মৌসুমী রায়

 


তিতাসের বাঁকে


      কাকটা এত রাতে ডাকছে? বিরক্ত হয় তিতাস। আবার ছরছর করে জলের শব্দ। বাথরুমের কলটা কি খোলা? তিতাস উঁকি মারে।
-নাতো।তবে?
ভাবতে ভাবতে তিতাস ড্রেসিংটেবিলের সামনে।
চুলটা পেঁচিয়ে কোনমতে টপনট করে নিল।
মুখে সামান্য ক্রীম। 
-ভাল্লাগছে না। ধুর, অংশুমান কি ঘুমালো? ঝুঁকলো তিতাস।

-কি হয়েছে অংশুমান?
তিতাসের হাতটা চেপে ধরলো অংশুমান। মুখে বললো,
-ন না। কিছু নাতো।
অংশুমান মিথ্যে বললে চোখে চোখ রাখেনা তিতাসের।
-তখন কিছুই খেলে না। গুমরে বসে আছো।
-আ আমার খুব ভয় লাগছে। 
-ওমা!কেন গো?
-কেউ আমাকে ফলো করছে।
-আবার!
তাহলে আবার কাউন্সেলিং। বাবাকে বলতে হবে।
পিহুটাও এখন আটকে গেল। 
কি যে করে তিতাস! শুয়ে পড়লো।
আলগোছে অংশুমানকে জড়িয়ে নিলো। কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো।
অন্যদিন  তিতাস আর অংশুমান পাশাপাশি শুয়ে থাকে,
পাথরের মত। কিম্বা কোন শীতল হিমবাহ। মাঝে বুঝি একটা আলাদা আকাশ খেলা করছে। বা অন্য কোন নদী।
ফোনটা বাজছে। ধরলো তিতাস। বাবা ,রিংব্যাক করেছে।
-হ্যাঁ বাবা। তাহলে শণিবার থেকেই।
 অংশুমান ঘুমিয়ে পড়েছে। পাশবালিশটাকে আঁকড়ে ধরে। কেমন শিশুর মত!

টুং করে একটা মেসেজ ঢুকলো। রণদেব!
মোবাইলের আলোয় তিতাসের মুখটা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
এই এক খেলা হয়েছে। সারাদিন টুং টাং।
রণদেব !
ফেসবুকে দেখা।
ঠিক বারো বছর। একযুগ। একযুগ পরে তিতাস রণকে পেলো। লাইফটা একদম ডাল হয়ে গেছিল।
বোর!
পিহু নেই। সদ্য বিভবেন্দুর সাথে একপ্রস্থ ক্যাঁচাল!
খুব মুড অফ ছিলো তিতাসের। খুব খুব।
বিভবেন্দু তিতাসকে ব্লক করে দিলো?
আনথিঙ্কেবল!
প্রথম কটা দিন যে কি কষ্ট হয়েছে তিতাসের।
রাতগুলি কেমন ফাঁকা,ফাঁকা।
মাঝে কদিন মর্ণিংওয়াকে গেল। সেখানেই 
স্যান্যাল আঙ্কেলকের সঙ্গে পরিচয়।
ওঃ! হোয়াট আ পার্সোনালিটি। তিতাসের বড্ড আপশোষ। কেন যে জাষ্ট তিরিশ টা বছর আগে জন্মালো না। ওর পাশে দৌড়াতে পারলেই যেন ,ফিলিং হট! রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে আঙ্কেলের। এখনো কি টাইট ফিগার! তিতাস ফিদাহ!
হলে কি হয়?
লোকটা বড় বোরিং।
কফিশপে নিয়ে গিয়ে বলে,
-মা, আমি তোর মুখে আমার মেয়ের ছায়া দেখি!
নিকুচি করেছে!
কত কি ভেবে তিতাস কফি ডেটটা ফিক্স করেছিল!
অংশুমান অফিসে যেতেই ফোনটোন করে...
এখন ভাবলেই হাসি পায় তিতাসের।
হাউ ক্রেজি সি ওয়াজ...
কদিন ফালতু ফালতু অংশুমানকে ঝামেলায় ফেলতে হলো। ফেলতেই হলো।
আবার বাবা ডাঃ ত্রিপাঠীকে বুক করলেন।
ইট ওয়াজ আ লং প্রসেস।
পিহুটা এখন থাকলে খুব সুবিধা হতো তিতাসের।
একা একা নর্থ থেকে সেই টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপো।
বিচ্ছিরি লাগে তিতাসের।
রণদেব ঠিক তখন ই , এলো কমিক রিলিফের মত। তিতাসের বোরডম কাটাতে।
নয়তো সারাদিন তিতাসের বাঁধাধরা রুটিন।
-অংশুমান, আর ইউ ওকে? যাবার সময় কি আবার কেউ তোমাকে ফলো করেছিল?
-না, না তিতাস। আজ ঠিক আছি।
-লাভিউ ডার্লিং!
-লাভিউ টু বেব।




           এই নিয়ে আরেক দফা অ্যালার্ম বাজলো। কাকটা সঙ্গে সঙ্গে  খুব কর্কশ ভাবে ডেকে উঠলো। 
 পাতলা রজাই এর ভিতর থেকে কোনমতে হাতটা বের করে অ্যালার্ম অফ করলো অংশুমান। নভেম্বরের এই হালকা শীত শীতভাব আর সকালের মিঠে রোদ।
মাকে মনে পড়ে তাঁর। এই মুহূর্তটাকে মুঠোর মধ্যে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে অংশুমানের। সময় বয়ে যায়। তবু অংশুমান রজাই মুড়ে শুয়েই থাকে। অফিসে কানাঘুষো শুরু হয়ে গেছে অলরেডি।
 -অংশুমান কি মেন্টাল?
জানে না অংশুমান‌। তিতাস হয়তো বলতে পারবে। মা ছাড়া এক তিতাসকেই এতটা ভরসা করতে পেরেছে সে। নয়তো পারতপক্ষে মেয়েদের এড়িয়েই চলে সে। কেমন একটা অস্বস্তি হয় তাঁর।
ঠিক বোঝানো যাবে না। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব।
তিতাস কি হতাশ? বিরক্ত হয় অংশুমানের ওপর?
পাঁচবছর হয়ে গেল ,একসাথে তারা।
 তিতাস যেন তাঁর মা। তেমনটাই কেয়ারিং। তিতাস মা হলে  হয়তো খুব ভালো মা হতে পারতো। হয়তো কেন? ডেফিনিটলী হতো।
তাকে কত যত্নে আগলে আগলে রাখে তিতাস।
মা ঐ ভাবে চলে না গেলে অংশুমান আরেকটু সাহসী হতো। আর পাঁচটা ছেলের মত।
হৈ চৈ, ফ্রেন্ড সার্কেল, লেট নাইট, উইক এন্ড লং ড্রাইভ, সোশ্যাল মিডিয়া, দু একটা খুচরো অ্যাফেয়ার...
অংশুমান ভাবতেই থাকে , দিতিপ্রিয়া ,দীপ্রা, সোহিনী সবাই সব্বাই খুব বিরক্ত হয়েছিল তাঁর উপরে। কি করবে অংশুমান?
সে ফীল করে। কিন্তু রেসিপ্রোকেট করতে পারে না। কেবল তিতাস! একমাত্র তিতাসের কাছেই সে ফ্রী। নির্ভার। মুক্ত।
        
          একমনে গনেশ জননীর ছবিটা দেখছে অংশুমান। একটু আলাদা লাগছে না, আজ?
এ বাবা ! ছবিটা উল্টে গেছে কি করে?
অংশুমান নামলো। ছবিটা সোজা করতেই ,জলের ছরছর শব্দটা পেল। স্লিপার গলিয়ে বাথরুমে ঢুকলো।
-যাহ, কলটা কে খুলে রাখলো?
তিতাস, তিতাস....
-যাই।
তিতাস ছোট তোয়ালেটায় হাত মুছতে মুছতে ঢুকলো।

"পাঁচিলে বয়স ভেজে। চিলেকোঠা ভিজে একাকার। 
শিরা কেটে নিয়ে গেছে কাপড় মেলার সরু তার। 
একা ছাদ ভয় পায়। যদি বৃষ্টি নেমে আসে ফের?"

অংশুমানের গলা গমগম করে উঠলো। তিতাসকে বকতে চায় না সে। বরং কবিতা শোনানো যাক।

-আবার শুরু করল!অসহ্য লাগে এইসব ঢং।
ছেলেদের এইসব ন্যাকামি! ডিসগাষ্টিং!

মুখে তবু একটা আহ্লাদী হাসি মেখে তিতাস বললো,

-বাহ,বেশ কবিতা। কার লেখা গো? জয় নাকি শ্রীজাত?

-উফ্, নামটা কিছুতেই মনে আসছে না। 
মাথা চেপে বসে পড়লো অংশুমান।

-আবার অস্বস্তিটা হচ্ছে? তিতাস এগিয়ে গেলো।
-নাহ, মনে করতে পারছি না ,তিতাস। কেন ?
আমার কি মেমরি লস হচ্ছে? তিতাস..
-প্লীজ, এভাবে ভেবো না বাবু। সব ঠিক হয়ে যাবে। 
চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে
দেখলো,অংশুমান শূণ্য চোখে জানলার দিকে তাকিয়ে।
তিতাসের চোখে অদ্ভূত এক হাসি খেলে গেলো।
কাকটা তখনো ডেকেই যাচ্ছে।



   গড়িমসি করেও অংশুমান অফিসে গেছে।
তিতাস ঝটপট রেডি হয়ে নিলো। বিগ শপার, পার্সে  অংশুমানের সবকটা কার্ড, কিছু নোট ভরে রেডি হয়ে নীচে নামতেই ফোনটা বাজলো।
-পিহু! এই অসময়ে!
-বল
-দিদিয়া, তুই আবার শুরু করলি? বাবা খানিক আগে ফোন করেছিল। 
-আর ওমনি তুই রাতের ঘুম বরবাদ করে মাঝরাতে আমাকে জ্ঞান দিতে বসলি!
-দিদিয়া, আর কবে তোর বুদ্ধিশুদ্ধি হবে?
-হবে না আর। ব্যাস, হয়েছে শান্তি? এবার ঘুমো।
সকালে উঠেই তো ছুটবি।
-প্লীজ দিদিয়া। অংশুমান দা খুব ভালো মনের মানুষ।
- বাবাকেও তো তুই ভালো মনের মানুষ বলেই চিনিস,তাই না?
-হোয়াট ডু ইউ মীন দিদিয়া?

তিতাসের মুখে একটা বিষন্ন হাসি ফুটে উঠলো।
-বাদ দে। রাখছি, তুই ঘুমো। আমি একটু বেরিয়েছি।

-দিদি, যাবেন?
একটা নীল রঙের টোটো।
-করুণাময়ী চলো।
তিতাস রণকে ফোন করলো। বিজি আসছে।
-উফ্, ভাল্লাগে কিচ্ছু আমার।
-কিছু বলছেন দিদি?
-না, তুমি সি সি ওয়ান চলো।
-করুণাময়ী বললেন তো!
-তুমি যেতে পারবে? নাকি আমি নেমে যাবো?
রণ কলব্যাক করেছে।
-তুমি সি সি ওয়ান আসতে পারবে?
- আরে মিটিংএ আছি।
-পারবে ? ইয়েস অর নো ?
- ইউ আর ক্রেজী তিতাস?
কট করে ফোনটা কেটে দিলো তিতাস। রাগটা আবার উঠছে। ঘাড়ের কাছটা কেমন দিব দিব করছে।
স্যান্যাল আঙ্কেলকে রিং করলো।
-সি সি ওয়ানে আসবেন একবার?
- তুমি বরং আমার বাড়িতে চলে এসো তিতাস।

                সাজানো গোছানো ছিমছাম বাড়িটার গেটে বোগেনভেলিয়া আর ফ্লেমিং ট্রাম্পেটের বাওয়ার করা। টোটোর ছেলেটি খুব অবাক হলো।
দিদি তার হাতে একটা পাঁচশোর নোট গুঁজে দিলো।
-ইয়ে মানে আমার কাছে চেঞ্জ হবে না দিদি।
খুচরো নেই?
-সবটা রেখে দাও। ভুরু নাচালো তিতাস।
ছেলেটাকে আজ ব্যাপক জ্বালিয়েছে।
-না না দিদি। আপনি দুশো দিন।
-আরে রাখো। তোমার জন্মদিনে দিদির গিফ্ট!
ছেলেটার মুখটা কি আলো ঝলমলে হয়ে গেলো?
কে জানে। গেট খুলে ভিতরে ঢুকলো তিতাস।

-আরে এসো এসো। দ্যাখো সুতপা, কে এসেছে?
তিতাস। তোমাকে বলেছিলাম না,  পার্কে সেই মর্ণিং ওয়াকে আসে...

তিতাস একটু জড়োসড়ো পায়ে ড্রয়িংরুমে বসতেই ভিতর থেকে পর্দা সরিয়ে যিনি ঢুকলেন তাকে দেখে তিতাস খুব অবাক হলো।

       
আরে! বাড়ির কাকটা এখানে কি করছে? কাকটা কি অংশুমানকে কিছু বলতে চায়?
ঘাড় বেঁকিয়ে কেবল তাকে দেখছে। কুকুরটাও কেবল ওর জুতো শুঁকছে।ওরা কি টের পেয়ে গেল, অংশুমান আজ অফিস কেটেছে?
 ফোনটা ইচ্ছে করে সে সুইচড্ অফ করে দিয়েছে। নাহলে এতক্ষণে গুচ্ছের ফোন এসে হাজির হতো। বিরক্ত লাগে। সব ফোন কি সব সময় অ্যাটেন্ড করতে ভালো লাগে!
আজ বরং লেকের ধারে ঝিম মেরে বসে থাকতে ভালো লাগছে অংশুমানের। অন্তত সন্ধে অবধি নিশ্চিন্ত। কেউ তাকে খুঁজবে না। এই সময়টুকু আজ সে ছিনিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু সে তিতাসকে নিয়ে ভাববে।
তিতাস, তিতাস। 

              এবারের উইক এন্ডে তিতাসকে একটা সারপ্রাইজ ট্যুরে নিয়ে যেতে হবে।  সেবারের মত। মন্দারমণির সেই মনাস্টারির মত রিসর্টটি।
সমুদ্রের দিকের একদম শেষ ঘরটিতে ছিলো তারা। পূর্ণিমার রাত। সমুদ্রমুখী বারান্দার সিঁড়ি ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে রূপালী ঢেউ। ফুরফুরে হাওয়া। শান্ত নিস্তব্ধ তটরেখা বরাবর হেঁটে যাচ্ছে একটি ঘোড়া। একলা ঘোড়সওয়ার।
তিতাস আর সে। তিতাস যেন অনেক কিছু বলতে চাইছিলো। অংশুমানের  কিন্তু চুপ করে বসে থাকতেই ভালো লাগছিল। কিছু কিছু কথা কানে গেলেও অংশুমান তিতাসকে শুধু দেখছিলো।
 তিতাস ও মায়ের মত শাড়ি পরতেই পছন্দ করে।
চাঁদের আলোয় তিতাসকে একদম মা মনে হচ্ছিল।



       তিতাস চুপ করে বসে। সুতপাও। স্যান্যাল আঙ্কেল একাই বলছেন। নানান কথা। তিতাস সুতপাকে দেখছে। ভাবা যায়? ঐরকম হ্যান্ডসাম ম্যাচো ম্যানের স্ত্রী সুতপা! এত সাধারন! তাতেও স্যান্যাল আঙ্কেল বুঁদ হয়ে আছেন! দাম্পত্যের আঠা কি তাহলে সন্তান? ওদের সন্তান তো আর নেই। তাহলে? তবে এই একাত্মবোধ, এই নির্ভরতা? হিসাবটা তিতাস কিছুতেই মেলাতে পারেনা।
           খানিক বাদে সুতপা উঠে গেলেন। ফিরে এলেন একটা ট্রে তে কফি আর কেক, কুকিজ নিয়ে।
তিতাসের একটুও খিদে নেই এখন।
-খেয়ে নাও, সব আমার নিজের হাতে তৈরী।
কি গভীর গলা সুতপার! যেন দূর থেকে কোন ঝরণার শব্দ ভেসে আসছে। 
আচ্ছা, এইরকম জলের শব্দ কি সে আগে কোথাও শোনেনি তিতাস। প্রাণজুড়োনো।

-আরে ,হাত গুটিয়ে বসে থাকলে সুতপা তোমাকে ছাড়বে ভেবেছ? খেয়ে নাও তিতাস।
সুতপা খাওয়াতে বড় ভালোবাসে।
-আমি? ইয়ে মানে আমার পেট ভরা । এই মাত্র ব্রেকফাষ্ট করেই...

-নন্দুও এমন বায়না করতো বলো, কিছুতেই খাবেনা। ওকে দেখলেই আমার কেবল নন্দুর কথা...
-থাক না। থাক।
সুতপার গলাটা কেমন খসখসে হয়ে গেলো। ঝরণা থমকে গেলে যেমন হয়। জোর করে থামিয়ে দিলেন স্যান্যাল আঙ্কেলকে।
এগিয়ে গিয়ে আঙ্কেলের পাশে বসে তাঁর পিঠে হাত রাখলেন।

এমনটা তিতাস কোনদিন পারে না। পারবেও না হয়তো আর কোনদিন। অংশুমানের কথা ভাবলেই কেমন যেন দমবন্ধ লাগে তিতাসের। 
অংশুমান কি আদৌ কোনদিন তিতাসকে স্বামী হিসাবে ভালোবেসেছে? জানে না তিতাস।




                ব্রিফকেস থেকে এক্সট্রা চাবিটা বার করে দরজা খুললো অংশুমান।
-স্ট্রেঞ্জ! তিতাস তো কখনো বাড়ির বাইরে বেরোয় না!  বড্ড ঘরকুনো। ঠিক মায়ের মত।
মৃদু হাসি অংশুমানের ঠোঁটে।
ছরছর করে জলের শব্দ। 
-প্লাম্বারকে ডাকতে হবে। 
তিতাসকে বলবো।
ফোন করতে গিয়েও রেখে দিয়ে বারান্দায় এলো সে। কাকটা চুপ করে কেন!
তাকে দেখেও কেমন শান্ত হয়ে বসে। ওর খাঁচার সামনে চুপ করে বসে অংশুমান।
তিতাস না ফেরা অবধি অংশুমান কিচ্ছু খাবেনা। ফিরলে তবে।

সামনের ঝাঁকড়া গাছটা থেকে দু একটা করে শুকনো পাতা টুপটাপ  পড়ছে। কি যেন নাম গাছটার! কিছুতেই মনে পড়ছে না। অংশুমান মাথা ধরে ঝাঁকাতে লাগলো। যদি মনে পড়ে!
কেন যে এমন হয় ?

কাকটা ক্যাঁ ক্যাঁ করে ডেকে উঠলো। ঐ তো , তিতাস গেট ঠেলে ঢুকছে। 
 -অংশুমান! এত তাড়াতাড়ি?
যেন চমকে উঠলো তিতাস।

-তিতাস, তিতাস, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
এত দেরী । জানোনা ,তোমাকে না দেখলে আমার কি ভয়ানক টেনশন হয়?

-তুমি আজ এত তাড়াতাড়ি? তিতাস শুকনো হাসলো‌, গ্রসারী ফুরিয়ে গেছিলো, তাই...

-ওহো। তাই বলো। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। তুমি তো জানো, মাও এমন এক দুপুরে বেরিয়েই...

-এসব কথা থাক না।

তিতাস ভিতরে ঢুকে গেলো। বাথরুমের কলটা কি আবার খুলে রেখেছে অংশুমান? জল পড়ে যাচ্ছে। অদ্ভূত !
 তিতাস বাথরুমের দরজা খুললো।
- কই, নাহ! কলতো বন্ধ!
-তিতাস ,তিতাস, আমার খিদে পেয়েছে।
-দিচ্ছি...


          রাগটা আবার উঠছে। তিতাসের ইচ্ছে করে সব কিছু ভাসিয়ে দিয়ে, নিজেও ভেসে যায়।
অনেক হয়েছে ,আর না।
অংশুমানকে খেতে দিয়ে চুপচাপ ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
-বাবা, আমি আর পারছিনা।

-আবার শুরু করলি?

-এভাবে কতদিন চলবে বাবা ?

-চালাতে হবে,তিতাস। জানিস তো আমার কত টাকা ধার দেনা হয়ে গেছে তোর মায়ের অসুখের সময়ে।
পিহু এখনো বিদেশে। তুই আমার ভরসা তিতাস।
-বাবা, অংশুমান যে দিন সব ধরে ফেলবে?

-আমার তোর ওপরে আস্থা আছে ।  অংশুমানের সব দায়িত্ব তোর তো। হে ,হে। জানি আমার তিতাস কখনো হারেনি।  ইউ ক্যান হ্যান্ডেল।
অংশুমান ,ওর বাড়ি, চাকরি, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট...


বাবা আরো কি সব বলছিল, তিতাস ফোনটা কেটে দিলো। এই নাগপাশ থেকে তাঁর মুক্তি নেই।
কাকটা  কি তিতাসের দিকে চেয়ে কিছু বলতে চায়? কেমন ডানা ঝটপট করছে।

-তিতাস, তিতাস ,আমার ঘুম আসছে না। তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও।

-আসছি।
চোখ মুছে তিতাস বেডরুমে ঢুকলো। নাকের পাটা দুটো ফুলে ফুলে উঠছে তাঁর।

-তিতাস, আজ আমি খুব খুশী। জানো, আজ আমাকে কেউ ফলো করেনি...


       অংশুমানকে বেশ চনমনে দেখাচ্ছে।
ব্রেকফাষ্টে আজ ওর ফেভারিট লুচি ,আলুর সাদা তরকারি। ওর মা যেমন বানাতেন।

-তিতাস,তুমিও খেয়ে নাও।
-খাবো। তুমি বেরোলেই তো আমি ফ্রি।
-এই জন্য ই তোমাকে এত ভালোবাসি তিতাস।
ঠিক আমার মায়ের মত!
-মা!
তিতাস মা? মায়ের মত? 
তিতাস আসলে কে, অংশুমানের?

কাকটা আজ সকাল থেকে ডানা ঝাপটে যাচ্ছে।
তাকে চুপ করাতেই বাড়িটা শান্ত। বাথরুমের সেই জলের শব্দটাও নেই।
তিতাস নীচে নেমে এলো।
-আমি আসছি তিতাস।
-বাই ডার্লিং।

         অংশুমান বেরোতেই তিতাস ঝটপট ঘরে ঢুকে জিন্সটপ পরে নিলো। চোখে ডার্ক সানগ্লাস। মাথায় উইগটা লাগিয়ে দ্রুত ল্যাচ কি টেনে প্রায় দৌড়াতে থাকলো।
 অংশুমান হয়তো অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে...



মন্তব্যসমূহ

  1. কী সুন্দর করে গুছিয়ে লিখলে মৌসুমী! চনমনে অথচ যন্ত্রণাবিদ্ধ তিতাসকে দেখলাম ছুটে চলে যাচ্ছে। যেন কিছু ধরতে চাইছে!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য