ডঃ পার্থ প্রামাণিক


বেনারসে ফেলুদার খোঁজে ### 

'ফেলুদা চলে গেলেন'। না,  শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়ানকে আমি মোটেও এভাবে দেখতে রাজি নই। কারন, ফেলুদা অমর, তার বিনাশ নেই, থাকতে পারে না। শ্রী রায়ের এ এক এমনই সৃষ্টি যা শ্রষ্টার মৃত্যুতেও শেষ হয়ে যায় না। তবে এটা মানতেই হবে ফেলুদাকে যিনি আমাদের সামনে প্রথম চলমান অবস্থায় হাজির করেছিলেন তিনি অবশ্যই সৌমিত্রবাবু।

পরবর্তীতে অন্য সুযোগ্য অভিনেতা ফেলুদার ভূমিকায় এলেও এই চরিত্রে সৌমিত্রবাবুর আবেদন সম্ভবত বাঙালীর কাছে সবচেয়ে বেশী। কালের নিয়মে তিনি আজ পরলোকগত। তাঁকে যথাযত শ্রদ্ধা জানানোর যোগ্যতা আমার নেই। বছর দুই আগে কাশী বা বেনারস গিয়েছিলাম মূলত 'জয়বাবা ফেলুনাথ' ছবির সুটিং স্পটগুলি দেখতে। সেই দেখাটাই আপনাদের দেখাবার চেষ্টার মাধ্যমে শ্রদ্ধেয় অভিনেতাকে আমার শ্রদ্ধা জানানো।

বেশ কয়েকবার কাশী গিয়েছি। কখনো বাবা-মায়ের সঙ্গে, কখনো স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে। বছর দুই আগে গিয়েছিলাম একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। উদ্দশ্য 'জয়বাবা ফেলুনাথ' ছবির সুটিং স্পটগুলি খুঁজে বের করা ও দেখা। হোটেলে পৌছে একজন গাইডের খোঁজ করলাম, পেয়েও গেলাম। হোটেলেরই এক বাঙালী কর্মচারী। ভদ্রলোক স্থানীয় মানুষ। অনেক সাহায্য করলেন, অলিগলি চিনিয়ে দিলেন। হাজির করলেন মগনলাল মেঘরাজের বাড়িতে। আসুন একে একে দেখে নিই সেই সব জায়গা, যেগুলি স্বনামধন্য প্রোদোষ সি মিটার ও তাঁর শ্রষ্টা শ্রী সত্যজিৎ রায়ের উজ্বল উপস্থিতির সাক্ষী।

"আপনি বয়ঃজেষ্ঠ, আপনিই করে দিন........."

ক্যলকাটা লজের খাতায় সই করার দায়িত্বটা লালমোহন বাবুকেই দিয়েছিলেন ফেলুদা। এই লজটির কথা গল্প ও ছায়াছবিতে থাকলেও বাস্তবে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে এই রকম নামে কোন ভ্রমনার্থী-বাসস্থান নেই। 'দশাশ্বমেধ বোডিং হাউস' বলে একটি থাকবার জায়গা আছে এবং সেখানকার লোকেরা এটিকে সুটিং স্পট বলে দাবি করলেও ক্যালকাটা লজের কোন  অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। এরপর আসি দ্বারভাঙ্গা ঘাটের কথায়, সেই বিখ্যাত ঘাট যেখানে দর্শন দিতেন মছলিবাবা। ঘাটের পাশেই সেই খাড়াই সিঁড়ি যা দিয়ে পরচুলা বিহীন মছলি বাবাকে অনুসরন করে উপরে উঠে যায় ফেলুদা। আবিস্কার করে ফেলে বাবার আস্তানা আর সেখানে ঢুকবার গোপন দরজা। এসবই আজও অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে কিন্তু বাবাজীর গোপন আস্তানা, যেটি আসলে দ্বারভাঙ্গা প্যালেসের একটি অংশ সেটি এখন এক বিলাসবহুল হোটেল, তাই সাধারনের অগম্য। দ্বারভাঙ্গা ঘাটের পাশেই রানামহল ঘাট যেখান দিয়ে ফেলুদার মক্কেল ঘোষাল বাবু সস্ত্রীক মছলিবাবার দর্শনে এসেছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় যেন ছবির ফ্রেমের  মধ্যেই ঢুকে পড়েছি। যে কোন সময় থ্রি-মাস্কেটিয়ার্সের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।

"আমার আরেকটা অস্ত্র আছে.......মগজাস্ত্র......" 

মনে পড়ে ফেলুদার বেনারসের মক্কেল ঘোষাল বাবুদের বাড়ির কথা? বেনারসের নাগওয়া লঙ্কা এলাকায় বাড়িটি। বাড়িটির একতলায় এখন লিটল ফ্লাওয়ার হাউস স্কুল। বাড়ির বর্তমান মালিকের পরিবার থাকেন দোতলায়। অনেক অনুরোধে বাড়িতে ঢোকবার অনুমতি পাওয়া গেলো। বর্তমানে বাড়ির চত্বর অনেক ছোট হয়ে গেছে, গঙ্গা অনেকটা দূরে সরে গেছে তবে বাড়ির ছাদ ও ছাদে বিখ্যাত রুকুর ঘর একই রকম রয়ে গেছে। ওটি এখন বাড়ির ঠাকুর ঘর হিসাবে ব্যবহার হয়। ওই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে যেন শুনতে পেলাম...." আমার আরেকটা ......."

"আমি ঘুষ নিই না মগনলালজী......."

এবারের গন্তব্য মগনলাল মেঘরাজের বাড়ি। নীল সার্টের সঙ্গে ফেলুদারা যে জ্ঞানবাপীর রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল সেখান দিয়ে যাওয়া বর্তমানে মুশকিল। ক্যামেরা দূরের কথা, পেন নিয়েও যাওয়া চলবে না, এতই নিরাপত্তার কড়াকড়ি। তাই বাঙালি টোলার দিক দিয়ে মগনলালের বাড়ির রাস্তা ধরলাম। পাঁড়ে হাওলির সেই গলি যেখানে বেনারসের রাতের অ্যাটমসস্ফিয়ার বুঝতে গিয়ে জটায়ুর সাহসের স্টক ফুরিয়ে গিয়েছিল বা শশীবাবুর ছুরিকাহত হবার গলি সবই একই রকম রয়ে গেছে। এখানেই রয়েছে সেই বাড়ি যেটি মগনলাল মেঘরাজের বাড়ি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে বাড়িটির ভেতরের অবস্থা বেশ করুন। বিবর্ণ থাম, নেমে আসা বটের ঝুড়ি মন খারাপ করে দেয়।

"আপনার কোমরে যেটা সুড়সুড়ি দিচ্ছে সেটা আগেয়াস্ত্র, অতএব.......".

ছবির ছোট ভিলেন বিকাশ সিংহকে ফেলুদার গ্রেপ্তারের দৃশ্যটি মনে আছে? ঠাঠেরি বাজারের রাম ভান্ডারের বিকাশবাবুর পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে ধরে ফেলুদা। গলিটি একই রকম থাকলেও দোকানে সেই সাবেকি চেহারা আর নেই। এখন একটি শ্রী যোগ হয়েছে নামের আগে। এরপর বিকাশবাবুর দোষ কবুল করার জায়গা মানমন্দির ঘাটের মানমন্দির। খুব সুন্দর ভাবে সংরক্ষিত জায়গাটি। 

লেখার শুরুতে বলেছিলাম ফেলুদা অমর, তার বিনাশ নেই। এখন এই লেখা লিখতে লিখতে বেনারসের অলিতে গলিতে ফেলুদার সন্ধানে ঘোরার স্মৃতি টাটকা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে শুধু ফেলুদাই অমর নন। তার শ্রষ্টা শ্রী সত্যজিৎ রায় ও চরিত্রের রুপদানকারী শ্রী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এই দুটি নামও অমরত্ব লাভ করেছে। বাঙালী যতদিন বাঙলা পড়তে পারবে, বাঙলা বুঝতে পারবে, তারা বেনারসে বেড়াতে গিয়ে কেদার ঘাটের আটকোনা বুরুজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে অবশ্যই শুনতে পাবে মগনলালের হাতে লালমোহন বাবুর হেনস্থা হবার পর ফেলুদারূপী সৌমিত্রবাবুর সেই প্রতিজ্ঞা " আমি হয় এর বদলা নেবো, না হয় গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে দেব"।

কীভাবে যাবেন- 

শিয়ালদহ এবং হাওড়া থেকে বেনারস যাওয়া যায় ১৩১৩৩ শিয়ালদহ-বারানসী এক্সপ্রেস, ১২৯৮৭ বিভূতি এক্সপ্রেস, ১৩০০৯ দুন এক্সপ্রেস, ১৩০০৫ পাঞ্জাব মেল প্রভৃতি ট্রেন। এছাড়া মুঘলসরাই(পন্ডিত দিনদয়াল উপাধ্যায়) যায় এমন ট্রেনে সেখানে পৌছে সেখান থেকে অটো বা গাড়িতে বেনারস পৌছনো যায়।

কোথায় থাকবেন-

বিশ্বনাথ মন্দির তথা দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে থাকতে হলে হোটেল সাহু(০৫৪২২৪৫৫৪১১), হোটেল গ্যাঞ্জেস(০৯৪৫২৪০৬৫২৪), দশাশ্বমেধ বোডিং হাউস(০৫৪২২৪০১৭০১)। এছাড়া বেনারসে প্রচুর হোটেল ও ধর্মশালায়েছে। গোধুলিয়া মোড়ের কাছে ভালো বাঙালি খাবারের দোকানও আছে।

ছবি :

 

মানমন্দির

ঠাঠেরী বাজারের শ্রীরাম ভান্ডার
পাঁড়ে হাউলির গলি
শশীবাবু খুন হবার গলি



মছলিবাবার ডেরায় যারার গোপন দরজা

দ্বারভাঙ্গা ঘাটের সিঁড়ি

রানামহল ঘাট

ঘোষাল বাড়ি

ঘোষাল বাড়ির ছাদ ও রুকুর ঘর

আটকোনা বুরুজ সহ কেদার ঘাট

জমজমাট দশাশ্বমেধ ঘাট

কাশী বিশ্বনাথের গলি

 

মগনলালের বাড়ি বাইরে থেকে

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য