মেঘনা চট্টোপাধ্যায়
খুঁটি ####
উনুনের সামনে পাথরের মতোন বসেছিল বকুল। কড়াইতে লাল টকটকে কীসের একটা ঝোল ফুটছে আপনমনে। সাঁড়াশি খুন্তি খসে গেছে হাত থেকে। শূন্য দৃষ্টি মেলে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
বকুল আর অলীকের সংসার চল্লিশ বছরের পুরনো। চোদ্দ বছর বয়েসে বউ হয়ে এসেছিল। বছর না ঘুরতেই অমল কোলে এলো। দুবছর বাদে কমল। সেই ছেলে, ছেলের বউ, নাতি, নাতনি নিয়ে আজ ভরা সংসার। সারাদিন তাঁত বুনে আর রেডিও শুনে দিনগুলো অলস নদীর মতো মসৃণ কেটে যায় তার। আগে সংসার সামলাতো শ্বশুর, শাশুড়ি, আইবুড়ো ভাসুর। এখন সামলায় ছেলেরা, ছেলের বউরা।
অলীক তো চিরকালের বেকার বাউন্ডুলে। আসান মল্লিকের আলেয়া হার্ডওয়্যারে ফাইফরমাশ খেটে যে কটা পয়সা পায় তাতে তার নিজেরই কুলোয় না। নেশাভাং নেই, শখশৌখিন নেই, জুয়োসাট্টা নেই। দোষের মধ্যে কেবল ওই এক - নটায় হার্ডওয়্যারের দোকানে সাটার পড়লে গুটিগুটি পায়ে কানাইয়ের বাড়িতে গিয়ে বসা। কানাইয়ের বউ সরস্বতী বকুলের থেকে অনেকটাই বড়। হলে কী হবে! তার মোমের মতো চামড়া, মাখনের রঙ, আঁটোসাটো ওথলানো গড়ন, চাবুক চাউনি আর কাচভাঙা হাসি এখনও তাবৎ পুরুষকে অবশ করতে পারে। এ হেন সরস্বতীর ক্ষীরের মতোন শরীর মেখে রোজ ঘন্টা দেড়েক টিভি না দেখলে অলীক থাকতে পারে না। সকালে দোকানে যাওয়ার আগে সরস্বতীর কাঁচা বাজারটাও এক ফাঁকে করে দিয়ে যায়। তখন অবশ্য ভালোবাসাবাসির তেমন সুযোগটুযোগ থাকেনা। কানাই অলীকের ন্যাংটোবেলার বন্ধু। তাই এ বাড়িতে তার যাতায়াত কারো চোখে লাগেনা তেমন।
কানাইয়ের ফুলের দোকান । সারাদিন বাড়ির সামনের টঙে বসে বাপব্যাটায় মালা গাঁথছে, ফুল গোছাচ্ছে, পাতা সাজাচ্ছে। জগতে আর কোথায় কী ঘটছে তা নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই। অলীক যে তাদের বাজারহাট করে দেয় , মাঝেমধ্যেই সরস্বতীকে এটা সেটা এনে দেয় – এতেই তারা কৃতার্থ।
কিন্তু বকুল তো রক্তমাংসের মানুষ। সহজাত অধিকারবোধ আর ঈর্ষার বিষ তাকে তিলে তিলে ঝলসায়। এতগুলো বছর ধরে সে কত ছলে ভোলাতে চেষ্টা করেছে ও বাড়ির পথ, পারেনি। সরস্বতীর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ফল হয়েছে উলটো। তার মুখে অলীকের সাথে তার মাখামাখির গল্প ঠারেঠোরে শুনে ঘেন্নায় তার গা ঘুলিয়ে উঠেছে। অনেক মান-অভিমান- ঝগড়া-কান্না- উপোষ- দিব্যি –মানতের শেষে বকুলের আশ্রয় ওই সারাদিনের তাঁতঘরের খটরখটর আর রেডিওর গান। এইভাবেই কেটে গেছে চল্লিশটা বছর।
কিন্তু কিছু ঘা থাকে সময়ও যার জ্বালা জুড়োতে পারেনা। বকুলের পাকা বাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, মোবাইল, খাট, আলমারি, শোকেস, সোফা, গ্যাসের উনুন। বকুলের কেজি ইশকুলে পড়া ফুটফুটে নাতিনাতনী। বকুলের ছেলে বৌরা তাকে হাতের তেলোয় করে রাখে। তবু পোড়া ঘাটা দিনরাত দগদগ করে, মাছি বসে, গাঢ় শোকের গন্ধ বার হয়। একটাই প্রশ্ন টিপ টিপ জলের ফোঁটার মতো তার বুকে অরিরাম ঝরে পড়ে, “কি ছিলোনা তার, কীসের কমতি ছিল যা ওই এঁটো লোকটাকে চিরকাল তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখলো?”
সেদিন বাড়ি ফিরে অলীক না খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়েছিল। জিজ্ঞেস করতে ভিজে ভারী গলায় বললো, শরীর ভালো নেই। পরে পাড়ার গেজেট ফুলি কথায় কথায় বলেছিল , সরস্বতীর বুকে ক্যানসার হয়েছে। হবেই তো। জয় মা! তোমার বিচার বড় সূক্ষ্ম । যে বুকের গর্বে সে থৈ থৈ করতো তাই আজ বাদ গেলো বলে। এবার কি নিয়ে খেলবি খেল।
ব্যাপারটা এত সহজে মিটলো না অবশ্য । রোগ ধরা পড়েছে লাস্ট স্টেজে। অলীক কাজকর্ম, সংসারধর্ম ভুলে দিনরাত কেবল হাসপাতাল ঘর করতে লাগলো। সরস্বতীর সময় বেশী ছিল না। রোগ ধরা পড়ার আড়াই মাসের মাথায় চিরতরে উপড়ে গেলো বকুলের সতীনকাঁটা। খবরটা কানে পৌঁছোতে স্থবির হয়ে গেলো সে। আজ অনেকদিন বাদে হেঁসেলে ঢুকেছিল তরিবৎ করে খাসির মাংস রাঁধতে। ফুলির মুখে খবরটা শুনে কেমন ব্যোমভোলা হয়ে গেলো। হাত থেকে খসে পড়লো সাঁড়াশি-খুন্তি ।
কর্তব্যের খাতিরে দেখতে যেতেই হল। উঠোনের মাঝখানে খাটে শোয়ানো তার জন্মশত্তুর সরস্বতী। এই কদিনেই পোড়া কাঠের মতন হয়ে গেছে। ন্যাড়া মাথায় কৌটো উপুড় করে সিঁদুর পরানো। পরনে হাওয়াই গোলাপি জামদানী। হয়তো অলীকেরই দেওয়া। আলতা ডোবানো পায়ে মোটা মোটা রূপোর খাড়ু। হয়তো ...... । বলো হরি হরি বোল, বলো হরি ......। মুখে কাপড় ঠুসে বসে থাকা বকুলের বুক মুচড়ে একটা বিকৃত গোঙানি বেরিয়ে এলো। ছেলেরা বিস্মিত হয় – সরস্বতী মরলও তো বকুলের কি ! কমল মাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে ওবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। অমল টোটো ডেকে আনে। বকুলের কান্না বেড়েই চলেছে। যেন বাঁধ ভেঙে ভেসে যাচ্ছে একটা আস্ত জনপদ। বাড়ি ফিরে দেখে অলীক তাঁতঘরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে পড়ে আছে মরা গাছের মতো। প্রেম তো বহুদিন গেছে, এবার তার ওপর থেকে সব ঘৃণাও চলে গেলো বকুলের। প্রেমহীন ঘৃণাহীন এই আদিগন্ত নিস্পৃহা নিয়ে কি করে বাঁচবে বকুল। নিজেকে এত নিঃস্ব লাগে তার। সে ফুলে ফুলে কাঁদে। অলীক আর তার সন্ততিরা অবাক হয়ে দেখে বকুলকে। আর বকুল দেখে তার সমস্ত প্রেম-প্রত্যাখ্যান-অবহেলা-অপমান-ঈর্ষা আর ঘৃণা আঁচলে বেঁধে চন্দনের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে স্বর্গে উঠছে এক মাখন রঙের স্বৈরিণী। হারা পাশার দান আঁকড়ে ডুকরে ওঠে বকুল, “আমি কি নিয়ে থাকবো বলো, আমি কি নিয়ে থাকবো”। ঘৃণাও তো একটা বন্ধন – আজ অলীকের সাথে তার সেই বন্ধনটুকুও ছিন্ন হল । তাঁতঘরের এফএমে বেজে চলে, “মন বলে আমি মনের কথা জানি না”।
খুব ভালো লেগেছে। এক্কেবারে অন্যরকম।
উত্তরমুছুনঘৃণাও একটা বন্ধন,উফ্ কি অদ্ভুত।খুব সুন্দর গল্প।
উত্তরমুছুনমৌ আর সৌমী, আদর তোদের
উত্তরমুছুনগায়ে কাঁটা দিলো মেঘনাদি। উফঃ কি অদ্ভুত অনুভূতির প্রকাশ।
উত্তরমুছুনভালোবাসা
মুছুনঅপূর্ব লাগলো!
উত্তরমুছুনদারুন গল্প, খুব উপভোগ করলাম।
উত্তরমুছুন