সোমা দত্ত

 
মুখোশ *****
বাবার হাতের এক চড়ে একবার এমন কালশিটে পড়েছিল, যে একমাস হাঁটুর উপরে টনটনে ব্যথাসহ সেই গোল চাকা দাগটি টিকে থেকে মনে করিয়ে দিতো সন্ধ্যে ছটা বাজলে পড়তে বসতেই হবে। আজকের এই ইম্পোর্টেড অতিমারীর কামড়ও শহরে কালশিটে ফেলে চলেছে গত পাঁচমাস ধরে আর ঘর থেকে বেরোনোর আগে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে কোণঠাসা কঙ্কালসার জীবন নিয়ে মুখে মুখোশ এঁটে মুখোশধারী মানুষদের বাদ দিয়ে পাঞ্জা লড়তে হবে নির্লজ্জ্ব উলঙ্গ এক জীবাণুর সাথে.....,তবে, যদি নিতান্ত জিলাপির প্যাঁচ মনে না থাকে,  তবে মানুষের ভিতরকার ভিত্তিপ্রস্তরের কুমতি ও সুমতির মতো সব ঘটনারও ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকেই আলোকপাত করা যেতে পারে। বাবার ঘুষি রূপেন চড় খেয়ে যেমন আমার আর কোনোদিন সন্ধ্যেবেলা বই নিয়ে বসতে ভুল হোতো না। সন্ধ্যে ছ'টা বাজলেই হাঁটুর উপরটা কেমন যেন টনটন করে উঠতো এবং আপাতদৃষ্টিতে এটিকে ইতিবাচক ফল হিসাবেই ধরা হোতো কারণ পিতৃদেব বেশ গর্বের দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে নিরুচ্চারেই বলতেন, দেখো কিভাবে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া বানাতে হয়। তেমনই এই কোরোনা ক্লিষ্ট ধরাভূম। স্থূল ও সূক্ষ্ম দুরকম বিচারেই ইতি ও নেতি পাশাপাশি বর্তমান। নেতির জন্য হাত তুলে লাভ নেই, সোশ্যাল মিডিয়া ও আনসোশ্যাল "মুখ কি বাত"
যত্নের সাথে নিরক্ষরতা দূরীকরণ করে ফেলেছে। বরং ইতির দিকে ঝোঁকা যেতে পারে, ঝুঁকি ও ফাঁকি দুই-ই বেশ কম। 
যেমন মাস্ক বা মুখোশ। 
অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন, "Man is least himself when he talks in his own person. Give him a mask, and he will tell you the truth"
সুতরাং যা সত্য আর যা সত্য বলে প্রতীয়মান এই দুইয়ের বিভেদরেখা বরাবর আপনি জাগলিং করতে পারেন নানাবিধ মুখোশ এর খোলস নিয়ে। মুখোশের আড়ালে আপনার সমস্ত মিথ্যের বা সমস্ত সত্যির অভিব্যক্তি স্বচ্ছন্দ, ধরা পড়বার বা ভাঙচুর হওয়ার কোনো ভয় নেই । আপনি পাচ্ছেন ফিল্টার করা অক্সিজেন, আর দিচ্ছেন ফিল্টার মারা কার্বন যৌগ .......শোকে, আনন্দে, রাগে, ঘৃণায়, জোচ্চুরিতে, হিংসায় আপনার মায়াবী চোখের কটাক্ষ, সবুজ হয়ে ওঠা চোখের মণি রোদচশমার আড়ালে নিরুচ্চার, আপনার ফুলে ওঠে নাকের পাটা n95 এর ঢালের ওপারে নিস্পৃহ, আপনার ফুঁসে ওঠা ঠোঁট ও থুতনি ফিল্টার হয়ে বলিরেখাহীন, ভাঁজহীন, মোচরহীন এক ব্যক্তিত্ব। এই আপনিই আগে কঠোর পরিশ্রমে আপনার ভিতরকার শৃগালবাহিনীকে অরণ্যের অন্ধকারে রেখে সামুদ্রিক গভীরতা মুখে মাখিয়ে প্রলুব্ধ করেছেন আপনার মাছের চোখটিকে, তীর ছুড়েছেন প্রতিবিম্বে চোখ রেখে, এবং আপনার নিপুণ দক্ষতায় মীনচক্ষু বিদ্ধ। এই যে ভার্চুয়াল মুখোশটি আপনাকে আমদানি করতে হোতো প্রতিবার, আর যার জোরে সামাজিক সিঁড়ি বেয়ে আপনি ওঠানামা করে থাকতেন, তার জন্য সাধনার প্রয়োজন ছিলো বই কি! একটু চির খেয়েছে কি আপনার সার্ভার ডাউন, আপনি লক্ষ্যভ্রষ্ট এবং কোন বুমেরাং এরপর আপনাকে ভিজিল্যান্সে রাখবে আপনি জানেন না।
আর এখন? পঁয়ষট্টি থেকে তিনশো টাকার মধ্যে আপনি বিভিন্ন মুখোশ পেতে পারেন। দীঘির জলের মতো মুখোশের জন্য ডায়াল করতে পারেন এক, সামুদ্রিক সবুজ মুখোশের জন্য ডায়াল করতে পারেন দুই, ধূমকেতুর মতো মুখোশের জন্য তিন, রামধনু রং মুখোশের জন্য চার এবং কাস্টমাইজড মুখোশের জন্য নগরপালিকার সাথে যোগাযোগ করতে জিরো ডায়াল করতে পারেন । 
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতায় অমিত বলে, "ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্রী।" তবে স্টাইলের উপর ফ্যাশনের চাপানউতরে আপনি দশের মধ্যে কত নম্বর পাবেন কবি বলে যান নি। কিন্তু কোভিড 19 এর দায়বদ্ধতা আপনাকে মুক্তমনে মুখোশ দিলোই যখন, তখন নিশ্চল ভাবাবেগ নিশ্চিত করতে এবং ভার্চুয়াল মুখোশকে বিশ্রাম দিতে নির্ভরতা বাড়ান বাজার চলতি কপট কবরে। ওই উলঙ্গ মুখোশবিহীন জীবাণু আপনার ম্যানহোল খুলতে যদি বা পারে আপনার স্বজন-বান্ধব কখনোই পারবে না। 


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য