মেঘনা রায়
#কেদারনাথের চরণে#
আজ প্রায় ৩০ বছরের শীতঘুম থেকে জেগে ওঠা পুরোনো স্মৃতির বলিরেখাময়
সত্যি ভ্রমণ অভিজ্ঞতার গল্প শোনাই | যখন মিত্রকাফে,গোল বাড়ির
কষামাংস,প্যারামাউন্টের বিখ্যাত লস্যি রমরম করে দাপিয়ে ব্যাবসা করছে
কলকাতার বুকে | আমি তখন নীলরতন ম্যেডিকেল কলেজের সদ্য পাশ করা উঠতি ডাক্তার
| এক্সটেনশন হাউস স্টাফ শিপের ডিউটির চক্করে পিষ্ট হচ্ছি | M.D তে চান্স
পেয়েছি কিন্তু ক্লাস শুরু হয় নি | N.R.S এর NHQ হোস্টেলে থাকি | মেস
চালিয়ে বন্ধুরা মিলে খাই আর হিমালয় দেখার অদম্য ইচ্ছের একটা স্বপ্ন আমাকে
কখন যেন আলাদা করে দেয়। এই ইচ্ছে তৈরি হওয়ার পেছনে আমার রুমমেট সার্জারি
বিভাগের ছেলে শ্যামলের একটা অবদান আছে বৈ কী!গত বছর শ্যামল কেদার বদ্রী
গেছিল |সেই গল্প শুনে শুনেই আমার এই সুপ্তবাসনার লালন পালন |
"হিমালয় দেখতে যেতে চাও ? কেদারনাথ যাবে? " আমি বেচারা তখন মন দিয়ে
দাড়ি কাটছিলাম।শ্যামলের কথায় ফট্ করে হাত থেকে রেজারটা পড়ে গেল | বললাম
"কেন তুই নিয়ে যাবি?সাতসকালে এমন কথা বলছিস? আজ মেডিসিনের আউটডোর আছে বেশি
ভ্যানতাড়া করিস না |" শ্যামল কাচুমাচু করে বললো " তুমি তো গত বার বললে তোর
মতো সুযোগ পেলে আমিও যাব | " আমি বললাম "তা সেই সুযোগ কী জানলা দিয়ে
আসলো?" শ্যামল বললো "মন দিয়ে শোনো, আমি যে ট্যুর কোম্পানির সাথে গত বছর
কেদারনাথ গেছিলাম তারা কাল আমার সাথে যোগাযোগ করেছে যদি কোনও চেনা ডাক্তার
থাকে জানাতে | আমি এবছর ওদের সাথে অমরনাথ যাব।"এবার শ্যামল একটু দম নিল
"তুমি চাইলে যেতে পারো কুন্ডু স্পেশালের সাথে ।" শ্যামল কে বলেছিলাম ঠিকই |
আমি তো তখন ভাবিনি সুযোগ এমন টপ করে হেঁটে হেঁটে চলে আসবে! হসপিটাল
ডিউটির সাথে এক বছরের একটি ডিপ্লোমা করছি তার স্টাইপেন্ড পাই হাজার টাকা |
সারা মাসের খাবার খরচ চালিয়ে হাতে আর বিশেষ কিছু থাকেনা । এই টাকা দিয়ে
কী আর হিমালয় ভেঞ্চার করতে যাওয়া যায়? ডাক্তারি পাশ করার পর প্রায় তিন
বছর হতে চললো, এখনো কোনও ইনকাম নেই । মা চাকরি করেন বলে মাঝে মাঝে বাড়ী
থেকে কিছু হাতখরচ পাই । শ্যামলকে সেকথা জানাতে শ্যামল বললো "তোমার তো টাকা
লাগছেনা |, ওরা তোমাকে ডাক্তার হিসেবে নিয়ে যাবে । দুবছর আগেও কেউ যেতে
চাইতোনা , তখন ওরা নিখরচায় নিয়েই শুধু যেত না , আলাদা করে কিছু
রেমুনারেশনও দিত | এখন অনেকেই হিমালয় ভ্রমণে যেতে চাইছে তাই ওরা টাকা
দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু হাত খরচ ছাড়া তোমার বিশেষ কিছু খরচ হবে না,
দেখো যাবে কিনা? " আমি বেশ উত্তেজিত হয়ে প্রচন্ড স্পীডে রেডি হয়ে
হসপিটালের দিকে ছুটলাম। শ্যামলকে বললাম " আজকের দিন টা সময় দে |" কাঁধ
শ্রাগ করলো শ্যামল। আমার আজ স্যার এ.আর সির (অবনী রায় চৌধুরীর) সাথে আউট
ডোর | থিক থিক করছে পেশেন্ট | আমি সারা দিন ধরে সব পেশেন্ট দের মাথার ওপর
দিয়ে কেদার ডোম, সবুজ বুগিয়াল, সাদা মেঘের আধখানা পালক পালক হয়ে ভেসে
থাকা দেখলাম | স্যার চোখ নাচিয়ে বললেন" আজ এতো স্পীড কারুর সাথে এ্যাপো
আছে নাকি? " আমি লাস্ট পেশেন্টের এ্যবডোমেনে পারকাশন তাল ঠুকে ক্লিনিকাল
টেস্ট শেষ করে বললাম "হ্যাঁ স্যার কুন্ডু স্পেশাল |" দেখলাম স্যারের
থুতনিটা ঝুলে গেল।
অবশেষে যাওয়াটা কিন্তু আমার হলো | মহাঅষ্টমীর দিন মায়ের নাম নিয়ে রওনা
দিলাম,| হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ির নীচে অপেক্ষা করবে পুরো টিম উইথ
ম্যানেজার । আমরা অমৃতসর মেল ধরবো | অনেক দর দাম করে না ঠকে শেয়ালদা
মার্কেট থেকে সস্তার নতুন ব্যাগ কিনেছি । সস্তার তিন অবস্থা বুঝতে পারলাম
হাওড়া স্টেশনেই । বাস থেকে নেমে স্টেশনে ঢুকতে যাবো , ফটাৎ করে ব্যাগের
হ্যান্ডেল গেলো ছিঁড়ে । মনটা কু ডাকলো , কী জানি কী হবে ! জীবনে প্রথমবার
হিমালয়ের অন্দরে যাচ্ছি , ভয়ংকর রাস্তা , একা ! স্টেশনেই মুচির খোঁজ করে ,
হ্যান্ডেল সেলাই করিয়ে মিটিং পয়েন্টে যখন পৌঁছলাম তখন সবাই চলে গেছে,|
কারন ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে বেশ অনেকক্ষণ আগে | শুধু ম্যানেজার
মলয়বাবু চোয়াল শক্ত করে বার বার ঘড়ি দেখছেন | আমি কাছে যাওয়া মাত্রই দৌড়
শুরু করলেন | যাই হোক উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে অবশেষে ট্রেনের পাদানিতে পা
রেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম | গ্রুপের সবার সাথে আর পরিচয় করা হলো না । তবে
ট্রেনে দুরাত কাটাতে হবে । আলাপ ঠিকই হয়ে যাবে ।
পরের দিন সবার সাথে আলাপ পরিচয় করে,, গল্প গুজবে ভালোই কাটলো ।
এখনকার মতো অসংখ্য ট্যুর অপারেটার তখন ছিল না । হাতে গোনা কয়েকটি সংস্থা
ছিল । তার মধ্যে অন্যতম বিশ্বাস যোগ্য সংস্থা ছিল কুন্ডু স্পেশাল । ভালো
ভালো ফ্যামিলির লোকেরা ওদের সাথে বছর বছর তীর্থ দর্শনে যেতেন । আমাদের
গ্রুপেও সেরকম কিছু বিশেষ ব্যাক্তিত্ব ছিলেন | আজ এতো বছর পর লিখতে বসে
অনেকের কথাই কেমন পরিস্কার ভাবে মনের সেলুলয়েডে ধরা পড়ছে। যেমন সত্যেন্দ্র
নাথ বসু , জয়পুরিয়া কলেজের প্রফেসার । ওনার সাথে ওনার লাইফ পার্টনার এবং
সিস্টার ইন ল | আর শ্যামলদা । শ্যামলদার সাথে মেন্টাল ওয়েভ লেন্থের মিল
হওয়ার দরুন আমার সাথে বিশেষ ভাব হয় |, কারন শ্যামলদা আমার থেকে মাত্র
কয়েক বছরের বড় | , সদ্য সদ্য MIT (USA)থেকে ফিরে এসে Institute of
Chemical Biology তে কাজে জয়েন করেছে । তারপর থেকে পুরো ট্যুরে আমি আর
শ্যামলদা একসঙ্গেই বেশীর ভাগ সময় কাটিয়েছি । ছিলেন উমা রায় |
ইন্দিরাগান্ধীর প্রধান মন্ত্রীত্বের সময়কার MP ছিলেন মালদা জেলার। উনিই
ছিলেন টিমের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ,| ৭৩ বছরের স্মার্ট সুন্দরী দেশ বিদেশ
ঘোরা মিশুকে এক মহিলা । ট্যুরে বিভিন্ন সময়ে বাসের দীর্ঘ টানা জার্নিতে
নানা রকম খাদ্য সামগ্রী ওনার গুপ্ত ভান্ডার থেকে বার হতো আর আমরা সবাই
তার ভাগ পেতাম । ছিলেন বীরেন্দ্র নাথ মৈত্র । তৎকালীন সময়কার মালদা
জেলার হরিশ্চন্দ্রপুর অঞ্চলের MLA ফরোয়ার্ড ব্লকের |, পরবর্তী কালে ৬৮
বছরের এই যুবক মন্ত্রীও হয়েছিলেন, | চন্দন মৈত্র হলেন সল্টলেকের
নামকরা আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার। সদ্য বিবাহিত মেয়ে জামাই সহ ওনাদের
প্রায় তেরো চোদ্দ জন আত্মীয় স্বজনের গ্রুপ | শিবানন্দ চাটার্জী , আমার এই
ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মুখ্য চরিত্র । উনি জার্মানী থেকে কিছু কাজ শিখে ভারতে এসে
নিজে স্বাধীন ভাবে সার্ভিস গ্যারেজ খুলেছেন । থাকেন বালিগঞ্জের
মেন্ডেভিলা গার্ডেনে । ওনার সঙ্গে বছর দশ বারোর দুটি মেয়ে আর স্ত্রী । তবে
ওনার বয়সের তুলনায় মেয়ে গুলো বেশ ছোট বলেই মনে হল | সব মিলিয়ে ২৫ জনের
গ্রুপ |
পরদিন হিমালয়ের গভীরে প্রবেশ করার সময় ঘনিয়ে আসলো । আমি উত্তেজিত
হয়ে যাচ্ছি একথা ভেবে যে এতোদিনে আমার মনের ভেতরকার সুপ্ত বাসনা পূর্ণ হতে
চলেছে । অনেক সৌভাগ্য থাকলে মানুষের হিমালয় বা কেদারনাথ দর্শন হয় |,
আমার ক্যামেরা নেই, বন্ধুর (শুভ্র ) থেকে ক্যানন ক্যামেরা ধার নিয়েছি ।
তা দিয়ে ছবি তুলছি হিসেব কষে । কারন ৩৬ টি করে ছবি তোলা যায় । আমার দুটো
ফিল্ম আছে , তা দিয়ে সমস্ত ট্যুর চালাতে হবে । দেবপ্রয়াগ , রুদ্রপ্রয়াগ
ইত্যাদি সঙ্গম দেখা শেষ করে আমরা স্নিগ্ধ পাহাড়ি গঞ্জ পিপলকোটিতে গিয়ে
থামলাম দিনের শেষে । পর্বত পাঁচালির শুরুয়াৎও এই খান থেকে | হিমালয়ের
প্রত্যেকটি নেশাছাপানো গহন বাঁক অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে ধরা দিচ্ছে । জীবনে
প্রথমবার সব ইগোকে টোকা দিয়ে নস্যাৎ করে এই প্রগাঢ় আকাশচারী উচ্চতার কাছে
নতজানু আমি |
পিপলকোটি হয়ে পরদিন আমরা ধীরে
ধীরে
গৌরীকুন্ডে (৬৫০০ ফিট)পৌঁছে গেলাম ।আমরা ভারত সেবাশ্রম সংঘের আশ্রমে উঠলাম
। বেশীর ভাগ জায়গাতেই আমার রুমপার্টনার থাকছেন বীরেন্দ্র নাথ মৈত্র । কারন
আমরা দুজন কোনও ফ্যামিলিতে ফিট হচ্ছি না । যদিও বয়সের দিক থেকে আমরা দুই
মেরুর কিন্তু মনের দিক থেকে আমরা কাছাকাছি । দুজনেই অবিবাহিত । ভারত
সেবাশ্রম থেকে ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে বেশ অনেক নীচে গৌরীকুন্ডের গরম
জলের কুন্ডে| সেই উষ্ণ প্রস্রবণে অনেকেই স্নান করছেন । আমার এতো ঠান্ডায়
স্নান করার ইচ্ছে নেই । কিন্তু বীরেন্দ্র বাবুর ইচ্ছের কাছে হার মানতে হলো
। উনি নিজে স্নান তো করলেনই , আবার আমার জন্য একবালতি গরমজল নিয়ে আসলেন
কুন্ড থেকে । আমি অভিভূত হয়ে থাকলাম ৬৮বছরের এই যুবকের সান্নিধ্যে এসে ।
ভাবছি কী অসীম শক্তিশালী এই পুরুষ ,আর কী রকম মানবিকতা বোধ । এতো নীচের
থেকে বালতি করে জল আনা বেশ পরিশ্রম সাধ্য কাজ । আমি লজ্জিত হয়ে একথা জানাতে
উনি হা হা করে হাসলেন । বললেন " বয়সে এতো ছোট ডাক্তার সহযাত্রীকে ঠিক
রাখতে হবেনা ,!! আমাদের শরীর খারাপ হলে তখন কে দেখবে?" এরপর আর কিছু বলার
থাকতে পারেনা । গৌরীকুন্ডে সেদিন সন্ধেটা কাটলো সবার শারীরিক খোঁজ খবর
নিতে নিতে । অনেকেই বয়স্ক, কয়েকজন ডায়াবেটিক ইনসুলিন নেন প্রতিদিন। কেউ
কেউ হাই প্রেশারের পেশেন্ট হার্টের ওষুধ খান নিয়মিত । সবারই বি.পি চেক
করতে হলো । শিবানন্দ বাবুও ওনার কাগজ দেখালেন । আগে একবার হার্টঅ্যাটাক হয়ে
গেছে | ওনার ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান ওনাকে আসতে নিষেধ করেছিলেন | কাগজপত্র
দেখার পর আমি আমার স্বল্প জ্ঞানের ক্লিনিক্যাল চোখ দিয়ে জরিপ করে ভদ্রলোক
কে কাল কেদারনাথ যেতে বারণ করলাম । উনি চকচকে চোখে হাসি নিয়ে বললেন ,
"এতো দূরে যখন চলেই এসেছি তখন কেদারনাথ দর্শন না করে যাব না কিছুতেই|"
ম্যানেজার বাবু এসেও ওনাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন বললেন ," আপনি আজ রয়েছেন
পাহাড়ের নীচের দিকে কাল ১৪ কিমি চড়াই রাস্তা পার করে আপনি হঠাৎ কেদারনাথ
টপে প্রায়(১২,০০০ ফিট) হাইটে পৌঁছবেন , যেটা আপনার জন্য ঠিক হবেনা |"
শিবানন্দ বাবু তবুও নাছোরবান্দা বললেন"এসেছি যখন যাবোই ।"
প"রদিন সকালে আমরা বেশীর ভাগ মালপত্র গৌরীকুন্ডে রেখে, কেদারনাথের
দিকে হাঁটা শুরু করলাম | গত রাতে আমার বেশ কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল , প্রবল
ঠান্ডায় | সকাল থেকে মাথাটা টিপ টিপ করছে আর শরীরটা কেমন দুর্বল লাগছে।
বুঝতে পারছি আমার অল্টিটিয়ুড সিকনেস হচ্ছে | কাউকে বলারও নেই,, টিমের
ডাক্তারই নাকি অসুস্থ | যাইহোক বয়স্করা বেশীর ভাগ খচ্চর নিলো, দুএক জন
কান্ডি ভাড়া করলো । আমি , শ্যামলদা, এবং আরো কয়েকজন হেঁটেই যাবো ঠিক
করলাম । আমার অবশ্য এছাড়া অন্য উপায়ও ছিলনা পকেট যে ফাঁকা | শুধু অঙ্কের
পেন্ডুলামের মতো ১৪কিমি টা মাথায় দুলতে থাকলো । আমরা হাঁটতে শুরু করলাম ।
পাহাড়ে হাঁটার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই । সমতলে হাঁটার সঙ্গে এর কোন
তুলনাই হয়না প্রতিটি পদক্ষেপে তা বুঝতে পারছি | প্রথম দফাতেই ঘেমেনেয়ে একসা
হলাম | বেদম হয়ে হাঁপাতে লাগলাম ২ কিলোমিটার রাস্তা পার করেই। হঠাৎ দেখলাম
শিবানন্দ বাবু খচ্চর নিয়ে আসছেন । কেমন আছেন জিজ্ঞেস করাতে বললেন "ভালো
আছি ।" উনি দেরী করে বেরিয়েছিলেন , কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি আমাদের হাঁটার
দলকে টপকে এগিয়ে গেলেন । আমরা খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছি । রাস্তার প্রতিটি
গাছপালার গন্ধ , মন্দাকিনীর প্রতিটি বাঁকের জলোচ্ছ্বসের শব্দ , ওপারের
নিবিড় অরণ্যাণী ,উড়ন্ত টিয়ার ঝাঁক,অদূরের অজানা রহস্য ময় উচ্চকোটির হিমালয়
, সব কিছুই আমাকে এতোটাই বিমোহিত করে রেখেছে যে আমি ঠিক যেন আর সেই আমি
তে নেই হিমালয়ের উপাখ্যানে মিশে যাচ্ছি একটু একটু করে | একটা ঘোর ঘোর ভাব
কাজ করছিল মনে | রাস্তা টা ধাপ ধাপ সিঁড়ি করা । কিছুটা সিড়ি ভেঙে আবার
কিছুটা সমতল অংশ | সমতল অংশটাতে হাঁটার সময় বেশ দম ফিরে পাচ্ছি। তবে অনেক
জায়গায়ই বেশ সংকীর্ন | বার বার পাহাড়ের দিকে শরীর চেপে লাগিয়ে দিতে
হচ্ছে, খচ্চর ,এবং কানডি ও ডানডি ওয়ালাদের পথ ছেড়ে দেবার জন্য । আমরা যখন
হাঁটছি তখন কানে আসলো গতকাল খচ্চর সহ একজন তীর্থযাত্রী এইখান থেকে নীচে
গড়িয়ে পড়ে গেছেন । এই যেখান থেকে পড়েছেন সেখানে নীচে মন্দাকিনী কে আর
দেখা যায়না | শুধু তার গর্জনই প্রতিভাত হয়ে বুকের ভেতর হিম করে দেয় ।
তিন কিলোমিটার যাবার পর ছোট্ট একটা চটি এলো । আমরা দাঁড়ালাম দম নেবার জন্য
। সময় তো আমার জন্য আটকে থাকবেনা , পৌঁছাতে হবে বিকেলের আলোয় । অনেক বয়স্ক
পুরুষ মহিলারা অচল বিশ্বাস কে সম্বল করে "জয় কেদার" জয়ধ্বনি দিতে দিতে
আমাদের থেকে অনেক তাড়াতাড়িই চলে যাচ্ছে । কিন্তু আমার কাছে তো হিমালয়ের
সবটাই কেদারনাথের সমতুল্য । আমি সর্ব গন্ধ নিতেই এখানে এসেছি । তাই তীর্থ
দর্শন আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয় । ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠছি , সামনে আরো
তিন কিলোমিটার রাস্তা শেষে রামওয়াড়া চটি । আরো কিছুটা যাবার পর সামনে
তাকিয়ে দৃষ্টি আটকে গেলো এক অত্যাশ্চর্য গিরিশৃঙ্গে । পাহাড়ের শেষ সীমানায়
মেঘের পেছনে ঝকঝক করছে কেদারনাথ শৃঙ্গ সপারিষদ যদিও শুধু মাথাটুকুই দৃষ্টি
গোচর হচ্ছে | জীবনে কোনদিন এতো কাছের থেকে এই দৃশ্য দেখব কল্পনা
করিনি,আমি স্তব্ধ নির্বাক। চোখ ফেটে জল আসছে এখনও ১০ কিমির কঠিন চড়াই পথ
আমার পরীক্ষা নেবে | আমাদের কিছু পেছনেই ছিলেন ম্যানেজার বাবু খচ্চরের
পিঠে |,, তিনি আমার অবস্থা দেখে বহু ট্যুর করার অভিজ্ঞতা থেকে বললেন "
ডাক্তার বাবু আপনি এই খচ্চর টায় উঠে পড়ুন "আমি আমতাআমতা করায় বললেন "যা
বলছি তাই করুন |আপনার শরীর খারাপ হলে ঘোর বিপদ " | আমি আর কথা না বাড়িয়ে
উঠে পড়লাম | মোটামুটি দুপুর পার করে কেদারনাথে পৌঁছে গেলাম | এখানেও ভারত
সেবাশ্রমেই আমাদের এক রাত্রের আস্তানা |ওঃ বাবা আশ্রমের অবস্থান যে মন্দির
চত্বরের ও খানিক ওপরে একেবারে মন্দাকিনীর কোলের কাছে। সেই নদীর প্রবল
জলোচ্ছ্বাস হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে পাথরে | তার এই বিপুল
শব্দতরঙ্গে কানে তালা লাগার উপক্রম | আমাদের গ্রুপের সবাই এসে গেলে গরম চা
আর পাকোড়া নিয়ে হাজির নান্টু | অমানসিক পরিশ্রম করছে এই হাড় কাঁপানো
ঠান্ডায় | চা পানের শেষে একাই একটু হাঁটতে বার হলাম। প্রচন্ড কন্ কনে
ঠান্ডা উত্তুরে হাওয়ার সাথে আমার ভেতরের উলিকট,সস্তার সোয়েটার, গ্লাভস
,মাঙ্কিক্যাপ উন্ডচিটার আমাকে উষ্ণ রাখার ফাইট করে যাচ্ছে | কেদারডোমের
মাথায় কৃষ্ণ ঘনমেঘের জমায়েত | একটু নীচে মন্দির চত্বর ঘিরে দুনিয়ার
ভবঘুরে, নামমাত্র ছাইমাখা সাধু, হোটেলের দালাল,পুজো-আচ্চা নিয়ে প্রবল
উন্মাদনা, পুজো দেবার লাইনে কৌশলী মহড়া এসবের কোনও কিছুই আমায় স্পর্শ
করছেনা | কিন্তু কেদারের নামেই বহতা,,যা পুরাণের প্রবাদের চেয়েও শতগুণে
সত্যি | কেদারের মন্দিরের পেছনে গগনচুম্বী পর্বতের রথী-মহারথীর আকর্ষণ
কিন্তু দুর্নিবার | তার সাথে টুকরো মেঘের থেকে থেকে দোল খাওয়া প্রান্তিক এই
উপত্যকায় উতুঙ্গ সব শিখর শ্রেণী অচিন জীবনদর্শনের পরিচয় ঘটায় | কী যেন
আছে এই আমোঘ স্থানটিতে | ভিড় ছাড়িয়ে একলা হতেই শিবানন্দ বাবুর সাথে দেখা |
আপাদমস্তক ঢেকে ছোট মেয়ের হাত ধরে চিত্রার্পিতের মতন বসে আছেন একটা
পাথরে | পাশেই খরস্রোতা মন্দাকিনী, অদূরে সবুজ বুগিয়ালে সাদা ভেড়ার পাল
তাদের গলায় ঘন্টার ঠুনঠুন শব্দ আমাকে বিবশ করছে । আমি ওনার কাছে গিয়ে
জিজ্ঞেস করলাম কিছু অসুবিধা হচ্ছে নাতো? ক্লিষ্ট হেসে জবাব দিলেন "ভালো
আছি |" আমি বললাম "আপনি এখানে আর একদিন এক্সট্রা থেকে যান" শুনে উনি কেমন
এক বিষাদময় হাসি দিয়ে মেয়েটা কে জড়িয়ে ধরলেন ৷ রাতে প্রচন্ড ঠান্ডায় এবং
উচ্চতা জনিত কারণে আশ্রমের ডরমিটরি প্রায় হসপিটাল হয়ে গেল | কারুর বমি
হচ্ছে তো কারুর প্রেসার ফল করছে | কারুর আবার শ্বাস কষ্ট সঙ্গে প্রচন্ড
কাঁপুনি | প্রায় অর্ধেক রাত অবধি আমাকে কারুর না কারুর ঘরে ছুট গিয়ে
সামাল দিতে হয়েছে | শেষে মলয় বাবুই আমাকে ঘরে বিশ্রাম নিতে পাঠালেন |
হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কেন এরা ডাক্তার সঙ্গে আনে!!
কেদারনাথের উপহার পেলাম পরের দিন ভোরবেলায় | ঘরথেকে বাইরে পা ফেলেই
প্রথম শিহরণ | প্রভাতী সূর্যের সোনা গলানো রঙের আলো ধুইয়ে দিচ্ছে
হিমবিস্ময় কেদারশৃঙ্গের অবয়ব | ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সম্মোহিত হয়ে দেখি
এই অমরাবতীকে | দূরাগত মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি সমস্ত জাগতিক চেতনার
ঊর্ধ্বালোকে নিয়ে যায় আমায় | নিচু হয়ে আঙুল বুলিয়ে তুলে নি সবুজ বুগিয়ালের
অমৃত শিশির বিন্দু,| অজান্তেই কপালে ঠেকাই। বিশুদ্ধ আলোর ভোরে সব
প্রিয়জনদের নিয়ে আসার শপথ করি। আবারও আসব আমি এই স্বর্গীয় উপত্যকায় |
পুজো দেওয়া শেষ করেই সবাই নেমে যাবার তোড়জোড় করতে থাকে | আমিও অগত্যা
নিম্মমুখে অগ্রসর হই। বয়স্করা অনেকেই খচ্চরের পিঠে অলরেডি কিছুটা এগিয়ে
গেছেন | ম্যানেজার বাবু কে কাছে দেখতে পেয়ে আমি বললাম "এতো তাড়াহুড়ো করে
নামা কিন্তু একেবারে ঠিক হচ্ছে না | বিশেষ করে যাদের গতকাল শ্বাসকষ্ট
হয়েছিল |" যাই হোক আমিও শ্যামল দার সাথে নামতে শুরু করি | দুপুর আড়াইটের
কাছাকাছি গৌরীকুন্ডে আশ্রমের কাছে এসে গেছি হঠাৎ শুনি একটা চিৎকার করে
কান্নার আওয়াজ | মলয়বাবু ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এসে,আমার হাত ধরে দৌড়
করিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন"সর্বনাশ ডাক্তার বাবু শিবানন্দ বাবুর খুব
খারাপ অবস্থা |" ছুটতে ছুটতে দোতলায় ওনাদের ঘরের ভেতরে ঢুকে দেখি উনি
একদম শেষ নিঃশ্বাসের কিণারায়। ঘোলাটে বিস্ফারিত চোখ, স্নোরিং শুরু হয়ে
গেছে | মুখে দেওয়া সর্বিট্রেট লালার সাথে বেরিয়ে পড়ছে | আমি তড়িৎ গতিতে
আমার মেডিকেল স্যাক থেকে ডেকাড্রন ইঞ্জেকশন রেডি করে যখন পুশ করছি, উনি
আমার হাত চেপে আঁকড়ে ধরেন,,যেন শেষ আকুতি | আমার তখন কোনও আবেগ কাজ করছে না
| ডেকাড্রনের কাজ ৩মিনিটও স্থায়ী হল না!! সিরিঞ্জ ফেলে আমি অক্সিজেন বলে
চেঁচিয়ে উঠি,অবশেষে ওনার কোমরে চড়ে কার্ডিয়াক ম্যাসাজ দিতে শুরু করি । আমার
সমস্ত ইমার্জেন্সি অভিজ্ঞতা দিয়ে মিনিট দশেক লড়াই করতে পারলাম | তার পরই
ওনার চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল পরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন | বিদ্ধস্ত আমি মুখ তুলেই
দেখি গতকালের সেই ছোট মেয়ে চোখ ভর্তি জল নিয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে |
ওনার স্ত্রী এবং অন্যান্যরা ওনার শরীর ধরে কান্নাকাটি শুরু করলেন |
শ্যামলদা আমাকে আস্তে করে নামিয়ে আনলে বুঝতে পারি এই ঠান্ডায় আমি ভেতরে
ঘেমে পুরো ভিজে সপ সপ করছি | স্বগতোক্তি করলাম "একবার যদি উনি আমার কথাটা
শুনতেন!!"
বিকেলের হিমঘরে আমাদের বসিয়ে রেখে
বানভাসি গাড়োয়ালি বরিষ ধারা শুরু হল অবিশ্রাম | ওনাদের আত্মীয় স্বজনদের
খবরাখবর দেওয়া হয়েছে | সেবাশ্রমের তৎপরতায় স্থানীয় লোক জোগাড় হল বটে
কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টির জন্য কাঠ জোগাড় করা সম্ভব হল না। বজ্রবিদ্যুৎ
সহ কেদারনাথ বার্তা দিল কাল ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে | সারা রাত মৃতদেহ
আগলিয়ে বসে থাকা হল | এর মধ্যেও "জয় কেদার " ধ্বনি অব্যাহত রইল | এই
ব্রহ্ম ধ্বনিই হয়তো এই চরম সঙ্কট কালে আমাদের মনকে ভয় মুক্ত রেখেছে | কঠিন
বাস্তবের মুখোমুখি হয়েও সবাই পালা করে যৎসামান্য রাতের আহার সারলেন |
আমি কিছুই খেতে পারলাম না কয়েকটা বিস্কিট আর জল খেয়ে বিশ্রাম করলাম |
সমস্ত আইনের বিধি মেনে আমার হাত শিবানন্দ বাবুর ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিল |
কোনও দিন স্বপ্নের ধার দিয়েও ভাবিনি আমার প্রথম হিমালয় দর্শনের অভিজ্ঞতার
সাথে একজন সহযাত্রীর মৃত্যুর শীতার্ত শূন্যতা জড়িয়ে থাকবে!!
পরেরদিন ভোরের আগেই বৃষ্টি থেমে চরাচর ভেদ করে সূর্যদেব তার বিশুদ্ধ
আলোরশ্মি ছড়িয়ে কালরাত্রির গ্লানি মুছিয়ে দিল | আমরা সহযাত্রীরা এবং
স্থানীয় লোকেজন একত্রে মৃদু বোল ধ্বনি দিতে দিতে শিবানন্দ বাবুর মরদেহ
গৌরীকুন্ডে, মন্দাকিনীর ধারে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে সৎকার করলাম | জীবনে এই
প্রথম আমি কাঁধ দিলাম | স্থানীয় পুরোহিতের মন্ত্রচ্চারণ কে ছাপিয়ে দাউ দাউ
করে জ্বলন্ত চিতার আগ্নিশিখায় স্বয়ং শিব শিবানন্দ কে নিয়ে গেলেন |
অমৃতলোকে |
"হরি ওম নমঃ শিবায়ঃ"
দিদি আমি অত ভালো বিশেষণ দিতে পারি না। শুধু একটা কথাই বলব আজ থেকে ভ্রমনকথা লেখায় আমি আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করলাম।🙏🙏🙏🙏
উত্তরমুছুন