নন্দিতা মিত্র


প্রবঞ্চক 
=========

বহুদিনের অযত্নে তোমার বাগান ভরা ছিলো আগাছায় । তাদের মাথায় থোকা থোকা বনফুল । আগাছার জঙ্গলে প্রাণপন লড়াই করে বেঁচে আছে একটামাত্র শীর্ণ গোলাপের ডাল । তার মাথায় পোকায় কাটা অপুষ্ট , রক্তাক্ত কুঁড়ি । 
আমি পথ হাঁটছিলাম , রাজপথ । হঠাৎ চোখ গেলো রাজপথ ছেড়ে নেমে যাওয়া এঁদোগলির শেষপ্রান্তের পড়ন্ত রাজপ্রাসাদে । সেখান থেকে ভেসে আসছে সুরভিত বাতাসের মৃদু গুঞ্জন ।  তুমি বারান্দার আরামকেদারায় বসে বইয়ে মগ্ন ।  আঁচলটাকে কোমড়ে গুঁজে এগিয়ে গেলাম , চুপিসারে,  বুনোফুলে আমার এলোখোঁপা সাজাবো বলে। আমার  নূপুরের নিক্কণে  ভাঙলো তোমার ঘোর । বিস্মিত ক্রোধে জিগ্গেস করলে " কি চাই ? " আমি দ্বিধাগ্রস্ত আঙুল তুলে দেখালাম তোমার বাগানের দিকে । সেই মুহূর্তে , ঠিক সেই মুহূর্তে,  আমার অনামিকার সাতটি হীরের তিমির আলো ফেলল তোমার অনাগত জন্মের চোখে । তুমি বিমূঢ় স্তব্ধতায় এগিয়ে গেলে তোমার বাগানের আগাছার জঙ্গলে ... চারিপাশে ফুটে আছে থোকাথোকা বনফুল ... তুমি দেখলে না তাদের । মন্ত্রমুগ্ধতায় ছিঁড়ে নিলে কীটদষ্ট অপুষ্ট রক্তাক্ত গোলাপকুঁড়ি । আমার অন্তরাত্মা আর্তনাদ করে উঠলো , " নাগো গোঁসাই , না ! আমাকে দিও না ঐ পোকায় কাটা গোলাপকুঁড়ি । খোঁপায় গোঁজার একমুঠো বনফুল চাই । "
তুমি নিজে হাতে পরালে সেই গোলাপকুঁড়ি , আমার খোঁপাতে । আমার কুন্তলস্পর্শে জেগে উঠলো তাদের রক্তাক্ত হৃদয়-পাঁপড়ি .... আমার খোঁপাতে প্রস্ফুটিত হলো  রক্তিম গোলাপ আর তার কাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত দেশ-কাল ঢেকে গেলো ভালোবাসার উৎসবে। 
চকিতে চোখ গেলো তোমার দিকে । তখন তোমার বুকের মধ্যে ফুটতে শুরু করেছে মস্তবড় একটা সূর্যমুখী ফুল । তুমি তড়িৎ অপ্রস্তুতে, বেনিয়ানে ঢেকে নিলে সূর্য্যের আশ্রয় । 
আমি খোঁপাতে লাল গোলাপ নিয়ে পা বাড়াই সূর্যাস্তের খোঁজে , জনসমুদ্র-রাজপথ তাকিয়ে থাকে মস্ত লাল গোলাপের দিকে । 
তুমি নীতিগত সত্যে ঢাকলে  হৃদয়ের সত্য , আমি হৃদয়ের সত্যে মুছি নীতির সত্য, আজীবনের বদঅভ্যেস বলতে পারো .... আজীবনের । 
আসলে , প্রকৃতপ্রস্তাবে , দিনের শেষে , তুমি আমি সকলেই প্রবঞ্চক ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য