রিমলী বিশ্বাস
ফোবিয়া *****
-------------
হেমন্ত
এসে গেছে বেশকিছু দিন, গভীর ভাবে ভাবলে বেশকিছু কাল! হিম হিম ছায়াচ্ছন্ন
হয়ে আছি সেই কবে থেকেই, আমি এবং আমরা। মাঝে মাঝে বড্ড ভয় করে, কোথায় যেন
আটকা পরে আছি, পালাবার পথ নেই, চারিদিকে শ্বাসকষ্ট, অন্ধকারে! একেই না
ক্লাসট্রোফোবিয়া বলে!
আমি
টের পাই কিভাবে দিনদিন একা হয়ে যাচ্ছি! তুমিও পাও হয়তো! সে-ও পায়, হয়তো বা
ও-ও! এভাবেই একে অপরের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন, ক্রমাগত দূরত্ব...মাইল কিংবা
যোজন নয়, আলোকবর্ষ! ধোঁয়া ধোঁয়া সিগ্রেট কাউন্টারে শেষ হয় না আর,
নির্দিষ্ট আঙুলের ফাঁকে পুড়ে ছাই হয়ে যায়... একা একা! শুনছি নাকি গ্লোবাল
ওয়ার্মিং অনেকখানি কমে এসেছে লকডাউনের কারণে। তবে কি হিমযুগ এলো? এসেই গেল!
কেমন যেন গা-ছমছম করে আসন্ন শীতে! শীতকাল চোখের সামনে ডুয়ার্সের ছবি নিয়ে
আসে না, এখন শীত মানে মর্গ...সাদা চাদরে মোড়া আমি তুমি কিংবা যে কেউ!
মৃত্যুর আগে বা পরে...একা! ভয়ে সিঁটিয়ে আছি! কেউ সত্যিই কোত্থাও নেই!
এতখানি একলা আজ মানুষ! হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তেই অটোফোবিয়ায় আক্রান্ত হই।
একাকীত্বের ভয় কার নেই?
আমার
একটা বর্ষাকালীন ভয় ছিল, আর ওটাই ছিল আমার একমাত্র ভয়। এসট্রফোবিয়া। যে
মেয়েটির শ্রাবণ মাসে জন্ম তারই কিনা বজ্র-বিদ্যুতের ভয়! কিন্তু সত্যিই সে
ভয় আমায় জাগিয়ে রাখতো মধ্যরাতের বৃষ্টিতেও! মেঘ করলে বুকের ভেতর ভয় ভারি
হতে হতে কিউমুলোনিম্বাস হয়ে যেত! আমি ট্রপোস্ফিয়ার ছাড়িয়ে মেসোস্ফিয়ারে
পৌঁছোতে চাইতাম। পারতাম না। আমার সীমিত ক্ষমতা নিয়ে ভয় পেতাম শুধু।
বহুদিনের চিকিৎসায় সে রোগ আমাকে ছেড়ে গেছে। তবুও ভয়, তা যেকোনও বিষয়েই হোক,
আমি আর একেবারে অমূলক বলে উড়িয়ে দিতে পারি না। কারণ আমি জানি, ভয়ে কতখানি
কষ্ট মিশে থাকে।
এই যেমন
হেলিয়োফোবিয়া, সূর্যালোকে ভয়! এ-ও আবার হয় নাকি! হয়, ডাক্তার যখন বলেন
'তোমার শরীরের রক্ত সূর্যালোকে দূষিত হবে বেশি।' তখন সে ভয়ও হয়। ভোর ভোর
ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গোটা একটা দিন যখন বলে 'আড়ালে থাক'...বড্ড অনুপযুক্ত লাগে
নিজেকে পৃথিবীর মাটিতে। তবুও বেঁচে থাকতে হয়, আড়ালে আবডালে থেকে বাঁচিয়ে
রাখতে হয় চারাগাছ, মা যে!
হেমন্তের
দিনে শিশিরের কথা বলবো না, তাকি হয়! এই নভেম্বরেই হঠাৎই একদিন
শিশির-পতন-ধ্বনির মতন নিজেকে আবিষ্কার নিভৃত স্বরে! তখনই বুঝতে শেখা কেমন
করে পায়ে পায়ে ভালোবাসা এসে দাঁড়ায় বুকের দরজায়, কড়া নাড়ে, খুলব কি খুলব
না করতে করতেই হিমেল হাওয়ায় ছিটকিনি নেমে আসে! তারই সঙ্গে এক অদ্ভুত ভয়!
এলগোফোবিয়া... ব্যথার ভয়! আর অবশ্যম্ভাবি সে ব্যথা পেতেই হয়! এড়ানো যায় না!
হয়তো তার থেকেই জন্ম হয় এক কবির!
আজ
কেন এত ভয়ের কথা লিখছি? লিখছি কারণ ওই একটামাত্র প্রক্ষোভ অবশিষ্ট আছে,
ভাবলাম তারই চর্চা হোক। কি ভীষণ ভয়কে ভয় পেতাম, সেই ভয়ই যখন মাথার চুল থেকে
পায়ের নখ পর্যন্ত আষ্টেপৃষ্ঠে ধরলো, দেখলাম, এরই সঙ্গে বসবাস সবচাইতে সহজ!
কেননা সে নিজেকে আড়াল করে না, তার অন্য কোনও মুখোশ নেই, সে যে ভয়াবহ সেটাই
তার একমাত্র পরিচয়। মহামারি সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করালো আমাদের
প্রত্যেককে। যেখানে ভয় অত্যন্ত নির্লজ্জ ভাবে নগ্ন। তারই সঙ্গে উলঙ্গ হতে
দেখে নিলাম গোটা একটা সমাজকে! দেখে নিলাম কিভাবে নিজেরটুকু বুঝে নিতে হয়,
সাবধানতার নামে স্বার্থপরতা শিখিয়ে দিলাম পরবর্তী প্রজন্মকে, ভুলে গেলাম
প্রতিবেশী থেকে প্রেমিকের নাম! হিমবাহ বহনকারী বুকে কিভাবে আর নতুন করে
আগুন জ্বলতে পারে, জানা নেই! হিমকথারা বড্ড শীতল, তারচাইতেও শীতল
এন্ড্রোফোবিয়া... মানুষের ভয়! হ্যাঁ, একমাত্র ওই ভয়টাই যুক্তিসঙ্গত, আর যা
কিছু, এসময়ে সবই অপ্রাসঙ্গিক।
অনুভূতিরা রূপকথার পাখনা মেলেছে।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ একটি মুক্তগদ্য। বিষয়বৈচিত্র্যে এবং লেখার মুন্সিয়ানায় কবিতাকেও ছাপিয়ে গেছে। গদ্যের হাতটি ও আবিষ্কৃত হল।
উত্তরমুছুনবাঃ বেশ অন্যরকম। তোমার কবিতার মতো এই লেখাও ভালো লাগল।
উত্তরমুছুননানা ফোবিয়া নিয়ে তরতরে গদ্য। খুব ভালো লাগলো রিমলী।
উত্তরমুছুন