হেমন্ত দাস
ঘুসপেটিয়া
শৈশবে কার্গিল যুদ্ধ বাঁধলো , সত্যজিতের আঁকার খাতা জুড়ে শুধু অপটু হাতের আঁকায় সৈন্য ও ট্রাঙ্কের ছবি , পাহাড়ে উঠছে ট্রাঙ্ক । সৈন্যদের হাতে বন্দুক । পাহাড়ের গা ঘেঁষে জাতীয় পতাকা উড়ছে ।
সত্য ঘুম থেকে উঠেই প্রতিদিন সকালে ছুটে যায় রাস্তার মোড়ে , যেখানে ভুনায়োলা ভাজাভাজি বিক্রি করছে ! তারপাশেই একটা টিনের স্ট্যান্ডের ওপর একজন বয়স্কলোক গণশক্তি কাগজ লাগিয়ে দিয়ে যায় প্রতিদিন । সারা কাগজ জুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে সে যুদ্ধের ছবি । ছবির নিচের লেখাগুলো ভালো করে খুঁটিয়ে পড়তে থাকে সে । রবিবার ছাড়া টিভির সামনে যায় কি করে ? কিন্তু রেডিও আছে একটা সন্তোষ কোম্পানির , রেডিওতে যখন ঘোষক বলা শুরু করে - " খবর রীলে করে শোনানো হচ্ছে ।" কানটা খাড়া হয়ে উঠে সত্যর , সমস্ত মনোযোগ তখন ঐ খবর পাঠকারী ব্যক্তির কণ্ঠের কাছে । বারবার শুনে একটা নাম সে গেঁথে নিয়েছে মাথায় ।
যুদ্ধের ব্যাপারে বাবাকে নানান প্রশ্ন করে জ্বালায় । "যুদ্ধ পরিস্থিতি" টা আসলে কি ? বাবার বন্ধু মাতাল 'কে সি কামিলা' এসে মাঝে মাঝে ক্লাস ফাইভের ছাত্রকে অঙ্ক দেয় - "একটা নৌকায় কুড়ি কাহণ খড় আছে , নৌকার ফুঁটো দিয়ে যদি বোয়াল মাছ সেই খড় খায় ! চারগন্ডা বোয়াল মাছ তবে তিনপন খড় গড়ে কতটা করে খাবে ?" মাথা চুলকে খাতার পৃষ্টা শেষ করেও খড় আর বোয়াল মাছের হিসেব কিছুতেই মিলাতে পারে না সে । সত্যর অসহায় ভাব দেখে প্রতিবার হো হো করে হেসে উঠে কে সি কামিলা ।
সত্য শুনেছে তার জন্মের আগে থেকেই নাকি এখানে পূর্বরেলের টার্মিনাল হবে । মাকড়সার মতো কল্পনার জাল বিস্তার করতে থাকে মাথায় । ভাবে বড়ো হলে এখান থেকে ট্রেন ধরে কার্গিল যুদ্ধে যাবে ।
জুটমিল থেকে বাবা ফিরলেই সে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তুলে - আচ্ছা বাবা ! আমাদের এখানে ট্রেন লাইন কোথায় বসবে ?
বাবা ক্লান্ত কণ্ঠে বলে - ট্রেনের লাইন বসলে আমরা থাকবো কোথায় ? এখানে সব বাড়ি-ঘর ভাঙা পরবে । আমাদের বাড়িটাও ।
বিস্ময়ে সত্য বলে - অনেক জায়গা লাগবে ? তাহলে কাকলিদের বাগানে তো একটা ট্রেন চালাতে পারে ?
বাবা সত্যর কপালে চুমু খেয়ে বলে - ওটুকু জায়গায় হবে না ! অনেক বড়ো জায়গা লাগবে । আমাদের এই পুরো কলোনী থেকেও বড়ো জায়গার দরকার ।
কলোনির পাশে যে কুণ্ডু লাইন ঘেঁষে ডোবাটা আছে ! আগে ওটা বড়ো ঝিল ছিলো , তার পাশ দিয়ে জঙ্গল শুরু হয়েছে । যেটা এখন দেশভাগে আসা কিছু মানুষের টুকরো টুকরো বাগানের ভেতর বাড়ি গজিয়ে উঠেছে । সত্য দেখেছে তার ওপাশে অনেক জায়গা , ওদিকে কেউ থাকে না । পুরো কাশফুলের মাঠ , ওদিকে কোথায় যেন সোজা চলে গেছে । কতদূর গেছে , কে জানে ! ট্রেন লাইন তবে ওদিকে তো করতে পারে ! একটু দূরে হলেও ! কালাবুড়িদির সঙ্গে ঘুরে আসতাম প্রতিদিন !
পড়তে বসলেই যত ভাবনা সত্যর মাথায় এসে কিরবির করে । অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে । ওর পড়ার শব্দ না পেয়ে মা ঝাঁজিয়ে ওঠে , চিৎকার করে বলে - "চুপ করে বসে আছিস কেন ? সামনে পরীক্ষা তো ! নাকি ? জোড়ে জোড়ে পড় ! আমি রান্না করতে করতে যেন শুনতে পাই ?"
আজ সকাল থেকেই সত্যর মনটা খুব খারাপ , কাগজে এইমাত্র পড়ে এসছে - 'কফিন বন্দী' হয়ে সৈন্য এসছে । কুণ্ডু লাইনের ওদিকে সাহেব বাগানে । সত্য দেখতে যাবে বলে বায়না করেছিলো , কিন্তু ওর মা যেতে দেয়নি । কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো সে - "সবাই তো দেখতে যাচ্ছে ! আমি গেলেই দোষ ? আমি কালাবুড়িদির সঙ্গে যাবো আর টুক করে দেখে চলে আসবো !"
তবু কেন জানি মা কিছুতেই যেতে দিলো না !
"ধুর কিছু ভালো লাগে না । বাড়ি থেকে যেদিন চলে যাবো ! সেদিন বুঝবে ! সব ব্যাপারে - এটা করবি না । ওটা করবি না । একটু খেলতে দিতে চায় না । সব সময় পড়তে বোস । পড়তে বোস ! ভালো লাগে না আমার এসব ।"
মা হাতের খন্তি নিয়ে তেড়ে এসে বলে - "বেশী বকবক করবি না । তোর বাবা যখন থাকবে ! তখন এসব শুনাবি তাকে । এরপর যদি কাঁদিস তো ! এটা দেখে রাখ !" কথাগুলো বলে হাতের খন্তিটা বারকয়েক নাড়িয়ে দেখায় মা ।
হটাৎ মাইকের শব্দে মা ও সত্য চুপ হয়ে যায় । রাস্তার ওপাশ দিয়ে হল্লা গাড়িতে বলতে বলতে যাচ্ছে - "থানা ও ' উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি'র পক্ষ থেকে আপনাদের জানানো হচ্ছে - আগামী মাসের মধ্যে আপনারা যে যার জায়গা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান । আগামী মাসেই রেলের তরফ থেকে অধিগ্রহণের কাজ শুরু হবে ।"
মা বিড়বিড় করে বলতে থাকে - "এরা সব বেইমান । প্রতিরোধ কমিটির নামে টাকা খেয়ে বসে আছে ।"
কোন ফাঁকে সত্য ছুটে যায় হল্লা গাড়ির কাছে ; অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে জলপাই রঙের পোষাক পরা সিপাহীদের দিকে । ওদের একজন ধমক দেয় - "ভাগো ইহাসে ! ভাগো ! ঘুসপেটিয়া ।"
সিপাহির কথা শুনে সত্য মুচকি মুচকি হেসে বিড়বিড় করে - "ঘুসপেটিয়া" ! ঘুসপেটিয়া কি গালি ? নাহ এটা সৈন্যদের কথা । ওরা যখন রেগে যায় ! তখন বলে ঘুসপেটিয়া ? দারুণ কথাটা কিন্তু ! ঘুস-পেটি-আ ।
বাড়ি ঢোকার সময় বাবুদার সঙ্গে দেখা হলো সত্যর । বাবুদাকে দাঁড় করিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো - "আচ্ছা বাবুদা ! বলো দেখি ঘুসপেটিয়া মানে কি ?"
বাবুদা বিষন্ন মনে বলতে থাকে - "যারা অন্যদেশ থেকে এদেশে ঢুকেছে , তাদের ঘুসপেটিয়া বলে । এদেশটা আমাদের নয় রে সত্য । দেখলি না বলে গেলো ঘর-বাড়ি ভেঙে আমাদের তাড়াবে ! আমরা এবার কে কোথায় যাবো ! তার ঠিক নেই রে ভাই ।"
বাবুদার কথাগুলো শুনে সত্যর চোখ ছলছল করে ওঠে । "এ দেশ আমাদের নয় ? তবে কোনদেশ আমাদের ?"
বাবু দা সত্যর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে - "জানি না ।"
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন