নন্দিনী_ রায়
বারকয়েক ফোনটা বাজার পর বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলেও, কন্ঠস্বরে তার রেশটুকুও
না রেখে ' হ্যালো ' বললেন অমলেন্দু সোম। ধৈর্য্য ধরে অপরপক্ষের সব কথা
শোনেন।
শেষে নিজে দু একটি মাত্র কথা বলেন। তার কন্ঠ এবং বক্তব্যের আন্তরিকতায় সম্ভবত সন্তুষ্ট হন ফোনের ওপর প্রান্তের মানুষটি। অমলেন্দু সোমের এই গুণটি তাকে তাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তিনি শোনেন বেশি, বলেন কম। ফোনটা রেখে সেক্রেটারিকে বলেন, এখন আর কোনো ফোন আমায় দিও না। জরুরি মিটিং এ থাকবো। তুমি প্রত্যেকটা ফোন রিসিভ করে ডায়েরিতে ডিটেইলস লিখে রাখবে।
শেষে নিজে দু একটি মাত্র কথা বলেন। তার কন্ঠ এবং বক্তব্যের আন্তরিকতায় সম্ভবত সন্তুষ্ট হন ফোনের ওপর প্রান্তের মানুষটি। অমলেন্দু সোমের এই গুণটি তাকে তাকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তিনি শোনেন বেশি, বলেন কম। ফোনটা রেখে সেক্রেটারিকে বলেন, এখন আর কোনো ফোন আমায় দিও না। জরুরি মিটিং এ থাকবো। তুমি প্রত্যেকটা ফোন রিসিভ করে ডায়েরিতে ডিটেইলস লিখে রাখবে।
কনফারেন্স
রুমে ততক্ষনে প্রায় সবাই এসে গেছে। তিনি ঢুকতেই সকলে একটু নড়েচড়ে বসলো।
পার্টির পুরোনো নতুন সব ধরনের সক্রিয় কর্মী আজ উপস্থিত। গত ভোটে তার এলাকায়
ভোটের মার্জিন অনেক কমেছে। চিন্তার এবং আজকের আলোচ্য বিষয় সেই নিয়েই।
আর্দালি এসে নক করতেই ভ্রূ কুঁচকে গেল। সেও কাঁচুমাচু হয়ে বললো, স্যার ছোট
ম্যাডাম আপনাকে এই হাই প্রেসার আর সুগারের ওষুধটা আগে খেয়ে নিতে বললেন।
অমলেন্দু দেখলেন, একটা ট্রের ওপর ছোট্ট বাটিতে দুটো ওষুধ ঢাকা দেওয়া, এক
গ্লাস জল আর ফলের রস।কোঁচকানো ভ্রু জোড়া সোজা হয়ে যায় প্রখর
ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিধায়কের। মুখের কঠিন রেখা নরম হয়ে আসে। বৌমা শ্রীময়ী
শুধু নামে নয়, কাজেও সার্থকনামা। কর্তব্যে ত্রুটি নেই। মিটিং এ বসলে যে তার
নাওয়াখাওয়ার ঠিক থাকবে না, সে তা জানে। ফলের রস আর ওষুধ খেয়ে গ্লাস ট্রে
তে রেখে বললেন, আর কোনো ডিস্টারবেন্স নয়।
বহুকালের
বিপত্নীক অমলেন্দু বাবুর জীবন কাটছে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে ডুবে। ক্ষুরধার
বুদ্ধিসম্পন্ন, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ অমলেন্দুকে কোনো কাঠি বাজি করেও যখন
দমানো গেল না, তখন পার্টির সকলে তাকে নেতা হিসাবে মানতে বাধ্য হলো। একটা
সময়ে বিপক্ষ রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষেরাও তাকে সমীহ করতে শুরু করলো।আসলে
তিনি কাজ করতে গিয়ে কখনো রাজনৈতিক রঙ দেখেন না। সাধ্যমতো সকলের সমস্যাটা
অান্তরিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেন।
অমলেন্দুর
জীবনে একটাই অস্বস্তি। ছেলে অয়নাংশু। দেবদর্শণ রূপ তার। বিদেশি ডিগ্রী।
কিন্তু কোনো কাজে এলো না। অয়নাংশুর উশৃঙ্খল জীবন। মদ জুয়া নারী, সবেতেই
সিদ্ধহস্ত। যতই তাকে লুকিয়ে করুক,অমলেন্দুর নিঁখুত নেটওয়ার্কে সবটাই ধরা
পড়ে। আর তাই মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধের কাঁটা খচখচ করতে থাকে। বন্ধু
কন্যা শ্রীময়ীকে নিজে পছন্দ করে এনেছিলেন ঘরে। যেমন স্নিগ্ধ রূপ তেমনি
স্বভাব। ভেবেছিলেন একে পেয়ে অয়নাংশু শুধরে যাবে। তার দীর্ঘদিনের নারী
বর্জিত সংসারে একেবারে তার মায়ের জায়গা নিয়েছে শ্রীময়ী। দোর্দন্ডপ্রতাপ
শ্বশুরকে সে গভীর মমতায় বেঁধে ফেলেছে। কিন্তু পাল্টাতে পারেনি অয়নাংশুকে।
অমলেন্দু জানেন এতে শ্রীময়ীর কোনো ত্রুটি নেই। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে।
কিন্তু সে রুচিশীলা, ছেলের বিকৃত রুচির সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়। আর
এখন তো হালই ছেড়ে দিয়েছে। শ্বশুরের প্রতি তার অভিযোগ নেই। এটা যে তিনি কেবল
বুঝেছেন তা নয়, শ্রীময়ী স্পষ্ট ভাষায় তা জানিয়েছে। আর এই জায়গাটাতেই বড়ো
বিপন্ন বোধ করেন অমলেন্দু। তিনি তো এই দায় এড়াতে পারেন না। এত যত্নের বদলে
যদি শ্রীময়ী তাকে দোষারোপ করতো, ঘৃণা করতো, হয়তো একটু স্বস্তি পেতেন।
কিন্তু এই নিঃস্বার্থ সেবা বড় বালাই!
মিটিং
এ আজ প্রায় সকলেই উপস্থিত থাকলেও উল্লেখযোগ্য ভাবে নেই জোনাল কমিটির নকুল
বাউড়ি। এর আচরণ অত্যন্ত সন্দেহজনক। আপাত গ্রাম্য বোকা চেহারার লোকটা আসলে
পাঁকাল মাছের মত। খবর পেয়েছেন, সে গোপনে ঘোঁট পাকিয়ে দল ভাঙতে চাইছে। দলীয়
কার্যকলাপের সাথে সেই চিন্তার কাঁটাও অস্বস্তি বাড়াচ্ছে।
গতকাল
গভীর রাতে মধ্য কলকাতার এক বারে বার ডান্সারের সাথে অশ্লীল আচরণ এবং ওপর
চড়াও হওয়ার অপরাধে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে অয়নাংশু। ভাগ্যিস পুলিশ অফিসারের
সঙ্গে অমলেন্দুর যোগাযোগ বেশ ভালো। অমলেন্দুকে তার নিরপেক্ষ কাজের জন্য
যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন। সেই সুবাদেই থানায় পৌঁছনোর আগেই তাকে ছাড়ানো গেছে।
এটা থানা, কোর্ট পর্যন্ত গড়ালে তাকে প্যাঁচে পড়তে হতো। কাল রাতে স্বভাব
বিরুদ্ধ ভাবেই কথা কাটাকাটি করেছেন ছেলের সঙ্গে। শ্রীময়ী চুপচাপ দাঁড়িয়ে
ছিলো। কিন্তু যখন নেশার ঘোরে অয়নাংশু বাবাকে ধাক্কা মারতে যায়, মাঝখানে এসে
দাঁড়ায় সে। একটি শব্দও না বলে শীতল দৃষ্টিতে পোড়াতে থাকে স্বামীকে। তারপর
শ্বশুরকে দু হাতে আগলে ঘরে নিয়ে আসে। বিজাতীয় ক্রোধে ফুঁসতে থাকে অয়নাংশু।
ঘরে
এসে বৌমা এক গ্লাস জল আর হাই প্রেসার এর ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বলে, বাবা শুয়ে
পড়ো। এসির মধ্যেও ঘামতে থাকা শ্বশুরমশাইয়ের কপাল থেকে শেষবিন্দুটা মুছে
নিয়ে শ্রীময়ী দরজা টেনে দিয়ে চলে যায়। ঘুম আসেনা অমলেন্দুর। ইস্পাত কঠিন
নার্ভের মানুষ তিনি। বেশ বুঝতে পারছেন ভবিষ্যৎ। ছেলের এই ঘটনা প্রকাশ হলে
এবারের ভোটে তার টিকিট পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যাবে। না, তিনি ক্ষমতার জন্য
ভাবেন না। কিন্তু রাজনীতিতে বড্ড বেনোজল ঢুকে পড়ছে। সেটা আটকানো দরকার।
তিনি শক্ত হাতে হাল না ধরলে এই নকুল বাউড়ির মত ভুঁইফোঁড় নেতারা পার্টিকে
মাটিতে মিশিয়ে দেবে। তার অনেক দিনের স্বপ্নে লালন করা দলকে শক্ত মাটিতে
দাঁড় না করিয়ে তিনি সরে আসতে পারবেন না। আরও একটা বড়ো চিন্তা শ্রীময়ী।তার
বড়ো স্নেহের মেয়েটি। নিজের সন্তান হলেও এমন সেবা করতো না। বরাবর তার কোমল
মূর্তি দেখে এসেছেন। কিন্তু কাল যখন অয়নাংশু তাকে ধাক্কা মারতে গেল...
সত্যি কথা বলতে কাল বেশ অবাক এবং হতাশ হয়েছেন তিনি। এযাবৎ বাবাকে এড়িয়েই
চলতো ছেলে। সামনাসামনি পড়ে গেলে নজর নামিয়ে কুঁকড়ে যেত, কিন্তু কাল...
ভ্রূটা কুঁচকে গেল... তাছাড়া কালকের ঘটনার পর শ্রীময়ীর ওপর অত্যাচার যদি
বাড়ে! অত্যন্ত চাপা স্বভাবের মেয়ে সে। বন্ধ ঘরের ভেতরের ঘটনা সে কোনোদিন
মুখ ফুটে শ্বশুরকে বলবে না। দু হাতে কপালের রগ টিপে ধরেন। মাথাটা দপদপ
করছে। অনেক ভেবে পুরনো একটা ফোন থেকে একটা নম্বর ডায়াল করেন অমলেন্দু...
পরশু
রাতের ঘটনার পর পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় হঠাৎ চোখের সামনে সবকিছু
অন্ধকার হয়ে আসে। শ্রীময়ী ধরে না ফেললে একটা রক্তারক্তি কান্ড হতো। সে
ড্রাইভারের সাহায্যে নিজেই নার্সিংহোমে নিয়ে আসে। ডাক্তারি পরিভাষায় হাই
ব্লাড প্রেশার এবং নার্ভ জনিত সমস্যা। দিনদুয়েক চিকিৎসার পর অনেক বিধিনিষেধ
মানার শর্তে রিলিজ পাওয়া যায়। এই দুদিন পক্ষীশাবকের মত তাকে আগলে রাখে
শ্রীময়ী। অয়নাংশু ঘটনার দিন থেকেই বাইরে ট্যুরে। দলের ছোট বড়ো নেতারা পালা
করে দেখতে আসছেন। সব সামলাচ্ছে শ্রীময়ী। বাড়িতে রান্নার লোক থাকলেও
শ্বশুরের রান্না নিজে হাতে করছে সে। ঠারেঠোরে সকলে অয়নাংশুর কথা জিজ্ঞেস
করলে শ্রীময়ী অকপটে বলে দিচ্ছে ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে। দিনরাত বাবার খোঁজ
নিচ্ছে। ফিরে আসতে চাইছিলো, বাবাই বারন করলো। ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে
তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়েন অমলেন্দু।
বহুদিন
বাদে আজ একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন অমলেন্দু। বৌমাকে একটু কায়দা করেই
বাপের বাড়ি পাঠিয়েছেন। পাছে তার চাপা উত্তেজনা টের পেয়ে যায়। আকাশটা কেমন
থম মেরে আছে। একটুও বাতাস বইছে না। আকাশের রঙ ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। মনে হয়
ঝড় উঠবে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানবার সাথে সাথে মোবাইলের দিকে চোখ
চলে যাচ্ছে বারবার। কদিন ধরে নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জেরবার তিনি। আবহাওয়ার
পূর্বাভাসে সকলকে সতর্ক করা হচ্ছে। কালবৈশাখী আসছে! কালই বটে! বুকের
ভেতরের ঝড়কে সামলাতেই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যাচ্ছেন। অনেক ভেবে এতবছর বাদে
শঙ্করকে ফোন করেছিলেন! সেদিন বাপ ছেলের ধস্তাধস্তির সময় যখন শ্রীময়ী তাদের
মাঝখানে দাঁড়ালো, আচমকা ওর গায়ের নানা জায়গায় কালসিটে দাগ দেখতে পেয়েছেন
তিনি। তাছাড়া নার্সিংহোমেও দেখেছেন চোখের নীচে গাঢ় কালির পোচ।সেটা যে কেবল
শ্বশুরের চিন্তায় নয়, তা বুঝতে তার বেগ পেতে হয়নি। দীর্ঘদিনের সহায়িকা
সরমাকে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলেন, শ্রীময়ী কনসিভ করেছিল।কিন্তু অয়নাংশুর
অত্যাচারে সে প্রেগন্যান্সি অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেছে। অমলেন্দু নার্সিংহোমে
থাকার সময় শ্রীময়ী নিজেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।কিন্তু কিছুতেই সে তার
শ্বশুরমশাইয়ের যত্নে ত্রুটি রাখেনি। কদিন ধরেই নাকি ভাবছিলো ভালো খবরটা
কিভাবে দেবে। আর তার মধ্যেই এই। এই প্রথম একটা সুতীব্র কষ্ট ছড়িয়ে পড়লো বুক
জুড়ে। মেয়েটা কী ধাতু দিয়ে তৈরি! নাহ, শ্রীময়ীর কোনো ক্ষতি তিনি হতে দেবেন
না। শঙ্করকে ফোন করার পর এতটা সময় যে ভারি বাতাসটা তিনি বুকের ভেতর বয়ে
বেড়াচ্ছিলেন, তা আছড়ে পড়ার সময় হয়েছে। শঙ্করের পেশাদারি হাতেই আসুক ঝড়!
বাকিটা তিনি সামলে নেবেন...
অসাধারণ।বাবা হয়েও ক্ষমা না করায় খুশি হলাম।খুব ভালো গল্প।
উত্তরমুছুনতিনি খুব সুন্দর পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম
উত্তরমুছুনবেশ ভাল লাগল।
উত্তরমুছুন