নন্দিতা কুণ্ডু মিত্র
সিকিমের এক নির্জন গ্রামে
সিকিমের সিল্করুটে অনেকেই ঘুরতে যান। তাদের মধ্যে অনেকে নির্জনে থাকতে পছন্দ করেন। সিকিমে অনেক নিরিবিলি পাহাড়ী গ্রাম আছে। তাদের মধ্যে ছোট্ট, সুন্দর পাহাড়ী গ্রাম রোলেপ। পূর্বসিকিমের সিল্করুটের এক নতুন স্পট রোলেপ। নতুন হলেও স্বর্গীয়, প্রাকৃ্তিক সৌন্দর্যের কারনে খুব তাড়াতাড়ি এটি জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে। নিউজলপাইগুড়ি থেকে খুব দূরে না হওয়ায় শুধু রোলেপকে উদ্দেশ্য করেই দুদিন অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। প্রকৃ্তির কোলে শান্তি ও নির্জনে কাটাব বলে চলে এলাম এখানে। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট ছোট্ট ঝুলন্ত বাড়িতে শেরপা, রাই আর গুরুংদের বসবাস। দূরে নীল আকাশ আর তার নীচে সবুজ পাহাড় আর সবুজের মধ্যে ভেসে চলেছে টুকরো টুকরো মেঘের দল। বৌদ্ধ অধ্যুষিত রোলেপের সব জায়গায় বৌদ্ধমন্ত্র লিখিত লুংদার বাতাসে উড়তে দেখা যায়। মাথা পিছু ৯০০ টাকায় থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল একটি হোমষ্টেতে। সহজ সরল মানুষগুলো ভুট্টা আর ঝুমচাষের সাথে সাথে পর্যটকদের জন্য হোমষ্টে খুলে জীবিকা নির্বাহ করেন। হোমষ্টেগুলোর একটি সুবিধা হল বাড়ির মতোই সুস্বাদু খাবার পাওয়া যায় আবার থাকা-খাওয়ার খরচাও আয়ত্তের মধ্যে। গাড়ী থেকে নামতেই একমুখ হাসি নিয়ে বাড়ির মালকিন আমাদের স্বাগত জানালেন।
বিকালে শান্ত, নিরিবিলি গ্রামটির রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম রোলেপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নদী রংপোখোলার ধারে। তবে নদী এখানে ভয়ংকর। খরস্রোতা নদী পাহাড়ের বুকে আছড়ে পড়ছে আর বিভিন্ন আকারের পাথরে ধাক্কা খেয়ে এগিয়ে চলেছে রুদ্রমূর্তিতে, নতুন উদ্যম নিয়ে। স্থানীয় মানুষ এই নদীকে লুম্ফখোলাও বলেন। ছাঙ্গু লেক থেকে উৎপন্ন হয়ে এই নদী তিস্তায় গিয়ে মিশেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় নদীর পাশে বসে। এখানে বসে বেশ কিছুটা সময় কাটালাম। হিমেল বাতাস বইছে। তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ল এক কাপ গরম ধোঁয়া ওঠা কফির। নদীর ওপরের ব্রীজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটি ছোট্ট দোকান। চারিপাশের সবুজ পাহাড়ের মাঝে ছোট্ট একটি দোকান। দেখেই ভালো লেগে গেল। দোকানের একটা ছাউনির তলায় বসে অর্ডার দিই কফি ও মোমোর। কিছুক্ষণ বাদে দোকানের মালকিন আর তার মেয়ে হাসিমুখে কফি ও মোমো নিয়ে এসে হাজির।
সুস্বাদু কফি ও মোমো খেয়ে আবার বসলাম নদীর ধারে। চারিদিকে তাকিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে থাকি আর নিসর্গের মায়াজালে আবদ্ধ হতে থাকি। চারিদিকের রহস্যময় জঙ্গল যেন নিস্তব্ধতায় ঘেরা। এরই মধ্যে স্রোতস্বিনী নদী জলতরঙ্গের ঝংকার তুলে আপন মনে এগিয়ে চলেছে। মনে হল যেন এক কল্পনার জগতে এসে পড়েছি যেখানে চরাচর জুড়ে শুধু নৈঃশব্দ খেলা করে। এখানে শুধুই নদী কথা বলে তার পরম প্রেমিক অরন্যের সাথে। হঠাৎ দিনের আলো কমে এল। পাহেড়ের সন্ধ্যেটা যেন বেশী তাড়াতাড়ি হয়। পরিবারের সবার ডাকে হুঁশ ফিরল। চোখে উদ্দামতা আর মনে উল্লাস নিয়ে চললাম আমাদের অস্থায়ী আস্তানার উদ্দেশ্য। নদীর পাড়ে পাহাড়ী জঙ্গল আর তার একপাশে আমাদের হোমস্টে। সুন্দর, ছিমছাম হোমস্টেটিতে হোটেলের আধুনিক অনেক সুবিধাই নেই। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে ভোগবাদের তত্ত্ব চলে না। ঘরে এসে সন্ধ্যেবেলায় গরম গরম পকোড়া আর চা একেবারে জমে গেল। ঘর থেকেই নদীর তর্জন গর্জন শোনা যায়। দামাল গতিতে ছুটে চলা নদীর সাথে বয়ে যেতে থাকে মন। ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। একদিক থেকে ভালোই মনে হল। এরকম একটা নৈসর্গিক জায়গায় এসে জাগতিক সবকিছু তুচ্ছ বলে মনে হয়। প্রকৃতি যেন এখানে থমকে দাঁড়িয়ে আছে এক আদিম শূন্যতায়। নিজের অজান্তেই মন বলে ওঠে এই তো সেই জায়গা যেখানে শুধুই নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। বাড়ির সুস্বাদু রান্নার মতই রুটি ও চিকেন খেয়ে ঘরে ফিরে এসে নদীর উচ্ছল শব্দকে সঙ্গী করে ঘুমের জগতে প্রবেশ করলাম।
পরদিন ভোরে অজানা পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। শীতের পোশাক গায়ে বিছানার উষ্ণতার মায়াটুকু কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। গোটা পাহাড়ী গ্রামটার ঘুম এখনও ভাঙেনি। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা, কিন্তু ঠাণ্ডার ভয়ে ঘরে থাকলে তো আর ভোরের স্নিগ্ধতাকে অনুভব করা যায় না। তাই আশেপাশে হেঁটে ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম সবাই। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। জানালার কাঁচে দেখলাম বৃষ্টি তার উপস্থিতি জানান দিতে আলপনা এঁকে রেখে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চললাম, বেশ কিছুটা যাওয়ার পর ঝর্নার শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দের উৎস ধরে হাঁটতে থাকলাম। বেশ কিছুটা গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে একেবারে ঝর্নার কাছে পৌঁছে গেলাম। অসাধারন এক ঝর্না, নাম বুদ্ধ ওয়াটার ফলস। সিকিমের পথে চলতে গিয়ে আমরা অনেক ঝর্নার দেখা পেয়েছি, কিন্তু বুদ্ধ ওয়াটার ফলসটি অন্যরকম সৌন্দর্যে মোড়া। পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা ঝরনাটি সবুজ পাহাড়ের উপর থেকে সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ফেনিল ধারায়। তার গর্জনের ফলে চারিদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। এখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। ঘরে ফিরতে মন চাইছিল না, রাস্তা দিয়ে শুধু উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকলাম আর ফটো তুলতে থাকলাম। রাস্তায় যেতে যেতেই দেখলাম আকাশে মেঘের ঘনঘটার মধ্যে সূর্য্যিমামা ঝিলিক দিয়ে হাসছেন। পথের ঠারে নানারকমের অজানা ছোট ছোট ফুল ও রংবেরং-এর পাতা দেখে অবাক হলাম। এখানকার প্রতিটি বাড়ীর টবেও নানারকম ফুলগাছ যত্ন সহকারে লাগানো রয়েছে। পাহাড়ী মানুষগুলোর পরমস্নেহ যত্নে এরা বেড়ে উঠছে।
হোমস্টেতে ফিরে এসে প্রাতঃরাশ করে আমাদের বেরোনোর পালা। কিন্তু এমন সুন্দর জায়গা ছেড়ে যেতে মন চাইছে না কিছুতেই। মণে হল পিনকোড হারিয়ে ফেলা চিঠির মত এসে পড়েছিলাম এখানে, পরিযায়ী পাখির মত আস্তানা গেড়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। আবার ফিরে যেতে হবে ইট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলে, নদী, সবুজ পাহাড় আর অরন্যে ঘেরা রোলেপকে কথা দিলাম আবার আসার। শহুরে ব্যস্ততা ছেড়ে প্রান ভরে অক্সিজেন নিয়ে রোলেপের উষ্ণতা গায়ে মেখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম অন্য এক আস্তানার খোঁজে।
কিভাবে যাবেনঃ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ১৩০ কিমি দূরে অবস্থিত রোলেপ।
কোথায় থাকবেনঃ অনেক হোমস্টে আছে, থাকা ও খাওয়া মোটামুটি মাথাপিছু ৮০০-১০০০ টাকার মধ্যে।
কখন যাবেনঃ বর্ষাকাল বাদে বছরের যেকোন সময়।
ছবি ও লেখায় রোলেপকে ভালোবাসলাম
উত্তরমুছুন