রাখী সরদার


শ্রেষ্ঠ বিরহবেদ
"আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়।"


শাশ্বত প্রেমের সূতোয় ছোপানো এই শব্দকটি
শুধুমাত্র কিছু শব্দ নয়।শরীর ও হৃদয়ের মধ্যেকার
এক অমোঘ সমীকরণ। যা সোনালী, রূপালী ছন্দে
ছায়ায় পরপর সাজানো থাকলে স্বর্গের পারিজাত।
আর ওলোটপালোট হাওয়ায় লকলকে আগুন।
এই শিমূলরঙা বিকেলে চণ্ডীদাসের পদাবলীতে
বুঁদ হয়ে থাকা তো এই বনশালের ঘ্রাণে তুষের
আগুনের মতো ধিকি ধিকি পুড়ে যাওয়া ।

শব্দগুলো কী ধীর শান্ত, পদ্মপাতায় জমে
থাকা ফোঁটা দুই জলের মতো অথচ চেতনার গভীর
তলদেশে এর কী ঢেউ! পরিত্যক্ত দালানের এক
অংশে ফুটে থাকা বনগন্ধী ফুল কিংবা হাড় বের করা লাল ইটের মাংস ।

জানালার ওপারে বিকেলের বৈশাখী মেঘ
কালো জিজ্ঞাসা চিহ্নের মতো ঘন হয়ে এসেছে।
কেন এই ডানা  ভাঙা উচ্চারণ!এত কথা বলছি
কেন এই প্রশ্ন‌ই তুমি করছো মেঘ।হে অজানা
মুসাফির ,তুমি এই তুলতুলে সাদা ,এই অতিপেলব
কৃষ্ণ মেঘ।আজ দিগন্তরেখায় কাঁপতে কাঁপতে
আমার পঞ্চম সুরের ধারে মেঘলা করে এসেছ।
এতদিন ধরে বুকের কাছে গুটি সুটি মেরে বসে
থাকা মনকেমন হঠাৎ আজ বৃষ্টি রূপে ঝরে
পড়তে চায় আমার প্রাচীন স্মৃতির দাওয়ায়।
দীর্ঘকাল যাবৎ আমার যাবতীয় ভালোলাগা ,
ভালোবাসা,আকাঙ্ক্ষা, ব্যর্থতা স্মৃতির পাতায়
মুড়ে নিজ হৃদয়ের সম্পুটে ভরে রেখেছিলাম ।
আজ এক লহমায় উড়ে আসা মেঘের বিস্তারে
ভিতরের মাথুর জেগে ওঠে। তীব্র ব্যথায় কৌটো
খুলে জমে থাকা ভালোবাসা, আকাঙ্খা, ব্যথা
এমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল যে কাকে রেখে কাকে কুড়িয়ে নিই।

 আমার উদাসী হৃদয় আজ আগ্রাসী
ঝড়ের কুণ্ডলী।সমস্ত কিছু গ্রাস করে নিতে ব্যস্ত।
শরীরের সমস্ত রক্ত, মেদ,মজ্জায় যেন বিদ্যুৎ
চমকাচ্ছে।সেই বিদ্যুতের ঝলকে চমকে উঠছে
আমার ভিতরের সর্বনাশ। এমন অস্থির মুহূর্তে
কোথাও থেকে রামদাসী মল্লারের সুর ভেসে আসে।কে যেন অতি পেলব প্রয়োগে কোমল গান্ধারকে
গড়িয়ে দিচ্ছে নিখিল ভুবনে। ঝড় থেমে যায়।
কোথা থেকে সহজ শীতল বাতাস উড়ে আসে ,
আমার মনখারাপের ঢাল বেয়ে নামে বিষণ্ণতার
ধারা ও এক‌ই সাথে ভালোলাগার সুবাস।উঠোনের
কনকচাঁপার পাতা থেকে মৃদু খসখসে ভালোবাসার
শব্দ শুনতে পাই।ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির এক সংকেতহীন
নিস্তব্ধতায় বুঁদ হয়ে পড়ি। চোখের পাতা ভারী হয়ে
আসে।আমার শেষ না হ‌ওয়া কবিতা জলে ভিজে
মিশে যেতে থাকে সাদা পৃষ্ঠার আড়ালে। কেউ
স্মৃতির নিভৃতে থেকে ফিসফিস স্বরে বলে ওঠে --
' ভাসো,ভেসে যাও অরূপমোহনে। মনে হল আমি
আমার সত্যকে খুঁজে পেয়েছি। হাতে তুলে নিই
"গীতবিতান।"মনে হয় এইই আমার জগত,এইই
আমার শ্রেষ্ঠ বিরহবেদ।যার প্রত্যেকটি অক্ষর
প্রেম ও আনন্দের এক  স্বর্গীয় মূর্ছনা।শব্দহীন চুপ হয়ে বসে থাকি। বৃষ্টি কখন থেমে গেছে।গাছের ঝিকিমিকি ছায়ার ভিতরে টুকরো চাঁদ দেখা দিয়েছে। পাশের বাড়ির গ্রামোফোন থেকে ভেসে
আসছে ----

"যে জন দেয়না দেখা, যায় যে দেখে -- ভালোবেসে
আড়াল থেকে --
আমার মন মজেছে সেই গভীরের গোপন
ভালোবাসায়।।"

মন্তব্যসমূহ

  1. মুগ্ধ হলাম। গভীর অনুভবকে শব্দের রিনিঝিনি সুরে বাজিয়ে তোলা কত কঠিন কাজ। যার সেটা আসে আপনা থেকেই আসে। শুভেচ্ছা রইল।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য