবাসা।
উত্তরমুছুনঅপার আনন্দ পেলাম সোমা ফলকআরা আমার স্বপ্ন জাত।ভালো থেকো।ভালোবাসা।
উত্তরমুছুনআদ্যপান্ত পুরো পত্রিকাটি আমার ভালোভাবে পড়া শেষ । স্পষ্ট বক্তব্য:
উত্তরমুছুনবাতিঘর অধলাইন অসময় সংখ্যার শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি । যে কোন পত্রিকার
জন্য সত্যিই এ গল্প বৌবাজার পি সি চন্দ্র থেকে কিনে আনা একটি পাঁচভরি
সোনার হার ।
আদ্যপান্ত পুরো পত্রিকাটি আমার ভালোভাবে পড়া শেষ । স্পষ্ট বক্তব্য:
উত্তরমুছুনবাতিঘর অধলাইন অসময় সংখ্যার শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি । যে কোন পত্রিকার
জন্য সত্যিই এ গল্প বৌবাজার পি সি চন্দ্র থেকে কিনে আনা একটি পাঁচভরি
সোনার হার ।
আদ্যপান্ত পুরো পত্রিকাটি আমার ভালোভাবে পড়া শেষ । স্পষ্ট বক্তব্য:
উত্তরমুছুনবাতিঘর অধলাইন অসময় সংখ্যার শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি । যে কোন পত্রিকার
জন্য সত্যিই এ গল্প বৌবাজার পি সি চন্দ্র থেকে কিনে আনা একটি পাঁচভরি
সোনার হার ।
আপ্লুত।কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লাম।আরো মনোযোগ দেবার ইচ্ছা হচ্ছে লেখালেখিতে।
উত্তরমুছুন