অয়ন জোয়ারদার


  ।।ইচ্ছা নাটক।।


পাঁচ এর দশক থেকে নাটকের জগতের তিনটি পথ । 'গণনাট্য' ও 'নবনাট্য' বা গ্রুপ থিয়েটার আর শেষটি পেশাদারী থিয়েটার । গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা প্রাজ্ঞরা করবেন, কিন্তু  গণনাট্য বাদে বাদবাকি নাটকের দলগুলো আদপে ছিল 'ব্যক্তি কেন্দ্রিক নাট্যদল' - এর ,এবং তার বা তাদের সহযাত্রীদের নাট্য আন্দোলন । থিয়েটারে রাজনীতি আসবে নাকি আসবে না তার নির্ভরতা থাকত সেই গ্রুপ থিয়েটারের কর্ণধার ব্যক্তিটির ওপর । আগেও ছিল আজও আছে । মতামত নিয়ে নাটক ও তার বিনির্মাণ খুবই সামান্য ।

পূর্বের দর্শক ও তার সমস্যা যেমন দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের জ্বালা-যন্ত্রণা, কৃষক সংগ্রাম এসব আছড়ে পড়েছিল নাটকে - 'বাস্তুভিটা' (দিগেনচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়), 'দলিল' (ঋত্বিক ঘটক) , 'নতুন ইহুদি' (সলিল সেন) তারই ছবি । বিজন ভট্টাচার্যের 'গোত্রান্তর' ঋত্বিক ঘটকের 'জ্বালা'য় প্রতিফলিত হল সমাজ আর মানুষ ।

 ৫০-৬০ এর দশকে গ্রুপ থিয়েটারে দুটি ধারা লক্ষ্য করতে পাই খুব সরল ভাবে, প্রথমত শম্ভু মিত্রের শৈল্পিক সমাজ সচেতন প্রয়াস আর অন্যটি উৎপল দত্তের স্বঘোষিত রাজনৈতিক ইজম বিন্যাসে ভারতীয় নাট্য উপস্থাপনার এক স্বতন্ত্র ধারা  । সমাজ থাকছে নাটকে, রাজনীতি থাকছে, থাকছে উপস্থাপনার ভাষা খোঁজার এক দুর্নিবার ইচ্ছা ।


ব্রেখটীয় নাট্য রীতি আসে, দর্শক দেখে 'তিন পয়সার পালা', 'ভালোমানুষ', 'মারীচ সংবাদ', 'জগন্নাথ' । অ্যাবসার্ড নাট্য আন্দোলন নিয়ে আসেন বাদল সরকার । অ্যাবসার্ড-খানিক বাস্তবতার মিশেল নিয়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায় । এইভাবে ইতিহাস হতে হতে রাজনীতি ইতিহাস হয়ে গেল । পশ্চিমবঙ্গে সুস্থির নিরবচ্ছিন্ন সরকার । নাটকও রাজনীতির পথ ছাড়লো, অন্য ভাষা খোঁজার চেষ্টা হল । যত নব্বইয়ের দিকে এগোচ্ছি থিয়েটার তত ড্রইংরুম হয়ে গেল । আমরা পেলাম চন্দন সেনের 'দায়বদ্ধ' । থিয়েটারের অর্থনীতি লিখতে বসার মতো সফল একটি প্রযোজনা ।  বোর্ড থিয়েটার এসেছে এক ভ্রান্ত পেশাদারিত্ব নিয়ে, কালো রঙের পোস্টারে যথারীতি পাততাড়ি গুটিয়েছে;কোনো রাজনীতির জন্য বোর্ড থিয়েটারকে বিদায় নিতে হয়নি, রাজনীতি একটু ধোঁয়া দিয়েছিল মাত্র! শেষ রজনী লেখা হয়েছিল শুরুতেই।বাংলা থিয়েটার তখনও অবধি পেশাদারিত্ব দেখেনি । সবাই চাকরি করেন, ছুটি নিয়ে থিয়েটার করেন, দুই একটি দল বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পান না কেউই । ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে অধিকাংশ । রেলে চাকরি করাদের দল, ফারাক্কা ব্যারেজের দল - এসব ছিল । তার মধ্যে সর্বক্ষণের থিয়েটার করেন কেউ কেউ । যারা পরে তারকা হবেন । চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন থিয়েটার করবেন বলে । মেনে নিচ্ছেন অভাবে চলা জীবন । কেউ কেউ ভাবছেন নাট্য গ্রাম, রেপার্টরি, দুচোখে স্বপ্ন, সারাদিন নাটকের ইচ্ছে ।


এতক্ষণ বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে যারা ওই সময় থেকে এই সময়ের থিয়েটারে এসে পড়েছেন তাদের অতীতের স্মৃতি খানিকটা উস্কে দেওয়া । রাজনীতিতে ঝুলকালি পুরনো জামাকাপড়ের গন্ধ শুঁকোতে শুঁকোতে পরিবর্তন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, পরিবর্তিত হলো রাজনীতি, পরিবর্তিত হলো সংস্কৃতি । পঞ্চাশের দর্শকের যে সময় বলেছি যারা নাটক লিখছেন সময় নিয়ে, নব্বইয়ের পরে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া রাজনীতিতে একটিই নাটক, যা নিয়ে শোরগোল পড়ল । তার নাম 'উইঙ্কল-টুইঙ্কল', রচনাকার ব্রাত্য বসু । মাইলস্টোন বলতে হয় । এমন একটি নাটক যাতে রাজনৈতিক বক্তব্য পরিষ্কার । টানাপোড়েন তো হবেই, বাকবিতণ্ডাও হল । সফল হল সেই প্রযোজনা । ইতিমধ্যে বহু দল কলকাতায়, মফস্বলে কেন্দ্রীয় সরকারের আনুকূল্যে প্রযোজনা করছেন, উৎসব করছেন । অনেক ছেলেমেয়ে শুধু থিয়েটারের কাজ করে পেট চালায় । বিয়ে করে সন্তান প্রতিপালন করে কতজন তা জানা নেই । গ্রুপ থিয়েটার আর সেভাবে নেই । পেশাদারী থিয়েটার । পেশাদাররাই বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন । 

একটি দল বছরে দুটি বা চারটি প্রযোজনা নামাচ্ছে । দশটি নাটকে একটি বা দুটি মুখ । মিনার্ভা রেপার্টরি তৈরি হল, তৈরি হল রবীন্দ্রভারতী রেপার্টরি । ঝকঝকে কাজ তকতকে প্রযোজনা । ছেলে মেয়েরা টাকা পাচ্ছে রিহার্সাল থেকেপ্রযোজনা  অবধি অথবা স্যালারি । কিন্তু সেটাও চলল একটা সময় পর্যন্ত । তারপর রাজনৈতিক নাটকের সেই একই আকাল । হয় পুরনো নাটক নয়তো মঙ্গলকাব্য অথবা শেক্সপিয়র । তাও আবার গোটা শেক্সপিয়ার নয় ।

ম্যাক বাইক, বাদ্য, মিরর, আন্ডারস্ট্যান্ডিং, সিনড্রোম ইত্যাদি ইত্যাদি । মঙ্গলকাব্য আর দেশভাগের গল্পের বাকি নেই আর । 'অশালীন', 'ভাইরাস এম' এর পরিবর্তে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার আমাদের দিচ্ছেন 'কে ?', 'সিনেমার মতো', অথবা অধুনা 'মীরজাফর' । বিনির্মাণ হচ্ছে গিরিশ ঘোষের নাটক । একটা 'নানাহে', 'অলকানন্দার পুত্রকন্যা', 'শোভাযাত্রা', 'মায়া', অথবা 'মেয়েটি' হচ্ছে না ।

ইদানিং 'কোজাগরী', 'লেফট রাইট লেফট' নাটকে রাজনৈতিক বক্তব্য পাওয়া গেল, সফল ও হলো । কিন্তু মূলস্রোত সেই প্রয়োগ নির্ভর থিয়েটারের পক্ষে ।

এছাড়া কিছু দল প্রায় সার্কাসের পর্যায়ের থিয়েটার করছে ।  'বায়ো-নদীজ-শালজ' এসব নামের থিয়েটারও হচ্ছে । একদল ঘরে থিয়েটার করে, জীবনানন্দের কবিতা খানিকটা দর্শককে দিয়ে পড়ায়, অন্ধকার করে অভিনেতা অভিনেত্রীর গায়ে গলন্ত মোম ফেলে। গ্রোটস্কি বলেছেন না কি!ব্যাপারটা হইস্কির এফেক্ট কিনা জানি না। সম্প্রতি জানলাম শীৎকার আনয়ন করেই বাচিক শেখান একজন। লিপ টু লিপ কিস করতে না পারলে নাকি তুমি অভিনয়ই জানোনা! তাই কিস এর কর্মশালা!!ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কারুর কাছে বেশ মজার ,রসের।জানিনা, এগুলো কোন ভরত মুনি বা ব্রেখটিয় মস্তিষ্কপ্রসূত । নাটক করতে গেলে নাকি লিপ টু লিপ কিস তোমায় করতেই হবে ! জামা খুলিয়ে গলন্ত মোমবাতির ফোঁটা ফেলা হচ্ছে শরীরে।হাত পা কেটে রক্তের ফোঁটা পড়িয়ে দেওয়া হলো দর্শকের কপালে। যাই কিছু হোক নাটক দেখার স্বাদ মিটলো না। চারিদিকে অনেক দল, সর্বহারাদের মত থিয়েটার চর্চা হয় না আজকাল, পয়সা কড়ি আছে, উৎসব আছে, সেই নাটক  মনেহয় খুব একটা নেই, যা দেখে চুপ থাকতে ইচ্ছে করে, রাতে দেখে সকালে চায়ের চুমুকেও মনে করায়; ভাবায়, অস্বস্তিতে রাখে দৃশ্যের স্মৃতি। এত দল, এত পরিচালক এত নাটক !! অতি উৎপাদনে ক্ষতি হচ্ছে না তো! ভাবতে বলব আমার শ্রেষ্ঠ নাট্যকারদের ,পরিচালকদের ,তা সে কলকাতার বা জেলারই হোক। যাঁরা লেখেন না, নির্মাণ করেন না, অথচ প্রেরণা যোগান ,অর্থ যোগান, তাদেরও বলবো ,একটু দেখুন না, "নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে", অথবা অবধুতের রচনার নাট্যরূপ দিয়ে,অথবা মৌলিক রাজনৈতিক নাটকের স্ফুরণ ঘটাতে ! এ ঘটনা ঘটতে লাগবে যোগ্য পরিচালক ,খুঁজে নিন না, শান্তিপুর, জলপাইগুড়ি, বহরমপুর ,কল্যাণী, কলকাতা থেকে।অভিনেতা আছে প্রচুর ক্ষমতাশালী! চমক না দিয়ে ,একটা সৎ কাজ হোক সবাই মিলে ,এক্সচেঞ্জ হোক শহর থেকে গঞ্জের। সাজানো নয়! লাইন পড়ুক দর্শকের ।হাপিত্যেস করে পরবর্তী শোয়ের অপেক্ষায় ফিরে যাক দর্শক।

বাংলা থিয়েটারের নিজের ভাষা তৈরি হোক, আরেকটা টিনের তলোয়ার দেখি সবাই।

প্লিজ স্যার ...আমরা তো দেখিনি অনেককিছু! একটা সাদামাটা নাটক, সরল থিয়েটার হোক না ! সহজ গল্পই ,বলার কায়দাই, বরাবর বাঙালি গ্রহণ করেছে, সে থিয়েটার বা সিনেমা যাই বলো।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য