সোমা কুশারী

 নাবাল
বিকেলের একটা গন্ধ আছে। কেমন একটা মনখারাপি গন্ধ! আস্তে আস্তে বিকেলের রোদ মরে আসে ছায়া সরে যায় ঠিক তখুনি ঘরে বসে সতীশ গন্ধটা পান।


বারো বাই দশের এই ঘরটায় ইংলিশ খাটে আধময়লা চাদরের উপর বসে থাকতে থাকতে কেমন একটা জড়তা কাজ করে আজকাল। উঠে ঘর লাগোয়া বারান্দাতেও যেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু কতক্ষণই বা এভাবে বসে থাকা যায়? পায়ের গোছ ফুলে ওঠে অনেকক্ষণ পর উঠে বাথরুমে যেতে হলে ঝিঁঝিঁ লাগে পায়! তবু চুপ করে বসে থাকেন সতীশ। বুলির মেয়েটা স্কুল ফেরত সোজা চলে আসে এ বাড়ি। শাঁওলির কড়া নির্দেশ, বিকেলে চা- টুকু করে সতীশের সামনে ধরে টিভি খুলে দেয় মেয়েটা। বরাদ্দ দুটো ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কুট বাড়িয়ে দেয়। কোনো কোনো দিন ইচ্ছে হলে সতীশ পয়সা বার করে দেন মেয়েটা এক ছুটে সামনের দোকান থেকে দু তিনখানা আলুর চপ বা বেগুনি আনে। দুজনে খান। অবশ্য সতীশ আজকাল কোনোকিছুরই তেমন কোনো স্বাদ পান না। ঐ মাড়ি দিয়ে কামড়ে চিবোতে থাকেন। যেমন আজ, মেয়েটা বসে বসে আয়েশ করে আলুর চপ খেলেও সতীশ একটুখানি ভেঙে হাতের ঠোঙায়-ই রেখে দেন। চপের তেল চুষে ঠোঙাটা কেমন জবজবে হয়ে ওঠে মন দিয়ে দেখেন। বিকেল গড়িয়ে ঘোর সন্ধ্যে নেমে আসে। ঝুপ করে ঘরটা অন্ধকার হয়ে যায়। আশপাশ থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসে। শাঁখের শব্দে হুশ করে কারো শ্যামলা একহারা চেহারাটা চোখের সামনে অল্প একটু দুলে ওঠে। সতীশ স্মৃতি হাতড়ান। 

রিক্তা নেই আজ একুশ বছর। সতীশ তখন সবে রিটায়ার করেছেন কিডনি ফেলিওরে রিক্তা চলে গেল। অবশ্য চিররুগ্না রিক্তা বিয়ের পর থেকেই ভুগত। আজ এটা তো কাল সেটা। হাঁপের টান, স্ত্রী রোগ, হাই সুগার হাই প্রেসার কী যে ছিলো না মহিলার! ঐ বিয়ের একবছর মতো সময় যতটুকু যা স্ত্রী সুখ পেয়েছিলেন তারপরই তো মেয়ের জন্ম হলো। আর ইউট্রাসে সিস্ট নিয়ে ভুগতে শুরু করলো রিক্তা। সতীশ তখন দুরন্ত পুরুষ। এ্যথলেটিক্সের কোচ হয়ে রাজ্য মিটটিট গুলো কভার করেন। রেলে চাকরী করলেও ঐ সুবাদেই মাসের মধ্যে পনেরো দিন অফিস না গেলেও চলে। সঙ্গে আছে গ্রুপ থিয়েটারের বাতিক। রিক্তাকে নিয়ে পড়ে থাকার মতো মন বা মানসিকতা কোথায় তখন?

মঞ্জীরাবৌদি সাথে পরিচয়টা তখনই। সুরেশদা কালের কল্লোলের পরিচালক আর মঞ্জীরা নায়িকা কাম গ্রুপের প্রাণভোমরা। সতীশ তখন নিয়মিত যাতায়াত করেন বিজয় গুপ্ত লেনে সুরেশদার বাড়ি। সম্পর্কটা দানা বাঁধছিলো দু - পক্ষের সম্মতিতেই। সুরেশদাও কী কিছু আঁচ করত? বিশেষত অনিকেতের জন্ম? সতীশ চোখ বোজেন। রিক্তাকে কী বঞ্চিত করেছিলেন? বোধহয় না! অসুস্থ শরীরে ঘরের কাজ আর মেয়ের ঝক্কি সামলাতেই রিক্তা তখন নাজেহাল! কী পেতেন সতীশ সংসার থেকে? নিয়ম করে ডাক্তার? সে তো চিরকাল রিক্তার মা আর দাদাই দেখিয়েছে । আসলে রুগ্না মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মনে মনে একধরনের অপরাধ বোধে ভুগত রিক্তার ভায়েরা আর বাবা মা। একরকম ভালোই হয়েছিল সতীশের পক্ষে। না হলে জীবনের কতগুলো বছর ঐ ডাক্তার ওষুধ করতে করতেই জীবন যেত!

রিক্তা চিরকাল অভিমানী মেয়ে। বাবা মা ছেলেদের গ্রাজুয়েট করলেও মেয়েকে হাই স্কুলের পাট চুকোতে দেননি বলা ভালো প্রয়োজন বোধ করেননি। লম্বা শ্যামলা চেহারার মেয়েটি টুকটাক ঘরের কাজ আর বন্ধুদের নিয়েই থাকতে ভালোবাসত। বোধহয় জানতো, অসুস্থ, অল্পশিক্ষিতা, অসুন্দরী মেয়ের বিয়ে হওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। সতীশ তাই বিয়ের একবছরের মধ্যে যৌনজীবনে ইতি টানলেও রিক্তা কখনো মুখ ফুটে কিছু বলেনি। অনেক পরে একবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞা ডক্টর মিসেস রীতি সিংহ সতীশকে সরাসরি এই প্রশ্নটা করেছিলেন সতীশ কী বলবেন ঠিক করে ওঠার আগেই রিক্তা জবাব দিয়েছিল...

- আমার ওসব ভালো লাগত না কোনোদিন ও।

সতীশ চমকে উঠেছিলেন। এখন এই একাকী জীবনে মাঝে মাঝে কথাটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে কেমন যেন অবসন্ন লাগে। মনে হয় তবে কী রিক্তা ও বেঁচে গিয়েছিলো? ভালোবাসাহীন শারিরীক আদানপ্রদানের বিনিময় প্রথায় ঘেন্না জমেছিলো ওর মনে ? তাই কী স্বামীকে একরকম ত্যাগ করেছিলো রিক্তা?মুক্তি দিয়েছিল তাকে? এতখানি জোর কোথায় পেল ও মেয়ে? তখনকার সময়ে বেশ বেশী বয়সেই বিয়ে হয়েছিল রিক্তার বোধহয় তখন ত্রিশ- টিশ হবে। সতীশ নিজেরই তখন সাঁইত্রিশ চলছে। মা বাপ বিয়ে একটা দিতে পেরেই বর্তে গেছিল।অবশ্য বিয়ের পর ও ডাক্তার ওষুধ করতে হচ্ছে বলে খুব যে খুশি ছিলো তাতো নয়! একটা বোঝার মতো সকলের করুণা কুড়োতে কুড়োতে কী নিজেকে একটা খোলসের মধ্যে ভরে নিয়েছিল রিক্তা?নইলে ঐ রান্নাটুকু সেরে টাইমে গুছিয়ে দেওয়া জামাকাপড় কেচেকুচে রাখা এসব করতেই কেমন হাঁপিয়ে উঠত। অবশ্য শরীর ভালো থাকলে। নইলে তো ঠিকে লোক গোপাকেই সব করতে হত।

মেয়ে শাঁওলিও মায়ের মনের মত হয়নি। অন্যদের মা যেমন তরিজুত করে রান্না করে ঘর গোছায় নিয়ম করে সিনেমা থিয়েটার যায় শাঁওলি কোনোদিন মাকে তেমন কিছু করতে দেখেনি। চিরকাল অসুস্থ কথায় কথায় শয্যাশায়ী মাকে ঐ বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই একরকম ঘৃণা করতে শুরু করেছিল মেয়ে। তার চেয়ে মামীদের আশ্রয় দিদার স্নেহচ্ছায়া বাপের আদর অনেকখানি জুড়ে ছিল। রিক্তা কিন্তু মেয়েকে জড়িয়ে মরিয়ে রাখতে চাইতো। মেয়ের বন্ধুদের খোঁজখবর নেওয়া, সময় পেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ার বিষয় জানতে চাওয়ার মধ্যে দিয়ে মেয়ের চোখ দিয়ে বাইরেটা দেখতে চাইত। সেবার শাঁওলি উচ্চমাধ্যমিক দেবে, মেয়ের পরীক্ষার টেনশনেই বোধহয় রিক্তার মারাত্মক সুগার বেড়ে গেল। হাসপাতালে দিতে হলো শেষপর্যন্ত রিক্তাকে। মেয়ে পরীক্ষা দিলো মামারবাড়ি থেকে। সতীশ ও মেয়েকে তেমন সঙ্গ দিতে পারলেন না ঐ প্রথমবার রিক্তাকে ভর্তি করতে হয়েছিল কলকাতায়। বাড়ি ফেরার পর শাঁওলি যখন সেই প্রসঙ্গ টেনে এলোপাথাড়ি কথা শোনালো মাকে সেই প্রথম রিক্তাকে ডুকরে কাঁদতে দেখেছিলেন সতীশ।মনে মনে মেয়ের উপর খুশিই হয়েছিলেন। কতকাল আর একটা অসুস্থ লোকের ভার বওয়া যায়?  

শাঁওলির বিয়েতে রিক্তার মতামত বিশেষ কেউ চায়নি। সতীশও কি আলাদা করে আর পাঁচজন স্বামীর মতো রিক্তার সাথে আলোচনা করেছিলেন? না। শুধু মেয়ের বিয়ের গয়না গড়াতে না দিয়ে রিক্তা যখন নিজের বিয়ের সীতাহার মটরমালা বালা বাউটি সব উজার করে দিয়েছিলেন সতীশ একবার ও প্রতিবাদ করেননি মনে আছে। শুধু বিয়ের দিন নিজের ভাই বৌদের আর শালাজদের পাশে সামান্য ফিনফিনে একটা সোনার চেন গলায় সুগারে খেয়ে যাওয়া শুকনো হাড় সর্বস্ব হাতদুটোয় শাঁখা পলার সাথে ঢলঢলে সোনার চুড়ি পরা ঢ্যাঙা লম্বা নিজের বৌকে দেখেছিলেন একটু হলেও খারাপ লেগেছিল সতীশের।

জামাই সঞ্জিত দিল্লীর ছেলে। মর্ডান! আপ টু ডেট। অসুস্থ কম কথা বলা অসুন্দরী শাশুড়িমাকে নিয়ে খুব একটা ভালো লাগা যে তার তৈরী হয়নি বলাই বাহুল্য। এমনকি দু চারদিনের জন্যে শ্বশুরবাড়ি এলে সে প্রায় যেচে যেচেই মামাশ্বশুরবাড়ি নিমন্ত্রণ নিতো।রিক্তা মনে মনে দুঃখ পেলেও মুখে কোনোদিনও কিছু বলতেন না। অথচ, সতীশ জামাইয়ের আনুগত্য পেয়েছিলেন চমৎকার। মাইন ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জিত শ্বশুরমশাইকে জিজ্ঞেস না করে কিছুদিন আগে পর্যন্ত কিছু করত না। এমনকি নাতনী অন্বেষার আইন পড়তে যাওয়া তারই পরামর্শে। অথচ হঠাৎ গত তিনবছরই আগে সব কেমন পাল্টে গেল। পর পর দুটো স্ট্রোকে ঘর বন্দী হয়ে পড়লেন সতীশ।   

গলাটা কেমন খুশখুশ করে ওঠে। জলের বোতলটা নিতে গিয়ে কী মনে হয় পা দুটো টান করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান। বুলির ছোটো মেয়ে টিভির পর্দা থেকে চোখ না সরিয়েই বলে...

-ওঠলা কেন? ফোন করবা? পিসি এখন করতে মানা করেছে না! রাতে করবা।

সতীশ উত্তর দেন না। চাবি ঘুরিয়ে আলমারিটা খোলেন। কোনের তাকে এখনো কখানা শাড়ি রয়ে গেছে। শাঁওলি এসব পরেনা। আজকাল সব সালোয়ার কামিজ প্যান্ট শার্টের যুগ! মৃতা মায়ের দুখানা পিঁজে যাওয়া সিল্ক কে আর দিল্লী পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে? হাতড়ে হাতড়ে দুটো মোটা মোটা অ্যালবাম বার করেন সতীশ। কাঁপা কাঁপা হাতে দুটো অ্যালবাম বয়ে এনে বিছানায় বসেন। টিউবটা জ্বেলে দিতে দিতে বুলির মেয়ে বলে...,

-বাব্বা! দাদু দিদাকে তুমি কী ভালোই না বাসতে গো! রোজ রোজ সন্ধ্যে হলেই পুরোনো ছবিগুলো হাঁটকাও। কী যে দেখ এতো?

সতীশ মন দিয়ে দেখেন। একটা শ্যামলা মেয়ের আবছা সাদা কালো ফটোগ্রাফ। বিয়ের পর পাশাপাশি, মেয়ে কোলে সদ্য মা, সেবার পুরীতে বালির উপর, মেয়ের বিয়ের দিনে...

আজকাল কথায় কথায় চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে! চশমাটা বদলাতে হবে বোধহয়। ছানি কাটিয়ে গতবছরই লেন্স বসিয়েছেন তবু কেন যে মাত্র ক'পাতা ওল্টালেই চোখ দিয়ে জল ঝরে বুঝতে পেরেও ঠিক ধরা দিতে চান না সতীশ!

হঠাৎ মনে পড়ে যায় বারান্দায় টবে রাখা মানিপ্লান্টে বহুদিন জল দেওয়া হয়নি। বুলির মেয়েটাকে চেঁচিয়ে বলেন--

-যা তো বারান্দার গাছটাতে মগে করে একটু জল দিয়ে আয়। কতদিন জল পায়না গাছটা!

বুলির মেয়ে হেসে ওঠে-

-কী যে বলো দাদু! ও গাছ তো কবেই মরে হেজে গেছে! নিজেই একদিন শিকড় সুদ্ধু উপড়ে ফেললে না?

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য