নির্মাল্য কুমার মুখোপাধ্যায়

 



ময়নাতদন্ত

 ++++++++++++++++ 

[এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি

রক্তফেনা মাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি

আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার; কোনদিন জাগিবে না আর-]

চারিদিকে গলা সমান উঁচু পাট। মাঝখানে এক চিলতে পতিত। জমির উত্তর মাথায় খেজুর-বাবলা। উইয়ের ঢিপী। দক্ষিণে বৃষ্টি জমে আশশ্যাওড়া আর কণ্টিকারির ঝোপ। নিচে জল, ছলাত ছল।জলে-কাদায়, মাছিতে- পিঁপড়েয় মাখামাখি হয়ে, আকাশের দিকে মুখটা একটু উঁচু রেখে, দুহাত দুপা দুদিকে ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়েছিল দুখিরাম সর্দার। একটা চোখ, একটা কানের লতি, এক গালের অর্ধেক নেই।

গলা থেকে ঠোঁট পর্যন্ত পুড়ে কালো হয়ে আছে। যে একটা চোখ এখনও আছে, সেও আর কোটরের ভেতর থাকতে রাজি নয়। ঠেলে বার হয়ে এসেছে যতদূর সম্ভব। ফোলা পেটের চাপে ঢোলা টিশার্ট ফাটোফাটো। প্যান্টের চেন ফেটে গেছে। এইরকম একটা অবস্থায় থানায় পৌঁছল খবরটা। আইসি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

গত তিনদিন ধরে নিখোঁজ ছিল দুখিরাম।মিসিং ডায়রি করে গিয়েছিল ওর গেজেটেড দাদা। নিরীহ শান্ত ভদ্র একজন ট্রাইব। পাত্তা না দিলেও কিছু মনে করবার মতো লোক নন উনি। কিন্তু গেজেটেড অফিসার জেনে আইসি একটু খাতির করেছেন। খুব মন খারাপ করে সামনের বেঞ্চিতে বসেছিলেন দাদাটি। আইসি তাকে ডেকে এনে উলটো দিকের চেয়ারে বসিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়েছিলেন। নিচু গলায় দাদা বলছিলেন,

-না না। বাড়িতে তেমন কোন অশান্তি ছিল না। না, বৌমার সঙ্গে তেমন ঝগড়াঝাঁটি কোনদিনই হয়নি। ওই টুকটাক। সেতো সবাইর হয়। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে কী নিয়ে যেন খুব চিন্তা করতো। হতে পারে, পেস্কারের চাকরিতে প্রচুর উপরি।কিন্তু ও কোনদিনই দু নম্বরি করতে পারেনি। বরং আমার কাছেই টাকা ধার করতো মাঝে মাঝে। ওসব করতে গেলে একটু চালাক চতুর হতে হয়। ও একদম ভোদাই টাইপের চ্যাংড়া। না না, অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেই কোনদিন দেখিনি। পালানো টালানো অনেক দূরের ব্যাপার। না, কাজে কম্মে ততো পাকা পোক্ত ছিল না ও। সবে প্রমোশন পেয়ে পেস্কার হয়েছিল। নথিপত্র তেমন গুছিয়ে রাখতে পারতো না। আসলে আমরা, মানে সর্দার কমিউনিটির লোকজন কোন কালেই কাগজপত্র তেমন গুছিয়ে রাখতে পারিনা। সেই জন্যই তো জমিজমা বিষয় সম্পত্তি সব বেহাত হয়ে যায় আমাদের। হাঃ হাঃ হাঃ…

আইসির ভুরু কুঁচকে উঠেছিল।ভাই নিখোঁজ আর দাদা হাসছে? ভাইয়ের বউটা দেখতে কেমন একবার দেখতে হবে। বয়স কত? ট্রাইবালদের এসব ব্যাপারে খুব সুবিধে, নন-ট্রাইবাল বলে নিজেকে একটু বঞ্চিত মনে হল আইসির।

-আপনি কিসে আছেন?

-আমি ওই ল্যান্ডে…

-ল্যান্ডে মানে? জে এল আর ও?

-না, মানে, এখন তো আর জে এল আরও নেই।তাই বি এল আর ও। ওই…

-হ্যাঁ, বুঝেছি। বি এল আর ও মানে তো ভীষণ ব্যাপার। আপনারাই তো জমিজমার আসল মালিক।

-মালিক কি না জানিনা। তবে ওই দ্যাখাশুনো করা…।

-না না, বিশাল ব্যাপার। ব্রিক ফিল্ড, বালি খাদান পাথর খাদান  সবই তো আপনাদের কন্ট্রোলে। ভেরি ফিশারি সব আপনাদের মুঠোর ভেতর।

কী ভাগ্যবান পরিবার। ভাবেন আইসি সাহেব। এক ভাই কোর্টে আরেক ভাই ল্যান্ডে। এই জেনারেশন যা কামাচ্ছে তাতে চারপুরুষ বসে খাবে।এরা নাকি আজও অবহেলিত নিপীড়িত, অনগ্রসর। হায় গণতন্ত্র!

-তা সাহেব জমিজমা আছে নাকি আপনার? ভাইয়ের নামে আছে?

-হ্যাঁ, ওই দেশের একটু ভিটেবাড়ি।সেখানে বুড়ি মা থাকে।

-ভাইয়ের অবর্তমানে সে সব কে পাবে?

-ওর বৌ ছেলেমেয়ে আছে, তারাই পাবে। কিন্তু অবর্তমানের প্রশ্ন এখনই উঠছে কেন?

-না, মানে, বাহাত্তর ঘণ্টা হয়ে গেল তো নিখোঁজ।এইসব কেসে সাধারণত বডি খালেবিলেই পাওয়া তিনচারদিন বাদে।

বডি সেই পাওয়া গেল, তবে খালে বিলে নয়, পাটক্ষেতের মাঝখানে।থানা থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে। বাতাস ভারি হয়েছিল দুর্গন্ধে। কুকুরগুলো লোকজন দেখে একটু দূরে সরে গিয়ে খুব চিৎকার করছিল। শকুনগুলো ঘাড় বেঁকিয়ে জ্ঞানী বৃদ্ধের মতো পচা গলা লাশটার ওপর নজর রাখছিল। ভ্যানরিকশা থেকে ধরাধরি করে নামানো হয়েছিল ফুলমণিকে। ভিড় ঠেলে পুলিশ ফুলমণিকে লাশ দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল।

ফুলমণির শোক ছিল সশব্দ কিন্তু চাপা। আছাড়ি-পিছাড়ি নয়। শব্দটা আহত আদিম কোনও প্রাণীর চাপা গোঙানির মতো। বেশিদূর ছড়াচ্ছিল না আওয়াজটা। মৃতের শরীর থেকে উঠে আসা দুর্গন্ধের চাপে ভারি হওয়া বাতাসের মধ্যেই পাক খাচ্ছিল।

তদন্তকারি অফিসার সিগারেট ধরিয়ে ফুলমণিকে বললেন,

-চিনতে পারছেন?

ফুলমণির গোঙানির হেরফেরে অফিসার যা বোঝার বুঝে নিলেন।শববাহকদের বললেন,

-ভাল করে পকেটগুলো দেখ।

মানিব্যাগ, চিরুনি আর একটা চিরকুট। চিরকুট দেখে জড়ো হওয়া গ্রামবাসী ঘন হয়ে এলো। আই ও সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পড়লেন এবং চিরকুট ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে বললেন,

-বেঁধে নে।

কালো পলিথিন, নারকেল দড়ি আর বাঁশের সাহায্যে দুখিরাম উঠল ভ্যানে। বডি চলল থানায়।

                        @@

[টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে

চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা]

সদর থেকে সাদা এ্যাম্বাসাডারে জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসেবে দুখিরামের গেজেটেড দাদার সঙ্গে আরও একজন কলিগ অফিসার এলেন মহকুমা হাসপাতালে।অতিরিক্ত জেলা শাসক, ভূমি দপ্তর, ঘটনায় খুবই উদ্বিগ্ন। উচ্চবর্ণের মানুষ হলেও তিনি বেশ কিছুদিন তপশীলভুক্ত জাতি উপজাতি উন্নয়ন দপ্তরের নোডাল অফিসার হিসেবে ট্রেনিং পিরিয়ডে কাজ করেছেন।সেই অভিজ্ঞতা থেকে আদিবাসীদের জীবনচর্চা নিয়ে বেশ কিছু বই লিখে নিজের খরচে ছাপিয়ে কলিগ অফিসারদের বিতরণ করে প্রবল আনন্দ পেয়েছেন। তার ড্রইংরুমে বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী মুখোশ এবং অস্ত্রশস্ত্র টাঙিয়ে রাখেন।তার ওপর নিহতের দাদা তাঁরই দপ্তরের একজন ব্লকস্তরের আধিকারিক। সদর ব্লকেই পোস্টেড। ছেলেটি সৎ, বিনয়ী। কাজেকম্মে উদাসীন।আজ পর্যন্ত কোনদিন কলম এবং ব্যাগ নিয়ে দাদাকে অফিসে আসতে দেখেননি। তবে নিয়মিত আসে যায়। রাগ হলেও তাকে কিছু বলেন না কারণ, এটাও খুব সত্যি, খুব অল্পদিনের মধ্যেই আরও গোটা দুয়েক প্রোমোশন পেয়ে তাঁরই চেয়ারের সমান্তরাল উচ্চতায় চলে আসবে দাদাটি। কলম-ব্যাগ না নিয়েই মাথায় লালবাতি লাগান গাড়িতে উঠবে। তার ডায়রি বয়ে নিয়ে যাবার মতোবডিগার্ডও সঙ্গে থাকবে একজন।

টেবিলে হাত রেখে অঝোরে কাঁদছিল দাদাটি। সাহেব জিগ্যেস করলেন,

-কী হতে পারে?

-আমি তো স্যার কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে ম্যাডামের সঙ্গে একটু আধটু ঝামেলা চলছিল শুনেছি।

-কী রকম ঝামেলা?

-ঠিক বলতে পারব না। কেস ফেস নিয়ে হতে পারে।

-হ্যাঁ, তাতো হতেই পারে। পেস্কারের কাছেই তো থাকে সব নথিপত্র। ওরাই মেন্টেন করে ওগুলো। ম্যাডামের নাম জানেন?

-জানি, সাবিনা। সাবিনা শবনম।

-সেরেছে, একে মেয়েছেলে তায়…।সংখ্যালঘু বনাম অনগ্রসর। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে?

-শুনেছি খুব খারাপ ব্যবহার করতেন ভাইয়ের সঙ্গে।

মিনমিন করে জানাল দাদাটি।

-বয়েস কত ম্যাডামের?

কিছুদিন আগেই সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্টের ওপর মিটিং ডেকে কমিটি তৈরি হল এই অফিসে।আগাগোড়া আলোচনাটাই ছিল নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচার। উলটো দিকের কথা আলোচনা হলই না। এখন দেখা যাচ্ছে উলটোটাও হয়। আইনটার আরও কিছু সংশোধন যুক্ত করবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন অতিরিক্ত জেলা শাসক।

-কত আর হবে, এই পঁয়তিরিশ ছত্রিশ।

দাদার জবাবে আরও উৎকণ্ঠিত হলেন এডিএম সাহেব।বললেন

-আপনি এখুনি রওনা দিন।আমার গাড়িটা নিয়ে চলে যান। সঙ্গে জেলার একজন অফিসার নেবেন। মুখার্জিকে ডাকুন আমি বলে দিচ্ছি ওকে যেতে। ও আমার হয়ে ওখানে কথাটথা যা বলবার বলবে। আমাকে রিপোর্ট করবে। আপনি হাসপাতালে নেমে গাড়িটা ছেড়ে দেবেন।ওকে?

এস ডি ও সাহেব বেশ বয়স্ক। কথা সামান্য জড়িয়ে যায়। ঘাড় নাড়ানর ওপর নিজের পুরো নিয়ন্ত্রণ নেই।বললেন,

-বোধয় এখানকার কোনও ডাক্তারই পোস্টমর্টেম করতে চাইছে না। বলছে, বডি নাকি হাইলি ডিক্মপোজড। যদি নাই করে তাহলে কিন্তু কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। ওখানেও একমাত্র মেডিকেল কলেজ ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা নেই। সে খুব ঝামেলা। বিশাল ভিড়। কোন কোন কেসে দেখেছি সপ্তাহ খানেক লেট হয়।

শোকার্ত বড় ভাইয়ের চোয়াল ঝুলে যায়। সঙ্গী আধিকারিক মুখার্জি বলে ওঠে,

-স্যার আপনি যদি সুপারকে একটু রিকয়েস্ট করে দেন। মানে এডিএম সাহেব সেটাই চাইছেন।

-বলেছিরে ভাই। আমার তরফ থেকে যেটুকু বলবার বলেছি। সুপার বলেছেন, সেটা কন্সার্নড ফিজিসিয়ানের ওপর নির্ভর করছে।

-ঠিক আছে, আমরা কন্সার্নড ফিজিসিয়ানকেই ধরি।

-হ্যাঁ, সে তো ধরতেই পারি, কিন্তু এনাটমির ব্যাপার তো। ওই জায়গায় আমরা, সিভিল এডমিনিস্ট্রেশন একেবারে হ্যান্ডিক্যাপড।

হাসপাতাল গেট পার হলেই বড় মাঠ। মাঝখানে ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়া। তার ছায়ায় বড়সড় জটলাটা দুখিরাম কেন্দ্রিক সেটা বোঝা গেল বার এ্যাসোসিয়েশনের কালো কোটের আধিক্য দেখে।

হাসপাতালের চত্বরে এসে এম্বাসাডার থামতেই গেজেটেড দাদা আর জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিকে ঘিরে ধরল সবাই।বেশির ভাগই ভীষণ উত্তেজিত।তার মধ্যে আদালত কর্মচারী সংগঠনের মহকুমা সম্পাদক অথচ পেশায় আদালতের আর্দালি ছেলেটি সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত। সে বলে চলেছে

-কেন পোস্টমর্টেম এখানে হবে না? কারণ ডাক্তারকে নাকি জুডিসিয়ারির হাই লেভেল ভয় দেখাচ্ছে। কলকাতা রেফার করতে বাধ্য করছে। তাহলে ওদের দুদিক থেকেই সুবিধে। ওখান থেকে আরও হাইলেভেলে চাপ দিয়ে রিপোর্টে যা খুশি লেখান যাবে। এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া চাই।

সামান্য দম নিয়ে গলা তুলে ছেলেটি বলল,

-আমরা তাই জেলা প্রশাসনকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চাই যে, দুখিরাম সর্দারের মৃত্যুর উপযুক্ত তদন্ত দাবী করে দোষী ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত মহকুমা আদালতের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ থাকবে।

সদর প্রশাসনের প্রতিনিধি বললেন,

-এই যে শুনুন, পোস্টমর্টেম কোন ডাক্তার করবেন জানা গেছে?

উত্তেজিত সম্পাদক বললেন,

-কে আবার, ডাক্তার ঘোষ। ওই যে বাজারের মধ্যে বিশাল চেম্বার কাম ল্যাবরেটরি- প্যানারোমা আল্ট্রাস্ক্যান যার। তিনতলা। এয়ারকন্ডিসন্ড। শালা, গু-মুত ঘাঁটা ডাক্তার। ও কী বোঝে পোস্টমর্টেমের? ওর আসল ইনকাম তো এ্যাবরশন কেসে। আমরা জানিনা? সব জানি। প্রশাসন মুখ বুঁজে আছে কেন? বাতিল করুক ওর লাইসেন্স। দেখি কত হিম্মৎ? কী করে করবে? বড় বড় অফিসাররা বৌ শালী নিয়ে ওর চেম্বারে যায় পেট চাঁচতে।

যেন এক অনন্ত ক্রুদ্ধ তুবড়ির মুখ খুলে গেছে। এখন শুধু উদগীরন। ঘৃণা, ঈর্ষা, সন্দেহ আর বিদ্বেষের ফুল্কি ছিটচ্ছে কেবল।

-সরকারি ডাক্তার হয়ে প্র্যাকটিশ চালায় কী করে তার জবাব চাই আজ।

একটু ফাঁক পেতেই জেলার  প্রতিনিধি জিগ্যেস করলেন,

-কেন এরা এরকম করছেন? সরকারি কাজ সরকারি নিয়মেই তো হবে।

-চক্রান্ত স্যার গভীর চক্রান্ত। দুখিরামদা মাল খেত না। ম্যাডাম চাপ দিত। আমাদের হাতে কল্কে রেখে উনি ধোঁয়া উড়োবেন। আপনি জেলা প্রশাসন থেকে এসেছেন। সব জানাবেন ডি এম সাহেবকে। বলবেন, আদিবাসীদের কায়দা করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

-এই যে, ডাক্তারবাবু এসে গেছেন।

-কই কই কোথায়?

-ওয়ার্ডমাষ্টারের ঘরে।

-চল চল চল।

ঘরে ঢুকে দেখা গেল, চকচকে টাক, গোলগাল মুখ, হাইপাওয়ার চশমা, প্রাচুর্যে থইথই চেহারার একজন গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে বসে মন দিয়ে পুলিশ রিপোর্টটা পড়ছেন। কয়েকজন অত্যুৎসাহী গলা বাড়িয়ে রিপোর্টটা পড়বার চেষ্টা করছেন। কিন্ত হাতের লেখা এতই খারাপ যে ইচ্ছে করলে খোদ ডাক্তারবাবুই গোপন আনন্দ উপভোগ করতে পারেন।

রিপোর্টের বিশেষ বিশেষ অংশে তদন্তকারি অফিসার আন্ডারলাইন করে দিয়েছেন। তার মধ্যে এক জায়গায় লেখা ‘মৃতদেহটিতে ভাল মতন পচন ধরেছে,’ আরেক জায়গায় লেখা, শেষের দিকে, ‘মৃতের পকেটে একটা হাত চিঠি পাওয়া গেছে, সেখানে সুস্পষ্ট ভাবে বিচারক সাবিনা শবনমকে দায়ি করা হয়েছে। লেখা আছে, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাঁচার কোন উপায় ম্যাডাম রাখেননি। আমাদের সর্দার কমিউনিটিকে বাঁচানর কেউ নেই।তাই নিজেই নিজেকে শেষ করে দিলাম।’

গলা বাড়িয়ে যারা রিপোর্ট পড়ছিল তাদের চেয়ে ডাক্তারের পড়বার স্পিড বেশি। পড়া হয়ে গেলে ডাক্তার সেটা ভাঁজ করে পকেটে পুরে ফেললেন।

মর্গের দিকে একটা ছোটখাটো মিছিল রওনা দিল। জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি ডাক্তারের কানে কানে জেলার নির্দেশ বলতেই ডাক্তার বললেন যে এই অনুরোধ তাঁর কানে আগেই এসে গেছে।তবে পুলিশ রিপোর্ট খুবই হতাশাব্যাঞ্জক। মনে হয় না তাঁর পক্ষে কোন সহযোগিতা করা সম্ভব।

[মর্গে কি হৃদয় জুড়ালো

মর্গে- গুমোটে

থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে!]  

মর্গ, লাশ রাখার ঘর। হাসপাতালের মূল বাড়ি ছাড়িয়ে বেশ কিছু দূরে উত্তরের পাঁচিলের গায়ে পশ্চিম কোণায়। পাঁচিলের ওপারে গোরস্থান। লোকালয় বেশ দূরে। এলাকা জুড়ে যেন মৃত্যু মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসে আছে।

কেউ লক্ষ্য করেনি, হাসপাতাল চত্বরে ইতিমধ্যে দুজন সাব ইন্সপেক্টার এবং জনা ছয়েক কনস্টেবল কখন ঢুকে পড়েছে। বোঝা গেল কখন? যখন ডাক্তারকে ঘিরে চলতে থাকা প্রায় দেড়শ লোকের  ছোটখাটো মিছিলটাকে পুলিশ মর্গের তিরিশ মিটার দূরে থামিয়ে দিল। কেবল ডাক্তার, গেজেটেড দাদা আর সদর প্রশাসনের আধিকারিককে মর্গের বারান্দা অবধি যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হল। বাদবাকি সবাইকে এমনকি আদালত সংগঠনের মহকুমা সম্পাদক কাম আর্দালিকেও আটকে দেওয়া হল দূরে। সম্পাদক একবার প্রবল প্রতিবাদি সত্তার চাপে বেষ্টনীর ফাঁক দিয়ে গেল যেতে চেয়েছিল। কিন্তু ছোকরা এক এস আই তাকে একদম শরীর দিয়ে আটকে দেওয়ায় সম্পাদক একটা চক্রান্তের গন্ধ পেল। পুলিশের সামনে অনেক বাঘা বাঘা লড়াকু নীরব হয়ে যায়। তাদেরই একজনের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিল শাখা সম্পাদক।

মর্গের গাঁথনির চারপাশে এবং ভেতরে মৃত্যুর গন্ধ অনেক ঝাঁজালো। এখানে দুখিরাম একা নয়। বাইরেরে জগতে সে নিঃসঙ্গ ছিল হয়ত, কিন্ত মৃত্যুর পর বেশ কিছু সঙ্গীকে পেয়ে গেছে এই মর্গের ভেতর। ভারি শাটারের পেছনে টাইট কোল্যাপসিবল। ভেতরে সারি সারি র‍্যাক। রেলের স্লিপার কোচের মতো সাজান। ত্রিস্তর। স্তরে স্তরে নীরব নিথর দুখিরামের সঙ্গীরা। জীবন দিয়ে নয়, মৃত্যু দিয়ে যেন সবাই সবার সঙ্গে বাঁধা। সে বন্ধন গন্ধের। নাড়ি ওলটানো, চেতনা অবশ করা গন্ধগোকুল সবাই।

হড়হড় করে শাটার উঠে গেলে কোল্যাপসিবল চিরে দুই শববাহক মিলে  নামাল দুখিরামের শরীর।মৃত্যুর মুহূর্ত থেকেই মানবদেহে পচনের শুরু।চতুর্থ দিনে এসে সেই পচন দুখিরামের শরীরকে ভেঙেচুড়ে বাঁকিয়ে একটা একটা নতুন ফর্ম এনে দিয়েছে। মাথা এবং বুক, দুইই ঠেলে উঠে আকাশ ছুঁতে চাইছে।মেরুদন্ড বেঁকে তৈরি হয়েছে এক মহা ধনুক। মৎস্যাসনের ভঙ্গিতে শায়িত দুখিরাম যেন এখনই সেই ধনুকে দেবে টংকার, ছিটকে বেরিয়ে যাবে যাবতীয় ইহলৌকিক সমস্যা ভেদ করে, এই মর্গ ছেড়ে, এই ডাক্তার-বদ্যি, জজ-ব্যারিস্টার, হাকিম-এজলাস, নথিপত্রের যাবতীয় গ্যাঞ্জামকে উপেক্ষা করে, অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে।

ডাক্তার ঘোষ, যেন সিদ্ধান্ত নেওয়াই আছে, এমনভাবে নাকে রুমাল দিয়ে বার দুয়েক দুখিরামকে জরীপ করে না বাচক মাথা নাড়তেই পুলিশ ব্যারিকেডের ওইপারের ছোট জনতাকে জানিয়ে দিল পোস্টমর্টেম এখানে হচ্ছে না। তার সঙ্গে জমা ভিড় সরিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দিতে পুলিশ তৎপর হল।

সুপারের নাম ডি, কে, মণ্ডল। উপজাতি না হলেও তপসিলী জাতিভুক্ত। চেম্বারের ভেতরেই তাকে ঘিরে ধরল হতাশ জনতা।এখানে নেতৃত্ব দিল বার এ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক। দু হাত বুকের কাছে নিবেদনের ভংগিতে জড়ো করে সহ-সম্পাদক বললেন,

-স্যার, আপনি নিজে একবার চলুন। আপনি দেখে যদি বলেন হবে না তো হবে না। আমরা বডি নিয়ে কলকাতায় চলে যাব।

সুপার সবার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বললেন,

-দেখুন, ডাক্তার ঘোষ একজন সিনিয়ার ডাক্তার, যথেষ্ট অভিজ্ঞ। উনি যখন বলেছেন এখানে সম্ভব নয়, তো সম্ভব নয়। তাছাড়া আপনারা জানেন এখানে আমাদের অত উন্নত ইকুইপমেন্ট, ফরেনসিক কিছুই নেই।

পেছন থেকে ভেসে এল,

-সব ফিটিং হয়ে আছে দাদা।

-কোটার মাল আবার কী ডিসিশন নেবে?

-মহাশ্বেতাকে খবর দিন, দলিত হত্যা, সব টাইট হয়ে যাবে।

-ই টিভি এসেছিল, মহাশ্বেতা এতক্ষণ রওনা হয়ে গেছেন।

-চল চল ম্যাটাডর ডাক। সন্ধ্যের ভেতর না ঢুকলে আবার নো এন্ট্রির ঝামেলায় পরে যাব।

-দাঁড়া একটা হেস্তনেস্ত করে যাই। দরকার হলে সুপার শুদ্ধ ঘেরাও হবে। তুই মুহুরি সমিতির সেক্রেটারিকে খবর দে। যা হওয়ার এখানেই হবে, আর সেটা করবে সুপারের বাপ।  

জটলা তেতে উঠছে দেখে দুজন পোড় খাওয়া ডাক্তার এগিয়ে এলেন। সুপার জুনিয়ার কিন্তু তারা সিনিয়ার। তবু বাঁচাতে তো হবে।তাদের একজন সুপারের কানে কিছু মন্ত্র দিলেন। মুহূর্তে পাল্টে গেল সুপারের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।বললেন,

-ঠিক আছে, আমার সঙ্গে ডাক্তার মিশ্র এবং ডাক্তার ব্যানার্জি থাকবেন। আমরা একটা বোর্ড গঠন করে আরেকবার দেখে ডিসিশন নেব। চলুন।

দুখিরামকে আরেকবার নামতে হল। আরও একটু ত্বরান্বিত হল তার পচন প্রক্রিয়া। বোর্ড আগের সিদ্ধান্তেই অনড় রইল।

[শোনো

তবু এ মৃতের গল্প;- কোনো

নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;

বিবাহিত জীবনের সাধ

কোথাও রাখেনি কোনো খাদ]

আই.ও, অনাথবন্ধু পাটুলি, তপশীলি জাতি ভুক্ত সাব ইনস্পেক্টর, আই সি নিত্যানন্দ ব্যনার্জি, বর্ণ হিন্দুর সামনে এটেন্সনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে বললেন,

-স্যার, ফরোয়ার্ডিং লেটার রেডি করে ফেলেছি। এখন সাড়ে চারটে। যদি একটু ফোনে কনফার্ম করা যেত সুপার বা এডিসনাল সাহেব আছেন কি না তাহলে কলকাতা যাওয়ার এপ্রুভালটা নিয়ে রাখতাম।

-এত তাড়া কীসের?

আই সির গম্ভীর প্রশ্নের জবাবে পাটুলির উত্তর,

-মানে বডি এত ডিকম্পোজড হয়ে গেছে যে এরপর নিয়ে গেলে আর—

-তাতে আপনার মাথাব্যাথা কীসের? সরকারি কাজ সরকারি নিয়মে হবে।

বলেই যেন একটা ক্লু খুঁজে পেলেন এমনভাবে বলে উঠলেন আই সি,

-ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আয়াম সরি, আপনাদের সংগঠনের ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই। প্রেশার আসছে। যান যান। বড়সাহেব একজন ডিসট্রিক্ট জজের চেম্বারে। যাওয়ামাত্র স্যাংশন পেয়ে যাবেন। সত্যিই আপনারা ভাগ্যবান। আমাকে কোনদিন আপনাকেই না স্যালুট মারতে হয়। মরার পরেও প্রিভিলেজ পাবেন, চিন্তা নেই।

খোঁচাটা হজম করে নিলেন অনাথবন্ধু পাটুলি।বাইরে আসতেই মৃতের গেজেটেড দাদার মুখোমুখি।হতভম্ব ভাবে দাদা তাকালেন। একটা সিগারেট বার করে এগিয়ে দিয়ে পাটুলি বললেন,

-আপনার ভাইয়ের লেখা সুইসাইড নোটটা রিপোর্টে কোট করবার ফল ভাল হবে না বলে মনে হচ্ছে। চাকরি থাকলে হয় এখন। ধুস, যা হয় হবে শালা। আর সহ্য হয়না বুঝলেন।

ইতিমধ্যে পাথর ফুলমণিকে নিয়ে এসেছে সংগঠন। সঙ্গে বাঙলায় টাইপ করা দেড়পাতার এফ আই আর।ডিউটি অফিসার স্ট্যাম্প প্যাড এগিয়ে দিলেও ফুলমণি আঙুলে কালি নিল না। সংগঠনের একজনের দিকে হাত বাড়িয়ে কলম নিয়ে সই করল।একটু বেঁকে গেল অক্ষরগুলো। ঠিক সেই সময় ক্রুক্রুক্রু করে টেলিফোন বেজে উঠল।

-নমস্কার, হাঁসাডাঙা পুলিশ ষ্টেশন।

তারপরই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন ডিউটি অফিসার।

-স্যার, হ্যাঁ স্যার, মানে না স্যার। এইমাত্র জমা পড়ল স্যার। না এখনও পড়ে দেখার সময় পাইনি স্যার।

এই অবকাশে দেখা যাক, কী লেখা আছে মুহুরি এ্যাসোসিয়েশনের লিখে দেওয়া  ফুলমণির এফ আই আর-এ।

হাঁসাডাঙা থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক

হাঁসাডাঙা। নদীয়া।

মহাশয়,

আমার বিনীত নিবেদন এই যে, আমি ফুলমণি সর্দার, স্বামী মৃত দুখিরাম সর্দার আপনার এলাকাধীন বিবেকানন্দ পল্লীর ভাড়াটিয়া। আমার স্বামী হাঁসাডাঙা এস ডি জে এম এর অধীনে ২য় ফৌজদারি আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট সাবিনা শবনমের বেঞ্চ ক্লার্ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

উক্ত হাকিম সাহেবা খাস কামরায় ও প্রকাশ্য আদালতে আমার স্বামীকে নানা ভাবে হয়রানি করিতেন, আদিবাসী বলিয়া অপমান করিতেন। কটু মন্তব্যগুলি আদালতের উকিলবাবু ও মক্কেলদের সামনেই করিতেন। বহুবার চাকুরি খাইয়া লইবার হুমকি দিয়াছেন।

ফোন নামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ডিউটি অফিসার ঢুকে গেলেন আই সি-র ঘরে। নিচু গলায় চলল নাতিদীর্ঘ আলোচনা। বাইরে, টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট চাপা পড়া অবস্থায় পড়ে রইল ফুলমণির এফ আই আর, যার পরবর্তী অংশটুকু এইরকম,

-আমার স্বামী প্রায়ই তার জীবনের নানা হতাশার কথা আমাকে বলিত। ছোটবেলা থেকে কতরকম অপমান নিচু জাতি বলিয়া সহ্য করিতে হইয়াছে সেই সব কথা বলিত। মাঝে মাঝেই আদালতে যাইতে চাহিত না। পরে জানিলাম উক্ত ম্যাডামের অত্যাচারের ভয়ে সে আদালতে যাইতে ভয় পাইত। বিপদের আশঙ্কায় আমি সব ঘটনা জেলা জজ বাহাদুরকে তিনমাস আগেই লিখিত জানাইয়াছিলাম। কিন্তু কোন বিহিত হয় নাই।

ইতিমধ্যে ডিউটি অফিসার ফিরে এসেছেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে এফ আই আর তুলে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করে দিয়েছেন,

-গত ইং ১৫-৬-২০০২ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় সাধারণ পোশাকে বাড়ি হইতে আমার স্বামী খুব মন খারাপ লইয়া বাহির হইয়া যান। তাহার পর সারারাত বাড়ি আসেন নাই। পরদিন সকালেও কোন খবর না পাইয়া আমি আপনার নিকট একটি মিসিং ডায়রি করি। যাহার নম্বর ৩৮৭৬ তাং ১৬-৬-২০০২। আজ লোকমুখে খবর পাই যে আমার স্বামীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে। সংবাদ পাওয়ামাত্র আমি ঘটনাস্থলে গিয়া স্বামীকে শনাক্ত করি।

আমার স্বামী নিখোঁজ হইবার পূর্বে প্রায়ই বলিত উক্ত বিচারক ম্যাডাম তাহাকে খাইয়া ফেলিবে। বলিত, তুই আদিবাসী, কাজকর্ম জানিস না। তোকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় তার ব্যবস্থা আমি করে দিয়ে যাব।

ছাই ঝাড়লেন ডিউটি অফিসার। ফের পড়া শুরু করে দিলেন,

-আমার দৃঢ় বিশ্বাস উক্ত ম্যাডামের অকথ্য অত্যাচারে এবং প্ররোচনায় আমার স্বামী আত্মহত্যা করিতে বাধ্য হয়েছেন। আমার স্বামী আমাকে খুবই ভালবাসিতেন এবং আমাদের মধ্যে কোন পারিবারিক কলহ ছিল না। কোনদিন আমরা কেহ কাউকে ছাড়িয়া থাকি নাই।

শেষ প্যারায়—

-আমার বিনীত নিবেদন এই যে আমি যাহার অত্যাচারে স্বামীহারা হইলাম এবং শিশুপুত্র পিতৃহারা হইল, উক্ত ঘটনার তদন্ত করিয়ে উক্ত ম্যাডামকে আইনানুগ এমন শাস্তি দেওয়া হউক যাহাতে ভবিস্যতে আর কেউ যেন কোনদিন কোন আদিবাসির ওপর অত্যাচার করিবার সাহস না পায়।

ইতি নিবেদিকা

ফুলমণি সর্দার। তাং- ১৮-৬-২০০২।

একটু নিচে আবার লেখা

ক্রমশ- আমার স্বামীর মৃতদেহ পাওয়ার পর তাহার পকেটে একটি চিঠি পাওয়া যায়। সেখানে তিনি সব ঘটনা লিখে জজ ম্যাডামকে মৃত্যুর জন্য স্পষ্টভাবে দায়ি বলিয়া লিখিয়া গিয়াছেন।

শুধু সই করে রিসিট কপি ফেরত দিচ্ছিলেন ডিউটি অফিসার। সাংগঠনিক সম্পাদক কপিতে তারিখ সময় এবং সিলমোহরটি লাগিয়ে নিলেন।বললেন,

-এইভাবে আর কতদিন চালাবেন আপনারা?

থানা চত্বরে এখন কালী বা শনি মন্দির অথবা দুইই আবশ্যিক। এখানেও আছে। বটগাছ ঘিরে ফাটল ধরা চাতাল। চাতালের কেন্দ্রে গ্রহরাজ। আশপাশে ছড়ান ছেটান পাব্লিক। জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিকে ডেকে চা দিল আদালত কর্মচারী সংগঠনের কেউ একজন। বাকিরাও চা পেল। সেখানে নানা রকম আলোচনা হল।যেমন-

-আগে থেকে কিছু টের পাননি আপনারা?

-একদম না। টের পেলে ম্যাডামের বাচ্চাকে আচ্ছা করে টাইট দিয়ে দিতাম।

-দুখিরাম কি কাজ কর্ম তেমন জানতেন না?

-কী করে জানব? মাস তিনেক হল প্রমোশন পেয়েছে। আগে ছিল মালখানায়।

- না জানলে কী হয়েছে? আমরা আছি।আমাদের তো বলবে? আমি তো ফার্স্ট কোর্টে আছি। পাতার পর পাতা অর্ডার লিখে দিচ্ছি। সাহেব চোখ বুঁজে সই করে দিচ্ছে।

-সাহেবরাই বা কাজ কজন জানে?

-ম্যাডামের ব্যবহার কিন্তু খারাপ।

-মুখ তো নয় যেন পায়খানা।

-উকিলদের সঙ্গেও জঘন্য ব্যবহার।

-দুখিরামের স্ত্রী যখন জানাল তখন ব্যবস্তাহ নেন নি?

-অবশ্যই নিয়েছি। জরুরিভিত্তিক মিটিং ডেকে আলোচনা হয়েছে। রেজোলিউশন নিয়ে জেলা কমিটিকে পাঠান হয়েছিল।ডেপুটেশনের ডেট চাওয়া হয়েছিল।

-কিন্তু তার মধ্যেই দুখিরামদা এমন কাণ্ড করে বসল।

-ম্যাডাম কিন্তু জোর কলকাঠি নাড়ছে। মেডিকেল কলেজে বডি নিতে পারলেই ওপর থেকে ব্যাপারটা চেপে দেবে।

-দেখলি না, ডাক্তারগুলো কেমন কুঁইকুঁই করছে।

-বিচারকরাই যদি এইরকম করে তবে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?

-বিচারের বাণী নিরবে নিশীথে কাঁদে।

-নিশীথে নয়, নিভৃতে।

-ওই হল নে।

চা শেষ হলে জ্বলে ওঠে কিছু বিড়ি আর সিগারেট। ধোঁয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওড়ে জল্পনা আর কল্পনা।

-আমার মনে হয় কেসটা মার্ডার হিসেবে দেখাবে। ম্যাডাম তাহলে সাইড কেটে বেরিয়ে যাবে।

-মার্ডার দেখান অত সোজা? বডিতে কোন ইনজুরিই নেই।

-না; বলবে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে।

-মোটিভ?

-দুখিরামদা পার্টির সঙ্গে লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছিল। হিস্যা বরাবর কাজ না হওয়ায় মার্ডার।

-অত সস্তা? জোর করে বিষ খাওয়ালে ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন থাকবেই।

-আরে দূর। জোর করে কেন? মালের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়েছে। ভিসেরায় বিষ আছে, মালও আছে।

-বডির যা কন্ডিশন, ভিসেরাটাই আছে কি না সন্দেহ।

একজন হোমগার্ড সহসা এসে জানাল,

-আই ও সাহেব পার্টির বড়দাকে ডাকছেন।

জল্পনা থামিয়ে দলটা রওনা দিল আই ও-র টেবিলে। অনাথবন্ধু পাটুলি, আই ও, মেডিকেল কলেজে বডি পাঠানোর জন্য অনুমতি তাড়াতাড়ি নিতে চেয়েও দ্বিধাগ্রস্ত।বাধা অনেক, সেগুলো বড়দাকে জানালেন।

প্রথম বাধা, থানায় গাড়ি নেই। রাউন্ডে গেছে। গাড়ি ফিরবে তবে কখন ফিরবে জানা নেই। ফিরলেও তেল নেই। তেল পেলেও বডির সঙ্গে যাওয়ার মতো ফোর্স নেই। ফোর্স থাকলেও কারও যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। কারণ, টিভিতে এখন ভারত বনাম জিম্বাবয়ের ওয়ান-ডে চলছে।

সমাধান- থানার বাইরে ভিডিও হলের সামনে হাইরোডের ধারে সারি সারি সুমো।কেউ না যাক, পাটুলি যাবে। সদরের আপডাউন ভাড়া চারশ। অনাথবন্ধু গিয়ে এসপির কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে আসবে মেডিকেল কলেজে বডি নেওয়ার।

যদি এসপির অর্ডার আজ পাওয়া যায় তাহলে কাল সকালে বডি নিয়ে যেতে হবে মেডিকেলে। কলকাতার জন্য গাড়ি দেবে এসপি অফিস। কিন্তু সেই গাড়ি রেডি হয়ে আসতে সময় নেবে অন্তত দুদিন। ততক্ষণে দুখিরাম সবটাই একটা তরল পদার্থে পরিণত হয়ে যাবে।

সমাধান- সুমোর পাশেই ম্যাটাডর গ্যারেজ। কলকাতা আপডাউন ভাড়া উইথ ডেড-বডি – ২০০০ টাকা।

তৃতীয় বাধা- ডোম। যারা বডি প্যাক করে গাড়িতে তুলবে তাদের পলিথিন, আতর, নারকোল দড়ি আর চুল্লু বাবদ ৫০০ টাকা। এছাড়া অনাথবন্ধু, দুজন কনস্টেবল আর মৃতের সঙ্গীদের কলকাতা যাতায়াতের জলখাবার, চা, পান, বিড়ি বাবদ ১০০০ টাকা।

সাকুল্যে ৩৯০০ টাকা লাগবে বডিটাকে মেডিকেলের টেবিলে তুলতে। এখানে অনগ্রসর বা উপজাতির জন্য কোন ছাড় নেই।

সন্ধ্যের মুখে রওনা দিল অনাথবন্ধু। সুমোয় অনেক জায়গা। সংগঠনের লোকজন রোজ মুরগির মতো লোকাল ট্রেনে আফিস করে। আজ পা ছড়িয়ে ফিরল সুমোয়। দুখির দাদা গেল ম্যাটাডরতলায়।

[তবুও তো পেঁচা জাগে

গলিত স্থবির ব্যাঙ আরও দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে

আরেকটি প্রভাতের ইশারায়-অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।]

কলকাতার মর্গ মানে সে এক এলাহি ব্যাপার। মফস্বলের মর্গের মতো মৃত্যুর জমাট বাঁধার অধিকার নেই সেখানে। অনবরত বডি আসছে, বডি যাচ্ছে। ঝনঝনাৎ শব্দে খুলে যাচ্ছে কোল্যাপসিবল। চারিদিক ঝলমল করছে আলোয়। বরফে, জলে, কাদায় মেঝে পেছল। তার মধ্যে দিয়ে লাশ টপকে টপকে ডোমদের আনাগোনা। শীর্ণকায়, ভীমবাহু শববাহকের দল ট্রলি করে নিয়ে আসছে ওয়ারিশ-বেওয়ারিশ সব লাশ। হরেক বর্ণ, হরেক গন্ধ, হরেক চেহারা সেই সব লাশের।হরেক তাদের মৃত্যুর ইতিহাস।

পলিথিনের মোড়ক খুলতেই আর ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ল দুখিরামকে। এতক্ষণ ধরে নিজেদের আটকে রেখে রেখে তার শরীরের প্রত্যঙ্গগুলো পরস্পর নিজেদের ওপরেই তিতি-বিরক্ত।বার বার খোলা আর বন্ধ করা, ওঠান আর নামানো আর পছন্দ করছে না তারা। প্রশস্ত টেবিলের ওপর উঠে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চাইছে এই প্রশস্ত মৃত্যু উপত্যকায়।

ডেমন্সট্রেটর, এক্সপার্ট অফ ফরেনসিক এন্ড টেস্ট মেডিসিনের নির্বিকার ইশারায় বিশ্লেষণ ত্বরান্বিত করে ফেলল লাশব্যবচ্ছেদকারীরা। নির্ধারিত প্রোফর্মায় সহকারী একজন লিখে নিল তথ্যগুলো।

কন্ডিশন অফ দ্য বডি- এডভান্সড ডিকম্পোজড।

মাথার চুল দাড়ি গোঁফ এবং নখ পচনের ফলে ঝরে গেছে।

কোমরের চারগাছি লাল এবং কালো সুতো অক্ষত।

শরীরে আঘাতের কোন চিহ্ন নেই।

স্ক্যাল্প- ডিকম্পোজড। মেমব্রেন- ঐ। ব্রেইন- ডিকম্পোজড এন্ড লিকুইফায়েড। প্লুরা- ডিকম্পোজড। পেরিকারডিয়াম- ঐ। হার্ট – ঐ। মাউথ, ফ্যারিন্স এন্ড ইসোফেগাস- ডিকম্পোজড। লার্জ এন্ড স্মল ইন্টেস্টাইন- ঐ। লিভার কিডনি-ঐ। ব্লাডার – ডিকম্পোজড এন্ড এম্পটি। অরগ্যান অফ জেনারেশন- ডিকম্পোজড। ফোরস্কিন- ঐ।

ইনজুরি- NIL ফ্রাকচার- NIL ডিশলোকেশন – NIL কেবল পাকস্থলীতে ৫০ গ্রাম পরিমাণ গাঢ় রঙিন তরল উইথ আ পানজেন্ট স্মেল। বিষতেল। প্রাণহরণকারী কীটনাশক। ঐ তেল প্যাক করে লেবেল সেঁটে কেমিকাল এগজামিনারকে পাঠানর সুপারিশ সহ অনাথবন্ধু পাটুলির হাতে তুলে দিলেন কর্তৃপক্ষ। ময়নাতদন্ত শেষ।

এখন এই পচা গাল লজঝরে টুকরো টুকরো বডিটাকে গোছাতে হবে। তুলে দিতে হবে আত্মীয়দের হাতে। শেষকৃত্য সুসম্পন্ন করবে বাড়ির লোকজন। তারজন্য আবার জোড়া দিতে হবে দুখিরামকে। চাই নতুন পলিথিন, কলাপাতা অথবা মানকচুর বড় বড় পাতা। চাই নাইলন দড়ি। সস্তা প্যাকিং কাঠের বাক্সো। প্রচুর আতর। সবই আছে ধারে কাছে। কারিগরও মজুদ। কিন্তু এটা রাজধানী। সব কিছুর মর্যাদা আলাদা। লাশ জোড়া দেওয়ার মজুরিও তাই একটু বেশি। পুরো ৫০০০।

গেজেটেড দাদা মেঝেয় বসে পড়লেন। ঘুষ না খাওয়া কর্মচারীর মাসের শেষ যেমন হয় তেমন রয়েছে দাদার। আশেপাশের থেকে ধার করে এনেছিলেন হাজার ছয়। ভেবেছিলেন হয়ে যাবে। কিন্তু এই রেট ধারনার বাইরে ছিল। ড্রাইভারদের কাউকে পাওয়া গেল না। তারা গেছে চা খেতে আশপাশেই কোথাও। দেরি করা যাবে না আর। অনাথবন্ধু পকেট হাতড়ে বললেন,

-আমার কাছে বড় জোর হবে শ পাঁচেক।

আকুতি মাখা চোখে বড় ভাই এগিয়ে গেলেন মানুষ জুড়বার কারিগরদের কাছে।কান্নায় বুজে আসা গলায় বললেন,

-ভাই একটু কম সম করে হবে না?

কালো কালো শরীরগুলো লাল লাল চোখে অর্ধনগ্ন জান্তব চেহারার কেউ কেউ এগিয়ে এল। একজন বলে উঠল,

-তু কউন হ্যায় মুর্দাকা?

-দাদা, বড়া ভাই। ক্ষুদিরাম সর্দার।

-সর্দার? সান্থাল আছিস? তব তো তুর পায়সা নাই।

-হ্যাঁ ভাই, আমার কাছে অত পয়সা নেই।

-ঠিক হ্যায়, এ চান্দুয়া, উঠ বে সাল্লা। জলদি হাত লাগা। সর্দার, তু এক কাম কর, পনদ্রাসা রুপেয়া নিকাল। তু হামার আপনা আদমি, তেরা কাম মাগনা করে দেব। স্রিরফ দারুকা দাম নিলাম- যা।

উঠে পড়ল দলটা- এগিয়ে গেল টেবিলময় ছড়িয়ে থাকা দুখিরাম সর্দারের দিকে।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য