তুষারকান্তি নাথ





 নব কৈলাসের অন্দর
নদীপাড় থেকে নৌকা-ঘাট পর্যন্ত দুদিকের ঢালু বেলাভূমি শ্বেতশুভ্র কাশ ফুলের জঙ্গলে ছেয়ে রয়েছে।  হওয়ায় আন্দোলিত হচ্ছে তাদের পুষ্পমঞ্জরি। সেই আন্দোলিত ঢেউয়ের ছোঁয়ায় পুলকিত মনের শরীরও। শান্তিপুরের নৃসিংহপুর ফেরিঘাট থেকে নৌকায় চেপে বসলাম ভাগিরথী পার হব বলে। বিশালাকার নৌকায় মানুষ, সাইকেল, মোটর বাইকের সাথে মালভর্তি ভ্যান আর ছোট গাড়িও উঠেছে পারাপারের জন্য। সে এক হইচই ব্যাপার। ভাগিরথীর ঢেউযুক্ত অসমতল জলতল সূর্য কিরণের অভিঘাতে লাজ রাঙা হয়ে উঠেছে। সেই জল কেটে আমাদের নৌকা পৌঁছে গেল ওপাড়ের কালনা ফেরিঘাটে। ঘাটের পাড়েই টোটো স্ট্যাণ্ড। টোটোয় চেপে পিচের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। শহরের ঘিঞ্জি পথ। গন্তব্য দেড় কিমি দুরের অম্বিকা কালনার বিখ্যাত নব কৈলাস বা একশ আট শিব মন্দির।    
বিশাল মন্দির চত্ত্বরের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করলাম। পাশেই পুরাতত্ত্ব বিভাগের পরিচিত নীল-সাদা বোর্ড। সামনের মন্দিরময় চালচিত্র যেন আকাশ থেকে ঝুলে পরেছে কোন জাদু কাঠির ছোঁয়ায়। দুটি সমকেন্দ্রিয় বৃত্তাকার পথে পরপর একই অবয়বের মন্দিরগুলি অবস্থিত। একটার সাথে অন্যটা লেগে রয়েছে। বাইরের বৃত্তে ৭৪টি এবং ভিতরের বৃত্তে ৩৪টি মন্দির রয়েছে। মোট ১০৮টি মন্দির। সারা ভারতে একশ আট শিব মন্দির মাত্র দুটি জায়গায় আছে। একটি বর্ধমানের নবাবহাটে, অন্যটি এই অম্বিকা কালনায়। কালনার এই মন্দিরের অপর নামনব কৈলাস মন্দিরকথিত আছে বিষ্ণুপুরের রাজকীয় সম্পত্তি হস্তান্তর ও মালিকানা উদযাপনের জন্য এই মন্দির নির্মিত হয়। ১৮০৯ সালে রাজা তেজ বাহাদুর এই নব কৈলাস মন্দির কমপ্লেক্স নির্মাণ করেন।  বাইরের বৃত্তাকারে সাজানো মন্দিরের সামনে প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া বৃত্তাকার পাকা পথ। এই পথ ও ভিতরের বৃত্তের মাঝের পরিসরে সবুজ কেয়ারী করা লন ও ফুলের গাছ। সত্যিই অনন্যসুন্দর। ভিতরের বৃত্তের কেন্দ্রস্থলে লোহার জাল পরিবেষ্টিত এক জলাধার রয়েছে। মনে করা হয় মন্দির নির্মাণের সময় জ্যামিতিক কাজের জন্য  বড় কম্পাস বসানোর জন্য এই গর্ত খোঁড়া হয়। অন্য মতে, এই কুঁয়ো নিরাকার পরম ব্রহ্ম মহাদেবের প্রতীক। কেউ কেউ বলেন পূজার্চনার জলের জন্য এটি খনন করা হয়। জলাধারের পাশে একটি গোড়া বাঁধানো বেল গাছ রয়েছে।  দুটি বৃত্তে মোট চারটি প্রবেশ পথ আছে। 
ইষ্টক নির্মিত প্রতিটি মন্দিরই আটচালা প্রকৃতির এবং আনুমানিক কুড়ি ফুট উঁচু ও সাড়ে ন্য় ফুট চওড়া। সম্মুখ ভাগের দেওয়ালে পোড়া মাটির অলঙ্করণ মন্দিরগুলিকে পূর্ণতা দিয়েছে। টেরাকোটায় চিত্রিত হয়েছে রামায়ন ও মহাভারতের খণ্ডচিত্র এবং শিকার দৃশ্য। যদিও অনেক প্যানেলই সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে চলেছে। প্রায় দু-ফুট উঁচু ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি মন্দিরের চুড়ায় ধাতব গোলাকার চাকতি বিদ্যমান, দরজা কেন্দ্রমূখী এবং ভিতরে উত্তরমূখী শিবলিঙ্গ আসীন। বাইরের বৃত্তের মন্দিরগুলিতে পর্যায়ক্রমে সাদা ও কালো বর্ণের শিবলিঙ্গ অধিষ্ঠিত। ভিতরের বৃত্তের মন্দিরের শিবলিঙ্গের রঙ সাদা। আজ থেকে দুশো বছর আগে যে নিখুঁত জ্যামিতিক পদ্ধতি অনুসরণ করে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল তা সত্যিই বিস্ময়কর। মন্দির চত্ত্বরের বাইরে পশ্চিম দিকে জলেশ্বর এবং পূর্ব দিকে রত্নেশ্বর নামে আরও দুটি পঞ্চরত্ন শিব মন্দির রয়েছে। 
নব কৈলাস মন্দিরের মূল ফটকের ঠিক উল্টো দিকে বিশাল রাজবাড়ি চত্ত্বর। বাঁধানো রাস্তা দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকে সবুজ লন আর বাঁ দিকে সুউচ্চ, পূর্বমূখী প্রতাপেশ্বর মন্দির। রাজা প্রতাপচাঁদের প্রথমা স্ত্রী প্যারিকুমারী দেবী ১৮৪৯ সালে এই মন্দির নির্মাণ করেন। উঁচু ভিত্তির ওপর স্থাপিত এক খিলান প্রবেশ পথ এবং ঈষৎ বক্র শিখ্র সমন্বিত এই মন্দির ঊনবিংশ শতকের রেখ দেউলের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তৎকালীন সময়ে নির্মিত বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরের মধ্যে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ মন্দির। মন্দির গাত্রে হিন্দু মহাকাব্যের চিত্র, শ্রীচৈতন্যের পৌরানিক কাহিনী, দূর্গা ও রাবনের ছবি, মানুষের প্রাত্যহিক জীবন যাত্রা ইত্যাদি পোড়া মাটির কাজ ফুটে উঠেছে শিল্পির হাতের নিপুণ ছোঁয়ায়। প্রতাপেশ্বর মন্দিরের পাশেই রয়েছে রাজবাড়ির অন্যতম নিদর্শন রাসমঞ্চ।  এটি ১৭৫৮ সালে নির্মিত। ছাদবিহীন এই রাসমঞ্চের কেন্দ্রে ঠাকুর দালান। রাজাদের আমলে এখানে রাস উৎসব পালন হত।        
রাজবাড়ি চত্ত্বরের এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে ঊনবিংশ শতকের বাংলার সংস্কৃতির নানা মনি মানিক্য। ডান দিকে বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির। উচ্চ ভিত্তির ওপর ইষ্টক নির্মিত আটচালা মন্দিরের গর্ভগৃহের সম্মুখে সুসজ্জিত ত্রিখিলান প্রবেশ পথ বিশিষ্ট একটি বারান্দা। মন্দিরের দেওয়াল দেবদেবীর মূর্তিসহ নানাবিধ পোড়ামাটির ফলকে সজ্জিত। সামনেই কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির। রাজা তিলকচাঁদের মাতা লক্ষ্মীকুমারী দেবী  ১৭৫৫ সালে এই পঞ্চবিংশতি রত্ন মন্দিরটি  তৈরি করেন। সামনে অপূর্ব অলঙ্করণে সমৃদ্ধ তিন খিলান প্রবেশ পথ এবং প্রলম্বিত চালা বারান্দা। তিনতলা এই মন্দিরের অন্দরে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত। মন্দিরগাত্রে ফুলকারি কাজ, বকাসুর বধ, নৌকা বিলাস, অশ্বমেধ যজ্ঞ, বন্দুকধারী সৈন্য, দেবদেবীর মূর্তি ইত্যাদি পাড়ামাটির কাজ রয়েছে। পাশেই পরপর পাঁচটি শিবমন্দির অধিষ্ঠিত। এই মন্দিরগুলি পঞ্চরত্ন মন্দির নামে পরিচিত। ঊনবিংশ শতকে তৈরি আটচালা এই মন্দিরগুলি একই সারিতে অবস্থিত এবং বিভিন্ন মাপের।  বর্ধমান রাজবাড়ির অন্যতম আকর্ষণ লালজী মন্দির। ১৭৩৯ সালে মহারাজা জগৎরামের স্ত্রী ব্রজকিশোরী দেবী এই রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটি নির্মাণ করেন। প্রাকার  বেষ্টিত এই পঞ্চবিংশতি রত্ন মন্দিরটির সম্মুখ ভাগে রয়েছে  নাট মণ্ডপ এবং একটি পর্বতাকৃতি মন্দির যা গিরিগোবর্ধন নামে পরিচিত। মূল মন্দিরটি নানাবিধ পোড়া মাটির অলঙ্করণে মণ্ডিত। ঊনবিংশ শতকের শিল্পীর শিল্পের কৌলিন্য সত্যিই বিস্ময়কর।
সন্ধ্যা নেমে আসছে। এবার ফেরার পালা। রাস্তায় উঠে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরলাম। এ যেন রাজার হুকুম। রাজরক্ষী রাস্তায় টহল দিচ্ছে। মাথায় পাগড়ি, ইয়া মোটা গোঁফ, হাতে লম্বা লাঠি। ডান দিকে বর্ধমান রাজবাড়ির সুপ্রসিদ্ধ মন্দির সমূহ আর বাম দিকে নব কৈলাস মন্দির চত্ত্বর। সন্ধ্যারতির পিদিম জ্বলে উঠেছে মন্দিরে মন্দিরে, সাথে ঘণ্টা ও শঙ্খ ধ্বনি। পিতলের রেকাব ভর্তি প্রসাদ নিয়ে মন্দির বালিকা সামনে এসে দাঁড়াল। হঠাৎই টোটোওয়ালার ডাকে হুঁস ফিরল। টোটোয় উঠে বসলাম। রাস্তার আলো পড়ে সামনের পুরাতত্ত্ব বিভাগের বোর্ড চকচক করছে।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য