মেঘনা রায়


 বাংলাদেশের ডায়েরী  ####

কোনও অর্থ খুঁজে পাই নি ,আমার বারে বারে বাংলাদেশ দেখার গোপণ বাসনার | বাংলাদেশ আমার মায়ের জন্মস্থান | এই সফর কী আমার বিদেশ ভ্রমণ নাকি মানস ভ্রমণে মায়েরই স্বদেশে ফেরা ?? কোন কালে ছিন্নমূল হয়ে বসতির জন্যে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন |  " নিয়া যাবি আমারে একবার বাংলাদ্যেশে " জীবনের  শেষ আর্তি  মায়ের এক পরম চাওয়া | 

বরিশাল থেকে বগুড়ায়, ময়মনসিংহ থেকে মানিকগঞ্জ কোথায় না বোঝাতে চেষ্টা করেছি মন কে , যে এ আমার মায়ের শৈশব  ও যৌবনের কথার দেশ আর আমার স্বপ্ন বিলাস | মায়ের মুখে শোনা পদ্মার ইলিশের ঝোল ভাতের স্বাদ সন্দেহাতীত ভাবে স্বর্গীয় ছিল | গোয়ালন্দের স্টিমার ঘাট আজ ইতিহাসের পাতায় | তাও যেন দেখতে পাই সেই ঘাট থেকে  প্যাডেল স্টিমারে চড়ার  দৃশ্য | পিল পিল করে মানুষ চলেছে নতুন ভুখন্ডের খোঁজে |  আমি জন্মাই নি এ দেশে তাও কেন আমার শিরা ধমনী সব অদৃশ্য শিকড় হয়ে পা বাড়িয়েছিল বাংলাদেশের পলিতে | আমি নিশ্চিত দেখতে পাই কীর্তনখোলা নদীর পাড়, ময়মনসিংহ টাউনের মহাকালি পাঠশালার  (যা কি না এখন কলেজ হয়েছে) সবুজ মাঠের পথে এক মোটা বেনী দুলিয়ে চলেছে আমার স্কুল টিচার মা | আমি নির্ভুল ভাবে চিনে নিতে পারি শহরের শেষ প্রান্তের  কোনও রেইন ট্রি যা আসলে আমার মায়েরই বিষাদ বৃক্ষ | যে হয়তো সখ্যতার গুণে মাকে মনে করে আজও পাতা ঝরিয়ে চলে |

             ঢাকা বোধ হয় খুব চেনা এক মুখর শহর | কিন্তু আমি যখন তাকে দেখি , তখন ঢাকা ঘুমিয়ে ছিল |  ঢাকা শহরের উপকন্ঠে আমি আধো ঘুম চোখে নেমে ছিলাম গাবতলীতে ভোর রাতে | বাসের কনডাক্টার আমাকে বিদেশি বুঝে সতর্ক করে বলেছিলো আলো ফোটার আগে যেন  বাস স্ট্যান্ডের   ওয়েটিং রুমের বাইরে  না যাই | কারন অতীব সম্ভাবনা আছে হাইজ্যাকারে  ধরনের | আর বেবি হইতেও সাবধান ,অগো লগেই নাকি হাইজ্যাকার দের কনট্রাক্ট থাকে | বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমার পহেলা শব্দচয়ন _হাইজ্যাকার আর বেবি | প্রথমটিতে মালুম হয়েছিল ছিনতাইকারী গোছের ,কিন্তু বেবি? পরে রিক্সাওয়ালার থেকে জানলাম বেবি মানে অটো রিকশা |

   যাই হোক চঞ্চল আমি হাইজ্যাকার আর বেবির ভয়ে বসে থাকলেও  বেশী ক্ষন সময়ের সাথে আপোষ করতে পারলাম কৈ!!অগত্যা ভোরের আলো ফোটার আগেই বেড়িয়ে চায়ের দোকানের খোঁজ করতে লাগলাম | কোনও দোকানই  খোলেনি | কিন্তু বন্ধ এক দোকানের সামনে একটি মাত্র রিকশা থেকে জড়ানো কন্ঠস্বর স্বাগত জানালো _" যাইতেন নাকি? " আমি তড়িঘড়ি কাছে গিয়ে রিকশার মানুষটিকে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম হাইজ্যাকার কিনা বোঝার জন্য | মানুষটি আধবুড়ো, তার সরল সোজা  কোঁচকানো মুখমন্ডলে ভোরের আবছায়াতে হাই জ্যাকার সুলভ রেখা খুঁজে পাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব বলেই মনে হল | আমি বরং সরাসরি ওনাকে  জিজ্ঞেস করলাম হাইজ্যাকার দের সা়থে ওনার যোগসাজস আছে কিনা? দার্শনিক নির্লিপ্তি নিয়ে উনি উত্তর দিলেন__"না | " আমি পরে অনেক ভেবে়ও নিশ্চিত হতে পারিনি এ বিষয় যে ওনার রেগে না গিয়ে সংক্ষিপ্ত উত্তরের পেছনে স়ঠিক কারণ টি ঠিক  কী? প্রবল রসবোধ? না কি আমাদের মতো আনাড়িদের কাছে এই প্রশ্ন  শুনতে শুনতে  ওনাদের অভ্যেস হয়ে গেছে |

 ‎       যাই হোক কিছুটা জড়তা নিয়েই আমি পল্টন মোড়ে যাবার জন্য রিকশায় চড়ে বসলাম,কারন বাংলাদেশে আমি তখন আমি একটি মাত্র হোটেলের নাম জানি  প্রীতম হটেল  এবং সেটা পল্টন মোড়ে | পল্টনের মোড় পৌঁছোনোর আগেই আমি জানতে চাইলাম কোনও চায়ের দোকান খোলা পাওয়া যাবে কিনা? উনি নির্ভেজাল প্রত্যয়ের হাসি দিয়ে এক্কেবারে প্রীতম হোটেলের লাগোয়া  ফুটপাথে চায়ের দোকানের সামনে রিকশা টি ভেড়ালেন | যেখানে ইতিমধ্যে উনুনে আঁচ পড়ে গেছে | আমি ওনাকে আমার সাথে চা পানের আমন্ত্রন জানানোর আগেই দেখি উনি নিজে গিয়ে দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিয়েছেন এবং কোন  বিস্কুটটা সকালে খাওয়া উচিত তা নিয়ে নিবিড় এক মতামত দিচ্ছেন | আমি কিছু বলার আগেই এভাবে নিজের জন্য চায়ের অর্ডার দেওয়াটা আমার নাগরিক মনে একটু গ্রাম্য ঠেকল বটে,তবে আমাদের প্রভাতী চায়ের আড্ডাকে ব্যাহত করতে  পারল না | চা পানান্তে আমি ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম জিনিসপত্র নামাতে | গত রাতে ভাঙানো ডলার থেকে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে চায়ের দোকানি ছেলেটিকে কত হয়েছে জিজ্ঞেস  করতেই সে বলল__"উনি দিয়া দিসেন | " ফেরার জন্য রিকশা ঘুড়িয়ে নেওয়া ওনার দিকে তাকিয়ে আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠি __"কেন?" উনি অমলিন হাসি তে  কোঁচকানো মুখ ভরিয়ে বললেন__"নিজে তো খাইতামই ,আফনেরেও খাওয়াইলাম | আফনে বিদিশি মানুষ | দোয়া কইরেন আমার লাইগ্যা |" স্তম্ভিত আমি ;আমার নাগরিক গালে একটি গ্রাম্য থাপ্পর কষিয়ে আধবুড়ো বেশি ক়থা বলা মানুষটি রিকশার প্যাডেলে চাপ দিলেন | এই ছিলো আমার বাংলাদেশ সফরের প্রথম দিন, প্রথম প্রলেপ | 

 ‎          আমার এই ভ্রমণ কাহিনির  পাতায় গল্পের মাহাত্ম্য বা মহত্ব কোনোটাই হয়তো নেই | এর শুরু আছে শেষ নেই ,,বয়ে যাওয়া আছে পূর্বাপর কোনও ক্রম নেই ,| এ এক  জীবন ধরে শুধু যাওয়া আর ফিরে আসার ছিন্নপত্র —

 ‎       কিছুই খুঁজিনি আমি,পেয়েছি সীমারেখা 

 ‎       নীরব কান্নার ঘুম  কাঁটা তারে অবশেষে 

 ‎        দেখেছি যদিও আমি শবরী তিতাস 

 ‎      সেই গাঙচিল বা মধুকপী ঘাসে এক উঠোন 

 ‎        পদ্মাার জলে বা মেঘনার কালো  জলে 

 ‎                হয়েছিলো এক ইচ্ছের নাম ||

 ‎       

                     নবজলধরশ্যাম ??শব্দটা অনেক তলানি ঘেঁটে মনে আসছে;সেই নির্লজ্জ শ্যাম ঝরে পড়ছে কোথায় ? না আমার পূর্বজদের দেশের  ঘাটে,মাঠে ,বাটে; ,আমি তার সাক্ষ্মী হয়ে থাকছি | ময়মনসিংহ শহরের  ব্রাহ্মপল্লি | ছোট বেলার শোনা গল্পের স্রোতের সাথে বর্তমানে যা দেখছি তা মিলিয়ে নেবার পালা | এই ব্রাহ্মপল্লিতেই ছিলো আমার মায়ের বাড়ি  বারোদির নাগ | একান্ত প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাস  ছিলেন প্রতিবেশী  | ব্রাহ্মপল্লি মূলত ছিল রেল কলোনির অংশ বিশেষ | আজ তার পরিবর্তন পরিবর্ধন হয়ে অন্য সাজ | দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়ি দেখব, আমি এতটাই আত্মমগ্ন বিভোর যে সেই ছোটবেলার শোনা গল্পের ইমেজ গুলো যেন আজ আমার মায়ের  আঙ্গুল হয়ে মনের সমস্ত ক্ষতয় হাত বোলাচ্ছে | ,আমি  কি নিজেই মায়ের প্রতিরূপ হয়ে যাচ্ছি | শুনতে পাচ্ছি সেই কণ্ঠস্বরে,,

              "শ্রাবণ ঘন গহন মোহে  

              গোপণ তব চরণ ফেলে

              নিশার মত নীরব হয়ে 

              সবার দিঠি এড়ায় এলে "

 

        ময়মনসিংহ স্টেশনে ট্রেনে করে নেমেছি সিরাজ গঞ্জের ঘাটে,|  ঘাটের সংলগ্নেই সেই বিখ্যাত ,মন হু হু করা পদ্মা নদী | যাকে নিয়েই কিনা  কত  গল্প ,সিনেমা ,নির্মলেন্দুর গান এপার ওপার দুই বাংলাকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল |  পদ্মা নামের ঐতিহ্যের ভার যে কত শত বঙ্গনারীর নামের ভূষণ হয়েছে তার হিসেব কি এই নদী রেখেছে? এই পদ্মার ওপর দিয়েই গেছে তখনকার দিনের বিখ্যাত সারা ব্রিজ | যা হয়তো বর্তমানের  ভৌগোলিক আধারে অতীতের গৌরব হারিয়েছে | কিন্তু গৌরব কি হারায়? লক্ষ মানুষের  অগুনতি পায়ের স্পর্শ তাকে আরো বিপুল ভাবে ঐতিহাসিক  বানায় |

       সদর ঘাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্যাডেল স্টিমার ছাড়ে,এবং এতে চেপেই আমার  ভ্রমণ অভিলাষ | এই জনপ্রিয় প্যাডেল স্টিমার গুলির একটা পাকা পোক্ত ইতিহাস আছে | স্কটল্যান্ডের ডামবার্টনে বিশ্ববিখ্যাত জাহাজ নির্মাতা উইলিয়ম ডেনি এগুলি তৈরি করেছিলেন | সম্ভবত কোলকাতার গার্ডেনরিচের ওর্য়াকশপে এর অংশ গুলিকে জোড়া লাগানো হয় এবং সেখান থেকেই  স্টিমার গুলি নারায়নগঞ্জে এসেছিল | এই  স্টিমার গুলির বিশেষত্ব হল এর দু পাশে দুটি বেশ বড় আকারের চাকা থাকে | যা জল কাটে আবার স্টিমারের ভারসাম্যও ধরে রাখে | ইতিহাস প্রাচীন পুরোনো হয়ে যাওয়া জলযান গুলিই বাংলাদেশের দামাল নদীর বুকে সবথেকে নিরাপদ আশ্রয় |কাগজে,টিভিতে  বাংলাদেশের লঞ্চডুবির কথা শোনা গেলেও এই প্যাডেল স্টিমার ডুবির ঘটনা স্মরণে আসেনা | কারণ ১৯২৯ সালের পর থেকে কোনো প্যাডেল স্টিমার ডুবি হয় নি | ঝড়ে ঝাপটায় ,সাইক্লোনে প্যাডেল স্টিমার বুক

আগলে   যাত্রীদের পৌঁছে  দিয়েছে চাঁদপুর  ,পটুয়াখালি, বরিশাল বা খুলনায় | তাই জাহাজের পাটাতনে পা রেখে মনে হল ইতিহাসের পাটাতনেই বুঝি চড়ে বসলাম | এই  সব জাহাজের সিলেটি কুকের হাতে মুরগির ঝোল,আর কেতা দুরস্ত ডিনারের খ্যাতি তখনকার দিনে ইয়ুরোপ অবধি ছড়িয়েছিল | আজও লন্ডনের ব্রিকলেনে ইন্ডিয়ান কারির যে  জয়ধ্বজা উড়ছে তার ৮০ শতাংশই তো আসলে সিলেটি রান্নার ট্রাডিশন |

         আমার  জন্য কেবিন বুক করা ছিল,কিন্তু স্টিমার ছাড়ার পর দেখলাম আমার মন প্রাণ সবই শরীর ছেড়ে বসে আছে স্টিমারের খোলা ডেকে |তাকে চার দেয়ালের খুপরিতে  বন্ধ করি কী করে? ডিনার  শেষ করে চলে এলাম ডেকে ,জাহাজ তখন ডাঙা ছেড়ে  সবে সরতে শুরু করেছে | যাত্রীরা কেউ দ্রুত লয়ে বা কেউ ধামারে বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত | জীবন্ত নদীর আখ্যানে অনেকটা আকাশ সাথে থাকলো এলোমেলো কিছু বুনো গন্ধ যুক্ত অন্ধকারের  সবুজ | সদর ঘাটের কিনারায় চোখ রেখে  দেখি দাঁড়িয়ে রয়েছে বহু বছর আগেকার স্থিরচিত্রে লেপ্টে থাকা মোটা দুই বেনী নিয়ে ফ্রক পরা  এক মেয়ে আর তার ছোট ভাই | তারা হাত নাড়ছে আমায় | ঝাপসা হতে থাকলো  তাদের মুখ নিঃসৃত টা__টা |

         রাত ক্রমশ গভীর হতে  থাকে, নভো মন্ডলের মেঘে  বিসমিল্লার সানাই | সেই সানাই এর সুর কোন ঘুর পথে নিয়ে যাচ্ছে নিশির মতো |টানা কিছুক্ষন এসে স্টিমার টি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল | কানে আসলো চাঁদপুর | চাঁ_দ_পু_র একটি চিৎকার ছিট্কে আসে  অজান্তে | সংযত হই ,এ যে আমার ঠামার দেশ | কত গর্বকরে আমার বুড়ি ঠামা চাঁদপুরের গল্প শোনাত | পদ্মা আর মেঘনার সঙ্গমে এই চাঁদপুর যে  ভুবন বিখ্যাত তার ইলিশের ঝাঁকের জন্য | তাকিয়ে দেখি নদীর বুকে জনজোয়ার | চাঁদ পুরের রেল স্টেশনে ট্রেন আসবে  সেই রেল যাত্রীরা জাহাজে উঠলে তবেই  আবার জাহাজ রওনা দেবে পরবর্তী গন্তব্যে | ভোঁ আওয়াজ তুলে রেলগাড়ি আসলো __জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় সরগরম হয়ে উঠলো স্টিমার | হুড়মুড় করে লোক উঠলো ,ফেরিওয়ালাদের তীব্র আহ্বান ,ধাক্কাধাক্কি,গালাগালি,পুঁটুলি হারানোর আর্তনাদ,যুবকদের অকারন হল্লাহাসি,,চরম বুনো গন্ধ কে চেনাতে থাকলো আমায় | কোথায় গেল সেই সফিস্টিকেশন ,আস্তে মেপে কথা বলা,নিত্তি মেপে চলা ,? সরু ছাল ছাড়ানো জিন্সের পাশে গাছকোমোর করে  পরা শাড়ির দল আর খালি গায়ের ধুতির জীবনধারা আমার সব  হিসেব অগোছালো করে দিলো | অবশেষে  স্টিমার ভোঁ দিলো  ,কলরব স্তিমিত হয়ে তীর ঘুমিয়ে পড়ল ,নদীর বুক কিন্তু জেগে রইল | সামনের ডেকে একলা আমি আর আমার  অন্ধকারের সংলাপ |

         আমার ডেক চেয়ারের দু হাত তফাতে এসে বসলো এক সওয়ারি | তার কাঁধ  থেকে ঝুলে রয়েছে এক খানা খোল | "দ্যাখসেন রাত্তির খানা?" আগন্তুকের প্রথম প্রশ্নে আমি একটু দিশেহারা | কি করেন আপনি?বিনীত ভাবেই রাখলাম প্রশ্ন | তিনি আমার প্রশ্নের তোয়াক্কা না করেই সংলাপে চলে গেলেন | "এমন রাত্তিরে আকাশের ডানা ঝাপটানোর শব্দ শুনলেই ডাকি গোবিন্দ গোবিন্দ | এদেশে আমি যারে কয় রিফ্যুজি | বাড়ি ছিল কুমিল্লায় ,আমরা জাত বোষ্টম | আমার ঠাকুরদার ছিলেন বড় গাহক | ওই দিগরে তো বটেই নোয়াখালি,টাঙ্গাইল এমনকি বরিশাল পর্যন্ত তার নাম ডাক ছিল | শীতের রাতে মাঠে হ্যাজাকের আলোয় সেই সব শব্দ গানের আসরের কথা ক্যামনে জানবেন আফনেরা?"  তা আমি জানতে চাইলাম  "এই গোবিন্দ টি কে?" তিনি তখন খোল খানায় চাটি মেরে বোল তুলতে  তুলতে বলেন | " সারাদিন দাওয়ায় বসে দাদু বোল তুইলত্যেন | সেই খোলের বোলের  বাড়া কমায় বৃষ্টিও কমত বাড়ত | বিলম্বিত চাঁটির শব্দে মৈরা আসত বিকালের আলো | ছাড়া ছাড়া বোলে একটা দুইটা প্রদীপ জ্বলত | সেই থেকে আমি হেই  গোবিন্দের  সেবা করি | খোলটির নামই গোবিন্দ | আমার মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেল "গোবিন্দর বোল ঝড় আনতে পারে?ঝড় ? " আকাশের সামিয়ানায় আমি যে গৌতম ঘোষের সিনেমার মতো একটি  বোহেমিয়ান ঝড় দেখবো বলে বসে আছি | সেই বোষ্টম বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বললেন " আফনেরে তো রাত খানা দ্যাখোনের জন্যই  কইলাম | " নদীর বুকে তখন ছোট মাঝারি জেলে নৌকা খুদে ব্যাটারির আলো জ্বালিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে |বোষ্টোম আমকে সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়ে কোথায় নিদ্রার ব্যাবস্থা করতে গেলেন ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না | আশ্বিনের গুমসো আকাশের নীচে খোলা ডেকে আমিও  কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন  হয়েছিলাম | রাত ৩টে  নাগাদ একটা বেশ জোড়়ালো দমকা হাওয়ায় নদীর বুক দুলে উঠলো |হাওয়ার দাপটে যত না তার চেয়ে বেশি মাঝিদের উচ্চকিত আওয়াজে | মালুম পেলাম ঝড় আসছে প্রবল ভাবে | দূরের আকাশ একটা দমচাপা আওয়াজ করে ডেকে উঠলো|জেলে নৌকা গুলো দ্রুত  পাড়ের দিকে সরে যেতে লাগলো | আমার যে বৃহস্পতি তুঙ্গে | তার দুর্দান্ত নিদাঘ দহন করা দিগন্ত কে ভাঙুক,ঈশান কোণে হাঁটুমুড়ে বসে থাকা সে | তার  অপেক্ষায় প্রতীক্ষায় এ আমার পরম চাওয়ার এক পূর্নর্প্রাপ্তি | অবশেষে সে জল ও হাওয়ার শরীরে শরীর মিলিয়ে  ঝাপটা মারলো স্টিমারের ধাতব গায়ে | ১৯২৯ সালের প্যাডেল স্টিমার দুলে উঠলো বটে কিন্তু টাল খেলো না |আমি অনেকটা মন্ত্র মুগ্ধের মতো বসে রইলাম আসনে সেঁটে,একবারও আমার উঠে যাবার কথা মনে এলো না | আমার নামের সাথেই যে মেঘবৃষ্টি  আর নদীর গভীর সম্পর্ক | আমার হাতেরই ডানায়  জলবিন্দু মেখে,,জীবন্ত নদীর আখ্যানে এই ঝড় প্রাসঙ্গিক বৈ কি ! তাকে তো আমি গভীর ভাবে চাইছি |

         জলের ঝাপটায় আমার শরীর মুখ ভেসে যেতে লাগলো, বৃষ্টির গমকে আমি কেঁপে  কেঁপে উঠতে লাগলাম | বাংলাদেশের দামাল নদীর বুকে এ যে আমার বৃষ্টির সাথে সহবাস |  স্থির বিশ্বাস ছিল এই পূর্বপুরুষের ভিটে মাটির দেশের  এই ঝড়  আমার ক্ষতি করবে না কিছুতেই |  প্রিয় পাঠক বিশ্বাস করুন দিগন্তকালীন  এই ঝড়ের ল্যান্ডস্কেপে কোনো লোকালাইজ্ড আলোক সম্পাত করতে একটুও ইচ্ছে করছিলো না |; তা সত্ত্বেও শব্দ গুলো কেমন  নিষাদ কোমল সত্তা নিয়ে চুপিসাড়ে আশ্রয় নিচ্ছিলো মনের অন্তরের  উপত্যকায় |  কবেকার সেই ছিন্নমূল মানুষের  কোমল গান্ধার আজ ও যে বয়ে নিয়ে চলছি !! লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছে দানা বাঁধছেনা ন্যারেটিভ! আমায় মাপ করবেন পাঠক , ভিজে সেই রাতের কোলাজ থেকে স্বাধীন স্বতন্ত্র দৃশ্যরূপ  যথাযথ ভাবে কুড়িয়ে আনতে  আমি বোধহয় অপারগ!!সত্যি অপারগ | নাই বা পারলাম!!চোখ বুজে  অাজও অনুভব করি, দেখতে পাই বৃষ্টিতে কানায় কানায় ভরে উঠেছে বাংলাদেশের স্রোতোস্বিনীরা | তাদের প্রতি সমভ্রমে মাথা নুইয়ে আসে ,,আড়িয়ালখান ,বাজিতপুর,জাঙ্গালিয়া,গাবখান কী সব  নাম, শুনলেই মনে হয় দিল্লির বাদশাহকে অগ্রাহ্য করা দেশজ নৃপতির পরাক্রান্ত সেনাপতিরা সব বল্লম উচিয়ে পাহারা দিচ্ছে গোটা বাংলাদেশ কে !!

   এক সময় ঝড় থেমে গেল ,ছেড়ে গেল আমায় বিবশ করে | ভিজে গায়ে কেমন শীত শীত  মন খারাপ আমায় জড়িয়ে ধরল | ভোর হবার আগেই স্টিমার এসে কীর্তনখেলা নদীতে পড়ল | সারারাত পাড় ঘুমিয়ে ছিল,আর জেগে ছিল নদী | এবার নদী ঘুমিয়ে নিচ্ছ খানিক __পাড় জাগছে একটু একটু করে |

চলে যাই শুকনো পাতা ছাওয়া ঘাসে ,নদী থেকে নদীতে ধানসিড়ি ,সন্ধ্যা ,সুগন্ধা পরবাসে ,সেই  আনকোরা  দিনের মতো নবান্নের পাকা ধান আজ ও কি ওড়ে? জারুল আমলকী,হিজলেরই বন 

মিলায়ে যায়

 কাহার

 পিছু পিছু |

 

মন্তব্যসমূহ

  1. আশ্চর্য লেখা এযেন কোনো উপন‍্যাসের নান্দীমুখ,অসাধারণ গো,অসাধারণ।

    উত্তরমুছুন
  2. অদ্ভুত এক আখ্যান....তরল কবিতার চুমুক.... ঝিম ধরায়

    উত্তরমুছুন
  3. অদ্ভুত এক আখ্যান....তরল কবিতার চুমুক.... ঝিম ধরায়

    উত্তরমুছুন
  4. অসম্ভব ভাল লেগেছে। প্রতিবেশী দেশটিকে নিয়ে কোথাও তো একটা বিগত নাড়ির টান আছেই। তাকেই যেন উসকে দিলো এ লেখা। স্যালুট।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য