সৌমী_আচার্য্য

ফাঁস

                    (১)

মনসার ভাসান গাইছে চোখ বুঁজে যাদব।ওর শরীরের পেশী ফুলে ফুলে উঠছে,ঢোল বাজানোর তালে তালে।কালো শরীরে রুপো রঙ চকচক করছে আলোয়।মোহিত হয়ে দেখছে পদ্ম।ওর চোখ ঘুরছে,পিছলে যাচ্ছে।মাথার ঘোমটা ডান হাতে আলগা করে ধরা।গান গাইতে গাইতে যাদব ঢোল বাজায় অদ্ভুত কায়দায়।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে ভাসছে মুখ।
গান শেষে প্রণাম সেরে ঢোল নামিয়ে রাখে।বাড়ির বুড়োবুড়ি ওর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকে।পদ্ম বুলিয়ে দেয় চোখ।

"বলি,সঙের মতো খাঁড়ায় থাকলি চলবো।ইদিকে আসো গো বৌ।"

পদ্ম সরে যায় রান্নাঘরে।মুড়ি,সবরি কলা,একটা করে রসগোল্লা,বাতাসা দেওয়া হয় মনসা ভাসানের দলকে।উঠোন জুড়ে সারাপাড়ার লোক।তাদেরো বাতাসা,মুড়ি দেয় পদ্ম আর বাড়ির মহিলারা মিলে।আকাশে মেঘ কেটে চাঁদ জ‍্যোৎস্না ছড়াচ্ছে।

"ইট্টু জল দেন গো।"

চোখ তুলে তাকায় পদ্ম।ঠোঁটে কাপড় চেপে ধরে।জলের গ্লাস কাঁপা হাতে এগিয়ে দেয় যাদবের দিকে।মুহূর্ত পরে চোখ নামিয়ে চলে যায়,ঘরের পিছনে।

                      (২)

"গদাইদার বৌডারে দেখলি?ইস্ ওমন সুন্দর এ তল্লাটে নাই।"

"সুন্দর কিসে হয়রে শীতল?শরিলডা বুইরা হয় তখন সুন্দর খুঁজবি কনে?"

"তোর যেমুন কতা।সুন্দর, সুন্দর।তার অতো ব‍্যাখ‍্যান কিসি?"

"ওর চোখ দুইডা ব‍্যথায় মরতাসে।দাঁতে ঘোমটা চাপে নাকি কান্নায় ঘোমটা।"

"ওরে শালা।এতো দেখসো তুমি।আর আমি কইলে দুষ।"

"দেখি নাই,দ‍্যাখা দিসে।"

"অতো দেইখ‍্যো না।গদাইরে চেনোই তো।হের মতো শয়তান দুনিয়ায় দুইডা নাই।ধামাখালি বাজারডা পুরা হাতের মুঠায় পুরসে।এইবার তো শুনসি পঞ্চায়েতের টিকিট পাওনের কথা আছে।ইদিকে গেরামের লোক তরে চায়।কি রে হাসোস ক‍্যান।কিছু ক।"

"কি কমু হেগো বাড়ি গান গাই,হেগো ওষুধ দিই,আর হের শত্তুর হবো আমি?কি কস?চুপ যা।সব্বোক্ষণ কথা কইতে নাই।"

যাদব বিড়ি ধরায়।দুটো টান দিয়ে চাঁদের আলোয় ঘোমটা চাপা দুটো ঠোঁট খোঁজে।একটা কালো মেঘ চাঁদের বৃত্ত ঢাকতে থাকে।থলথলে কালো মেঘের নীচ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ছটফট করতে থাকে চাঁদ,ছেঁড়াছেঁড়া আলো দেখতে দেখতে লখার মন বিষন্ন হয়ে ওঠে।গান ধরে লখা.....

"আমি না গেলাম যমুনার ঘাটে/না তুলিলাম জল/না হেরিলাম তারে সখী/না হইলাম চঞ্চল/.....আমার চোখ বান্ধিবি,মুখ বান্ধিবি/পরাণ বান্ধিবি কেমনে?

মেঠো সুর ভাসতে থাকে জোলো হাওয়ায়। কালীনদীর টানে।সন্দেশখালির এক পাকা বাড়ির এক ঘরের এক বালিশ ভিজতে থাকে।থলথলে শরীরের মেঘ তখন গভীর ঘুমে নাক ডাকছে।যাদব যেনো দেখতে পায় রাতের আলোর মতো।

                       (৩)

গদাই পাকাঘরের বারান্দায় বসে শব্দ করে চা খাচ্ছে।লুঙ্গি টা ভূঁড়ির নীচে কেতরে পড়ে আছে,যেন বাঁধা নেই খোলা।রোমশ বুকে সোনার চেন।গোঁফহীন বড়ো মুখটায় স্তরে স্তরে মাংস।থ‍্যাবড়া নাকের দুপাশে একজোড়া চোখ।যে চোখে নিষ্ঠুরতা ঠাণ্ডা বরফের মতো ভাষাহীন।পদ্ম সংকুচিত হয়ে দাঁড়ায় সামনে।ডাগর কচি বৌটাকে জড়িপ করে গদাই বলে...

"কিছু কওনের আছে নাকি?"

"আজ্ঞে,বেসান্তি পিসিমার কাল রাইতের থিকান বমি।অহন নেতায় পড়তাসে।"

"যাদবরে কেউ খবর দিসে।"

"আজ্ঞে ,কারে?"

গদাই বোঝে,বৈশাখে সবে বিয়ে হয়েছে এই দিনকুড়ির ভেতর গ্রামের সবটুকু জানার কথা না বৌয়ের।নাকটা ঝেড়ে নেয় বাঁহাতে ,লুঙ্গিতে মুছতে মুছতে বলে...

"নিতাইরে কোও যাদবরে যায়া কয়া আসতে।"

"আইচ্ছা।"

পদ্ম পিছন ফিরতেই গদাই বলে..

"এই যে,আরেকডা কথা শুইন‍্যা যাও।কাল আমার কোলকাতা যাওন লাগবো।আইজ রাতে দুদিনের মতো জামা কাপড় গুছায় থুইও।"

আকাশ জুড়ে মেঘ আসে।গুমগুম আওয়াজে পদ্মর বুকের মধ‍্যে মাতন লাগে।

                         (৪)

"আপনের পিসিমা কেমন আছে?"

পদ্ম চমকে তাকায়।আজ সকালে গদাই কোলকাতা গেলে ঘরের কাজ সেরে সেই যে নদীতে চান করতে এসেছে আর ফেরেনি সে।শ্মশানের ধার ঘেঁষে কালীনদীর পাড়ে বসে আছে।মানুষের গলার আওয়াজে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়।যাদব প্রশ্নটা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।একটা সাদা ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা।কোমড়ে লাল ডুরে গামছা।খালি গা।একবার তাকিয়ে পদ্ম বলে...

"অহন ভালো আছে।আইচ্ছা আপনে কি মেশান জলে?বমি বন্ধ হয় কেমনে?"

হাহা করে হাসে যাদব।

"এইডা আপনেরে কয়‍্যা দিলে লোকে আমার কাছে আসবো ক‍্যান?"

"আপনে সত‍্যি মন্তর জানেন?"

"কিসের মন্তর?"

"সবাই কয় আপনে অনেক মন্তর জানেন।"

"আপনের লাগবো,মন্তর?"

পদ্ম ঘাড় নেড়ে না বলে।হেঁটে চলে যেতে নেয়।যাদব বলে...

"আপনে একা একা কি করেন নদীর ঘাটে?"

"কথা কই,আমার কথা।নদী শুনে।আমারে নিয়ে বয়া যায়।"

যাদব খানিক এগিয়ে আসে।আড়চোখে চারিদিকের নিস্তব্ধতা চোখে মেখে বলে...

"যদি আর কেউ শুনতি চায়,শোনাবেন?"

"সবাইরে শোনাতে পারিনা।তবে যদি কেউ গান শোনায় তারে শুনাইতে পারি।"

মুচকি হাসে পদ্ম।ঘোমটার আড়াল খসে যায়,দ্রুত মাথায় তুলে ফেরার পথ ধরে,ভেসে আসে শব্দ কণা...

"সন্ধ‍্যায় এক পাগল এই নদীর ঘাটে গান গায়,কালীনদীর কিনারে।আপনার কথা সে শুনতি চায়।"

জোলো হাওয়ায় সন্দেশখালির একটা ঘর  ওলোট পালট হয়।

                        (৫)

"তারপর  আর পাঁচডা মাইয়ার মতো বরের লগে চইলা আইলাম।কেউ জিগায় না কি ইচছা,কি চাই।বাপেও শুধায় নাই,এই আধবুড়ারে পছন্দ হইসে কিনা?মায়েরে কইসিলাম, মায় কলো..."বাপের দশবিঘা ধানি জমিটা হের কাছে বন্ধক ছিলো,ছাইর‍্যা দিসে আর বড়ো দাদারে কুন লঞ্চে যেন কাম দিসে তাই আমার পছন্দ তে কাম কি?"

যাদব শুনেও যেনো শোনে না।এইসব দুঃখ কথা পানসে লাগে তার।এতো ঘরে ঘরে।..."এতে চমক কোই?"..মুখের ভিতর বিস্বাদ টের পায়।বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে।ঝকঝকে আকাশে আলোর হাজার কুচি।দুজনের মধ‍্যে হাত তিনেক দূরত্ব।যাদব বেলফুলের চাপা গন্ধ পায়।পদ্ম উঠে দাঁড়ায় মাটি থেকে...

"মনসার ভাসানের গান করেন।ভাবসেন কখনো নখিন্দরের অমন শরীলের বননোনা ক‍্যান দিসে?সোয়ামি হলেই ভালো বাসোন যায় না।শরীলের ভিতর একখান নদী থাকে,হেই নদীরে খুবলাইলে জল আসে না বাজোনদার।পাহাড়ের সোন্দর বুকখান ছুয়া থাকলে জল নামে শরীলে।"

যাদব পদ্মর দিকে তাকিয়ে বলে...

"আপনের কাছে শরীলের এত গুণ?ভালোবাসা বুঝেন কিসু?নখিন্দর যখন কংকাল হইলো,তখুন হেরে তো ফ‍্যালায় নাই বেউলা।"

খলখল করে হাসে পদ্ম।

"ও বাজানোদার,যে সোন্দর শরীলডারে ,মানুষডারে বেউলা মন দিসে,তার শরীলে কি যায় আসে?কিন্তু ভালোবাসনোর জইন‍্যে কিছু তো লাগে।রাতের বেলা তুমি গান গাও,আমি চোখ বুইজা শুনি ।বুকের মইধ‍্যে দরজা গুলান হাট কইর‍্যা খুইল‍্যা যায়।চাঁদের আলোয় ভাসতি ভাসতি পেয়ার ফুলের গন্ধ শুঁকি,তুমার সমত্ত শরীলডারে মনে পড়ে না তো বাজোনদার।তখন মনে হয় তুমারে চিনিই না,দেখিই নাই।ভালোবাসা বড়ো বালাই গো।"

যাদব হাঁ করে তাকিয়ে থাকে পদ্মর চলে যাবার দিকে।কে এই নারী?অশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে,ধূর্ত ব‍্যবসায়ীর বৌ,নাকি অন‍্য কেউ?যাদব একটু ছুটে গিয়ে পদ্মর সামনে দাঁড়ায়।আলতো হেসে তাকায় পদ্ম

"কাল আসবেন ঘাটে?আরেকডা গান শুনাতাম।"

পদ্ম হাঁটতে থাকে। আলে গোখড়োর শঙ্খ লাগে গোপনে,বিষ বাড়তে থাকে...গানে ভাসে বেদনা

"বন্ধু তোর লাইগা রে আমার তনু জ্বরোজ্বর/মন লয় ছাড়িয়া রে যাইতাম থুয়া বাড়ি ঘর/বন্ধু তোর লাইগ‍্যা রে"

                          (৬)

"আরে সব সময় এতো কি ভাবোস।ঐ গদাইয়ের হাতি যদি গেরামের ভার যায়,কার ভালো হবে ক।তুই একবার হ‍্যাঁ কয়া দেখ।পার্টির রঙ কেউ দ‍্যাখবো না,তোরেই ভোট দেবো সগলে।"

নারানকাকার গলায় উদ্বেগ স্পষ্ট।যাদব তবু কিছুতেই সায় পায় না।

"লোকের সুক দুকখে পাশে থাকি,গান গাই,ঢোল বাজাই হেই আমার আনন্দো গো কাকা আর কিছু আমারে কয়ো না।আমার মন টানে না।"

"আরে গদাই যদি পঞ্চায়েতের পোধান হতি পারে,সবার আগে চুল্লুর ঠেক গুলা গজাইবো আবার,মা,বেটিদের বাইরানো বন্ধ হবো,বুঝোস না।ওর আশেপাশে যে জঞ্জাল গজায় উঠতাসে ট‍্যার পাস না।"

"আমারে ছাড়ান দেন কাকা।আমি যাই।"

হৈহৈ করে ওঠে সবাই কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারে না যাদব।কোনো অনুনয় কাজে আসে না।

                          (৭)

চাঁদ আকাশে নেই।একটা আবছা অন্ধকারে কালী নদীর পাড় ঝিম ধরে আছে।শুক্রবার করে গদাই কোলকাতা যায়।রবিবার সকালে ফেরে।পদ্ম আজ আঁচল গায়ে জড়ায়নি।কাঁধ থেকে কোমড়ে আঁটো করে বেঁধেছে।যাদব সংকোচে তাকাতে পারে না।ওর বরের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তের অপরাধে গুটিয়ে আছে।

"কি হইলো?একখান গান শোনাবা না।তাইলে আর লাজলজ্জা ছাইড়‍্যা আসি কেন?বেসান্তি পিসিমার ট‍্যাকড় ট‍্যাকড় শুনি কির লগে?যাও আর আসবো না।"

"খাঁড়াও,না যাও।আমার মনের মইধ‍্যে ঝড় উঠতাসে বোঝো না।"

"না বাপু বাজোনদার।বুঝি না।মানুষের জন‍্যি ভাবো তুমি।এইডাই সত‍্য।গত বুধে বাঁধ ভাঙি গেরামে জল ঢুকতেছিলো।রাতারাতি তুমিই লোকজন নিয়ে সারালে।সকগলরে ভালোবাসো তা ভোটে দাঁড়াতি ভয় ক‍্যান।ঐ আমার ঘরের গোখরোডারে ভয় পাও ক‍্যান।আমার শরীল,মন সব হ‍্যার ছোবলে শ‍্যাষ।তুমি ওরে হারালি আমার শরীল জুড়ায় বাজোনদার।"

"সত‍্যি তুমি খুশি হোও পদ্ম।"

"হ,হের মুখে তোমার জন‍্যি চিন্তার ছাপ দেহি,গেরামে সব্বাই তুমারে ভালোবাসে হের ঘুম উইড়‍্যা যায়।আর আমার বুকডা জুড়ায়।আরো অনেক কিছুতেই খুশি হই।সে তুমি বুঝবা না।গান গাও।"

যাদব পা মুড়ে বসে নদীর কিনারে।দুদিন পর নমিনেশান জমা দেবার সংকোচ কেটে উদ‍্যোমে ভরে গেছে মন।পদ্মর বিশ্বাস তার বুকে জোর এনে দেয় গেয়ে ওঠে যাদব....

"যথা তথা যাই,আমি যত দূর চাই
চাঁদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে জুড়াই"

পদাবলীর গভীর টানে পদ্ম যাদবের কাছে আসে,আঙুল রাখে পিঠের পেশীতে।যাদব ডুবতে থাকে পদাবলীতে।গান থামলে দুজনা চুপ করে থাকে খানিকক্ষণ।পদ্ম খুব গলা নামিয়ে বলে ....

"বাজোনদার ধামাখালির আড়োতে বস্তা বস্তা সাহিয‍্যের জন‍্যি আসা চাল লুকানো আছে।কাইল শনিবার হ‍্যায় কোলকাতায়।দেখো না মানুষগুলানের জন‍্যি যদি কিছু করতি পারো।"

চমকে তাকায় যাদব।পদ্মোর মুখে আবছা আলো।তবু যেনো চোখ দুটো ভেসে চলেছে স্বপ্নে।

"মাত্তর দুই কেজি কইর‍্যা চাল দিছে একেক জনরে,আর আইছে এক একজনের জন‍্যি দশ কেজি কইর‍্যা।বুকডা ফাটি যায় মানষের মুখের গ্রাস কারি লয়।হায়রে।"

যাদব অস্ফুটে ডাকে..."পদ্ম!"

"কাড়ি নিতেই হ‍্যার যত সুখ"

পদ্ম যাদবের গা ঘেঁষে আসে ।ওর নিশ্বাস ঘন হয়।

"বাজোনদার মানষের অসহায়তার উপর যারা জুলুম করে তারা দানবেরো অধম।বুকের মধ‍্যি ফাটি যায়।"

এই বলে বিস্মিত যাদবের ডান হাত নিজের বুকে চেপে ধরে,ঘাড়ে মাথা গুঁজে দেয়।চোখের গরম জলের ফোঁটায় ভিজতে থাকে যাদব।

"অসহ‍্য যন্ত্রণা বাজোনদার।অসহ‍্য যন্ত্রণা।শরীল না কি মন জানি না।শুধু মনে রাইখ‍্যো হের শত্তুর তুমি মুখ না দেহে কেউ,একজন,দুইজন নিয়া কামডা সারবা।বিলায় দাও সব।"

ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের বুকে নরম প্রলেপ লাগাতে থাকে আবছা মেঘ।

                   (৮)

"কি কস রে শীতল?একি সব্বোনাশ।"

"কাকা ওরে মাইর‍্যা ফেলবো,চলেন।আমি এক ঝটকায় দোড় মাইর‍্যা পালাইসি কুনো রকমে চলেন কাকা।"

নারান হেঁকে ডেকে কুড়ি পঁচিশ জনকে সাথে নিয়ে হনহনিয়ে এগোতে গিয়ে মোড়ের মাথায় জটলা আর চিৎকার শুনতে পেলো।দৌড়ে সবাই মিলে পৌঁছলো যখন লাইট পোষ্টে বাঁধা যাদব নেতিয়ে পড়েছে।কষ ফেটে দরদরিয়ে রক্ত পড়ছে,বাঁ চোখ থ‍্যাঁতলানো,হাত দুটো বোধহয় ভাঙা।নারান চিৎকার করে উঠলো....

"গদাই,এইডা তুমি কি করসো?"

গদাই এক কোণায় কেন্নোর মতো গুটিয়ে ছিলো,পিটপিট করে তাকালো।ওর পোষা
কুত্তা গুলো একসাথে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো....

"খবরদার,দাদা না থাকলি তোদের এই চোর ন‍্যাতারে জ‍্যান্ত জ্বালায় দিতাম।দাদার উপর কুনো কথা কবি না।পুলিশ আসুক।শালা চোর।"

দেখতে দেখতে সারা গ্রাম যেন ভেঙে পড়লো।গদাই হাত জোড় করে বললো...

"নারান তুমাদের নেতার  মাথায় কি দুর্মতি হইসিলো তুমরা জানো না।আমি কাউরে কই নাই।হেয় আমার ঘরেও নজর দিছে নারান।গুদামে আমার সব ইলিকটনিক্স জিনিস বস্তায় ভরা। সব তছনছ করসে।নৌকায় গাদা গাদা গম,ডালের বস্তা তুইল‍্যা আনছে।...আমার
পাহাড়াদাররা তাড়া কইর‍্যা,নদী পাড় কইর‍্যা এহ‍্যানে ধইর‍্যা ফেলার পর ওরে মারসে ঠিকই কিন্তু আমি যদি আজ কোলকাতা থিকা ফিইর‍্যা না আইতাম তাইলে তো সব্বোনাশ হইয়া যাইতো।"

গুনগুন করে উঠলো জনতার মধ‍্যে কেউ...

"হেয় তো গান গায়,ঘুইর‍্যা বেড়ায়,এ কাজ ক‍্যান করসে?কেউ উস্ কায় ছে।"

গদাই দাঁতে দাঁত ঘষে বলে....

"নদীর পাড়ে আমার বৌয়ের লগে জোর জবরদস্তি করসে কাল,বৌবা বাড়িত কাঁদতি কাঁদতি বিছানা নিসে,সেই খবর পাইয়‍্যা আমি আজি ফেরৎ আইসি।যদি চুরি কইর‍্যা ধরা না পড়তো তাইলেও কাল গেরামের মাতব্বরদের ডাকতাম।হের মতো পোলারে নেতা করো তুমরা।"

নারান এসবের মধ‍্যে যাদবের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।কোমড়ের বাঁধন আলাগা
করতে থাকে।ফিসফাস বাড়তে থাকে।গদাই নাক ঝেড়ে প‍্যান্টে মুছতে মুছতে বলে...

"ওর শাকরেদ শীতলরে শুধান,ক‍্যান চুরি করসে?"

শীতল জবাব দেয় অস্ফুটে...

"সরকারী সাহাইয‍্য হেয় লুকায় রাখসে গুদামে যাদব খবর পাইসিলো।"

গুঞ্জন ওঠে আবার, নারান ডাকে...

"যাদব,বাপ,ও বাপ...।এমুন কইর‍্যা মাইর‍্যা তুমরা ঠিক করো নাই গদাই।বাপরে..."

ওর নেতানো ঘাড় ডলতে থাকে নারান।কেউ একটা ভ‍্যান এনে দাঁড় করায়।ল‍্যাতপ‍্যাতে যাদবকে তুলে নিয়ে স্বাস্থ‍্য কেন্দ্রের পথ ধরে ভ‍্যান।গদাইয়ের গলার শেষ শব্দ ভেসে আসে...

"পুলিশ আইলে সব কথাই কমু নারান।তোমাগো নেতার কু কীর্তি,সাক্ষী আমার অনেক।"

নারান চোখের জল মুছতে মুছতে বলে...

"ক‍্যান গিসলি শীতল,ক‍্যান?"

"হ‍্যার ঘোরে আমারে টাইন‍্যা নিলো কাকা,টাইন‍্যা নিলো।"

স্বাস্থ‍্য কেন্দ্রের নড়বড়ে স্টিলের ট্রলিতে ঘরঘর করে যাদবের গলা।সন্দেশ খালির একটা ঘরে পোষা পদ্ম গোখরোর নাভিতে জিভ ঘুরে বেড়ায়।শরীর সুখে ক্লান্ত আলুথালু চুল কষে বেঁধে,চোখের তারায় পিশাচ নাচিয়ে শব্দ তোলে ফাঁঁস....

"শরীল চিরকাল থাকে না বাজোনদার।সুখ চিরকাল রাখতি গেলি ট‍্যাহা লাগে।আমি ট‍্যাহা ভালোবাসি আর তুমি?তুমি কি ভালোবাসো বাজোনদার?"

অনিশ্চয়তায় ডুবতে থাকে আচ্ছন্ন এক শরীর বিষন্ন এক মন।চোখে ভেসে ওঠে আবছা অন্ধকারে মায়াবী এক পদ্ম গোখরো।




মন্তব্যসমূহ

  1. যতক্ষণ পড়ছিলাম সম্মোহিত হয়ে ছিলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. সৌমী, এই লেখা অভূতপূর্। সাহিত্যমূল্য ও জীবন দর্শণে পরিপূর্ণ।। গল্পটা হঠাৎ রাজনৈতিক দিকে মোড় নিলো। না নিলে হয়তো অন্য এক উপাখ্যান পেতাম। যাই হোক, তোর কল্পনায় যে গল্পচিত্র দরা দিয়েছে তাকে সন্মান জানাই।

    উত্তরমুছুন
  3. আমার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা

    উত্তরমুছুন
  4. অসাধারণ! ওঃ এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। ট্রেচারীর একেবারে অন্য মাত্রা। ডায়ালেক্ট ব্যবহারে আরো ভালো হয়েছে। কী বলি এমন গল্প অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর একশো গল্পের মধ্যে থাকবে। অভিনন্দন সৌমী।

    উত্তরমুছুন
  5. কী বলি সৌমী, এককথায় অসাধারণ গল্প। টানটান। গতিময়। এবার থেকে তোমার গল্পের দিকেও চোখ থাকবে। খুব ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন
  6. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  7. সৌমী, আমি সব সময়েই তোমার লেখার ভক্। এই গল্পটা এককথায় অসাধারণ । গতিময়..টানটান রুদ্ধশ্বাস লেখা এক চুমুকে পান করে নিলাম। এখনো কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে আছি । যত দিন যাচ্ছে তোমার লেখা আরো পরিনত হচ্ছে। ভালো থেকো।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সৌমী, আমি সব সময়েই তোমার লেখার ভক্ত। এই গল্পটা এককথায় অসাধারণ । গতিময়..টানটান রুদ্ধশ্বাস লেখা এক চুমুকে পান করে নিলাম। এখনো কেমন যেনো ঘোরের মধ্যে আছি । যত দিন যাচ্ছে তোমার লেখা আরো পরিনত হচ্ছে। ভালো থেকো।

      মুছুন
    2. অনেক ধন‍্যবাদ দীপ্তেশদা

      মুছুন
  8. এক অদ্ভুত মাদকতায় জড়িয়ে ছিলাম শেষ পর্যন্ত। শব্দের ব্যবহার, পরিবেশ নির্মাণ প্রশংসনীয়। আরও লেখো...

    উত্তরমুছুন
  9. শীতলপাটির মতো ঠাস বুননের লেখা।গোগ্রাসে পড়লাম।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য