অদিতি ঘোষদস্তিদার


বিয়ের তারিখ #####

পিঁয়াজ ফোড়নের ডাল খেতে বড্ড ভালোবাসে লোকটা। 

লোকটা হল গোবিন্দ। বাসন্তীর ঘরের লোক।

চিরকালই তার চাহিদা কম। পান্তায় জল ঢেলে গোটা পিঁয়াজ দু' আধখানা করে দিলেই একগাল হাসি।

বরং বাসন্তীরই একটু আশঁটে গন্ধ পাতে না থাকলে গলা দিয়ে ভাত নামে না যেন। 

চুনোমাছের চচ্চড়ি বা হাঁসের ডিমের কষার বেশিটাই অবশ্য আসে বাসন্তীর পাতে।  বেড়ে গুছিয়ে দিলেও এক খাবলা মাছ বা ডিমের কুসুমটা টুক করে  থালায় ফেলে  গোবিন্দ। 

"ওমা! এতোটা দিলে ক্যানো? আচে তো আমার!"

"দেকলুম কেমন জুলজুল করে চেয়ে আচিস বেড়ালের মতন। খা, তুই কেমন চোখ আধবুজে আঙুল চেটে চেটে খাস, আমার দেকে মনে বড় শান্তি!"

সত্যিই শান্তির সংসার বাসন্তীর। গোবিন্দর বিড়ি সিগ্রেটের পর্যন্ত নেশা নেই। কাজের মানুষ।  সারাদিন কিছু না কিছু করছেই।

নিজের ছোট একটা ব্যবসা। সেটা চালিয়েও পালা পার্বণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হরেকরকম জিনিস তৈরী করে । 

কলসি বা সরার গায়ে আলপনা, সোলার ফুল, ঘুড়ির সময় ঘুড়ি আর কালীপুজোর বাজি। 

বাজি বানানো গোবিন্দের বড় আদরের কাজ। তারাবাজি, তুবড়ি, চরকি, দোদোমা আরো কত কী । জুটিয়ে নেয় গ্রামের আর পাঁচটা ছেলে মেয়েকেও। 

বেশ দু’পয়সা আসে তখন গোবিন্দের হাতে। 

কালীপুজোর পর একটা বড় করে ফিষ্টি হয়। মাংস ভাত খায় সব্বাই মিলে। 

আর তারপরই অঘ্রাণে তাদের বিয়ের তারিখ আসে। কার্তিক পুজোর দু'দিন পর।  

বাজি বেচার বাড়তি পয়সা জমিয়ে গোবিন্দ বৌকে দেয়  নাকছাবি, রুপোর মল, আবার কোনবার বাহারে দামি শাড়ি। 

পাড়ার লোকেরা এ নিয়ে মশকরাও করে! বাসন্তী তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে।

তবে বাসন্তীও আজকাল দেয় বরকে বিয়ের তারিখে কিছু কিছু।  আগে জানত না, মেয়েটা বড় হতে শিখিয়েছে। 

"তুমিও বাবাকে কিছু দাও, এটা তো দুজনের বিয়ের তারিখ। তাই না? শুধু নেবে?"

বড় বড় চোখে বাসন্তী হাঁ করে তাকিয়ে থেকেছে মেয়ের দিকে। তারপর বুঝেছে ব্যাপারটা। 

বাসন্তীও খাটিয়ে মেয়ে। 

বাড়িতে পুষেছে হাঁসমুরগী।  বড়ি দেয়, আচার বানায়। আজকাল  বাড়ির তৈরী বড়ি, আচারের খুব কদর শহরে। যে মাসিরা  শহরের বাজারে শাকপাতা বেচতে যায় তাদের দেয়। ডিমও বেচে।  বেশ দু’পয়সা হাতে আসে।  গত বছর গোবিন্দকে একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছে বাসন্তী। 

এবছর সব তছনছ। কি এক মরণ রোগ এসে সব বন্ধ করে দিল। রোগ এদিকে তেমন ছড়ায়নি, কিন্তু গোবিন্দের ব্যবসা প্রায় চলেই না। এলাকায় কারোরই প্রায় কাজ নেই। ট্ট্রেন বন্ধ ছিল এতদিন। সবে চালু হল. কিন্তু হয়ে লাভ? কাজই তো নেই। বাড়তি কাজেও মন্দ। ঘুড়ি ওড়ান হলো না, পুজোর সোলার কাজের বায়না এলো না, শেষ আশা ছিল বাজি!  সেই আশাতেও ছাই পড়লো। 


সংসার চালানোই কঠিন। যা দু’পয়সা জমান ছিল, মেয়েকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিতে হলো, কলেজ বন্ধ। পড়াশোনা করে কী ভাবে মেয়েটা! তাও একটু দূরে একটি বন্ধুর কাছে মাঝে মাঝে যায়, সব কিছু তো ফোনে করা যায় না, বন্ধুর ল্যাপটপে কিছু কাজ করে। 

বাজার আগুন। কোনমতে দুটি ডালভাতের জোগাড় করা  হয়ে উঠেছে প্রায় অসম্ভব। সবজি মাছ যে কতদিন চোখে দেখেনি। পিঁয়াজের দামও  আকাশ ছোঁয়া।  লোকে নাকি  মজা করে বলছে বিয়েতে সোনা না দিয়ে পিঁয়াজ দিতে, মেয়ে এসব গল্প করে।

 ঘরের হাঁস মুরগির ডিম্ সেদ্ধ করে মেয়েটার পাতে একটু দেয় বাসন্তী। বাকিগুলো বেচে যা দু'চারপয়সা আসে তাতে চাল ডাল কেনা কোনোমতে। সেও কতদিন হবে জানা নেই। হাঁস মুরগিকে খাবার তো দিতে হবে! পুকুরের গেঁড়ি গুগলি তো মানুষ খেয়েই শেষ করে দিচ্ছে। 

আজ বাসন্তী গোবিন্দের বিয়ের তারিখ। মনটা খারাপ হয়ে আছে।

আজকের দিনে বৌটাকে কিচ্ছু দেওয়া হলো না।  অন্যান্য বছর এই দিনে গোবিন্দ বাড়ি থাকে। মেয়েটা কত আহ্লাদ করে, মা'কে সাজায়। বাসন্তী কত ভালমন্দ রাঁধে। 

এবছর হাতে একটা পয়সা নেই।  ব্যবসার হালও তথৈবচ। যেটুকু টাকা ছিল তা দিয়ে মেয়ের নেটকার্ড ভরেছে সকালে। ও ছাড়া তো পড়াশোনার উপায় নেই। 

কিন্তু খাওয়াদাওয়া কি হবে কে জানে! দু’টি চাল ডাল ছাড়া ঘরে কিচ্ছুটি নেই। 

অনেকটা টাকা বাজির সরঞ্জাম  কিনতে খরচ হয়ে গেছে এ বছর। ভাবতেই পারেনি  এইভাবে লস খাবে।

কোনদিকে কিছু কূল  কিনারা করতে পারেনা, তাই মেজাজটাও খিঁচড়ে থাকে সারাক্ষণ।  

উঠোনে বসে একমনে নারকেলের পাতার শুকনো আগাগুলো ছোটছোট করে কাটছিলো গোবিন্দ, কাঠের উনুনের জন্যে। গ্যাস বুক করেনি গত তিনমাস।  কেরোসিন খরচ যেটুকু  বাঁচানো যায়!

হঠাৎ একটা আওয়াজে পিছনে তাকিয়ে হাতে কাটারি নিয়েই চমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।  

"এ কি করছিস! কেন করছিস! রাখ রাখ!"

"ফেলে দেব, সব ফেলে দেব। শুদু শুদু ঘর বোঝাই! বলেছিলুম অত কিচু কিনোনা।  বাজার ভালো নয়. কানে গেলো সে কতা!"

"আরে এমনি দিন তো থাকবে না চেরটে কাল! সামনির বচরে দেকবি কত্ত লাভ হবে!"

"কচু হবে! হাইকোটে অডার দেছে, মেয়ে বলেচে। সামনির বচর কেন, তারপরির, তারপরির কোনো বচরই হবে না!"

কথা বলতে বলতেই বাজির মালমশলাগুলো উঠোনে ছুঁড়তে থাকে বাসন্তী। 

গোবিন্দর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। 

"তবে রে হারামজাদি!''

কাটারি হাতে মারমূর্তি স্বামীকে দেখে একমিনিট থমকে গেল বাসন্তী। 

"মেরি ফেলো। একদম মেরি ফেলো! আর হ্যাঁ, আমার চিতেয় এগুলো দে দিও..."

বলে কাঁদতে কাঁদতে পেছনের বাগানের দিকে ছুটে  চলে যায় বাসন্তী।

ততক্ষণে হাতের কাটারি ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে বসে পড়েছে গোবিন্দ। 

মেয়েটা চিৎকার শুনে দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়েছিল। এমন সে কখনো দেখেনি। 

তবে বড় হচ্ছে, বুঝেছে সবই। 

"বাবা, শান্ত হও! যাও একটু বাইরে থেকে ঘুরে এস! আমি মা'কে সামলাচ্ছি। চিন্তা কোরো না।"


   

ভারী মন নিয়ে  বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোবিন্দ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আজকের দিনে এমনটা হলো! আবার একবার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো অভিমানে। বাসন্তী কি জানে না ওই জিনিসগুলো গোবিন্দর কাছে কতটা?

মুখুজ্যে মাসিমা দাঁড়িয়ে ছিলেন ওদের গেটের মুখে। এনাদের অবস্থা বেশ ভাল। দু'ছেলেই কলকাতায় ভালো চাকরি করে। 

"ও গোবিন্দ! তোমার হাত খালি আছে বাবা! পেছনের বাগানটা একটু পরিষ্কার করে কুপিয়ে দেবে?  ঠান্ডা পড়ছে, একটু তরকারির বাগান করতুম!"

ভালো করে  জমি কুপিয়ে চমৎকার করে মাচা বানিয়ে দিল গোবিন্দ। মাসিমা খুশি হয়ে উপরি আরো পঁচিশ টাকা দিলেন। 

সন্ধ্যের মুখে বাড়ি ঢুকল গোবিন্দ। বুক ঢিপঢিপ। 

কিছুই যেন হয়নি এমনভাব করে গোবিন্দ চেঁচাল,

"বাসন্তী, বাসন্তী শিগগিরি আয়, মাচ এনিচি , তেল ও . ."

সাড়া মিলল না।  তবে আওয়াজ শুনে বুঝলো বাসন্তী রান্নাঘরে। মাছের ব্যাগটা রেখে এলো সেখানে চুপচাপ। 

সারাদিন আজ মাটি  ঘাঁটা  হয়েছে।  ভালো করে চান করে এসে রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসল গোবিন্দ। মেয়ে গেছে বন্ধুর বাড়ি পড়া দেখতে।  

বাসন্তী তখন মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে কড়াইয়ে ছাড়ছে। 

ভয়ে ভয়ে দু'চারবার ঢোঁক গিলে গোবিন্দ কথা শুরু করলো। 

"আজগের দিনি তকে কিচ্ছু দিতি পারলুমনি। তাই একটুক মাচ আনলুম। কি দাম! মাচ আর তেলেই সব পয়সা শেষ!"

খানিকক্ষণ চুপচাপ। 

হঠাৎ গোবিন্দের কানে চেনা আহ্লাদী সুর। 

"আমি কিন্তু তোমার জন্যি গিপ্ট রেকিচি.."

কেমন যেন আলো আলো  মুখ করে বাসন্তী কোণে রাখা ঠোঙা থেকে থেকে বের করে দেখায় দুটি পেঁয়াজ। 

"পেঁজ? কোত্থেকে পেলি রে? পয়সা পেলি কোতায়?"

"বলব কেন? আমি কি তমাকে শুধিইচি কিচু মাচ নিয়ে?'

ঝিরিঝিরি করে আধখানা পিঁয়াজ কেটে ডালে ফোড়ন দিল বাসন্তী। একটা পিঁয়াজ আর ক'টা  লঙ্কা শিলে বেটে  মাছ রাঁধল। বাকি আধখানা দিয়ে হাঁসের ডিম্ ভাজা। 

রান্নার সুবাসে বাতাস ভরে উঠলো।

"অ বাসন্তী, যা বাস বেইরেচে না, নাকে যেন ঝাপটা এলো বৌভাতের ভিয়েনের, আজ আমাদের ফুলশয্যে কি বল!"

গোবিন্দ তাকাল ভরা চোখে বাসন্তীর দিকে। ছ'মাসের অভাবে বাসন্তীর সেই ঢলঢলে শরীর ভেঙে গেছে অনেকটাই। চোয়াল বেরিয়ে এসেছে। গাল বসে গেছে। 

 "মরণ! জামাই আসার সময় হল তবু শক দ্যাকো!"

কাছে ঘেঁষটে এলো বাসন্তী। ফ্যাকাশে মুখে হাজার সূর্যের আলো।

 

মন্তব্যসমূহ

  1. এমন আদর মাখা গল্প তো ভালো লাগবেই

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসার রুপ ও রসে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে গল্প।

    উত্তরমুছুন
  3. ভালোবাসার রুপ ও রসে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে গল্পটি

    উত্তরমুছুন
  4. My biased opinion. পাকা হাতের গল্প।

    উত্তরমুছুন
  5. অদিতি ঘোষদস্তিদার২৭ ডিসেম্বর, ২০২০ এ ২:৫৫ AM

    মন ভরে গেল

    উত্তরমুছুন
  6. বাহ্ খুব সুন্দর ভালবাসার গল্প

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য