ড. তুষার কান্তি নাথ

 থামদাঁড়া থেকে রিয়াংখোলা তীরে ###

আপার সিটংয়ের থামদাঁড়া সামার ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে সুশান্ত দুরে, বহু নীচে ছোট্ট এক পাহাড়ি উপত্যকা দেখাল। রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ ও উচ্চ দৃশ্যমানতা সত্ত্বেও তা বিশেষ প্রকট হল না। কেবল সবুজের সমারোহ চিরে সরু ফিতের মত বয়ে চলা ধারা আর সূর্যকিরণে চকচক করা কোন এক কাঠামো ছাড়া। লোয়ার সিটংয়ের এক্কেবারে শেষ প্রান্তের ঐ অবরোহী অঞ্চলই হল যোগীঘাট, আমাদের আজকের ট্রেকিংয়ের গন্তব্য। থামদাঁড়া থেকে দূরত্ব প্রায় দশ কিলোমিটার।  

    

ফুলেল গুরাস তো হারানোরই জায়গা  

বাঁ দিকে খাঁড়া সবুজ পাহাড়, ডান দিকে ধাপে ধাপে নেমে গেছে জনপদ। জনপদ বলতে গুটি কতক কাঠের







বাড়ি, নিষ্পাপ পাহাড়ি মানুষজন, গুচ্ছ গুচ্ছ নয়নাভিরাম বুনোফুল আর অপার সৌন্দর্য্য। চওড়া পিচের রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি, পথ প্রদর্শক আকাশ লেপচাকে অনুসরণ করে। সেই শুরু থেকেই আমাদের পিছু নিয়েছে কালো রঙের এক অপরিচিত সারমেয়। দীর্ঘ পথ আমাদের সাথেই চলছে। দেখে মনে হচ্ছে আমাদের কত দিনের পোষ মানা। এ যেন পঞ্চ-পান্ডবদের স্বর্গারোহনের সঙ্গী বা ‘পান্ডব গোয়েন্দা’র পঞ্চু।   

উৎরাইয়ের এক একটা বাঁক ঘুরতেই নতুন প্রেক্ষাপট, নতুন ক্যানভাস, ঠিক যেন জীবনের মত। পথের ধারের বাড়িতে সুদৃশ্য ফুলের বাগান। নাইট কুইন, ডেইজি, সিম্বিডিয়াম, ক্র্যানবেরি জবা, সেলোগাইনি - কি নেই তাতে! আমরা মাঝে মাঝে প্রধান রাস্তা ছেড়ে পথ প্রদর্শকের নির্দেশে ঝোপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা পথে বা ধাপ চাষের আল পথে সর্টকাট ধরছি। সে এক অনাবিল আনন্দ। পাহাড়ি প্রকৃতিকে এভাবে আঁকড়ে পথ চলার মজাই আলাদা। ইতিমধ্যেই আমরা জঙ্গল থেকে কাষ্ঠদন্ড সংগ্রহ করেছি যা এই বন্ধুর পথ চলতে লাঠির মত ব্যবহার করছি। ক্রমে সিটং-টু এর প্রাথমিক স্কুলের সামনে এসে পৌঁছলাম। একটু বিশ্রাম ও প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সাময়িক যাত্রা বিরতি ঘটল। ফটকের সামনে এক পূর্ণ যৌবনা প্রস্ফুটিত ডোম্বিয়া গাছের নিচে পাথরের ওপর বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার পথ চলা শুরু হল। নেমে যাওয়া পাহাড়ি ঢালের মাকড়িশাল গাছে একজোড়া ভার্টিডার্ট ফ্লাইক্যাচার এর খুনসুটিতে চোখ আটকে গেল। লেন্স বন্দী করার আগেই ফুরুৎ করে হারিয়ে গেল গুরাসের ঝোপে। ফুলেল গুরাস তো হারানোরই জায়গা।     

কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা... 

ভারী ঘন্টার আওয়াজে পাশ ফিরতেই দেখি সামনে সিটং চার্চ। তখন প্রার্থনা চলছিল। আমরা ঢুকতেই এক সহৃদয় ব্যক্তি চেয়ার এগিয়ে দিল। মনোরম শান্তির পরিবেশে হাঁটার শ্রান্তি দুর করতে হয়তো একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছিলাম। বাইরে বেড়িয়ে দেখি আমরা দলছুট ও গাইডহীন হয়েছি। সুশান্ত একটা সর্টকাট পথ ধরল। কিন্তু কিছুটা


এগোতেই বুঝতে পারলাম আমরা পাহাড়ি ভুলভুলাইয়ায় আটকে গেছি। প্রায় জনমানবহীন জায়গা। পরিত্যাক্ত বাড়ির উঠান, বাগানের আলপথ, নেমে যাওয়া ঢালু পথ ধরে একটা তুলনামূলক বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। অনেকটা বিশ্বাস ফিরে পেতেই দেখি, কিছুটা গিয়েই রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। আর রাস্তার শেষ প্রান্তে দেবদূতের মত দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় এক যুবক। স্মরনাপন্ন হতেই সে সাগ্রহে আমাদের নিয়ে চলল, রীতিমত গাইডের ভূমিকায়। তবে মূল রাস্তা ধরে নয়। ঝোপঝাড়, শরবন পার হয়ে উৎরাই বাঁশ বাগানে এসে ঢুকলাম। অসমান পথের রেখা ধরে এগিয়ে চলা। প্রায়ই কঞ্চির খোঁচা খাচ্ছি। নামতে নামতে প্রায় সমতল এক জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলাম। লতাপাতা, গুল্ম ও বৃক্ষরাজির ক্যানপিতে আটকে পরেছে সূর্যালোক। পাশের চড়াই থেকে ঝরা নেমে এসেছে। ঝরার জলে সৃষ্ট ছোট নালা পেরোনোর জন্য রয়েছে আদ্যিকালের, শ্যাওলা জড়ানো, ছোট্টো লোহার ব্রিজ। এক আদি ভৌতিক পরিবেশ। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর জঙ্গলের ঘনত্ব কমতে লাগল। ব্যাবলার, ড্রঙ্গো, বারবেট ইত্যাদি হরেক রকম পাখীর কলকাকলি আর হিমেল বাতাসে, পদব্রজের ক্লান্তি লাঘব হতে লাগল। জঙ্গল শেষে সুবিস্তৃত ধাপ চাষের ক্ষেত্র। কপি, লেটুস, টমেটো প্রভৃতি নানা রকম সব্জির চাষ হয়েছে। কিছুটা চড়াই পেরিয়ে পিচের রাস্তায় উঠলাম। অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় জানালাম ঐ যুবককে, যে আমাদের পাহাড়ি চক্রবূহ্য থেকে উদ্ধার করল। তবে মনে মনে প্রার্থনা করলাম এভাবে হারিয়ে যাওয়ার মজাই আলাদা। কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...।  

রিয়াং ও যোগীঘাট  

একটা বাঁক ঘুরতেই দেখি আমাদের গাইড উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর ঠিক পিছনেই স্টিলের সুদীর্ঘ ব্রিজ, যা থামদাঁড়া থেকেও দৃশ্যমান হয়েছিল। নীচে তিরতির করে বয়ে চলেছে রিয়াং নদী। এটাই যোগীঘাট। কেন এরকম নামকরণ হল তার সঠিক কারন জানা না থাকলেও মনে করা হয় যে যোগী সন্নাসীরা একসময় রিয়াংখোলার এই ঘাটে স্নান করতে আসত। তার থেকেই এরূপ নামকরণ। গুটিকতক বাড়ি, দোকান, একমাত্র হোম স্টে, সবুজ বনানী আর বহমান রিয়াং - এই নিয়েই সুন্দরী যোগীঘাট। স্বেচ্ছা নির্বাসনের আদর্শ জায়গা।   

মংপু ও লোয়ার সিটংয়ের মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে রিয়াং নদী। একদিকে কার্শিয়াং পাহাড়, অন্যদিকে মংপু পাহাড়। একদিকে সিটংয়ের তুরুক খাসমহল, অন্যদিকে লাবদা ও মংপু। রিয়াংয়ের ওপর যোগীঘাটের এই ব্রিজ যুক্ত করেছে দুই অঞ্চলকে। নবনির্মিত এই ব্রিজ ২০১৫ সালে তৈরি, দৈর্ঘ্য ৭৪ মিটার এবং ৫ মিটার চওড়া। এখনও হাঁটা পথের পুরাতন পরিত্যাক্ত ঝুলন্ত সেতু রয়েছে। এই নদী তীরবর্তী উপত্যকার উচ্চতা খুব বেশি (২১৬৫ ফুট) না হওয়ায় শীতের সময়ও খুব ঠাণ্ডা হয় না, আবার গ্রীষ্মের সময়ও এখানে খুব গরম হয় না। যোগীঘাট অঞ্চলটি রিয়াং নদীর সাথে প্রায় একই সমতলে। অর্থাৎ অন্যান্য পাহাড়ি নদীর ন্যায় গভীর গিরিখাত রিয়াংয়ের নেই। তাই এর সৌন্দর্যের ধরনও স্বতন্ত্র। চারিদিকে সবুজ নগরাজির বিস্তৃত ঘেরাটোপ। মাঝখানে যোগীঘাট যেন তার রূপসী প্রেমিকা রিয়াংকে নিয়ে সহবস্থান করছে। নদীর জলধারার মাঝে মাঝেই বিভিন্ন আকার ও আয়তনের উপলখন্ড। নদী বক্ষের মাঝে অবস্থিত প্রস্তর খন্ডের ওপর দিয়ে হাঁটা যায় অনায়াসে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। 

এবং অন্যান্য 

যোগীঘাটকে কেন্দ্র করে এক লপ্তে ঘুরে নেওয়া যায় লাটপাঞ্চার, অহলদাঁড়া, নামথিং পোখরি, থামদাঁড়া, সিটং ও মংপু। সিটংয়ের কমলালেবু, লাটপাঞ্চারের রুফাস নেকড্ হর্নবিল, অহলদাঁড়ার ৩৬০ ডিগ্রি প্যানোরমিক ভিউ, থামদাঁড়ার চায়ের বাগান, মংপুর সিঙ্কোনা কাল্টিভেশন, নামথিং পোখরির হিমালয়ান স্যালামান্ডার আপনাকে অভিভূত করবে। 

বেলা পড়ে আসছে। পাহাড়ি জঙ্গলে আলো-ছায়ার লুকোচুরি খেলা। পড়ন্ত সূর্যের কমলা রং শরবন, টাইগার গ্রাস পেরিয়ে রিয়াংয়ের জলে গুলে গেছে। রঙিন রিয়াং তখন আরও অপরূপা, আরও আবেদনময়ী। সুউচ্চ সবুজ পাহাড়, রক্তিম রিয়াংখোলা আর পাখির বিচিত্র কলকাকলিতে সমগ্র যোগীঘাট তখন মাতোয়ারা। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ আমিত্বকে রিয়াংয়ের জলে ছুড়ে ফেলে দিতে দিতে, মনে মনে ভাবলাম এ স্বেচ্ছা নির্বাসন যদি শেষ না হত!


 

মন্তব্যসমূহ

  1. জানুয়ারিতে সিটং যাচ্ছি আপনার এই লেখা ভীষণ ভাবে গাইড করবে।রিয়াং এর প্রেমে আগেই মজে আছি।তবে যোগীঘাট সম্পর্কে জেনে ভালো লাগলো।শুভেচ্ছা নেবেন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য