অমিতাভ দাস






কালনার পথে পথে

কালনা যাওয়ার ইচ্ছেটা হয়েছিল আরো প্রায় তিন বছর আগেই । নানা কারণে কেন যেন যাওয়াই হচ্ছিল না । কালনা মন্দিরময় শহর । বলেছিল এক ফেসবুক বান্ধবী । আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল । আমি যেতে পারিনি । বলেছিল সে নিজেই সব ঘুরিয়ে দেখাবে । তিন বছর পর অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে কালনা শহরে আসা ।

এক বর্ধিষ্ণু শহর কালনা । বর্ধমান রাজাদের তৈরী নানা মন্দির ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । ১০৮ শিব মন্দির বা নব কৈলাশ যেমন আছে , তেমনি আছে সাধক ভবা পাগলা , শাক্তপদকর্তা কমলাকান্তের সাধনপীঠ , আছে জাগ্রতদেবী সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির , এমনকী মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের পদছাপ । এ মাটি পবিত্র । শত শত বছরের ইতিহাস । সাধকের সাধনালব্ধ কালনার অলিতে-গলিতে কান পাতলে মনে হয় ইতিহাসের ফিসফিস কথা । রাজা-রাণী , পালকি , ঘোড়া , হাতি , লোক-লস্কর আর দেবতার আশীর্বাদ ধন্য অষ্টাদশ শতকের বাংলা ।

এক একটা দিন থাকে সব কাজেই বাধা আসে ।বাড়ি থেকে বেরিয়ে দেখি বাস নেই । অপেক্ষা আর অপেক্ষা । শুনলাম কোথায় শাসক দলের মিটিং অনেক বাস তুলে নিয়েছে । অল্প কিছু বাস চলছে । আধঘন্টার বেশী অপেক্ষা করে একটা বাস পেলাম । আওয়াল সিদ্ধি পর্যন্ত গিয়ে আবার ট্রেকারে নৈহাটি । ২৪-২৫ মিনিটের পথ এক ঘন্টায় পৌঁছল । ফলে যে ট্রেনটা ব্যান্ডেল থেকে ধরার কথা সেইটে পেলাম না । রামপুরহাট ধরে ব্যান্ডেল পৌঁছলাম । পাক্কা দেড় ঘন্টা ব্যান্ডেল স্টেশানে বসে থেকে কাটোয়া লোকালে যখন পৌঁছলাম তখন হাত ঘড়ি বলছে ৩-৪৫ । আমার বন্ধু দাঁড়িয়ে স্টেশানে । বাড়ি থেকে আমার জন্যে সুস্বাদু  খাবার বানিয়ে নিয়ে এসেছে । নিজের হাতে রান্না করেছে পোলাও আর চিকেন কষা । খিদের পেটে তা যেন অমৃত--আহা কী স্বাদ !! ওয়েটিং রুমে বসেই পেটপুজো সমাধা করেই স্টেশানের বাইরে এসে টোটো ধরলাম । গন্তব্য নব কৈলাশ বা ১০৮ শিবমন্দির ।

ট্রেনে বসে বসে একটা কবিতা লিখেছিলাম । আর বাকিটা সময় একটা পত্রিকা  থেকে গল্প পড়েই কাটিয়ে দিলাম । খুব একটা বোর ফিল করিনি । 

" পাখিময় গ্রাম

সোমড়াবাজারে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বটবৃক্ষের মতো একটি বিকেল হলুদ মাখা মাঠকে ছুঁয়েছিল । ভৈরবীতলায় পুজোপাঠ শেষে শান্ত হয়ে ঘুমিয়েছে দেবতার বিগ্রোহ । এই হেমন্তে ঝরে যায়  অপেক্ষারঙের পাতা । আমাদের অতিলৌকিক বাসনার মতো নির্জন লেগে থাকে বেহুলা স্টেশান জুড়ে । তোমাকে ভালোবাসার পর পদ্ম ফুটে ওঠে ওই সব রাত্রির মতোন । দেখি ধুলোর মতো ছুঁয়ে থাকা হাত--- গুপ্তিপাড়া , বর্ধিষ্ণু গ্রাম । নেমে যায় সহযাত্রী সব । ওই তো দেখা যায় তোমাদের পাখিময় গ্রাম..." 

টোটোতে যেতে বন্ধুকে বললাম কালনা সম্পর্কে দু-চারটি কথা । পূর্বে এই বন্দরনগরী কালনাই ছিল বর্ধমানরাজাদের গ্রীষ্মাবাস । শাক্ত ও বৈষ্ণব উভয়ের কাছেই তীর্থবিশেষ কালনা । ৬৮৮ শকাব্দে সাধক অম্বরীশ দেবী অম্বিকার কৃপায় সিদ্ধিলাভ করেন । সিদ্ধিদাত্রী বলে দেবী এখানে সিদ্ধেশ্বরী কালী নামে অভিহিতা । দেবী অম্বিকার নামেই কালনা অম্বিকা-কালনা নামে পরিচিত । মহারাজ চিত্রসেন ১৭৫১ সালে চারচালার মন্দির গড়েন দেবীর জন্যে । খুব-ই জাগ্রতা দেবী অম্বিকা । তবে ঐতিহাসিক মত , জৈনদেবী অম্বিকা কালান্তরে হিন্দু দেবীতে রুপান্তরিত হয়েছেন । গল্প চলতে চলতেই টোটো এসে দাঁড়াল ১০৮ শিব মন্দিরের সামনে ।

টোটো থেকে নেমে আমরা প্রবেশ করলাম নব কৈলাসে । প্রবেশের মুখেই জুতো খুলে রাখলাম । অপূর্ব চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আর নৈঃশব্দ্য বিস্মিত করে দিল । ১০৮ শিব মন্দির গোল করে ঘোরানো । মন্দিরের ছাদগুলি গম্বুজাকৃতি । আছে শ্বেত শিব আর কালো শিব । ১৮০৯ সালে মহারাজা তেজচন্দ্র মন্দিরগুলি তৈরী করেন । মন্দিরগুলির কেন্দ্রস্থলে একটি বেলগাছ । অদ্ভুত এক নীরবতা আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলল । চুপচাপ কেবল অনুভব করে গেলাম ইতিহাসের পদশব্দ । কল্পনার রঙে মনে হল ইতিহাসের ওপর দিয়েই হাঁটছি । খুব সুন্দর সাজানো । তবে মন্দিরগুলির শিল্পকর্ম আজ প্রায় কিছুই নেই , অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে ।

এই মন্দির থেকে বেরিয়েই উল্টোদিকে প্রবেশ করে দেখলাম অপূর্ব টেরাকোটা কাজের প্রতাপেশ্বর শিব মন্দির । ১৮৪৯ সালে রাজা প্রতাপচন্দ্রের মহিষী প্যারীকুমারী তৈরী করান এই মন্দির । চমৎকার এই মন্দিরটির শিল্পী ছিলেন বাঁকুড়ার সোনামুখীর রামহরি মিস্ত্রী ।এমন শিল্পীকে মনে মনে শ্রদ্ধা জানালাম ।  কেউ কেউ বলেন প্যারীকুমারী মঠ । কেউ বলেন জলেশ্বর শিব । আমরা দেখলাম স্থানীয় কয়েকজন বয়স্ক মানুষ মন্দিরে বসে আছেন । গল্প করছেন । আমরা দূর থেকে প্রণাম করে এগিয়ে গেলাম । সামনেই চমৎকার রাসমঞ্চ । যার কারুকাজ মুগ্ধ করে । সন্ধ্যা হবে হবে-- জ্বলে উঠেছে বহুবর্ণের আলো । পরিবেশ আরো চমৎকার রহস্যমদির হয়ে উঠেছে । ভালো লাগায় ভরে যাচ্ছিল আমাদের মন । আমরা এক অপার্থিবের নেশায় এগিয়ে যাচ্ছিলাম । 

একটু এগোতেই লালজী মন্দির ।এই মন্দিরের টেরাকোটা কাজ মুগ্ধ করে । অধিকাংশ কাজ সময়ের স্রোতে নষ্ট হয়ে গেছে । তবু যা দেখলাম , তার গুরুত্ব কম নয় । আমার বন্ধুটি অনেক ছবি তুলল । ১৭৩৯-৪০ সালে মহারাজা কীর্তিচাঁদ তাঁর মায়ের নির্দেশে এই মন্দির নির্মান করান । আগে ৫২ রকম ভোগ দেওয়া হত । পশ্চিমবঙ্গে মোট ৬ টি পঁচিশরত্ন মন্দির আছে , যার একটি লালজী মন্দির । লালজী ও শ্রীরাধার নিত্য পূজা হয় । দেখলাম পূজারি অদূরে বসে আছেন একটি সিঁড়িতে । নাটমন্দিরে এক ভদ্রমহিলা ভাগবৎ পাঠ করছেন । তাঁকে ঘিরে আছেন আরো কয়েকজন স্থানীয় মহিলা । ধূপ-দীপ জ্বলছে । আমরা কাছে গিয়ে প্রণাম করে নীচে নেমে এলাম । ওই মন্দির চত্বরের মধ্যেই আরেকটি মন্দির । একটু অন্যরকম । নাম গোবর্ধন মন্দির । ওই মন্দিরের মাথায় নানান দেবতা ও প্রাণীর ভাস্কর্য । অভিনব । প্রথাগত মন্দিরের থেকে আলাদা ।
ওখানেই দেখলাম একটা রঙ করা পালকি । যা পুরনো দিনের সাক্ষ্য দিচ্ছে নীরবে ।

শীতকাল । দ্রুত সন্ধ্যা নেমে আসে । একটু বেশি সময় থাকবার অবকাশ নেই । লালজী মন্দির থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম কৃষ্ণচন্দ্রজীর মন্দিরে । এটিও পঁচিশরত্ন মন্দির । তিনটি তল । নিত্য পূজিত হন কৃষ্ণচন্দ্রজী এবং রাধারাণী । মূর্তি দুটি দারুকাষ্ঠ নির্মিত । ভোগ হিসেবে নিত্য মাখন -মিছরি দেওয়া হয় । সন্ধ্যায় হয় আরতি । স্থানটির অবর্ণনীয় নির্জনতা ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ ভালো লাগে । কাছেই আছে রাম-সীতা মন্দির । সেখানে একজন অল্প আলোয় বসে রামকথা পাঠ করছিলেন । রামসীতা মন্দিরের উল্টোদিকে বদ্রী-নারায়ণ মন্দির । তবে সেখানে আলো বড় কম । বিগ্রহের মুখটা ভালো করে দেখা যায় না । সন্ধ্যার ধূসর আলোয় দেখলাম কাছেই একটা পাতকুঁয়া । এক বালতি জল ওঠানো । দেখেই বোঝা যায় বহু প্রাচীন এই কুঁয়া । ওপরে লোহার জালিকা দিয়ে ঘেরা । আমার বন্ধুটি কবি । সে কাছে গিয়ে দেখলে । বললে , এইখানে একটা ছবি তুলে দিন । বললাম , তাহলে এই স্থানে বোসো চন্ডালিকার মতো --- ছবি তুলে রাখি । ক্যাপশন : নির্জন মন্দিরে একা চন্ডালিকা । সে হাসলে । বললে , যত্ত ঢং...

যেকথা বলছিলাম , কৃষ্ণচন্দ্র মন্দিরটি তৈরী করান ১৭৭১ সালে রাজা ত্রিলোকচন্দ্র মা লক্ষ্মীকুমারীর উদ্দেশ্যে । আবার কেউ বলেন এই মন্দির তৈরী করেন লক্ষ্মীকুমারী স্বয়ং । যাইহোক , বন্ধুটির ইচ্ছে কিছুক্ষণ কৃষ্ণচন্দ্রজীর পদতলে বসবে । ফলে বসলাম । আমাদের উল্টোদিকে দুটি মেয়ে বসে বসে জনপ্রিয় হিন্দি গান শুনছে । বললাম , এখানে বসেও হিন্দিগান ! একজন শুনতে পেয়ে হেসে ফেললে এবং লজ্জা পেল মনে হয় । গান থেমে গেল । আমরা বসে বসে ইতিহাসের কথাই ভাবতে লাগলাম । রাজাদের কথা । তাঁদের বিপুল সম্পদের কথা । চারিদিকে বিচিত্র বর্ণের আলো আমাদের গায়েও এসে পড়ল । বন্ধুটি বললে , ওই দেখুন মন্দিরটা এখন আরো সুন্দর লাগছে । এবার একটা ছবি তুলুন ।

বাইরে এসে দেখি সন্ধ্যা হয়েছে । নেমে গেছে অন্ধকার । অথচ চারপাশে যেন উৎসবের মেজাজ । বন্ধু বললে , এবার আমাদের গন্তব্য কোথায় ? বললাম , সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি । তোমার কোনো সমস্যা নেই তো ? সে বললে , আমি স্থানীয় মানুষ । সমস্যা থাকবে কেন ? চলুন যাওয়া যাক , বলে একটা টোটোতে উঠে বসলে সে । আমি উঠতে উঠতে বললাম , চলুন ভাই সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ।
যেতে যেতে পথেই কথা হল বন্ধুটির সঙ্গে । কে এই সিদ্ধেশ্বরী ? বললাম , বহু পুরাতন দেবী । রূপরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গলে এই দেবী কথা আছে ।

তোমার মহিমা মাতা কী বলিতে পারি ।
অম্বুয়ার ঘাটে বন্দো কালীকা ঈশ্বরী ।।"

মনে রাখতে হবে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে কালনার নাম কিছ আম্বুয়া বা অম্বুয়া নগর । প্রথমে খড়ে ছাওয়া দুই চালার ছিল । বেশ উঁচু একটা ঢিবির ওপর । ইনি ছিলেন যোগী অম্বঋষির আরাধ্যা দেবী । তাঁর নামানুসারে দেবী অম্বিকা । অম্বিকার নামানুসারে অম্বিকা-কালনা । তিনি সকল সিদ্ধিদাত্রী বলে সিদ্ধেশ্বরী । যেখানে তিনি থাকেন সেইটি এখন সিদ্ধেশ্বরী পাড়া । 

১১৪৬ বঙ্গাব্দের ২৬শে জ্যৈষ্ঠ রাজা চিত্রসেন বর্তমান   মন্দিরির  নির্মাণ করেন । কথায় কথায় পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সামনে । টোটো থামতেই মন্দির লাগোয়া দুই দোকানি আমাদের ডাকলে । এমনকী নিজেদের মধ্যে বচসা শুরু করে দিলো কে আগে ডেকেছে । হাতে সময় নেই । সহজ সমাধান করে দিলাম । আমি এক দোকান থেকে পুজোর জন্য ডালা নিলাম , বন্ধুটি অন্য দোকান থেকে । 

ভেতরে প্রবেশ করে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে কয়েকটি সিঁড়ি পেরিয়ে মায়ের সামনে এসে বসলাম । পুজো দিলাম । প্রার্থনা করলাম । তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখলাম মায়ের অপার্থিব করুণাঘন রূপ । এদিন মা তুঁতে রঙের একটা বেনারসী শাড়ি পরেছিলেন। তিনি চতুর্ভূজা । পাঁচফুটের মতো দারুকাষ্ঠে নির্মিত । অথচ দেখলে মনে হবে যেন কষ্টিপাথরের । আমাদের পুজো হলে পর পূজারী বাইরে বেরিয়ে বেশ উচ্চকন্ঠে পাঠ করতে থাকেন--" হে কৃষ্ণ, করুণাসিন্ধু দীনবন্ধু জগৎ পথে...আরো একবার আমরা বুঝলাম , সব-ই নামের প্রভেদ । আসলে যে কালী সেই কৃষ্ণ ।

 খুব অল্প সময় ছিলাম । চলে আসতে হল । ট্রেন ধরতে হবে । দেখা হল না সাধক কামলাকান্তের সাধনাভূমি , ভবা পাগলার আশ্রম , মহাপ্রভুর পদছাপ , বদর শাহের মাজার , কালীনগর পাড়ার বুদ্ধমন্দির , ভগবানদাস বাবাজীর আশ্রম । যেখানে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এসেছিলেন মথুরবাবুকে সঙ্গে নিয়ে । একদিন আবার সময় করে যেতে হবে । তখন আবার কিছু লিখব । 
আমাদের টোটো এসে দাঁড়িয়েছে স্টেশানের কাছে । বন্ধুটি হাত নেড়ে বিদায় জানাল । বললে , সাবধানে যাবেন । সেই টোটোতেই সে চলে গেল বাড়ির পথে । আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম প্রায়ান্ধকার স্টেশানে ট্রেনের অপেক্ষায় । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য