সোমা কুশারী



"খেলুড়ি"
গোটা কুড়ি পঁচিশ কুচোকাচা নীল লাল জার্সি পরে মাঠময় ছুটে বেড়াচ্ছে। কটা অবশ্য গোল হয়ে ছায়াতেও বসেছে তবে সে সব হাতে গোনা, গনগনে দুপুরের আঁচকে মোটে পাত্তা না দিয়ে বেশিরভাগ-ই মগ্ন ব্যাট বলে। টিভিতে একমাস ধরে রোজ রোজ টি টুয়েন্টি দেখে দেখে এইসব খুদে খুদে ক্রিকেটাররা সব মাঠে কিছু করে দেখানোর জন্য মুখিয়ে আছে। ওদের সবুজসংঘ ক্রিকেট একাডেমী ও সেই রেশ রেখেই শুরু করেছে নিজেদের মধ্যে লিগের খেলা। ছটা দল বেছে নিজেদের মাঠেই এই গরমের ছুটির দুপুরগুলোকে একেবারে ব্যাটে বলে উপাদেয় করে তুলেছে।

মা বাবাদের ও উৎসাহের শেষ নেই, দিব্যি সক্কাল সক্কাল বাচ্ছা বগলে হাজির হয়েছে মায়েরা, বাবা মায়ের জুটি ও আছে বেশ ক'জন। নগদ দেড় হাজার করে প্রতি ছেলে পিছু দিয়ে টিয়ে বাড়ির লোক ও রাতারাতি ক্রিকেট বোদ্ধা হয়ে উঠেছেন। মাঠের বাঁ-দিকে পর পর লম্বা বেঞ্চে মায়েরা পাশাপাশি বসেছেন, বাবারা ও কেউ ঘাসে কেউ মাঠের রেলিং-এ জাঁকিয়ে বসেছেন। গা ঘামিয়ে নিচ্ছে ছেলেরা। সে এক দেখবার মতো দৃশ্য--ফুটবলের মতো গ্লামার হীন ব্যাপার নয় মোটে রীতিমত দুই দল দুই রঙা জার্সি প্যাড টুপি ফুপি পরে দেখার মতো হয়ে উঠেছে।

   মায়েদের উৎসাহ দেখবার মতো, এই সাত সকালে আসার জন্য কোন ভোরে উঠে রান্না বান্না সেরে টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার ভরে সকলে হাজির। ব্যতিক্রম শুধু নীল জার্সির মাঝারি উচ্চতার হাড় জিরজিরে মেয়েটা। ঢলঢলে জার্সি গায়ে সাধারণ কেটস্ পায়ে একমনে বল করছে। প্রখর সূর্যের তাপে কালো মুখটা আরো কালো হয়েগেছে, এরই মধ্যে ঘামে ভিজে উঠেছে পিঠের জার্সিটা। ওর মা ও বসে আছে অভিভাবকদের জন্য বরাদ্দ বেঞ্চের এককোনে। ও মহিমা মন্ডল, এই একাডেমীর একমাত্র মেয়ে খেলুড়ে---না! ওকে কেউ ক্রিকেটার বলে না এখানে। গর্বিত ছেলের মায়েরা ঠারে ঠোরে গত দুবছর ধরে বহু বুঝিয়েছে ও আর ওর মাকে ক্রিকেট খেলাটা অত সহজ নয়! বিশেষত একটা বছর বারো তেরোর মেয়ের ঝপ করে একগাদা ছেলের মাঝে প্র্যাকটিস করাটাও খুব একটা ভালো দেখায় না! তা মা মেয়ে শুনলে তো? একাডেমী কোচ ছোকরাকেও বলিহারি! দিব্যি ওটাকে মনোযোগ দিয়ে বোলিং শেখায়, একাডেমীর আরো দুজন কোচ আছেন তারা অবশ্য খুব একটা যে ওটাকে পছন্দ করেন না তা আচরণেই প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তমঘ্নর মায়ের অবশ্য কড়া নজর, এই তো একটু আগে বেশ রসিয়ে বলছিলো কবে নাকি দত্ত স্যার  এই মেয়ে আর ওর মাকে আচ্ছা ঝাড় ঝেড়েছিলেন ঐ ন্যাতার মতো কাম্বিশের কেটস্ পরে  খেলতে আসার জন্য। উত্তীয়ের মা  সব শুনেটুনে মুখ বেঁকিয়ে বললো, কত কীই-ই তো হলো এই দুবছরে , কোনোদিন দেখলাম না ব্যাট প্যাডটাও ঠিকঠাক কিনে দিয়েছে অথচ শখ কতো? অভিরুপের বাবা পুলিশের বড় পোস্টে আছেন ওঠা বসানো সব ওপর মহলে বলল - - ছাড়ো তো! ওর বাবা তো বাড়ির সামনে ছোটো একটা মুদিদোকান চালায় মা ও হেম ফেম করে ব্লাউজ টাউজে ও আর কত দূর যাবে? নিজেদের ছেলেদের খেলায় কনসেনট্রেট করো তো!

    দেবী মেয়ের একমনে বল করা দেখছিল। খেলা আরম্ভ হবার আগে  মেয়েটাকে অল্প স্বল্প কিছু খাইয়ে দিতে হবে। স্টীলের টিফিন বাক্সে মা আর মেয়ের রুটি আর আলু চচ্চড়ি ভরা আছে। আসার পথে মেয়েটা চারটে হজমোলা লজেন্স কিনে দিতে বলেছিল দেবী সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছে। মেয়েটার চাহিদা বড্ড কম, ঐ ডাল ভাত আলুভাজা হোক বা শুকনো রুটি আলু চচ্চড়ি সোনা মুখে খেয়ে নেয়। এই যে সপ্তাহে তিনদিন দেড়ঘন্টা ট্রেনে চড়ে একাডেমী আসে কোনোদিন মুখ ফুটে কিছু চায় না। শুধু এই ক্রিকেট খেলাটাই ওর প্রাণ। দেবী তাই কিছুতেই একদিন ও প্র্যাকটিস কামাই করায় না। রাত থাকতে উঠে ঘরের সব কাজ সেরে দুটো রান্না করে মেয়ে নিয়ে সেই বীননগর থেকে এই কল্যাণী মেয়েকে প্র্যাকটিসে নিয়ে আসে।


 কালো মেয়ে তার এই কঠোর পরিশ্রম করে করে আরো কালো আর ডিগডিগে হয়ে যাচ্ছে জানে দেবী, নিজের শাশুড়ি - ই তো রাত দিন ঠেস মেরে মেরে ছেলেকে কথা শোনায় - - ওরে ও মনু মেয়েটাকে ঐ ছেলেদের সাথে ব্যাট বল পিটোতে না দিলে কী চলছিলো না বাপু? একে তো পড়াশুনায় একেবারে মাথা নেই তারপর ঐ  খেলে দেলে রূপের ধুচুনি হলে আর দেখতে হবে না! জায়েরা যদিও সব আলাদা তবু বাড়ী তো একটাই, তারাও মাঝে মাঝেই ঠোকরায় - - - পূজোয় আর মেয়েকে সালোয়ার কামিজ টামিজ দিস না বাপু! ঐ সাদা প্যান্ট আর গেঞ্জি মেঞ্জি - ই কিনে দে বুঝলি! সন্তোষ কিন্তু কোনোদিন  মেয়ের এই খেলা নিয়ে পাগলামিকে খারাপ চোখে দেখেনি, বরং নিজে দোকান বন্ধ করে সপ্তাহে তিনদিন মেয়েকে নিয়ে আসতে পারবে না বলে দেবীকে জোর করে পাঠিয়েছে। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে ও মেয়ের ব্যাট প্যাড গ্লাভস যখন যা দরকার কিনে এনে দিয়েছে।

   দুবছর আগে যেদিন প্রথম বাপ-বেটিতে একাডেমীতে ভর্তি হবে বলে এসেছিল দেবী ও সেদিন রাজী ছিলো না। দুদিন ধরে স্বামীকে অনেক করে বুঝিয়েছিল দেবী ছেলেদের সাথে উঠতি বয়সের মেয়ের ছোটাছুটি খেলাধূলা ঠিক নয়! তারপর ওসব ক্রিকেট মিকেট বড় লোকের খেলা কী হবে ওসব খেলে? সন্তোষ শোনেনি অভাবের তাড়নায় পেটের তাগিদে তাকে ফুটবল ছাড়তে হয়েছে মেয়েটা তার সেই বছর দুয়েক বয়স থেকে বল পেলে আর কিছু চায় না হাঁ করে টিভিতে ক্রিকেট গেলে ওকে খেলা যে করেই হোক শেখাবে। একাডেমী ও প্রথম দিন নিতে চায় নি এতগুলো ছেলের মাঝে একটা মেয়ে খেলবে ক্লাব কীভাবে পারমিশন দেয়? শেষে অল্পবয়সী কোচ অম্লানের উদ্যোগেই মহিমা নিয়মিত প্র্যাকটিস করছে।

 আজকের ফাইনালটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সি এ বি থেকে কয়েকজন আসার কথা এই ম্যাচের পারফরম্যান্সের উপর আন্ডার থারটিনে সি করা নির্ভর করছে। দেবী মেয়ের জন্য রুটি তরকারি টিফিন বক্সের ঢাকায় বেড়ে দিতে দিতে ভাবে পারবে কী মেয়েটা? সেমিফাইনাল অবধি তো সব ঠিকঠাক-ই ছিলো গতকাল  রাতেই মাসিক শুরু হয়েছে। নতুন নতুন বলেই বেশ কষ্ট ও পাচ্ছে। আগের মাসেই তো যন্ত্রণার চোটে দু দুটো দিন স্কুল মুখো হতে পারেনি। আজ ও সকালে ট্রেনে আসার সময় কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল। পাশের বাড়ির মার মা পই পই করে বলেছিল দেবীকে এ অবস্হা সাত আট ঘন্টা বাড়ির বাইরে থাকা তার মধ্যে এত যন্ত্রণা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে? খেলা শুরু হবে বোধহয়, দেবী তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলে ম্যাচ শুরুর আগে মহিমা একবার বাথরুম ঘুরে আসতে বলতে হবে। ভালোভাবে ব্যবস্থা নিয়ে মাঠে না নামলে এতগুলো লোকের মধ্যে লজ্জায় পড়বে মেয়েটা।  মাঠের বাথরুমটা কমন আলাদা মেয়েদের কোনো ব্যবস্থা নেই মহিমা তাতেই তৈরি হয়ে নেয়। টস্ হয়ে গেল। মহিমাদের টিম  ব্লু ডট ব্যাট করতে নামছে। দেবী হাফ ছেড়ে বাঁচে, যাক্ মেয়েটা একটু রেস্ট পাবে।

   রেড ডট এমন বল করা শুরু করল যে পর পর ওয়াইড করছে ব্লুডট ও মায়ের আছে রান না করেই স্কোর বোর্ড চালু রয়েছে যখন তখন ব্যাটসম্যানদের দেখে কে? সৌমাদিত্য আর রাহুল সিংহ ওপেন করতে নেমেছিল দুই ওভার ওয়াইড আর খুচরো রান মিলে তেরো উঠতেই পর পর বলে দুজনে রান আউট হলো। সেই যে শুরু হলো বিপর্যয় পর পর উইকেট পড়া আর থামলই না। ব্লুডটের অভিভাবকদের মধ্যে থেকে চাপা গুঞ্জন উঠল একেবারে খেলো টিম গড়ে একাডেমী এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ছেলেগুলোর একটাও নিজেদের প্রতিভা মেলে ধরতেই পারছে না! রুদ্রদেবের বাবা একজন নামকরা গাইনোকোলোজিস্ট এত পার যে একদিন ও চেম্বার না করলে চলে না সেই তিনি ও আজ ছেলের খেলা দেখতে মাঠে এসেছেন আর রুদ্রদেবের কিনা এগারোটা রান করেই এল বি! ব্লুডট মাত্র একশো একুশে গুটিয়ে গেল দেবী অবশ্য মেয়ের কাছ থেকে আহা মরি কিছু আশা করেনি মহিমা আট রানে প্যাভিলিয়নে ফিরল। মেয়েটা বরাবরই পেশ বল করে ঐ চেহারায় অতো জোরে বল করার শক্তি যে কোথা থেকে পায় কে জানে?

  রেডডট প্রথম থেকেই চালিয়ে খেলছে। সি এ বিরুদ্ধে দুই কর্তা রেডডটের দুই বোলার রাজীব আর সওকতের সাথে আলাদা ভাবে কথা বলেছে সবাই খেয়াল করেছে। মায়েরা আলোচনা করছে শুনল দেবী যতই খারাপ ব্যাটিং করুক পলাশ আর রণি ও ওদের নজর কেড়েছে । তিন ওভার গড়াতেই  ব্লুডটের পুচকে ক্যাপ্টেন রৌনক মহিমা হাতে বল তুলে দিলো। দেবী ভয়ে ভয়ে মেয়ের ছুটে আসা লক্ষ্য করছে মাঠে হালকা গুঞ্জন ছেলেদের টিমে মেয়ে কে জানে সি এ বিরুদ্ধে লোকেরা কেমন ভাবে নেবে? পর পর কটা সঠিক লাইন লেংথ রেখে বল করেই মহিমা যেন জ্বলে উঠল পর পর দুই ওভারে কী সুন্দর পট পট দুটো উইকেট তুলে নিলো। তারপর-ই ঘটল ঘটনাটা হঠাৎ -ই মাঠে ফিল্ডিং করতে করতে শুয়ে পড়ল মেয়েটা।ছুটে গেল কয়েকজন দেবী ও ছুটল । অসহ্য পেটে ব্যথা তখন মেয়েটা কাতড়াচ্ছে। টেন্টে শুয়ে দেওয়া হল মহিমাকে । দেবীর দুচোখে ফেটে জল পড়ছে, আহারে! শেষে এত কষ্ট বিফলে গেল শুধু মেয়ে বলেই আজ এতবড় সুযোগটা পেয়েও ছিটকে গেল  মেয়েটা! টেন্টে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল অম্লান স্যার সঙ্গে  মাঠের ডাক্তারবাবু ও আছেন রুদ্রদেবের বাবা ডাক্তার মুখার্জী ও এসে পড়েছেন। মহিমা একঝলক দেখেই তিনি বললেন এর বাড়ি থেকে কে এসেছে? দেবী মেয়ের মাথার কাছে বসেছিল মুখ তুলে তাকাতেই ডাক্তার মুখার্জী বললেন মেনসুরাল পেন। তারপর ক্লাবের-ই একজনকে ডেকে একটা কাগজ পেন নিয়ে খস্ খস্ করে কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন। অম্লান ততক্ষনে দেবীর হাতে একটা ও আর এসের বোতল তুলে দিয়েছে দেবী ঢোকে ঢোকে খাইয়ে দিচ্ছে মেয়েকে।

   রেডডট পনেরো ওভারে নব্বই তুলে ফেলেছে। জেতা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ওষুধ গুলো খেয়ে মহিমা এখন অনেকটা সুস্হ। চুপচাপ মায়ের পাশে বসে খেলা দেখছে। হঠাৎ - ই অম্লান স্যার এসে ডাকলেন মহিমাকে,মেয়ে উঠে গেল নিঃশব্দে। তারপরই দেবী সহ সকলকে বিস্ময়ে হতবাক করে দিয়ে সটান  মাঠে নেমে পড়ল । মেয়েটা কী আজ পাগল হয়ে গেছে?  ক্যাপ্টেন রৌনকের হাত থেকে বল তুলে নিয়ে আবার মাঠের ঐ মাথা থেকে রান আপ করে ছুটে আসছে মেয়েটা। দেবী আর ভাবতে পারছে না। একটু আগেও জনে জনে প্লেয়ারের মায়েরা তাকে নানা কথা বলে গেছে পিরিয়ডের সময় মেয়েকে খেলতে আনার জন্যে, দেবী ও লজ্জায় অপমানে মনে মনে একরকম ঠিক করে ফেলেছে, আর নয়! বাড়ি গিয়ে সন্তোষকে বলবে ক্ষ্যামা দাও! আর মেয়েকে ঝুলন গোস্বামী বানিয়ে কাজ নেই! আর এখন? মেয়ে আবার মাঠে নামল। ছিঃ! ছিঃ! এতগুলো পুরুষ মহিলার সামনে মেয়েটার পিরিয়ডের কথা প্রকাশ পেয়ে তো গেছিল এখন আবার - -

   দেবীকে ভাবতে না দিয়েই পর পর তিনটে উইকেট নিলো মহিমা। যে দলটিকে একটু আগে মনে হচ্ছিল জয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তারাই শেষ পর্যন্ত ন রানে হারলো।

 কৃষ্ণনগর লোকালে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলো দেবী, সারাদিনের ধকলে পরিশ্রান্ত মেয়েটার মুখে চোখে আজ কিন্তু এক অন্যরকম আলো-----সামনের সপ্তাহে - ই যে বাপের সাথে কলকাতায় সি এ বি-র মাঠে সই করতে যাবে মেয়ে!  আসার  সময় অম্লান স্যার  যে বলে দিয়েছেন - - মহিমা, তোকে কিন্তু ইন্ডিয়া টিমে খেলতে হবে! পারবি তো? মহিমা জানে  ও ঠিক পারবে! পারতে ওকে হবেই।

  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য