অসিত মণ্ডল


খাঁড়ি

কৈখালি খেয়াঘাটে তখনও খেয়া পারাপার শুরু হয় নি।রাত ফিকে হয়ে ভোর হয়েছে সবে।চারিদিকে হালকা নরম আলোর আভা। ওপারে ঝাপসা সবুজ জঙ্গল।পাড়ে বাঁধা 'বাবা দক্ষিণ রায় 'খেয়া নৌকার তলায় অজস্র ঢেউ কুচির আলতো আঘাতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ মিশে যাচ্ছে নদীজল ছুঁয়ে আসা হিমেল বাতাসে।

নৌকা ভাসিয়ে দিল ওরা তিনজন।
পরাণ, নকুড় আর ইসমাইল।
'আজ কোন দিকি যাবা, পরাণদা?'  জিগ্যেস করে নকুড়।
'যাব নি, বিদ্যেধরী পেরোয়ে। দেকি।'
'বেশি ভিতরি যেও নি। তুমার তো আবার লিশা লেগি যায়।'
ইসমাইলের একথার জবাবে পরাণ কি বলে তা বোঝা যায় না।
যে যার গতিতে জল কেটে এগিয়ে যায়। মাতাল মাতলা পেরিয়ে চলে যায় অনেকটা জলপথ।
পোড়খাওয়া মাঝির মত অনায়াস দক্ষতায় নৌকার মাথা ঘুরিয়ে দেয় পরাণ।নকুড় আর ইসমাইল তখন তার দৃষ্টিসীমার বাইরে । ফুলে ফেঁপে ওঠা বিদ্যেধরীর ঘোলা জল ছেড়ে পরাণ এবার খাঁড়ির মুখে।থিকথিকে জল কাদার ওপর দিয়ে ধীরগতিতে গা-ঘিনঘিনে চেহারার বিকট কুমীর যেভাবে বাদা বনের ডাঙায় বুকে হাঁটে, সেভাবে নৌকা নিয়ে নালা ধরে বনের অন্দরমহলে সেঁধিয়ে যেতে থাকে পরাণ।
সরু নালার দু 'ধারে গরান গেঁওয়া হোগলার জটলা ক্রমশ ঘন হচ্ছে। জলের ধার ঘেঁষে কাদায় গাছ গাছালির জড়ানো মোচড়ানো শেকড় দেখে দূর থেকে প্যাঁচানো সাপ বলে ভ্রম হয়। গাছ পাতার ফাঁক ফোঁকর চুঁইয়ে পড়া আলো ছায়া কাটাকুটি খেলে।কাদা ফুঁড়ে উঁচিয়ে আছে অজস্র শ্বাসমূল। যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীকুল তীক্ষ্ণ নজর রাখছে তাদের নিজস্ব খাসতালুকে চোরাশিকারীর মত ঢুকে পড়া মানুষটার ওপর। গা গোলানো আঁশটে গন্ধের সাথে জল কাদা জঙ্গলের উগ্র বুনো গন্ধ মিলে মিশে একাকার। আপাত নিরীহ জলপথ জুড়ে এক অদ্ভুত গা ছম ছম করা নিথর নিস্তব্ধতা।
--  নয় নয় করি তা প্রায় বছর দশেক হতি এলো।এই বিদ্যেধরী, হেড়োভাঙা, মাতলা নদীর অথৈ জল, বাদা বন এসব যেন পরাণের জেবনের সনে এঁটুলির মত সেঁটি গেচে ।বাপটার ছবি চোখে ভাসে,  নদীর বুকে ছুঁয়ে থাকা ভোরের কুয়াশার মতন ঝাপসা । মউলি ছেল বাপ। পরাণ তখন এত্তোটুকুন। বাবা দক্ষিণ রায়ের লজর পড়ায় মধু ভাঙতি গে বাপ আর বাড়ি ফেরে নি।মাটা যে কুতায় চলি গ্যালো, তার হদিশ মেলল না।
নৌকা থামিয়ে ঝপাং করে জলে নামল পরাণ।গায়ে ছেঁড়া ফাটা গেঞ্জি।পরনে একরত্তি নেংটি।মাথায় গামছা প্যাঁচানো। মিশকালো পেটাই চেহারা। পাথর -কোঁদা মূর্তির মত টান টান পেশিতে বাদা বনের আধো -আলো পিছলে যায়।
নৌকার রশিটা শক্ত করে বাঁধে গাছের সাথে। অনুগত পোষ্যের মত নৌকাটা কাঁপতে কাঁপতে একসময় স্থির হয়ে যায়।তাগড়াই মানুষটার এক হাতে একটা লোহার শলা।অন্য হাতে তীক্ষ্ণ ফলার কোঁচ।
--- শালারা সব দল বেঁধি গত্তের মধ্যি লুকোয়ে আছে।টেনি টেনি বের কত্তি হবে উনাদের।
পরাণের চোখে মুখে খুশি  ঝিলিক মারে।ঠিক জায়গায় এসেছে।এসব নালা তার হাতের তালুর মত চেনা।আর গর্তের ধরন দেখেই বলে দিতে পারে কোন গর্তে কাঁকড়া আছে। সারা কৈখালি ঝড়খালি এলাকায় কাঁকড়া ধরায় তার মত নাম ডাক আর কারুর নেই।
খালুই ভরে গেলে ফের নৌকায় ওঠে পরাণ।একটু জিরিয়ে নেয়।গায়ের গেঞ্জিটা ভিজে সপসপে।একনাগাড়ে জলভেজা ঠান্ডা বাতাস বইছে।মাঝে মাঝে কাঁপুনি দেয় শিরশিরিয়ে। একটা বিড়ি ধরায় পরাণ।টান দিতে থাকে একমনে। বাতাসে ভাসিয়ে দেয় তামাক পোড়া ধোঁয়ার কুন্ডলী ।ভাবনার বুজকুড়ি কাটে মনবসতে।
--- সেই একরত্তি বয়েস থেকি পরাণ গোপীমোহনের বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটে। দুবেলা দুমুঠো খেতি দিয়ে লোকটা তারে তো বাঁচায়ে রেকিচে। খুব ভালোমানুষ। এলাকার নোকজন মান্যিগন্যি তো কম করে না। কৈখালি বাজারে তো গোপীমোহনের মাছ কাঁকড়ার আড়তেই এখন রমরমা। জমি জিরেতও কম নেই। তবে গুপীদা সক্কলির কাছেই বলে, পরাণ না থাকলি আড়তের এত বাড়বাড়ন্ত হতো নি। শুধু কি আড়তের কাজ করে আর মাছ কাঁকড়া ধরে পরাণ? বাজার ঘাট করা, ওষুধ পথ্যির যোগান, এ কাজ সে কাজ ---সবতাতেই পরাণ। নয়নতারা এ বাড়িতে বৌ হয়ি আসার পর থে, তার কাজ আরও বেড়ি গেছে । লয়নবৌদির সনে বন বিবির থানে পুজো দিতি যাওয়া, মেলায় যাওয়া ---কোন কাজটা না করে পরাণ? গুপীদার সময় কুতায়। আড়ত থেকি বাড়ি এসেও মোটা মোটা খাতা পত্তর নিয়ে বসি যায়। বন্ধকী কারবারে টাকা ধার নিতি, শোধ দিতি নোকজন আসে সব। এই পরাণ না থাকলি, চোখি সষ্যি ফুল দেখতি হতো।
ভাবনায় ছেদ পড়ে পরাণের।একটা খসখস আওয়াজে কান খাঁড়া।তীক্ষ্ণ নজর ঘুরে বেড়ায় পাড় ঘেঁষা জঙ্গলে, গাছগাছালির জটিল জটলায়, নিথর নিস্পন্দ জলধারায়।জল ঢোঁড়া সাপগুলো জল কেটে চলেছে। ওসব ঢ্যামনা সাপকে পাত্তা দেয় না পরাণ। ছোট ছোট আ -মাছা গিলে নির্বিষ হেলে সাপগুলো কাদার মধ্যে লুটোপাটি খাচ্ছে। এসব জঙ্গলে সাক্ষাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে জলের ওপর ঝুঁকে পড়া ডালপালা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে এগিয়ে আসে কালচে জলপাই রংয়ের বিষাক্ত শঙ্খচূড়। গত মরশুমে এমনি একদিনে ক্যাঁকড়া ধরছিল পরাণ। বৃষ্টি পড়ছিল টিপ টিপ করে। একদম চুপিসারে এগিয়ে আসছিল হাত পাঁচেক লম্বা এক বিশাল কালসাপ। মুহূর্তে সতর্ক হয়ে সজোরে হাতের কোঁচ ছুঁড়ে দেয় পরাণ। অব্যর্থ নিশানায় সাপটার পেট এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। ফিরে এসে গুপীদাদাকে, নয়নতারাকে সব বলে পরাণ।সব শুনে ভয়ে শিউরে উঠেছিল নয়নতারা।
এই তো কদিন আগের কথা । নয়নতারা সাবধান করে দেয়।
' তুমি আমারে কতা দাও। আর ওই জঙ্গলে যাবা না। '
পরাণের মায়াবী চোখে চোখ রেখে বলেছে তার লয়নবৌদি।
' না গেলি হবে? তুমার আড়তদারের আড়ত চলবে কি করি। রোজ যা ক্যাঁকড়া জমে তার অধ্যেক তো আমিই ধরি লয়নবৌদি।'
' তা হোক, তুমি যাবা না।শুনিচি ওরা নাকি জোড়ে থাকে।তুমি একখান মারি ফেলিচ।আর একখান তক্কে তক্কে তুমারে খুঁজতেচে।তুমারে ছাড়বেনি। আমি বন বিবির থানে পুজো দে আসব।নক্কিটি কতা দাও। তুমি ওই নালায় আর যেওনি।'
নয়নতারার চোখ ছলছল। পরাণের মাথাটা বিদ্যেধরীর মত উথলে ওঠা বুকের নিভৃত খাঁজে চেপে ধরে পরম আশ্লেষে। বিলি কাটতে থাকে পরাণের এলোমেলো চুলে।
গোপীমোহন তখন দাওয়াই ব্যস্ত তার সান্ধ্যকালীন বন্ধকী কারবারে।
নাঃ। তেমন কিছু চোখে পড়ল না। ভয় ঝেড়ে ফেলে লগি চালিয়ে নৌকা এগিয়ে নিয়ে চলে পরাণ জল জঙ্গলের আরও গভীরে। গাছ লতা পাতার ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আকাশে চোখ রাখে। মেঘের রং কালচে ধূসর।রোদের চিক চিকানি উধাও। মনমরা হালকা আলোর চাল ধোওয়া জল রং।
পাঁচ পাঁচটা বছর গড়িয়ে গেল। তার থেকে অনেক কম বয়সি নয়নতারাকে বিয়ে করে এনেছে গোপীমোহন। শত চেষ্টা চরিত্তির করেও নয়নতারার কোল ভরাতে পারে নি। জড়িবুটি শেকড় বাকর মাদুলি তাবিজ তো কম করে নি।কিন্তু যে কে সেই। বাসন্তী বাজারের নজু ডাক্তার কি সব ভুজুং ভাজুং ওষুধ দিয়ে বলেছে,
'লেগি থাকুন দাদা, একদিন ঠিক হয়ি যাবে নে। '
একদিন রাতে কিছুতেই দুচোখের পাতা এক হয় না পরাণের।শক্ত বিছানায় শুধু এপাশ ওপাশ গরান মারে। চোখ বুজলেই নয়নতারা বৌদির ডাগর চোখ আর নধর স্তনজোড়া। গুটি গুটি পায়ে নিজের ঘর ছেড়ে গোপীমোহনের শোবার ঘরের পেছনের জানালার ফাঁকে চোখ পাতে পরাণ। ঘরের ভেতরে আবছা আলো আঁধারে দুজন মানুষ মানুষির অস্ফুট কথন।নয়নতারার পরনে সুতোটি নেই। আর ধুমসো গোপীমোহনও উদলা। হঠাৎ ক্যাঁৎ করে এক লাথি কষায় নয়নতারা গোপীমোহনের মাজায়। পাথর -গরান খেয়ে সটান গড়িয়ে মেঝেয় পড়ে গেল গোপীমোহন।
'ঢ্যামনা, আধবুড়ো। বিষ নেই তার কুলোপানা চক্কর। এক ফোঁটা মুরোদ নেই। মদ্দা ফলাতি এয়েচে। আর কখখুনো আসতি পারবা না আমার শরীলে।'
নয়নতারা উদোম শরীরে কাটা পাঁঠার মত ছটফট করতে থাকে বিছানায় ।
গোপীমোহন শুধু হাঁপায় আর গোঙায়। তার ইচ্ছে হয়।   ন্যাতানো  নিস্তেজ নিষ্কর্মা অঙ্গটা ছিঁড়ে মাতলার জলে ফেলে দিয়ে আসে এখনই।
পরাণ ফিরে যায় নিজের ঘরে। তার শরীরের আনাচ কানাচ, খানা খন্দ বর্ষার প্রথম জলে ভেজা জঙ্গলের গাছ গাছালির মত এক অজানা শিহরণে আলোড়িত হতে থাকে রাতভর।
বাদা বনের জল জঙ্গল পরাণকে নিশিডাক ডাকে। অনিবার্য এই ডাক ফেরানোর সাধ্য তার নেই। তার কেন এই কৈখালি ঝড়খালি এলাকার দরিদ্র হতশ্রী গ্রামের পর গ্রামের মানুষের কারুরই নেই। কম মানুষ তো গেল না জঙ্গলের বাঘের পেটে। চেনা জানা কত জনের পা কেটে নিয়ে গেল রাক্ষুসে কুমীর কামটে। তবু কি বন্ধ আছে মীন ধরা ? মাছ কাঁকড়া ধরা ? ঘরে বসে থাকলে কি চলে মউলিদের ? কখন যে কার জীবনে ছেদ পড়ে কেউ জানে না।
কাল ছিল হাটবার। গোপীমোহনের আড়তে ভিড়ে ভিড়াক্কার।মাছ কাঁকড়ার যোগানদারে খরিদ্দারে ছয়লাপ। গদিতে বসে চালান দিয়ে টাকা জমা নেয় গোপীমোহন। নিলামদার দর হাঁকে। ছেঁকে ধরে পাইকারের দল।
পরান আনাজপাতির ব্যাগ হাতে বলে,
'গুপীদা, বৌদি নারকোল নিতি বলিছে। গলদা চিংড়ি দে রাঁধবে।'
'তা হাঁদার মত দাঁড়াই আছিস যে? যা লাগবে নিয়ে যা। বেলা হয়ি গ্যালো। আবার কখন রাঁধবে? '
পরাণ বাড়ি পৌঁছে বাজারের ব্যাগ নামাতেই নয়নতারা খেয়াল করে পরাণের মুখটা কেমন শুকনো ভাব।
'লিশ্চয় তুমি জলখাবার খাও নি ? সব কি আড়তের আদার বাদাড়ে খেয়ি নেচে? '
' না গো, লয়নবৌদি, তা কেন? একদিন এট্টু কম খেলি আর কি এমন ক্ষতি হয়? '
নয়নতারার চোখে আজ যেন অন্যরকম ইঙ্গিত টের পায় পরাণ এই ভরদুপুরে।
এক ঝটকায় নয়নতারা পরাণের শরীরটাকে কুমীর -গেলা করে কব্জায় নেয়। কাঁকড়ার সুগভীর হাঁড়ায় লোহার শলা ঢোকানোর মতোই পরাণ অবলীলায় সেঁধিয়ে যায় তার লয়নবৌদির আগ্রাসী গভীরে তার পৌণঃপুণিক ক্ষিপ্রতায়।
ঝড় থেমে গেলে আহ্লাদী স্বরে নয়নতারা বলে,
' কাল তো আবার খাঁড়িতে যাবা। কিন্তুক এট্টু আগে ফিরা আসবা। বন বিবির থানে পুজো দিতি যাবো। ভালো একখান খপর আছে।'
পরাণ শুধু হাসে।বলে,' আমার জেবনে আবার, ভালো খপর! '

সেই এত্তোটুকু বয়স থেকে বাপ মা হারা ছেলেটাকে ঠাঁই দেয় গোপীমোহন নিজের বাড়িতে। যতদিন তার নিজের মা বেঁচে ছিল ছেলেটাকে ছাড়াতে দেয় নি। মা চলে যাওয়ার আগে বলে গেছিল,' গুপী, ছেলিডাকে তাড়াস নি কুনদিন। বড্ড মায়া নাগে রে। '
গোপীমোহন আশ্বস্ত করেছিল। তারপর থেকে হাতে ধরে সব কাজ শেখায়। এখন তো তাগড়াই চেহারা। ছোটবেলার রোগা প্যাঁটকা ছেলের এখন গা গতরে চেকনাই। ইদানিং অমন মন শরীরে ফুরফুরে খই ফোটা ভাবের কারণ কি জানে না আড়তদার গোপীমোহন? সব বোঝে। আড়তে কাজের ফাঁকে কানা ঘুষো চলে।
'গুপীদা আছে ভালো। ঘরে অমন ফুলকচি ডবকা বৌ। শেয়াল বেঁধি বাঙির খেতি পাহারায় দেছে।'
' রাখ তো, তুমার কতা। আগের বৌডা তো কবেই ভাগিছে। এডাও যাবে। যৈবনবতী মেয়ি সোয়ামি সোহাগ ছাড়া কি থাকতি পারে? পরাণরে  ঠেকা দি যে কদিন রাখতি পারে।'
গোপীমোহন শুনেও শোনে না এসব কথা।
--- বৌটারে ঠিক রাখতি হলি পরাণ ছাড়া আর উপায় কি। এ জেবনে তার আর নিজির খ্যামতায় কিছু হবে নি।আজ যেন সত্যিই নেশায় পেয়েছে পরাণের। নৌকার খোলে আধ মড়া মাছগুলো খাবি খাচ্ছে। জাল দিয়ে মুখ বাঁধা খালুইয়ে বড় সাইজের নোনা কাঁকড়াগুলো দঙ্গল পাকিয়ে খচরমচর করছে।
খাঁড়িটা এখানে বাঁক নিয়ে ঢুকে গেছে জঙ্গলের বুক চিরে আরও গভীরে।আকাশের অবস্থা মোটেই ভালো ঠেকছে না। দেখতে দেখতে নিকষ কালো জলমেঘে ছেয়ে গেল। দোমড়ানো মোচড়ানো জট পাকানো কাদায় বের হয়ে থাকা গাছের শেকড়গুলো যেন জটিল রহস্যময় আবর্ত, যার থেকে বের হওয়া কঠিন। গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে নিরন্তর চুঁইয়ে পড়ছে উৎকট বুনো গন্ধের বিষাক্ত অন্ধকার।
আবার সেই খস খস সড় সড় চাপা শব্দ। সতর্ক হয়ে নৌকা থামায় পরাণ। সম্বিত ফিরে পায় সে। নয়নতারার কথা মনে পড়ে যায়। বাড়ি ফিরে বন বিবির থানে যেতে হবে। কিন্তু এ কোথায় চলে এসেছে সে! ওটা কি সেই গরান গাছ? এটা কি সেই কালচে জলপাই রংয়ের বিষধর শঙ্খচূড়ের ডেরা? গাঢ় সবুজ পাতার জটলার মধ্যে  কি ওটা?
হাড় হিম করা ভয়ের এক চোরাস্রোত সহসা তার শির দাঁড়ায় শিরশিরানি তুলে তাকে কমজোরি করে দেয়। হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে যায়।
এবার আর সে হাতের কোঁচ ছোঁড়ার ফুরসত পায় না।
একটা তীব্র আর্তনাদ আর চাপা গোঙানির শব্দ নিথর নীরবতাকে মুহূর্তে খান খান করে চারিয়ে যায় জল জঙ্গলের অগম গভীরে।
সন্ধ্যা নামতেই কৈখালি জুড়ে ঝুপসি অন্ধকার ।
হ্যারিকেনের টিমটিমে আলো জ্বেলে দাওয়ায় বসে আছে আড়তদার গোপীমোহন। তক্তাপোশে লাল কাপড়ে বাঁধাই করা খানকয়েক খেরোর খাতা। খাতা থেকে মুখ তুলে মাঝে মাঝেই উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে থাকছে পথের দিকে।
সদ্য পোয়াতি নয়নতারা সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে দেয় উঠোনের তুলসীতলায়।
হন্ত দন্ত হয়ে আসে নকুড় আর ইসমাইল। ' বিষ -কোঁচ মেরে এক্কেবারে সাবড়ে দিয়েছি গুপীদা ', হাঁপাতে হাঁপাতে এক নিঃশ্বাসে বলে নকুড় ।
গোপীমোহন ওদের দুজনের হাতে বন্ধকী জমির দুখানা দলিল ফেরত দেয়।
--- কাল সকালে বাসন্তী থানায় একখান মিসিং ডাইরি করতি হবে। সিখানেও কিছু খচ্চাপাতি আচে। থানার বড়বাবু যেন মাতলার কুমীর।
নয়নতারা সবার জন্য লিকার চা আর মুড়ি আনে।
তার দুচোখের চাহনিতে আপাত -খুশির সংযত ঝিলিক, অথচ বুকের গহিনে কি এক দূঃসহ ব্যথার মোচড়।

মন্তব্যসমূহ

  1. ভয়ংকর...... অদ্ভুত লেখা।ভীষণ ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  2. নিপুণ লেখনি গল্পের বুননে। লৌকিক আঙ্গিকের প্রতিবেশটি বেশ সুন্দর করে রচনা হয়েছে। ভালো লাগবে সকলের।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য