সোমা কুশারী
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আর মাত্র ছ'জন! বুলেটের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে!
দৌড়ছি আমি প্রাণপনে দৌড়ছি। ইশ! মুখোশে ঢাকা ঐ লম্বা মতন লোকটা বড় মামা না? হ্যা! ওটা ঠিক বড় মামা! লোকটার মুন্ডুটা ফুড়ে দেব বুলেটে... ছিটকে বেরোবে রক্ত... ঘিলুটা ছেতড়ে পড়ে থাকবে মাটিতে!
ঐ লোকটা নির্ঘাত অয়ন স্যার! বলে কিনা এইচ এসে লাড্ডু পাবো! ইডিয়ট কোথাকার! শালা দৌড়চ্ছে দেখ... টের পেয়েছে শুভায়নের হাতে রাইফেল এখুনি বুলেটের ধাতব গুলি ওর বুক ছ্যাঁদা করে দেবে। হা হা হা...
স্বস্তিকার মাও আছে এই ছ'জনের দলে। কেমিস্ট্রির রবিনস্যারের ব্যাচে নজরদারি করে মহিলা! মেয়েকে আড়াল করতে চায়। মেয়ে যেন ' দুধ পিতি বাচ্ছি'। শালা! কতদিন স্বস্তিকাকে হামি খায়নি শুভায়ন। ঐ ঐ তো এঁকেবেঁকে দৌড়চ্ছে স্বস্তিকার মা শার্প সুটার শুভায়নকে চকমা? ঠিক কানের পাশে লেগেছে গুলিটা ছট্ফট্ করছে মহিলা! আহ্! কী আরাম! স্বস্তিকা শুধু শুভায়নের।শালি! কুত্তি! মরলি তো সেই গুলিতে।
চোখ দুটো জ্বালা করছে শুভায়নের। কটা বাজে এখন? দশটা নাকি এগারোটা? দম্ দম্ করে দরজা পিটোচ্ছে মা! খেতে ডাকছে বোধহয়।উফ্! এরা যে কেন শান্তিতে খেলতে দেয় না!
-শুভ! শুভ! কী করছিস দরজা বন্ধ করে? খোল দরজা খোল!
রাগে মাথার মধ্যে দুশোটা ভিসুভিয়স জ্বলছে। রোজ রাতে ঐ অফিস ফেরত লোকটার সামনে বসে ডাল রুটি চিবোতে হয়... কালো বেঁটে ডালহৌসি পাড়ার সরকারী কেরানী ঐ শুভঙ্কর রায়কে দেখলেই আজকাল মটকা গরম হয়ে যায়! ভাবে কী লোকটা নিজেকে? শাহেনশাহ? একমাত্র ছেলে পড়ে শুনে তোপদার হবে? এত এত টাকা কামাবে? এই ভেবেই তো ফুটোমাদাড়ে এই লোকটা নামকরা কনভেন্টে ছেলেকে ভর্তি করেছে! অথচ, পকেটে মাসের শেষে একটা আধলা পয়সা পড়ে থাকে না লোকটার! শখ কত! ঐ স্কুলের ফিস আর টিউটর এর টাকা দিতেই তো সব ফৌত! কবে থেকে একটা মোবাইল চাইছি... রোজই বাহানা মারছে। আজকাল তো আবার গাজর ঝোলাতে শিখেছে বোর্ডের এক্সামে নাইনটি পার্সেন্ট পেলেই নাকি লেটেস্ট মডেলের মোবাইল বাঁধা! নেকুপুষু পেয়েছে আমাকে! নাইনটি পার্সেন্ট! হু!
লুঙ্গি আর দাদুর যুগের হাফহাতা বনিয়ান পড়ে লোকটা একমনে খাচ্ছে। বাঁহাতে গেমটা চালু রেখে ডানহাতে রুটি ছিঁড়ছি ...সেই এক মেনু। ট্যালট্যালে একটা ডাল আর ঢ্যাড়সের তরকারি! শালা! মুখ পচে গেল। শুভায়ন রায়ের কপালটাই যাচ্ছেতাই! সেন্ট জনসনের কোনো ছেলে ভেবেছে এই দিয়ে ডিনার খাবে? আমি খাই... খেতে হয়! শুধু এই দুঃখে ইলেভেনে উঠে বাড়ি থেকে লাঞ্চ নেওয়া বন্ধ করেছি... অঙ্কিত রাহুল প্রিয়াংশুরা যা বুলি করত! করবে না? সেই ক্লাস ওয়ান টু টেন শুভায়ন কী খায়?না ব্রেড জ্যাম এগ এগ জ্যাম ব্রেড! আর তা না হলে তেল চপচপে লুচি আর আলুচচ্চড়ি... ডিসগাস্টিং।
ডালের বাটিতে রুটির টুকরোটা চুবিয়ে মুখে ভরে পাঁচনম্বর লোকটাকে ঠাই করে গুলি চালালাম... ইশ্! ফস্কে গেল! যা শালা! কত সময় লাগছে রে... আর শুধু দুটো লোক বাকি এদুটোকে নিকেশ করতে পারলেই...
সামনের বাবা লোকটা কিছু জিজ্ঞেস করছে কী? কী বলছে লোকটা? শুনতে পাচ্ছি না মোটে। পাঁচ আর ছয় দৌড়চ্ছে এঁকেবেঁকে সমুদ্রের ধার ধরে নীল নীল জল আছড়ে পড়ছে তটে, কী স্বচ্ছ জল দেখলেই বুকের ভেতর একটা তীব্র টান তৈরী হয়... কোথায় এমন ঝকঝকে সমুদ্র আছে? লিসবনে? পাটায়ায়? নাকি থাইল্যান্ডে? ... আমার দৌড় অবশ্য ঐ দীঘা আর পুরী। বাপ লোকটা কোনোদিন ওর বেশী ভাবতেই পারবে না! আর ঐ মহিলা? দিনরাত শুধু কানের কাছে বুকনি ঝাড়ে...
-ভালো করে পড় শুভ খুব মন দিয়ে পড়। দেখবি কত টাকা হবে তোর... যা যা চাস সব পাবি!
এসব শুনলেই রাগে দুঃখে মনটা তিতকুটে মেরে যায়।সবই যদি নিজেই করব তো তোমরা আছো কি করতে? ঐ ডাল রুটি আর চারাপোনার ঝোল খাইয়ে মারার জন্য? যত্তসব মিডিল ক্লাস সেন্টু !
ক্লাসে ত্রিদিব আর আমিই এমন ম্যাদামারা ফ্যামিলির প্রোডাক্ট, সৈকত আর্য প্রমিতা সেলিম কী সব হাইফাই ক্লাস! বাড়ি গাড়ি টাকা! কী নেই ওদের? আমার বাপ মা সেসব জাস্ট ভাবতেই পারবে না! এই যে মাস গেলে একটা টিন এজ ছেলেকে মোটাটাকা পকেট মানি দিতে হয় মাসে একবার দুবার পিৎজা পার্টি ফার্টি হয় তাতেও খরচা আছে আবার ফ্রেন্ডসদের সাথে হ্যাং আউটের জন্যেও কিছু রেস্ত লাগে জানে আমার বাপ মা? নেট রিচার্জ করতেই তো কতগুলো টাকা লাগে! আর এই গেমটা? এটার জন্যে টু জিবি সাফিসিয়েন্ট? একদম না! তবু দেখ টাকা চাইতে গেলেই ভ্যাদামাছের মতো মুখ করবে যেন টাকা দিয়ে আমার ফরটিন জেনারেশনকে উদ্ধার করছে!
ঢ্যাড়স ব্যাপারটা যে কি অখাদ্য কাকে বোঝাব? বেছে বেছে পাতের পাশে ফেলে রাখতে হচ্ছে। মা দুবার একটু গাইগুঁই করলেও একদম পাত্তা দিলাম না। কী না সব্জি খা বাবু! সেই এক বস্তাপচা ডায়লগ! জাস্ট দুটো রুটি আলু খুঁটে গিলে নিয়ে হাত ফাত ধুয়ে গেমটা শেষ করব।
আজ বড্ড টাইম লেগে যাচ্ছে এতক্ষণ একটা গেম জিততে আগে কখনো লাগেনি। আসলে যত লেভেল পেরোচ্ছি গেমটা হার্ড হয়ে যাচ্ছে অভিরূপ অবশ্য বলছিল সেদিন এরপর নাকি গোটা দিনেও একটা গেম ফিনিশ করা যাবে না! এত হার্ড হবে ব্যাপারটা... ঐ মাত্র টু জিবিতে সারাদিন... বেশ টেনসটড লাগছে।
-বায়েলোজি ম্যাম এর টাকাটা দিয়েছিস তো?
বেঁটে লোকটা জিজ্ঞেস করছে।
ঝুপ করে মাথা নাড়ি। চট্ করে মাথায় খেলে যায় আরে! টাকাটা তো নেটপ্যাক ভরে খরচ হয়ে গেছে। দেওয়া হয়নি তো! ম্যাম কী ফোন করেছিল? লোকটা তো কোনোদিন টাকার কথা জিজ্ঞেস করে না। তবে আজ? মৈণাকরা ঠিকই বলে বায়োলজি ম্যামের ক্যারেক্টার ঠিক না! একটা বাচ্ছা ছেলে একমাস টাকা দেয়নি তাতে নালিশ করার কী দরকার? মালটা হেব্বি চুগলখোর!
দুটো রুটির তিনটে টুকরো ফেলে বেসিনে কোনোরকমে হাত ধুয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিই এতক্ষণে শান্তি! গেমটা শেষ করা যাবে নিশ্চিন্তে।
আরে! মোবাইলটা এত গরম হয়ে গেছে কেন? যা! হাং করে গেল নাকি? লাস্ট একটা টার্গেট সুট করা বাকি ছিল! কী হবে? হেরে যাবো আমি? জেতা হবে না আমার? মাথার শিরাগুলো কেমন দপদপ করছে ছিঁড়ে যাবে যেন এইবার!কী হবে এবার? গেমটা লুজ করব? কত দিন... কতদিন ধরে একটা নতুন সেট চাইছি... কিছুতেই দিচ্ছে না ওরা... চোখদুটো জ্বলে যাচ্ছে আমার! উফ! ঠিক আজই সেটটা বিগড়ালো... মাকে ডাকবো? কটা বাজে এখন? এখুনি আমার নতুন সেট চাই দামী একটা সেট!
-কী বলছিস কী শুভ? পয়ত্রিশ হাজারের সেট চাইলেই হলো? কোথায় পাবে বাবা?
-দেবে কিনা বলো? আজই আমার সেট চাই! নতুন সেট!
-অসম্ভব ব্যাপার! বাবা কিছুতেই পারবে না ! এই ফোনটাই সারিয়ে নে!
-সারাতে দেব? আর ততদিন? গেম ছাড়া থাকব? আর ইউ ম্যাড?
-সামনে তোর টেস্ট! কদিন পরে বারোক্লাস... এখন কী গেম খেলার সময়?
-এক্মামের চিন্তা তোমাকে করতে হবে না আমার ফোন চাই নতুন ফোন! দেবে কিনা বলো?
বাবা লোকটা যে এমন ঘেঁতো আগে বুঝতে পারিনি। অফিসে যাওয়ার আগে চানটান করে চুল আঁচড়ে জামা গলাচ্ছে দেখে নতুন ফোন চাইতেই ঠান্ডা গলায় বলল বোর্ড এক্মামের আগে ফোন পাওয়া যাবে না! খারাপ সেটটা সারাবার পয়সাও দিতে পারবে না! মা, অবশ্য হাজারটা টাকা দিয়ে ফোনটা সারিয়ে নিতে বলল লোকটা তাতেও রাজী নয়। কী করব আমি? গেম ছাড়া কী করে বাঁচব? ভেতরে ভেতরে কেমন একটা হাঁফ ধরে যাচ্ছে একটা চাপা কষ্টে বুকটা ফেটে যাবার আগে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ত্রিদিবকে সবটা বলতে হবে...
ত্রিদিব একটা দারুণ আইডিয়া দিলো কিন্তু একটু রিস্ক আছে... অবশ্য আমি হেল্পলেস এছাড়া আর কোনো উপায় নেই... আজ রাতেই প্লানটা এক্সিকিউট করতে হবে।
আলমারির চাবিটা মায়ের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারেই থাকে আর বড় আলমারির ছোট্ট খোপে মায়ের সোনার চেন আংটি আর কী কী যেন...
আহ্! চুলের মুঠি ধরে ঝাকাচ্ছে ডিউটি অফিসার... বাবার মুখটা পাথরের মতো... মা যে কেন কাঁদছে! ছোটো পিসি আর বড়মামাও এসেছে দেখছি...
মা লক্ষ্মী জুয়েলার্সের কাকুটা-ই কী পুলিশে খবর দিল? তবে যে হারটা নিয়ে মেপে টেপে আমাকে পঁচিশ হাজার টাকা দিলো?নাকি ত্রিদিব সব বলে দিল? ওর ও তো কবে থেকে একটা নতুন সেটের শখ... ওকে নিয়েই তো জিও স্টোরে ঢুকেছিলাম...
-আর ফোন কিনবি? অ্যাঁ? মার গয়না চুরি করে ফোন কিনবি? বজ্জাত!
-গেমের চক্কর সব স্যার... এই অনলাইন গেমগুলোই এদের শেষ করবে!
কনস্টেবলটা একটানা জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছে।বাপ মার সামনে ডিউটি অফিসারটা আমাকে মারছে দেখেও এরা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে ভাবা যায়? আর বড় মামা? কী বলছে ওটা?
কাল রাত থেকে গভর্মেন্ট গেমটা বন্ধ করে দিয়েছে? ভারতে আর কোথাও খেলা যাবে আর ? কেন? কী কারণে?
আমি যে গেমটা খেলব বলেই মায়ের হারটা চুরি করেছিলাম.... আমার যে ঐ লাস্ট লোকটাকে সুট করা বাকি... ওই... ওই... লোকটা রোজ আমার সামনে লুঙ্গি পড়ে বসে ঘাড়ে পাউডার ছড়িয়ে রুটি আর ডাল খায়... ঐ লোকটা... ঐ লোকটাকে আমি...
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ভালো লাগল সোমা।
উত্তরমুছুনখুব কষ্ট হলো কেন যে এমন হয়ে যাচ্ছে...ভালো লাগা সোমাদি
উত্তরমুছুনভাল লাগল।
উত্তরমুছুন