বৈশালী চ্যাটার্জী
তাহলে এবারের মতো পুজো শেষ l শেষ হলো বছরভরের তোড়জোড় আর অনেক অপেক্ষার l এখন ছাতিম ফুলের গন্ধ মেশা অল্প শিনশিনে রাতে কাঁচের জানলার ওধারে নতুন অপেক্ষারা ভীড় জমায় l তাদের ঢুকতে দিই না সহজে l শেষ আর শুরুর মাঝে যে ঘোর লাগা নেশা নেশা ভাব, তা আরেকটু উপভোগ করার সময় দরকার l দরকার ইচ্ছেগুলোকে ভালো করে গুটি বাঁধবার সুযোগ দেওয়ার l
এখনকার অপেক্ষাদের হুড়োহুড়ি, দাবীদাওয়া বড়ো বেশী l তাই হয়তো বহু পাওয়াকে ছাপিয়ে না পাওয়ার কষ্টটাই প্রকট হয়ে ওঠে l তখন ছোটবেলায় অপেক্ষার রঙ ছিলো আলাদা l এসময় ঘরে ঘরে তিলের নাড়ু, নারকেলের নাড়ু, তক্তি, ছাঁচের নানান মিষ্টি তৈরির গন্ধে পাড়া ম ম করতো l মা তার সাথে বানাতো কামরাঙ্গা গজা, কুটি গজা আরো কতো কী ! আমি অপেক্ষা করতাম মা'র ডাকের, "এদিকে আয়... দেখ তো রে কেমন হলো...."
আমরা বিজয়া করতে যেতাম প্রতিবেশীদের বাড়ি l রিম্পাদের বাড়ির নারকেল নাড়ুতে কর্পূরের গন্ধটা আমার ভারী ভালো লাগতো l দুই একটা সন্ধে এভাবে কাটতেই রাতে খাবার সময় মা ঘোষণা করতো, "ঢের হয়েছে l আর না l কাল থেকে বইপত্র নিয়ে বসবে l"...কথাটা শুনে শেষ পাতের ভাতটুকু খাবার ইচ্ছেটাই উবে যেত l
সকালে দাঁত মাজতে মাজতে পিছনের পুকুর পাড়ে গিয়ে দাঁড়াতাম l দ্দিভাইদের হাঁসগুলোকে দেখতাম কী সুন্দর সার বেঁধে হেলেদুলে এসে খানিক উড়ে ঝপাং ঝপাং করে জলে পড়ছে l ইশ ! কী মজা ওদের l রোজ রোজ ছুটি l পড়া নেই l স্কুল খুললেই পরীক্ষা নেই l খালি খাওদাও আর সাঁতরাও l এসব গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে যে দু'দন্ড ভাববো, তারও উপায় নেই l মা হাঁক পাড়তো , "এখনো দাঁতমাজা হলো না? আর কতক্ষণ ? "
বিরস বদনে ঘরে ফিরতে হতো l অতি অনিচ্ছায় বইপত্র খুলে বসতে বসতে দেখতাম বাবা অফিসে যাবার জন্যে তৈরী হচ্ছে l ওহ ! তবে আমি একা নই, আমার মতন হতভাগ্য আরো আছে !
দুপুরে মা'র সাথে এক বালিশে শুয়ে পূজাবার্ষিকী পড়তে পড়তে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়তাম l তাড়াতাড়ি আলো পড়ে আসা বিকেলে হঠাৎ ঘুম ভেঙে মন কেমন করে উঠতো l
"ডেকে দাওনি কেন?" বলতে বলতে জামা পাল্টে, মাথার সামনের দিকটা কোনোমতে আঁচড়েই দৌড় l মা পিছন থেকে চেঁচাতো, "আরে ও কী হলো ? পিঠের বোতাম আটকা ! "
কে শোনে কার কথা ? এক ছুট্টে ততক্ষণে বারোয়ারি মাঠে l
"খেলা অর্ধেক শেষ, এতক্ষণে আসা হলো ?" সীমা কোমরে হাত দিয়ে বলতো l আমি চটপট হাওয়াই চটি খুলে রেডি l দোলাদি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে বলতো, "কেয়া ভাই আমাদের দলে... "
খেলা শেষে মাঠের ধারে বসে আলোচনা হতো কার কোন জামাটা বেশী ভালো আর দামী l আমি ভাবতাম জামার আবার দামী কী? যে জামায় যত ঘের সে জামা-ই সবচেয়ে ভালো l ঘুরলে কেমন ফুলের মতন হয় l এসব অবান্তর আলোচনার চেয়ে হরেনকাকার দোকান থেকে দীপার কিনে আনা কচুভাজায় মন দেওয়াই বেশী জরুরী মনে হতো আমার l বাড়ি ফেরার পথে কমলকাকু ডেকে বলতো, "দু'খানা গান রেডি করে রাখবি, রোববার বারোয়ারিতে ফাংশান... "
ঠিক যে গানগুলো বিচ্ছিরি লাগতো মা তার থেকে দু'খানা বেছে পাশের বাড়ির বাপিদার সাথে তবলায় প্র্যাকটিস করতে পাঠাতো l আমি কোন এক অজ্ঞাত কারণে জ্ঞান হওয়া ইস্তক বাপিদার বাবা আর মাকে মামা আর মাসি ডাকতাম l জানলা দিয়ে দুই পরিবারে দিব্যি গল্প হতো রোজ l
তো বিচ্ছিরি লাগা গান দুটো খুব অনিচ্ছাসহকারে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বিচ্ছিরি ভাবেই গাইতাম l বাপিদা মুখ বেঁকাতো, "ছ্যাহ ! ওই শুক্লার মতো হচ্ছে ... "
আমার শুনে পিত্তি জ্বলে যেত l পাড়ার বেতালা বেসুরো শুক্লা শ্বাস টেনে টেনে জঘন্য গাইতো l রেগে বলতাম, "আর তোর ওই বারোয়ারীর ঢাকিটার মতো হচ্ছে... "
বাপিদা তবলা ফেলে উঠে যেত l আমি খাতা বন্ধ করে বাড়ি চলে আসতাম l
মা জিজ্ঞেস করতো, "কী হলো? "
জানলা দিয়ে মাসির কাছে সব শুনে মা বাপিদার পক্ষ নিতো l পড়াশোনায় বাড়াবাড়ি রকমের ভালো বাপিদা l প্রত্যেক পরীক্ষায় ওর ভালো রেজাল্ট আমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলতো l তাকে ঢাকি বলাতে মা রেগে গিয়ে সেবার বর্ণ বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেললো, "তুই ওকে ঢাকি বলেছিস? ওর নখের যুগ্যি নই তুস... "
সামান্য চিন্তা করে নখ খাওয়া বাপিদাকে সেদিন পুরো ডুবিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, "ওর নখ নেই... "
দেখতে দেখতে লক্ষ্মীপুজো পেরিয়ে কালীপুজো এসে যেত l
"ভাইফোঁটার পর স্কুল খুলেই পরীক্ষা...আরো ধিঙ্গি নাচন নেচে বেড়াও... ".. মা উঠতে বসতে মনে করিয়ে দিতো l তাতে আমার কচু l আমরা তখনও অতি উচ্চমার্গের আলোচনায় ব্যস্ত, "লক্ষ্মীপুজো সব বাড়িতে একই দিনে করে কেন রে? "
"সেটাই... একদিনে এতো খাওয়া যায়? "
"একেক দিন একেক বাড়িতে করবে, তা না... "
"সত্যি ! সব ভুলভাল নিয়ম l"
এরপর ফোঁৎ করে একটা সমবেত দীর্ঘশ্বাস আর বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা l
তারপর হঠাৎ একদিন শুক্লাদের বাড়িতে দোলনা চড়তে গিয়ে দেখতাম ওদের পাঁচিলের ধারের বিলিতি আমড়াগাছটায় একটাও পাতা নেই l ওই গাছে বাঁধা দোলনাটা আমাকে ওড়ার আনন্দ দিতো l ভীষণ জোরে দোল খেতে খেতে দেখতাম আকাশটা কেমন বাগানের পিছনের বাঁশঝাড়টা থেকে শুরু হয়ে দূরে মান্নাদের বিরাট চারতলা বাড়িটার মাথায় ফুরিয়ে যাচ্ছে, যার পুরোটাই যেন আমার বড়ো চেনা, বড়ো আপন l তখন জীবনের বহমানতা সম্পর্কে অজ্ঞ আমি আমার ওই ছোট্ট আকাশেই কেমন কুলিয়ে নিতে পারতাম সমস্ত সুখ-দুঃখ, হাসি- কান্না, চাওয়া-পাওয়া আর অপেক্ষাদের l
চলে যাওয়া দিনগুলোকে মাঝে মাঝে পিছু ডাকি l অবুঝের মতো অপেক্ষা করি তাদের ফিরে আসার l মুহূর্তের জন্যে ফিরে তাকায় তারা কিংবা হয়তো তাকায় না l সোহাগে আদরে মনে মনে তাদের গায়ে মাথায় হাত বোলাই আমি আর নির্নিমেষে চেয়ে দেখি তাদের চলে যাওয়া...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন