অপরাজিতা ভট্টাচার্য
ক্রাইসিস বলে
চাপটা সুপ্ত @@@
পরীক্ষা শেষ
হয়ে গেলে পড়াশুনো ছাড়া বাকি
সব করব। তার মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে গল্পই মুখ্য। বাড়ির সামনে বা
ফ্ল্যাটের নিচে, পার্কে খেলাধুলো, হাঁটতে হাঁটতে
কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়া। অফুরন্ত প্রাণ সম্পদের সেসব কথারা, ফুরোবে না মা না
ডাকলে। মোটামুটি ক্লাস সেভেন থেকে টুয়েলভ অবধি এই ধারা। কলেজে পৌঁছলে আড্ডার ধরন
বদলায়।
আলোচনার বিষয় ছেলেদের দলে একরকম, মেয়েদের দলে আরেকরকম। আবার ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে আড্ডা দিলে হয়ত অন্যরকম। এই বিনিময়টি পরীক্ষা শেষ হলে নির্ভার হয়। পড়ার চাপ লাঘব করতেও কিন্তু মস্ত দাওয়াই এই আড্ডা, যাকে বলে স্ট্রেস বার্স্টার। মোট কথা, এক দঙ্গল তাজা প্রাণ হাঁটতে হাঁটতে, গাছের ছায়ায়, গলির মোড়ে, ফুচকাওয়ালার পাশে দাঁড়িয়ে হুল্লোড় করবে। ভারতের যে কোন শহর, মফস্বল, গ্রামের ছবি।
২০২০তে অ্যানুয়াল পরীক্ষা, ক্লাস টেন, টুয়েলভের বোর্ডের পরীক্ষা আচমকা বন্ধ হয়ে গেল। কে বন্ধ করে দিল? কেন বন্ধ হয়ে গেল? এভাবে পরীক্ষা বন্ধ হয় নাকি? নিশ্চয়ই আবার হবে বাকি পরীক্ষা। ১৭ই নভেম্বর, ২০১৯ চিনের উহান প্রদেশে প্রথম নভেল করোনা ভাইরাস জনিত রোগীর সন্ধান মেলে। ২০২০র জানুয়ারি মাস নাগাদ ভারতে ভাইরাসটির বিষয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছিল। তখনো ভারত কোভিড ১৯র কৃপালাভ করে নি। জানুয়ারি মাসটি বড় করুণ কাটে ছেলেমেয়েদের। অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে সেকেন্ড ইউনিট টেস্ট বা টার্ম টেস্টের ঝাপটায় ওরা নাকানি চোবানি খায়। অ্যানুয়াল পরীক্ষা, বোর্ড পরীক্ষার শেষ বেলার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। প্র্যাক্টিকাল খাতা, জার্নাল শেষ করতে হয়। সেই নাভিশ্বাস সময়ে চিনের ইউহান প্রদেশ থেকে উড়ে এসেছিল নভেল করোনা ভাইরাসের খবর। অদৃশ্য ভাইরাসটি যে কার্যত পৃথিবীর নিয়ামক হয়ে উঠবে, জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে ভাবা যায় নি। আসন্ন পরীক্ষার চাপে, চিন্তায় ভাইরাসটি তখনো অতিরিক্ত চাপ হয়ে উঠতে পারে নি। নভেল করোনা ভাইরাসের কণ্টক গাত্র ৩০শে জানুয়ারি, ২০২০ কেরালার এক ছাত্রকে কাবু করেছিল। সারা ভারতে প্রাদুর্ভাবের প্রভাব যে কেমন হতে পারে, তা ছাত্রছাত্রীদের বাবা মায়েরাই বুঝে উঠতে পারেন নি, তো ছাত্রছাত্রীরা কোন ছাড়। ১৪ই ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন হয়েছে। হাওয়াতে বসন্তের লচক, গমক। ফরফর করে মন উড়েছে, বুক পুড়েছে।
ফুটে উঠছে যারা প্রাণ সম্পদে আগামীর জন্য, এক আতঙ্ক তারা অর্জন করবে আগামী মাসগুলোতে কল্পনাও করতে পারেন নি উচ্চ, মধ্য, নিম্নবিত্ত বাবা মায়েরা। ভাইরাসটি সমাজের প্রতিটি স্তরে অনাস্থা, আশঙ্কা, আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বিত্ত এক ধরনের আস্থার, সুরক্ষার ইমিউনিটি দেয়। সে ইমিউনিটিকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে হো হো হেসেছে করোনা ভাইরাস। জনতা কার্ফু বা লক ডাউনের মত শব্দ শিখেছে ওরা। আর তা শিখতে শিখতে পরিচিত জীবন চলন বদলে গেছে দুম করে। ২২শে মার্চ জনতা কার্ফুর পর ২৫শে মার্চ থেকে শুরু হয় প্রথম লক ডাউন। বিষয়টি অভিনব। একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ঘরবন্দি হয়ে পড়ল মানুষ। ফলে বোঝা কঠিন ছিল যে এই লক ডাউন শেষ হলে আবার লক ডাউন, আবার লক ডাউনে ওলট পালট হয়ে যাবে প্রতিটি দিন ও তার ছন্দ। অস্পর্শের দাওয়াই, মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। আর ঠিক এই ভাবেই ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে যে বোর্ডের পরীক্ষাও বন্ধ হতে পারে। স্কুল কলেজ কবে খুলবে জানা নেই।
লক ডাউন শুরুর রোমাঞ্চ ছিল ভালই। স্কুল, টিউশনে ক্লান্ত ছেলেমেয়েরা বেশ একটা মুক্তির কল্পনা করেছিল। না মেটা ঘুম পূরণ হবে, ছুটছুট দৌড়দৌড় ব্যাপারটা থাকবে না কিছুদিনের জন্য। তারপর স্কুল খুললে জমে থাকা পড়ার পাহাড় শেষ করে স্কুলে যাওয়া যাবে। তিন সপ্তাহের লক ডাউন শুরুর পরে পরেই কিন্তু কল্পনা, পরিকল্পনা বদলাতে লাগল। গৃহকর্ম সহায়িকার সবেতন ছুটি। ফল স্বরূপ ছেলেমেয়েদের ওপর নির্দিষ্ট কিছু ঘরের কাজ বরাদ্দ হল। এই যেমন ঘর ঝাঁট বা মোছা, জামা কাপড় মেলা, তোলা, নিজের খাবার থালা, প্লেট মেজে রাখা, সহজ কিছু জল খাবার বানানো, গাছে জল দেওয়া ইত্যাদি। বাড়িতে যে এই কাজগুলো থাকে তা জানাও ছিল না। কয়েকদিন করার পর অনীহা আসে। তবু ব্যাজার মুখে বরাদ্দ কাজগুলো করতেই হয়। কারণ মায়ের একার পক্ষে সমস্ত কাজ করা সম্ভব নয়। বাবার মাথায় ওয়ার্ক ফ্রম হোম নামক পাহাড়। তিন সপ্তাহের শেষে স্কুল খুলবে। জমে থাকা পড়াশুনো করার জন্য ভাল সময়। শুধু যদি একটু বেরিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা যেত, বেশ হত। সঙ্গে যদি থাকত রাস্তার স্টলের মুখরোচক খাবার। ছুটির পরাগ ভালই কামড়ে বসেছিল। কিন্তু ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন, টেস্টোটেরনের ওঠাপড়ায় মুড সুইং তারুণ্যের এক অমোঘ বৈশিষ্ট্য। হরমোন তিনটির স্পার্টে হাসিমুখ তিরিক্ষি হতে সময় বিশেষ লাগে না।
মায়েরা বাড়িতে স্ট্রিট ফুডের সম্ভার খুলে বসলেন। ছেলেমেয়েরাও হাত লাগাল। মোমো, এগ চিকেন রোল, মোগলাই পরোটা, ধোসা, ইডলি সম্বর, বিরিয়ানি, ফুচকা, রসগোল্লা, ডালগোনা কফি আরো কত কি যে ঢুকে পড়ল সেই ঘরোয়া মেনু কার্ডে। এই বয়সের বুকে অপরূপ এক সার্চ লাইট থাকে। সে লাইট জ্বলে ওঠে যখন তখন। লাইটের প্রাবল্য তার যুক্তি বুদ্ধিতে শান দেয়, ঢুকে পড়ে নানা ডিস্কোর্সে। বুকের সেই সার্চ লাইট জ্বেলে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেও সে দেখতে পায় মায়ের মুখ অপ্রসন্ন। পেট ভরে পছন্দের খাবার খেলে আগে মা যতটা খুশি হত, ততটা নয়, অন্যমনস্কও। মাকে কিছু জিজ্ঞেস করাও যেন যাচ্ছে না। কাজের মাসিটি আসছে না ঠিকই, কিন্তু কাজ তো ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। এর আগে কাজের মাসি দু তিনদিন না এলেও মায়ের এমন মুখ দেখে নি।
মায়েদের সমস্যার মূল দুই ভাগ এই লক ডাউনে। তাঁরা কর্মরত অথবা হোম মেকার। কর্মরত হলে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের জোয়ারে জেরবার অবস্থা। মায়েদের পড়তি ইস্ট্রোজেন উদ্যম কমিয়ে দেয়। অথচ লক ডাউন ২৪*৭ উদ্যম প্রার্থী। পাশাপাশি হোম মেকার মা সব সামলে হয়ত একটি ছোট ব্যবসা চালান ঘরে বসেই। সে ব্যবসা বন্ধ। আদৌ শুরু করা যাবে কিনা জানা নেই। বাবার অফিসে পে কাট হচ্ছে। বাবার বন্ধুর চাকরি আর থাকবে না জুন মাস থেকে। স্কুলের বন্ধুর বাবার চাকরি চলে গেছে… এসব খবর ছড়িয়েছে নিমেষে। যে মায়েরা হরিহর আত্মা হয়ে উঠেছিল, বাচ্চাদের স্কুল, টিউশন মাধ্যমে তারা এড়িয়ে যেতে শুরু করেছে চাকরি চলে যাওয়া পরিবারটিকে। চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে পরিবারটি। আর সেই চর্চা চমকে দিয়েছে তারুণ্যকে। অচেনা লেগেছে মাকে। আবার কারো মা হয়ত সে চর্চায় অংশ নেয় নি। সন্তান গর্ব বোধ করেছে মায়ের জন্য, এমনও হয়েছে। মার্চের শেষে শুরু হওয়া লক ডাউন এভাবেই উদ্বেগ, অনাস্থা বাড়িয়েছে। ধোয়া পাখলায় বিরক্ত হয়ে উঠেছে তারুণ্য। ছুটি নয়, নিস্ফলতার গুজরান।
২৫শে মার্চ, তিন সপ্তাহের যে লক ডাউন শুরু হয়েছিল, তার মেয়াদ বেড়ে গেল। ৩রা মে পর্যন্ত লক ডাউন চলবে জানা গেল। তিন সপ্তাহের লক ডাউন শেষ হলে স্কুল শুরু হবে। এমন আশা স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রছাত্রী দুই তরফেই ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্কুলের অনলাইন ক্লাস চালু হল। ল্যাপটপ অথবা মোবাইল থেকে পড়াশোনা হবে। স্কুলের অনলাইন ক্লাস কীভাবে হবে সে নিয়ে জল্পনা কল্পনা অনেক হল। শিক্ষক শিক্ষিকারা অনলাইন ক্লাস নিতে অভ্যস্থ নয়। ফলে ধাতস্থ হয়ে ক্লাস, পড়াশুনো শুরু করতে ছাত্র শিক্ষককে খানিক বেগ পেতে হল। মোবাইল, ল্যাপটপ ব্যবহার নিয়ে সমস্যাও শুরু হল বহু পরিবারে।
সমস্যাগুলি বিভিন্নরকম। ছাত্রছাত্রীর নিজস্ব স্মার্ট ফোন বা ল্যাপটপ অনেক ক্ষেত্রেই নেই। মূলতঃ মায়েদের মোবাইল ছেলেমেয়েরা টেনে নিল। কিছু শতাংশের কাছে নিজস্ব মোবাইল থাকায় তারা তেমন সমস্যায় পড়ে নি। মায়েদের মোবাইল থাকলেও দীর্ঘ সময়ের নেট সংযোগ না থাকার সমস্যা। অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারে স্মার্ট ফোন একটিও নেই। যাদের বা আছে তাদের এই অনলাইন পড়াশোনার ব্যাপারটি বোধগম্য হয় নি। নিছক বিনোদনের জন্য ফোনটি এ তাবৎ ব্যবহার হত। বেশ একটা ভজঘট্ট ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল অনলাইন ক্লাস। শিক্ষক শিক্ষিকারাও অনেক ক্ষেত্রে অভ্যস্থ হতে সময় নিয়েছেন। ক্লাস নোটস পাঠাতে পারেন নি নির্ধারিত সময়। গভীর রাতে ছাত্রের মোবাইলে পৌঁছেছে সে নোটস। পঠন পাঠন শুরুর দিকের অসুবিধে গুলো ধীরে ধীরে কমতে থাকল। অনলাইন ক্লাসে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে। ডাউট ক্লিয়ার করা যায়। কিন্তু মনঃসংযোগ এবার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। নিজের অজান্তেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে ডেকে জিজ্ঞেস করার কেউ থাকল না। ধাতানিতে মনঃসংযোগ ফেরে বৈ কি। ল্যাপটপ বা কম্পিউটারের চেয়ে মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে চোখ বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। মাথা ঝিমঝিম, ঘুমভাব।
অসুখের ভয়, সংক্রমণের ভয়, বাবা মায়ের চিন্তান্বিত কথাবার্তা গুটিয়ে ফেলেছে ওদের। প্রতিবেশীর করোনা সংক্রমণের খবর এলে বাকি প্রতিবেশীদের আচরণ অচেনা লাগছে। কাজের মাসির বাড়িতে চাল, ডাল ফুরিয়েছে। অনেকেই তাকে দ্বিতীয় মাস থেকে মাইনে দিতে রাজি নয়। ওরা কি খাবে এরপর? ভাবাচ্ছে। বন্ধুদের সঙ্গে ভিডিও কলের গল্পে মন ভরছে না। লক ডাউনের যাপন সব বন্ধুদের সমান কাটছে না। হীনমন্যতা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ ভাল লাগার বন্ধুটিকে ভিডিও কল করা সম্ভব হচ্ছে না। মেসেজে মিটছে না ঝগড়া, জট।
প্যাশনের বিষয়তেও মন লাগছে না বেশিক্ষণ। লক ডাউনে পড়াশুনো করা যাবে অনেক। না, তেমন হচ্ছে না। মনঃসংযোগের সমস্যা বাড়ছে। বাবা মাও ভেবেছিলেন বাড়িতে একটানা থাকলে, যাতায়াতের ধকল থাকবে না। সেলফ স্টাডি ভাল হবে। কিন্তু নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরছে ওদের। হয়ত বা হিংসাও। অনিশ্চয়তায় কাটছে সময়। বাবা মা নিজেদের অনিশ্চয়তায় ছেলেমেয়েদের অনিশ্চয়তাকে চিনে উঠতে পারছেন না। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক শিক্ষিকারাও ছাত্র ছাত্রীদের চোখ পড়তে পারছেন না। হাসি ঠাট্টার সুযোগ নেই তেমন। কে কার যষ্ঠি হবে কে জানে!
কুয়াশা সময়ের অতলে আছে কী আশার জহরত?
খুব ভালো ধরেছ বিষয়টা। সত্যিই এক চরম সংকট ছেলেমেয়েদের সামনে। ওদের হাত গলে বেরিয়ে গেল কতটা সময়। এ তো ক্র পূরণ হওয়ার নয়। আশা নিয়েই আমাদের থাকতে হবে এখন। এ ছাড়া আর উপায় কী?
উত্তরমুছুন