উৎপল মণ্ডল

"জ্যোৎস্নায় ভেজা নাকছাবি" : স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ এর গান
................................................................................
"জ্যোৎস্নায় ভেজা নাকছাবি" : স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ এর গান
.............
চোখেরও একটা নিজস্বতা আছে বোধহয়! যদিও সমস্ত ইন্দ্রিয়ের নির্দেশক শেষ পর্যন্ত মন বা ব্রেন তবু, প্রতিক্রিয়ার প্রাথমিক বার্তাটি  তো চোখ ই পাঠায়। তাই চোখটা থেমে গেল প্রথমেই, মলাটের  স্নিগ্ধ নরম নীল মুখচ্ছবিতে। কালো ব্যাকগ্রাউন্ড এর ওপর সেই স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি। নিচে কাঁচা নরম সাদা-- ঠিক মাটিতে আলপনা শুকিয়ে যাওয়ার আগে যেমন দেখায় তেমনি, লেখা "জ্যোৎস্নায় ভেজা নাকছাবি"। রঙের এই অনুভব আর নাম একাকার হয়ে, চেতনায় প্রতিভাসিত হলো, জ্যোৎস্না- স্নিগ্ধতা- রোমান্টিকতা.... আনুষঙ্গিক আরো আরো.. ।
 মুগ্ধতায় অন্যমনস্কভাবে পাতা উল্টাতে গিয়ে খুলে গেল মাঝখান থেকে একটি পাতা, একটি কবিতা--'বিস্ময়'। তা হোক। মাঝখান থেকে একটা টুকরো তুলে নিয়ে স্বাদ গ্রহণ করা তো যেতেই পারে! আর বিস্ময় শব্দটিই সেই আগ্রহকে বাড়িয়ে দেয়, কারণ বিস্ময় তো রোমান্টিকতারই অনুষঙ্গ। কিন্তু একি! এ তো অ্যান্টি রোমান্টিকতার পাথরে চুলের মুঠি ধরে ঠুকে দেওয়া! হঠাৎই এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা কবির, তারপর গল্প, কফি.. কিন্তু "শুধু প্রথম থেকে শেষ সংলাপ পর্যন্ত/অবাক হলাম না!/তারপর থেকেই খেয়াল হল/ওই ইমোশন টি গেছে।"তারপর দুটি স্তবকে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার প্রসঙ্গ, এমনকি সহনশীলতার চরম সীমা পর্যন্ত। শেষ স্তবকে-- "কথা দিলাম বিস্মিত হবো না/ওসব প্রক্ষোভ তোলা থাক/সাইকোলজি র থিসিস পেপারে!/অপ্রত্যাশিত বলে/আমাদের আর কোন বিস্ময় অবশিষ্ট নেই।" সাম্প্রতিক সভ্যতার যান্ত্রিক বেগে ক্লান্ত মানুষের আবেগ যে ক্রমহ্রাসমান সেটা অবশ্যই চিন্তার, কিন্তু তা বলে কি আবেগ, বিস্ময় সত্যিই অবশিষ্ট নেই? তা কি সম্ভব? দেবতার গ্রাস কবিতার মোক্ষদা কে মনে আছে আপনাদের? মনে আছে সেই কথাটি-- ' চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে'? তাহলে নিশ্চয়ই এটাও মনে আছে যে, সেটা তার মনের কথা ছিল না, ছিল মুখের কথা। এখানেও ঠিক সেরকমই, বলে আমার মনে হয়। সাম্প্রতিক জীবনযাত্রার যে কঠিন মোড়ক আমাদের নিত্যসঙ্গী তাকে তো ভাঙতেই হবে। না হলে তো বিস্ময়ে আর জাগবে না কোনো গান! কবি তাই করেছেন। সেই কঠিন মোড়ক যা আমাদের একঘেয়ে ক্লান্তিতে নিস্তেজকরে কিন্তু বিস্মিত করে না, তাকে চিনিয়েছেন কিন্তু ভেঙেছেন; নিশ্চয়ই ভেঙেছেন! না হলে বইয়ের নাম "জ্যোৎস্নায় ভেজা নাকছাবি" কেন? অদ্ভুত এই আপাত বৈপরীত্য আমাকে দ্রুত সুচিপত্রের অভিমুখী করে তোলে।
আবার অবাক হবার পালা। আশা করি আপনারও তাই হবে। দেখবেন, সমগ্র কাব্য টি আবার ছটি পর্যায়ে বা পর্বে বিন্যস্ত, সাম্প্রতিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে যা খুব সহজলভ্য নয়। 'উজানী শব্দেরা' (বারোটি কবিতা), 'পান্না রঙের পদ্য':(বারোটি কবিতা), 'ভাঙচুর কর নিষেধকে'(তিরিশ টি কবিতা), 'মন ও মনকেমন' (বাইশ টি কবিতা), 'অবিস্মরনীয়' (বারোটি কবিতা), এবং 'আমার সঙ্গে আমি' (চারটি কবিতা) নিয়ে এই পরিকল্পনা যেন মোট ছয়টি রংয়ের কিন্তু বিচিত্র ফুলে গাঁথা চমৎকার মালা। তারপর সেই বিচিত্র ফুলগুলিকে ধীরে ধীরে দেখতে গিয়ে, আপাতভাবে আপনার মনে হতে পারে যে হাতের কাছে যা কিছু ছিল সবই বুঝি গেঁথে দেওয়া হয়েছে! গোপন করব না, আমারও তাই মনে হয়েছিল! কিন্তু আমার অনুরোধ একটু গভীরভাবে (প্রয়োজনে একাধিকবার) মনোনিবেশ করলে দেখবেন, ব্যাপারটি তেমন নয় মোটেই । যথেষ্ট সচেতন প্রয়াসে, ভাব সাদৃশ্যে বিচিত্র সৌন্দর্যের এক চমৎকার বয়ান!
প্রথম পর্বটি 'উজানী শব্দেরা'। কবির পূর্ববর্তী দুটি কাব্যের সূত্রে বলাই যায় তার কবিতার একটি প্রধান উপজীব্য বিষয় প্রেম। সুতরাং উজান একটি চরিত্র, যেমন সুনীলের নীরা বা জীবনানন্দের বনলতা সেন,বা বুদ্ধদেবের কঙ্কাবতী কিংবা অজিত দত্তের মালতী। সে দিক থেকেও উজান অবশ্যই স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার, যেহেতু পুরুষ চরিত্র। কিন্তু শুধু কি সেটাই? তাহলে ' উজানী'  শব্দেরা বলা হচ্ছে কেন? উজান তো আসলে স্রোতের বিপরীতে চলা! একটু কবিতায় দেখা যাক।
গ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম স্তবক -- "ফ্লাইওভারে মোম রাস্তার নিয়ন আলোয়/উজান তুমি হঠাৎ করেই মেঘ নামালে/সেদিন কিন্তু আকাশ ছিল নীল শাড়িতেই/খামখেয়ালী অবদারেতে পথ আটকালে। " সত্যি কি কেউ পথ আটকালো এবং মেঘ নামালো? তাহলে আকাশ নীল শাড়িতে থাকবে কি করে! কিছুদূর এগিয়ে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয় যে, এ এক অনুভবের রাজ্য -- "তবুও উজান, তোমার কথা পড়লে মনে.. " আরো স্পষ্ট হয় আর দু চার পাতা এগিয়ে-- "উজান, তোমার জন্য শুধু আজও আমার/বুকের মধ্যে মেঘলা হলেই বৃষ্টি নামে।" 'কুয়াশা রাস্তা আর তুমি' কবিতার শেষ স্তবক এইরকম -- "উজান, জানো নভেম্বরের শেষে ই/ডুবতে থাকি অমলতাসের জলে!/আলগোছে ঠিক তোমায়ও খুঁজে নেব/আগের মতন রাস্তা নদী হলে।" লাইনগুলি চমৎকার। কিন্তু নভেম্বরে রাস্তা নদী হবে কি করে? আর সেই রাস্তায় অমলতাসই বা ঝরে, অমলতাসের জল হবে কি করে? নভেম্বরে তো ফোটে না এ ফুল! অতএব অনিবার্যভাবে এ এক স্মৃতিমেদুর রাজ্য। অমলতাস ফুলএর হলুদ রং গভীর তাত্পর্য আনে এখানে।
উজান তাহলে কেবলমাত্র এক ব্যক্তি অথবা কোনো প্রেমিক সত্তা নয়, স্মৃতিমেদুর এক অনুভবের জগত। দেখবেন, আমরা কথায় কথায় বলি-- সে এক স্মৃতির পাহাড়। মনস্তাত্ত্বিকভাবেও তাই। আমাদের সাবকনসাস মাইন্ড এ জমে থাকে পাহাড় সদৃশ্য স্মৃতি। আর বর্তমান সমতল জীবন যেনো এগিয়ে চলে সমুদ্র সদৃশ অনাগত অসীম এক ভবিষ্যতের দিকে। সাম্প্রতিক অতীত স্মৃতি যত সহজলভ্য, সুদূর অতীত স্মৃতি তেমনটা নয় কখনোই। স্মৃতির দূরত্ব যত বাড়ে, তার অভিমুখে পৌঁছতে ততই যেন সাঁতরাতে হয় উজান বেয়ে। পাঠককেউ যেন এতটা পথ উজানে সাঁতার কেটে পৌঁছতে হয় সেই উৎস ভূমিতে, যেখানে স্পষ্ট হয় কেন 'উজানী শব্দেরা' এর সচেতন এবং কী গভীর প্রয়োগ!
'পান্না রঙের পদ্য'-গুলিতেও সেই একই রকম চোরাবালি, যেখানে অসচেতন পাঠক ডুবে যেতে পারেন যৌবনের কবিতায়। কেননা পান্না সবুজ, আর সবুজকে যৌবনের প্রতীক করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু অনুভূতিশীল মানুষ আসলে মননে বাঁচে, আহার নিদ্রা মৈথুনের মধ্যে যে বাঁচা, তার সঙ্গে আর দশটা প্রাণীর বাঁচার কোন তফাৎ নেই। এবার আপনার সেই মনন জগতে, সেই স্মৃতির জগতে থাকতেও তো পারে কিছু রত্নের মতো উপাদান, যা থেকে প্রতিমুহূর্তে বিচ্ছুরিত হয় সৌন্দর্য এবং স্নিগ্ধ আলো! পান্না রঙের পদ্যগুলি প্রায় প্রতিটি এক একটি রত্ন এবং তা স্মৃতি ও মননজাত।
নাগরিক সভ্যতায় বন্দী জীবনে ক্লান্তির সূত্রেই পাশ্চাত্যে রোমান্টিক কাব্য আন্দোলন-জাত কবিদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়েছিল কল্পনার জগতে বিচরণ যা কখনো পশ্চাদমুখী (অতীত চারী তা) কখনো সম্মুখগামী। বর্তমানে এই নাগরিক ক্লান্তি ঠিক কোন পর্যায়ে নিশ্চয়ই বলার দরকার নেই। অতএব এই স্মৃতিমেদুরতা সময়জাত। কিন্তু সময় তো আসলে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এর ধারাবাহিকতা! বর্তমান জীবনে যে নিজস্ব সত্তা নির্মাণ, তাও তো আসলে সময় চেতনা। 'ভাঙচুর কর নিষেধকে' র তিরিশটি কবিতা এবং "মন ও মন কেমন"এর বাইশ টি কবিতা নিয়ে এই পর্ব দুটি হয়ে উঠেছে সেই সময়ের নির্মাণ। এখানে ' জন্মাষ্টমী ' বা 'সীতায়ন ' এর মত শক্তিশালী কবিতায় যেমন পুরান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে আধুনিক জীবনের দ্যোতক, তেমনি একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৫ই আগস্ট এর মত দিন কবির নিজস্ব ভাবনায় উজ্জল। কখনো বা 'পরকীয়া ' হয়ে উঠেছে এক সমাজদর্শনের জিজ্ঞাসা -- বৈধতা-অবৈধতা কি সামাজিকতার মানদণ্ডে নাকি চেতনায়? এমন কি অতি সাম্প্রতিক কালের চর্চিত বিষয় ' গুগল ' বা 'ক্যাফেটেরিয়া', ' অনলাইন ' কিংবা "ব্ল্যাক হোল 'যেমন হয়ে উঠেছে এক একটি কবিতার বিষয়, তেমনি আবার ' মালকোষ ' কিংবা 'শান্তিনিকেতন ' বা ' ' কোপাই '।
আর ' অবিস্মরনীয় ' পর্বে বিদ্যাসাগর, রবি ঠাকুর, সুকুমার রায়, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ প্রমূখ বারো জনকে নিয়ে রচিত বারোটি কবিতা, তাঁদের সম্পর্কে রিমলি র পঠন পাঠন এবং বোধের কারণেই অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। একটু উদাহরণ, 'জয় কবি কে 'থেকে -- তোমার জন্য লিখতে পারি এক পৃথিবী, আদ্যোপান্ত ভিজেছিলে কিশোরীবেলা, সাঁঝবাতির রূপকথারা, রাত্তিরেতে গল্প বলে ঝাউপাতা রা, সন্ধ্যাতারা আমার কাছেই, বজ্র লেখ আর লিখে যাও বিদ্যুৎ কে ... এইসব লাইনগুলি অথবা শব্দবন্ধ গুলি এক সাবলীল দক্ষতায় ব্যবহৃত আপন ভাব প্রকাশে। বারবার আমার মনে হয়েছে, এই ধরনের আরো কিছু কবিতা ভবিষ্যতে যুক্ত হয়ে একটি স্বতন্ত্র সংকলন হতেই পারে।
কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের কিছু নিজস্ব মাত্রা থাকে যা শুধু কবিতার জন্যই। এমনকি গদ্যে সেরকম হলে আমরা বলি কাব্যিক গদ্য। আসলে ভাব তো চিরকালই অপরিবর্তনীয়, শুধু ভাষার দক্ষতায়, শব্দ ব্যবহারের নিজস্ব শৈলীতে হয়ে ওঠে কবিতার নির্মাণ। এবং এই কৌশলেই কবিতাও হয়ে ওঠে কখনো প্রাচীনপন্থী কখনো আধুনিক কখনো বা উত্তরাধুনিক। আলোচ্য কাব্যে শব্দ যোজনার সেই সাবলীল দক্ষতা চোখে পড়ে পাতায় পাতায়। কবিতা ধরে ধরে তার ব্যাখ্যা করতে গেলে এ লেখা একটি গ্রন্থ হয়ে উঠবে।সামান্য কিছু উদাহরণ দিই। যেমন, "বুকের ভিতর জ্যোৎস্না রংয়ের সমস্ত পাপ/অন্ধকারের নিয়ম মেনেই তাদের ডেকো!"(তোমায় ভেবে) পৃথক পৃথকভাবে এখানে প্রত্যেকটি শব্দের মানে আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু এই অতি পরিচিত শব্দগুলি পাশাপাশি বসে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? বাক্যটির কর্তা যেহেতু পাপ এবং সেটাও ব্যক্তিগত অনুভবের বিষয়, সুতরাং তার স্থান বুকে না হয় বুঝলাম,কিন্তু তাতে আবার রঙের আরোপ!চমৎকার অনুভূতির ইন্দ্রিয়ান্তরকরণ, কেননা রং এর আবেদন চোখে।কিন্তু সে রংও আবার জ্যোৎস্না রং, যার আবেদন আবার চোখেও নয়,মনে!! কী দাঁড়াল তাহলে? আচ্ছা, সেই কর্তা পাপকে আবার বলা হচ্ছে অন্ধকারের নিয়ম মেনে ডাকতে। অন্ধকারের অনুষঙ্গে মনে আসে অপরাধ বোধের কথা। এবার ঠিক আছে মনে হচ্ছে। তাহলে, হৃদয়ের সেই ডাকে একটু অপরাধ বোধ মিশ্রিত থাকলেও তাকে ছাপিয়ে যায় রোমান্টিক স্নিগ্ধতাময় এক আনন্দ।এতক্ষণে স্পষ্ট, কেন কর্তা এখানে জ্যোৎস্না রঙের সমস্ত পাপ। এরকম অজস্র আছে। অন্ধকার পাহাড়ি পথে ভোরের প্রত্যাশা কিভাবে ছায়াপথের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় তার চমৎকার কথন-- "আমি ছায়াপথ ধরে হাঁটছি/গুঁড়ো গুঁড়ো আলো যার নাম নেই/এই জোনাকিরা জোট বাঁধতো/সেই ফেরারি, ভোরেতে আসলেই।"(দূর পাহাড়ের গল্প)।  
আর শব্দ ব্যবহারে জ্ঞানের বিস্তার যেন এক নিটোল সাম্রাজ্য। কী নেই সেখানে! জোনাকি থেকে নক্ষত্র, পান্না থেকে প্রবাল, এ্যানাটমী থেকে ব্ল্যাক হোল, ক্যাফেটেরিয়া থেকে গুগল, উত্তর ফাল্গুনী বা স্বাতী থেকে শতভিষা, পুরাণ থেকে দামিনী বা অমলকান্তি এবং অবশ্যই পাহাড় থেকে সমুদ্র। কিন্তু এই জ্ঞানের অ্যাসিমিলেশন না হলে তা শুষ্ক কংক্রিটের মত হয়ে ওঠে, কবিতা হয়ে ওঠে দুর্বোধ্য এক বোঝা। এখানে তা একদমই নয়। বিস্তর জানার চমৎকার আত্তীকরণের জন্যই ছন্দের তালে তালে সাবলীল ভাবে নিঃশব্দে ঢুকে গেছে কবিতার শরীরে, বাড়িয়ে তুলেছে কবিতার সৌন্দর্য। সেটাই স্বাভাবিক, কেননা গ্রন্থের শুরুতেই দুটি পাতা উল্টে, বাঁদিকের একটি সাদা পাতায় দেখবেন চারটি লাইন, যাকে কবির স্বীকারোক্তি বলা যেতে পারে, তার দুটি হলো-- "কবিতা, আমায় শিখিয়ে দিও শুধু/সহজভাবে গভীর কথা বলা।" আর ছন্দের ব্যাপারে একটি কথাই বলার-- বাংলা ছন্দের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে কবির অনায়াসে দক্ষতা, গোটা গ্রন্থটি তার প্রমান।
আমি শুরু করেছিলাম অতীত স্মৃতির পাহাড় প্রসঙ্গ দিয়ে যা সমকালীন সমতলের জীবনকে আত্তীকরণ এর মধ্য দিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের এক অসীম সমুদ্রের দিকে। আসলে রোমান্টিক রা বর্তমানের মধ্যে থেকেই বিচরণ করেন কল্পনার জগতে। আর কল্পনার অভিমুখ দুটি--পিছনের দিকে অতীত আর সামনের দিকে ভবিষ্যৎ। প্রবাহমানতার এই অনিবার্য সূত্রেই এসেছে ভবিষ্যতের প্রসঙ্গও।
একেবারে প্রথম পর্ব 'উজানী শব্দেরা' র শেষ কবিতা "রোগশয্যায়' এ তার একটু আভাস পাওয়া গেছে-- "চলেও যাব ভালোবেসেই--/চন্দন কাঠ, তুলসী মালা, ধূপকাঠি/আগুন জল--সব্বাইকে।/উজান, একমুঠো বেলফুল--/ভুলে যেও না যেন।"আর গ্রন্থের শেষ পর্ব 'আমার সঙ্গে আমি'তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা। জীবন্ তো আসলে নদীর মতোই প্রবাহমান! আর 'নদীর প্রথম ভালবাসার নাম পাহাড়'(নদীজন্ম)। পাহাড়ের পাথুরে বুকে দুরন্ত আবেগে চলা নদী ক্ষতবিক্ষত হয়ে স্থিতধী হয়ে আসে সমতলের জীবনে। তারপর একদিন মোহনার কাছে গিয়ে যখন কান্না পাবে, নদী অবশ্যই ফিরবে পাহাড়ের কাছে, 'মেঘ তার পরকীয়া রূপ'(নদীজন্ম)। সত্যিই তো তাই! সূর্যতাপে বাষ্পীভূত মেঘ ই তো ফিরবে আবার পাহাড়ে, আবার নদী, আবার পাহাড়! এইতো আসলে জীবনবৃত্ত!! কল্পনার কি চমৎকার বিজ্ঞানসম্মত রূপ! অথচ এ এক কল্পবৃত্ত। কল্প বৃত্তই তো! তাই গ্রন্থের শেষ কবিতার একেবারে শেষ লাইন দুটি-- "একটুকু আমার থাক তেপান্তরের রাত/জ্যোৎস্নায় ভেজা নাকছাবি।"
...........
© উৎপল মণ্ডল।
********
 জ্যোৎস্নায় ভেজা নাকছাবি/--রিমলি বিশ্বাস/জানুয়ারি, ২০২০/দাঁড়াবার জায়গা/150 টাকা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য