অরিজিৎ কুণ্ডু



দুঃস্বপ্নের মত

১ .
পিটার পার্কার এখন  সব রকম  অলৌকিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে । এখন আর সে স্পাইডারম্যান না , শুধুই পিটার পার্কার । একদিন দেখে মেরী জেন তাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে । দেখে সে এতটাই অবাক কি করবে বুঝে উঠতে পারে না । মে আন্টি এদিকে মেরী জেনকে দেখে ভীষণই খুশি , “ যা পিটার , মেরীকে নতুন বাড়ির চারপাশটা ঘুরিয়ে নিয়ে আয় । “  পিটার হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকে । “ কি হল , চলো “ , বলে মেরী জেন । পিটার একইরকম হতভম্ব অবস্থায় তাকে বাড়ির বাইরেটায় নিয়ে আসে , সেখানে ভুলভুলাইয়ার মত সব সাদা লম্বা দেওয়াল একের পর এক , এমনভাবে একটার পর একটা যেন গোলকধাঁধা । মেরী জেন আগে আগে হাঁটতে থাকে আর পিটার পিছনে । এতক্ষণে পিটার খেয়াল করে আজ মেরী যেন একটু বেশিরকমের সুন্দরী , ফুলের ছোট প্রিন্টে ভর্তি নীল রঙের একটা শাড়ি , হাতে চুড়ি আর মাথায় একটা লাল টিপ । ঠোঁটে লিপস্টিকও গাঢ় করে লাগিয়েছে আজ । মেরী জেন হাঁটতে হাঁটতে মাঝেমাঝেই  পিছন ফিরে পিটারের দিকে তাকিয়ে হাসছে , যার  কারণ বা মানে কোনটাই পিটারের কাছে পরিষ্কার নয় । এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটা দেওয়ালের শেষের দিকে এসে মেরী পিছনে তাকিয়ে হেসে দৌড় লাগায় , হতবাক পিটারের কয়েক সেকেন্ড লাগে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে । তারপর সে পিছন পিছন দৌড়ায় । অনেকটা দৌড়ানোর পর মেরী জেনের কোন হদিশ না পেয়ে হাঁপাতে থাকে , হঠাৎ গোলকধাঁধার একদিকের দেওয়ালের কাছে পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখে মেরী জেন তার থেকে কয়েক মিটার দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে । পিটারের চোখ ততক্ষণে লাল , মুখ দেখে মনে হয় শুকিয়ে গেছে । তবু সে মেরী জেনের দিকে এগোনোর চেষ্টা করতেই আবার হেসে দৌড় দেয় সে । এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে একসময়  পিটার বুঝতে পারে ও নিজেই হারিয়ে গেছে এই ভুলভুলাইয়ায় , এদিকে তেষ্টায় গলা কাঠ । কিছুদূরে শুনতে পায় লোকজনের আওয়াজ । এগিয়ে গিয়ে দেখে কিছু মিস্ত্রী নতুন কিছু দেওয়াল তৈরী করছে একটা ফাঁকা জায়গায় । তাদের কাছ থেকে আগে একটু জল খেয়ে নিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করে , “ একজন নীল শাড়ি পরা মহিলাকে দেখেছেন এদিকে ? “ ।  “ কিছুক্ষণ আগে আমি ওদিক থেকে আসছিলাম “ , একদিকে দেখিয়ে অন্য একজন মিস্ত্রী বলে ,  “ এইরকম একজন মহিলা ছুটতে ছুটতে আমার দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ওদিকে একটা গুহায় ঢুকে যায় । ওই গুহা থেকে কেউ কোনদিন বেরোইনি ।“  পিটার মিস্ত্রীর দেখানো দিকে হেঁটে একটা গুহার মুখে এসে পৌঁছায় , বহু শতাব্দী পুরনো সব গাছ গজিয়েছে গুহার পাথুরে মুখের চারপাশ জুড়ে । গা হিম করা এক নিস্তব্ধতা ,  মনে মনে পিটার বলে  , “ With great power comes great responsibility . “ । মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ঢোকে গুহার ভিতর , ভিতরে দমবন্ধ করা অন্ধকার । ভয়ে পেটের নীচের দিকটা চিনচিন করে ওঠে , পিটার চারদিকে মোবাইলের টর্চ মেরে এগিয়ে যায় ।


২ .
কখনও কখনও এমন হয় , কোন একজনের কথা এত বেশি করে মনে আসে অন্য কিছু বা অন্য কারও জন্য ভাবারই সময় হয় না । সেই একজনের একরাশ চুল সরিয়ে হেসে ওঠা , চোখে চোখ রাখা অথবা তার হাতের আঙুল , শাড়ির ফাঁক দিয়ে কোমরে অল্প জমা মেদ – কি যে মনে আসে আর কি আসে না বোঝা দায় । কোথাও সেই বিশেষ মহিলাও পিটার পার্কারকে বুঝিয়ে দেয় তার মনের কথা , পিটারের বিশ্বাস হয় সে আর স্পাইডারম্যান না হলেও মেরী জেন এবার তার জীবনে আসবেই । চোখ বুজলেই আগে তার কাজল পরা চোখ , টিকালো নাক আর তারপর ধীরে ধীরে লাল টুকটুকে ঠোঁট , একরাশ চুল মনে পরে , মনে পরে কথা বলার সেই বিশেষ ধরণ , কণ্ঠস্বরের সেই বিশেষ রিনিঝিনি শব্দ । বন্ধুর বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে রাত তখন প্রায় ৩ টে , আর পিটারের মনে এসব ভুলভাল ভাবনা কিলবিল করছে । এতটাই ফাঁকা একটা জায়গায় বাড়িটা যে ছাদে উঠলেই জোরে হাওয়া বইতে থাকে সোঁ সোঁ শব্দ করে । অনেকদিন এরকম হাওয়ার শব্দ শোনেনি পিটার , হাওয়ার শব্দ শুনলেও তাতে হয় মিশে ছিল পাতার শব্দ বা কোন পাখির আওয়াজ – এরম বিশুদ্ধ হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দে চোখ বন্ধ করে নিল । চোখ খুলে দেখলো বসে আছে এক টিলার উপর , সামনে ধু ধু মাঠ । সেই মাঠ লম্বা জংলী ঘাসে ভর্তি , মাঠের মাঝে মাঝে এরম কয়েকটা টিলা । টিলার উপর বসে মুখের উপর দিয়ে , সারা শরীরের উপর দিয়ে সজোরে বইছে হাওয়া , দুকানের পাশে জানিয়ে যাচ্ছে তার উপস্থিতি – সোঁ সোঁ । দূরে একটা রেললাইন দেখা যায় , তার পাশ দিয়ে গোছা গোছা কাশফুল । আকাশের রঙ অবাক করে দেয় পিটারকে , সারা আকাশ জুড়ে বিরাট সব মেঘের আনাগোনা । যেন আভাস পাওয়া যায় কোন এক আসন্ন ঝড়ের । দূরের দিগন্ত থেকে একটা ট্রেন আসতে দেখে পিটার । টিলার উপর বসে থাকলে চলবেনা , ট্রেনটাতে করে অন্তত কোথাও পৌঁছানো যাবে । পিটার টিলা থেকে নামার চেষ্টা করে । পাথরে পা রেখে নামতে গিয়ে পরে যায় ,  নীচে গড়াতে থাকে । যখন ওঠে দেখে এক বিরাট জলাশয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে ,  অল্পদূরে জলের মাঝে একটা টিলার উপর বসে এক মহিলা । ওর চোখ তখনও ঝাপসা । সাঁতার না জানায় আরও বেশি হাবুডুবু খেতে খেতে দেখে ওই নীল শাড়ি পরে মেরী জেন টিলার উপর বসে হাসছে  । খাবি খেতে থাকে পিটার । মেরী জেন হাসতে হাসতে বলে , “ With great power comes great responsibility .” পিটার খাবি খেতে খেতে ডুবে যায় ।

৩.
ধাক্কার মত চোখ খুলে পিটার দেখে ও নিজের ঘরে ঘুমিয়ে । কিছুক্ষণ চুপচাপ উপরে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে যন্ত্রের মত উঠে বসে । স্বপ্নগুলো মনে করার চেষ্টা করে , খালি মনে পরে নীল শাড়ি পরে ছিল মেরী জেন । আরও কিছুক্ষণ চেষ্টার পর মনে পরে গুহায় ঢোকার সময় নিজেকে একটা কথা বলেছিল ও , ও ডুবে যাওয়ার সময় ঐ একই কথা মেরী জেন হাসতে হাসতে বলেছিল , “ With great power comes great responsibility . “ । এতদূর মনে আসার পর বিছানা থেকে উঠে বেসিনের কাছে গিয়ে ব্রাশ নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে পিটার দেখে ওর আঙুল থেকে আবার আগের মত সরু স্রু কালো জাল – মাকড়সার জাল । তবে কি আবার পিটার হারানো ক্ষমতা ফিরে পেলো ! নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে কাছের একটা বাক্সের দিকে আঙুল তাক করতেই জাল বেরিয়ে এলো আর এক টান দিতেই বাস্কটা তার গায়ে এসে পরলো । এবার আর তবে সন্দেহের কোন জায়গা রইলো না । ঘর থেকে চুপচাপ বেরিয়ে সোফায় মে আন্টির পিছনে এসে দাঁড়ালো পিটার । আন্টি সকাল সকাল খবরের চ্যানেল খুলে বসে । আসামে এন আর সিতে সাধারণ মানুষ কি অবস্থায় আছে , এন আর সি লিস্টে যাদের নাম ওঠেনি তাদের কথা কান্না – সবকিছু ঘোরের মত লাগছিলো । তার পরের খবর – হাঙ্গার ইন্ডেক্সে ভারত ১০২ –এ নেমে গেছে । অপুষ্টিতে ভোগা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের মুখ , বয়স্ক এক মহিলার  স্থির চোখের দৃষ্টি । টিভিতে আরও কিসব বলছে । পিটার নিজের দুহাতের তালু ঘুরিয়ে দশটা আঙুলের দিকে তাকালো । ওর আঙুলগুলো কাঁপছে তখন ।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য